পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও দক্ষিণে ভারত মহাসাগর ঘিরে অবস্থিত ভারতের অংশটি পেনিনসুলার ইন্ডিয়া বা ‘দক্ষিণ ভারত’ নামে পরিচিত। ভারতের এই অংশের রাজ্যগুলো দাক্ষিণাত্য মালভূমির উপর অবস্থিত। মালভূমিটি পূর্ব ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে শায়িত। ভারতের এই অংশে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গনা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত পদুচেরি।
কেন্দ্রশাসিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং লাক্ষাদ্বীপকে দাক্ষিণাত্যের নয়, দক্ষিণ ভারতের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর জলের উৎস কৃষ্ণা, কাবেরী, গোদাবরী, তুঙ্গভদ্রা ও ভাই গাই নদী। এই অঞ্চলের জনবহুল শহর হলো কোচি, কোয়েম্বটুর, চেন্নাই, বাঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদ। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ মানুষ কন্নড়, তামিল, তেলুগু ও মালয়ালম ভাষায় কথা বলেন। হিন্দি বলতেই চান না। বরং ইংরেজি বলায় ওঁরা সাবলীল। এখানে তুলনামূলকভাবে বিশেষ করে কেরালায় শিক্ষিতের হার বেশি।
মাগুরা হাসপাতাল ও কলেজের প্রীতিভাজন যশস্বী চিকিৎসকবৃন্দ, ডাক্তার অরুণ ঘোষের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের আয়োজন করেন। ভ্রমণ স্থল দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্য। ডাক্তার বাবুদের চাকরি ও পেশা বিবেচনায় বিমানে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিমানবন্দরে যাওয়া-আসা, দর্শনীয় স্থানে গমন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে। থাকা ন্যূনতম তিনতারা হোটেলে। ভ্রমণ শুরু জানুয়ারি ২০, ২০১৯ এবং শেষ জানুয়ারি ২৯, ২০১৯। গন্তব্য স্থান: মাগুরা থেকে কোলকাতা হয়ে চেন্নাই; চেন্নাই থেকে ত্রিবান্দ্রাম; ত্রিবান্দ্রাম থেকে কোভেলাম; কোভেলাম থেকে কন্যাকুমারী; কন্যাকুমারী থেকে রামেশ্বরম হয়ে মাদুরাই; মাদুরাই থেকে বাঙ্গালুরু হয়ে কোলকাতা; এবং কোলকাতা থেকে পুনরায় মাগুরা।
বলাবাহুল্য, ট্রেনে বা বাসে গেলে উল্লিখিত অঞ্চলসমূহের সবিস্তার প্রাকৃতিক দৃশ্য, জনগণের ভাষা, আহার ও যাপিতজীবনের চিত্র তুলে ধরা সম্ভব ছিল। পুষ্পকরথে গেলে সেই সুযোগ খুব বেশি থাকে না। স্বল্পসময়ে বিমানে, বাসে, নৌকায় ৫৬৬৭ কিলোমিটার ভ্রমণকালে যা দেখেছি, অনুভব করেছি, তা এই রচনায় পরিবেশনের প্রয়াস নিয়েছি। ভ্রমণের প্রায় তিন চতুর্থাংশ উড়ালপথেই যেতে হয়েছিল।
ভ্রমণসাথী সর্বমোট ২৭ জন। মহিলাদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ ডা. অরুণের মা সত্তরোর্ধ প্রয়াত বিনীতাদি, পুরুষদের মধ্যে ৮০ বছরের এই লেখক আর সর্বকনিষ্ঠ ডা. সঞ্জয় দত্ত ও বর্ণালী ঘোষের পুত্র সৌরদীপ। ২০ জানুয়ারি ২০১৯, রবিবার সকাল ৮টায় মাগুরা থেকে সাউথ লাইন এ.সি পরিবহণে কোলকাতার উদ্দেশে যাত্রা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যশোরে পৌঁছে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সংযোগকারী ঐতিহাসিক যশোর রোড ধরে বেনাপোলের দিকে চলতে থাকি। এককালে এই সড়ক ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ ছিল।
লেখকের জন্মদিন পালন
যশোরের জমিদার কালীপদ পোদ্দার তাঁর মাকে ছায়ায় ছায়ায় গঙ্গাস্নান করানোর লক্ষ্যে ২ লাখ ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয় করে যশোরের বকচর থেকে নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেন এবং রাস্তার দু’পাশে বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা দ্রুত বর্ধনশীল রেইনট্রি রোপণ করেন। প্রায় চার হাজার গাছ লাগানো হয়েছিল। রাস্তা নির্মাণ শুরু হয় ১৮৪০ সালে এবং শেষ হয় ১৮৪২ সালে। ২০৪০ সালে বেঁচে থাকা বৃক্ষের বয়স প্রায় ২০০ বছর হবে। যশোর রোডের বাংলাদেশ অংশের গাছগুলো কেটে সড়ক নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের নিসর্গপ্রেমী ও পরিবেশবিদেরা প্রায় ২৪ হাজার সমর্থকের স্বাক্ষরসহ হাইকোর্টে বৃক্ষ লোপাটের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মহামান্য হাইকোর্ট স্থগিতাদেশও দিয়েছিলেন। সরকার তবু গাছ কাটা বন্ধ করেনি। ভারতের অংশেও পরিবেশপ্রেমীরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হাইকোর্ট আন্দোলোনকারী পরিবেশবিদদের আবেদনে মান্যতা দিয়ে বৃক্ষ নিধন রোধ করার নির্দেশ জারি করেছিলেন। ভারতীয় অংশে জীবিত গাছগুলোকে এখনো রক্ষাণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে গাছগুলোকে মাঝে রেখে রাস্তা নির্মিত হয়েছে ও হচ্ছে।
ঐতিহাসিক বলার অন্য কারণও আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এই রোডের ভারতীয় অংশে বৃক্ষের ছায়ায় পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি অ্যালেন গিনসবার্গ শরণার্থীদের দুর্দশা দেখতে এসে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ শীর্ষক কবিতা লিখেছিলেন, যা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল। তিনি শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। সেই কবিতায় সুর দিয়ে গান গেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী মৌসুমী ভৌমিক। দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শত্রুমুক্ত যশোর শহরে এসে যশোর টাউন হলে প্রথম বিজয় সমাবেশ করেছিলেন।
বেনাপোলে ইমিগ্রেশন কাস্টম পেরিয়ে পেট্রাপোলে পৌঁছতে প্রায় ১২টা। পেট্রাপোলে আনুষ্ঠানিকতা বেশি এবং তা বিরক্তিকর। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের ভারতীয় কারো আবাসস্থলের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার চাওয়ার আবশ্যকতা কোথায়! আমি দায় মেরে বলতে পারি শতকরা ৯৯ শতাংশ যাত্রী ভুল ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দেন। ইমিগ্রেশন কখনো যাত্রী প্রদত্ত ঠিকানা ও ফোন নাম্বার যাচাই করেছেন বলে মনে হয় না। যাহোক, এ সব ঝুট ঝামেলা ট্যুরাধিপতি ও তাঁর সহযাত্রীরা সামাল দিয়েছেন।
নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
সীমান্তেই টাকাকে রুপিতে পরিণত করা নেওয়া হলো। টাকা ভাঙানোর ব্যাপারেও ফ্যাসাদ। ভারত সরকার নির্দিষ্ট রেট লিখে যাত্রীদের জানানোর ব্যবস্থা করেন না। ফলে একেক মানি চেঞ্জারের কাছে আলাদা আলাদা রেট। নতুন পর্যটকেরা প্রায়শই দালালের হাতে পড়েন এবং প্রতারিত হন। ভারত থেকে ফেরার পথে আরেক ঝামেলা। মানি চেঞ্জার ও ভারতীয় পুলিশ আগ বাড়িয়ে বলেন ভারতীয় মুদ্রা বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না। ভারত সরকার এরকম কোনো আইন জারি করেছেন কি না জানা নেই। তাঁরাও এ প্রশ্নে চুপ থাকেন। তাঁদের দাবি রুপিকে টাকা করে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশী টাকা নিয়ে ভারতে যাওয়া গেলেও, ভারতীয় রুপি বাংলাদেশে আনা যাবে না কেনো? ভারতের মানি চেঞ্জার টাকা ও ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপি দিতে পারলে বাংলাদেশের বেনাপোলের মানি চেঞ্জাররা রুপি বা ডলারের বিনিময়ে বাংলা টাকা দিতে পারবেন নাই-বা কেনো?
অধিকাংশ পর্যটক জানেন না, ভারত বা বাংলাদেশ থেকে কোন কোন জিনিস আনা-নেওয়া যাবে। এ বিষয়ে বড় করে তালিকা টানানো নেই। কাস্টমসের অধিকাংশ কর্মকর্তা এর সুযোগ নিয়ে যাত্রীদের হয়রানি করেন। যাত্রীদের পকেট খসিয়ে রফা করতে হয়। কড়ি ফেলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। দুই পাশের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হওয়া কষ্টকর। দুই দেশেই এ ধরনের অসঙ্গতি ও অত্যাচারের বিহিত হওয়া জরুরি।
বরাবরের মতো পেট্রাপোল থেকে বনগাঁ হয়ে অশোকনগরের কাছাকাছি এক হোটেলের চত্বরে বাস থামে। হোটেলে দুপুরের আহার সেরে বিকেল ৫টার মধ্যে কলকাতা হোটেল আলফ্রেস্কোতে পৌঁছে যাই। হোটেলটি বিমানবন্দরের কাছে। মাগুরা থেকে আলফ্রেস্কো ১৫২ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে ৮-৯ ঘণ্টা তরুণদের জন্য কিছু নয়। আমার জন্য ক্লান্তিকর। কাপড়-চোপড় ছেড়ে বিশ্রাম নেই।
কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ
স্ত্রীর মৃত্যুর পর ২০০৯ সাল থেকে আমি মাগুরায় ডা. গৌতম রক্ষিত ও জয়া বসাকের আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে জীবনধারণ করছি। তারা জানতো ২০ জানুয়ারি আমার জন্মদিন। আমাদের কালে শিশু, কিশোর, তরুণ ও বৃদ্ধ বয়সে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ ছিল না। এখন এক বছর বয়স থেকে জন্মদিনের উৎসব পালন বাধ্যতামূলক। আমার প্রবল আপত্তি সত্তেও সম্প্রতি জয়া মা, নাতি-নাতনীরাও ফি-বছর আমাকে নিয়ে এই কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। আমরা হোটেলে আসার পর ট্যুরাধিপতি অরুণ ও গৌতম বেরিয়ে গিয়েছিলেন। জানতে পাই ওনারা লেখকের জন্মদিনের আয়োজন করার জন্য বেরিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় হোটেলের বিপরীতে এক চাইনীজ রেস্তোরাঁয় জন্মদিন পালিত হলো। গৌরীসেন ডা. গৌতম রক্ষিত। তবে অরুণ বাবু সর্বজনীন ভ্রমণ তহবিল থেকে কেক, ফুল ও উপহার ইত্যাদির জন্য ব্যয় করেছিলেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী এবং বড় ছেলে এসেছিল। মনে হলো, সকলে আনন্দিত ও পরিতৃপ্ত। সকলের কাছে আমার প্রশ্ন জন্মদিন পালন কি সুখের না দুঃখের! ব্যক্তির পরমায়ু থেকে একটি বছর ঝরে যাওয়াকে কি স্বাগত জানাতে পারি!
সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। যে মহামানবের নামে এই বিমানবন্দর তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামের অন্যতম প্রাণপুরুষ ও উপমহাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রকৃতপক্ষে, বৃটিশ রাজ এই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। ওঁরা ধনে-প্রাণে মারা যাওয়ার আগে, সসম্মানে সরে যাওয়ার বিকল্প দেখেননি।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিগো ছাড়বে ১০টা ৪০ মিনিটে। ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট সময়ে ১৬৭২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে চেন্নাই পৌঁছাবো। আমরা যথাসময়ের আগে প্রস্তুত ছিলাম। বাহন এলে বেরিয়ে গেলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। লাগেজ ও সিকিউরিটি চেকিং সেরে সাড়ে নয়টার দিকে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে গিয়ে বসে থাকি। আমি পত্রিকা পড়ে সময় কাটাই। অন্যরা কখন ছাড়বে অপেক্ষায় ছটফট করতে থাকে। ওখানে খাবার দোকান রয়েছে। কিন্তু যে কোনো আইটেম হাতে নিলে পকেট থেকে ধোঁয়া বের হতে পারে। যে কফি নিচে ৩০ রুপি, তা এখানে ৮০ রুপি। লাউঞ্জে শুধু ফ্রিতে জলপান করা যায়। বিনে পয়সায় টয়লেট ও টিস্যু পেপারও মেলে।
বিমানবন্দরে অপেক্ষা
ইন্ডিগোতে সিট গ্রহণের অনুরোধ জানালে তিন তলার লাউঞ্জ থেকে হেঁটে ক্রম অধোগমন। মাটিতে অপেক্ষারত বাস। বাসে চড়ে উড়োজাহাজের কাছে নেমে লাইনে দাঁড়ানো। হাতে বা বুক পকেটে বোর্ডিং পাস। তা দেখিয়ে, এয়ার হোস্টেজের মিষ্টি হাসি ছুঁয়ে নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসলাম। আগে বিমানের সিটগুলোতে বেশ স্পেস থাকতো। এখন সিট বাংলাদেশের লোকাল বাসের সিটের মতো। নট নড়নচড়ন। আয়েশি ব্যবস্থাও আছে। তবে ফেল কড়ি মাখো তেল। বিমান ওড়ার পর প্রথমে চকোলেট ও পরে খাওয়ার প্যাকেট দিতো। সে সব দিন হয়েছে বাসি। এখন খাবার পেতে হলে যাত্রীর পছন্দের খাবারের জন্য আগেই টিকেটের সঙ্গে গোল মাণিক যোগ করতে হয়।
এয়ার হোস্টেজের সিট বেল্ট বাঁধা, মোবাইল অফ রাখা, অক্সিজেন মাস্ক পরা, লাইফ জ্যাকেট ও ইমার্জেন্সি ডোর ব্যবহা বিষয়ক রুটিন পরামর্শ প্রদান শেষে উড়োজাহাজের পাইলট সবাইকে স্বাগত জানালেন। উড়োজাহাজ ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। নাতি অয়োময় বলল, দাদু হেঁটে যাচ্ছে তো, উড়বে না? পরমার বুদ্ধি একটু বেশি। সে বলে দেখিস হাঁটতে হাঁটতে উড়ে যাবে। একটু পরে জাহাজ জোরে দৌড়ে বাতাসে ভর করে চলতে শুরু করল। (চলবে)