গতকাল ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট SQ447 সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের উড়ানকাল ছিল রাত ১০.২৫। চেঙ্গি এয়ারপোর্টে ৭ ঘণ্টা ট্রানজিট নিতে হবে। এরপর লানকাউইতে নিয়ে যাবে স্কুট নামে আরেক উড়োজাহাজ।
আমরা একসঙ্গে রওনা দিয়েছি ৮ জন আয়রনম্যান ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে কারো কারো বিদেশ যাত্রা প্রথম বারের মতো। বিমানবন্দরের দোতলায় অনেকগুলো লাউঞ্জ রয়েছে এবং যাদের পকেটে ক্রেডিট কার্ড আছে এবং তাতে অনেক টাকা জমা রয়েছে তারাই যেতে পারে। একজনের সঙ্গে আরেকজন ফ্রি। রাফাতের সৌজন্যে আমিও সুযোগ পেলাম। সেখানে দেখা হলো বেলাল, ফারুক, আতাউর, বদরউদ্দিন ভাইদের সঙ্গে। ওয়েস্টিনের মজাদার খাবার-দাবার খেয়ে পেট টইটুম্বুর।
ঢাকা এয়ারপোর্টে প্রবেশের আগে বারিধারার ঢাকা ডোতে ছিল আমার সাইকেলের বাক্স। সেখানে ইমরান ভাই সাইকেল বাক্সবন্দি করতে সাহায্য করেছিল। ফ্লাইটের আগে আমিত এসে আমাকে ফাইনাল প্যাকিং করতে সহযোগিতা করল। এরপর উবার এক্সএল দিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেখি ভাগ্নে নাফিস আমাকে বিদায় জানাতে চলে এসেছে। এদিকে সাতক্ষীরা থেকে সোহেল ভাই তার বোনকে বলে রেখেছেন আমি আজ রাতে মালয়েশিয়া যাচ্ছি। আপা বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা। সেই রকম খাতির যত্নে আমাদের ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দিয়ে, চা কফি খাইয়ে লাগেজগুলোতে ট্যাগ লাগিয়ে দিলো। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে যে, এই যাত্রায় যেভাবে সবার ভালোবাসা আর সহযোগিতা পাচ্ছি, ইভেন্ট পর্যন্ত সব কিছু ভালোভাবে শেষ হলেই শান্তি পাবো।
ইমিগ্রেশনে তেমন বেগ পেতে হলো না। আমরা সবাই বিডিট্রায়ের টিশার্ট পরে নিয়েছিলাম। কিন্তু পেছন থেকে আতাউর ভাইকে ডেকে নিয়ে গেলো ইমিগ্রেশন পুলিশ। তিনি তখনো টিশার্ট পরেননি। মালয়েশিয়াতে এত মানুষ যায় যে, কে জেনুইন তা বের করা তাদের জন্যই কঠিন হয়ে পড়ে। আতাউর ভাইকে হাবিজাবি জিজ্ঞেস করে পরে ছেড়ে দিলো। খামোখা সময় নষ্ট! ভেতর থেকে কিছু রিঙ্গিত কিনে নিলাম। বিমানে ওঠার আগে আমরা সবাই দেশের পতাকা নিয়ে ছবি তুললাম।
১৪ জনের বেশ বড় বহর যাচ্ছে এবার আয়রনম্যন ইভেন্টে। রাতে বিমান থেকে তেমন কিছু দেখা যায় না, তাই খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কাজ নেই। আকাশে থাকব মোটে চার ঘণ্টা। এদিকে নতুন করে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। সুন্দরী একজন বিমানবালার কাছ থেকে কিছু বরফ টুকরো চেয়ে নিলাম আর এক গ্লাস রেড ওয়াইন। চেয়ারের সামনের স্ক্রিনে অনেক অপশন রয়েছে। সাঁতারের নতুন একটা মুভি রিলিজ হয়েছে নেটফ্লিক্স এ- ‘ইয়ং উইমেন অ্যান্ড দ্যা সি’। যুক্তরাজ্যের প্রথম মহিলা সাতারু ট্রুডি এডারলি যিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন ১৯২৬ সালে। সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে সিনেমার গল্প। এবার আমরা যাচ্ছি আন্দামান সাগরে সাঁতার কাটতে, তাই এই সিনেমা থেকে কিছু অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় কিনা ভেবে দেখা শুরু করলাম। বাংলা চ্যানেলের আগে ‘নায়াদ’ দেখেছিলাম। অসম্ভব সাহসী সেই নারী ৩ বার কিউবা থেকে ফ্লোরিডা ১১০ মাইল পথ কঠিন এক চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হন। চতুর্থ বার গিয়ে চ্যানেল পাড়ি দেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর!
সিনেমা পুরাটা শেষ করার আগেই ঘোষণা এলো আমরা এখন নামতে শুরু করেছি। সিটবেল্ট বেঁধে ঘাড় সোজা করে বসে থাকো। সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে এসে উড়োজাহাজ টার্মিনাল-টু-এর দিকে মুখ ফেরালো। আসার আগে চেঙ্গি এয়ারপোর্টের ব্যাপারে অনেক গল্প শুনেছি এবং ভিডিও দেখেছি। এতো বিশাল আয়তনের বিমানবন্দর এশিয়ার মধ্যে আর দ্বিতীয়টি নেই! এখানে এত এত কিছুর আয়োজন আছে যে একজন ট্রানজিট পেসেঞ্জার খুব সাচ্ছন্দে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিতে পারে। সিঙ্গাপুর দেশ হিসেবে ছোট কিন্তু তারা প্রকৃতির ব্যাপারে খুব সচেতন। এয়ারপোর্টের ভেতরেই এত পরিমাণে সবুজের সমারোহ একবারের জন্যও বিরক্তবোধ আসবে না। ঝরনাধারা, বিশাল প্রজাতির বাগান, সূর্যমুখির বাগান, পায়ের তলায় মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে আর চারপাশে বুনো জঙ্গল, সেখানে বিচিত্র পাখপাখালির শব্দ! মাথা তুলে দেখি উপরে লেজার আলোয় জল ছলছল করছে, সেখানে নৌকার তলদেশ দেখা যাচ্ছে, তার তল দিয়ে মাছ ধরার জন্য একটা ভোঁদড় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। একদম জীবন্ত, সবকিছ কি মোহনীয়!
কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানোর আয়োজন, সিনেমা থিয়েটার- কি নেই এখানে! চেঙ্গি এয়ারপোর্টের বর্ণনা দিতে হয়তো আরো একটা লিখা লিখতে হবে। টার্মিনাল এক দুই তিন এই বিশাল জায়গাগুলোতে যেতে শাটল ট্রেন ধরতে হবে। টার্মিনাল-৩-এর পাশে ‘জুয়েল’ অনবদ্য এক স্থাপনা। আধুনিক স্থাপত্যকলার দারুণ নিদর্শন! দালানের মধ্যে এতো সুন্দর ঝরনাধারা কল্পনা মনে হয়েছিল প্রথম দেখে।
সিঙ্গাপুরের ভিসা নিয়েছি, ফেরার পথে ২৫ ঘণ্টা ট্রানজিট রয়েছে আমার, ঘুরে দেখবো অন্তত এই জায়গাটা। টার্মিনাল-২ থেকে ৩ এ যাওয়ার সময় এক ঝলক এই ঝরনা দেখা যায়। ইচ্ছা করেই এয়ারপোর্টের সঙ্গে এর সংযোগ রাখা হয়েছে যেনো এই ঝরনার মোহে পড়ে সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ। এদেশে ট্যুরিজমের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৮০ মিলিয়ন পর্যটক আসে। এসব দেখতে দেখতেই সাত ঘণ্টা চোখের পলকে কখন চলে গেলো টেরই পেলাম না। চেঙি এয়ারপোর্টে আমার ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড রাহাতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো, সেও আমাদের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিল। আয়রনম্যানের জন্য শুভ কামনা জানালো।
আমাদের সঙ্গে যারা আগে এই এয়ারপোর্ট দিয়ে গেছে তারা একটু ঝিমিয়ে নিলো। লানকাউইতে যেতে আমাদের টার্মিনাল-২ এ স্কুট বিমান ধরতে হবে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। জানালা দিয়ে লানকাউই দেখে বেশ উৎফুল্ল হলাম। আন্দামান সাগরের উপর উড়োজাহাজ এখন ডানা মেলে উড়ছে, কয়েকদিন পরেই এই সাগরে সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটতে হবে! মালয়েশিয়াতে প্রথমবারের মতো আগমন, মালয় ভাষায় যাকে বলে ‘সালামত দাতাং’ মানে ওয়েলকাম।
এবার আসল পরীক্ষা, মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন। আয়রনম্যানের ইভেন্টে যাচ্ছি, শুনেছি তারা এই রেইস অনেক কদর করে, বিশেষ করে লানকাউইতে। আমাদের একসঙ্গে দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞেস করলেন- আপনারা সবাই একদিকে অপেক্ষা করুন। ভাবলাম আলাদা খাতির করবে। সবাই যাবার পর আমাদের একে একে ডাকলেন। সবার পাসপোর্ট আর বাকি পেপারস সব নিয়ে চেক করা শুরু করলেন। আয়রনম্যন রেজিষ্ট্রেশনের কাগজ আমাদের সঙ্গে ছিল আর ফেরত যাবার টিকিটও কাটা আছে। তাদের চোখ দেখেই বুঝলাম বাংলাদেশ শুনে তারা ভালোভাবে দেখছে না আমাদের। নানা কিছু জিজ্ঞাসা শুরু করেছে। বদর ভাই আর ফারুক ভাইয়ের রিটার্ন টিকিট নিয়ে কিছু একটা কনফিউশান ছিল তাদের, এসব মেটাতে বেশ সময় চলে গেলো।
আমাকে ডাকার পর জানালাম আয়রনম্যন ইভেন্টে এসেছি। আমার দিকে এমনভাবে লুক দিলো যে তার বিশ্বাসই হলো না এই লোক আয়রনম্যান দিতে আসছে- কেমনে কি! ইয়া ভুড়িওয়ালা ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞেস করলো, ‘হোয়ার ইজ ইয়োর সাইকেল শু? বললাম, আমি ক্লীট শু ব্যবহার করি না। আর যদি করিও এই জুতা পরে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করা যায় না। সাইকেলে চড়লেই কেবল তা পরতে হয়। গর্দভ নাকি ব্যাটা! দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে রইলাম। এরপর ফেরার টিকিটে কুয়ালালামপুর দেখে বলল, লানকাউই থেকে কুয়ালালামপুর কীভাবে যাবে? বললাম, সাইকেল চালিয়ে যাবো আয়রনম্যান শেষ করে। বিশ্বাস করল কিনা জানি না, তারপর একমাসের ভিসা থাকা সত্ত্বেও আমার ফিরতি ফ্লাইটের একদিন পর তারিখ দিয়ে সিল দিয়ে দিলো।
আরেকজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, যদি আমি ফ্লাইট মিস করি বা অসুস্থ হই তখন কী করব? তিনি বললেন, এমন ইমারজেন্সি কিছু হলে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে এসে মেডিকেল সাটিফিকেট দেখিয়ে ভিসার সময় বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। বাংলাদেশ থেকে এলাম বলেই কি এমন ব্যবহার পেলাম!
আমাদের ছাড়া ততক্ষণে বাকি সব যাত্রী বের হয়ে গেছে। ব্যাগেজের কাছে এসে দেখি আতাউর ভাইয়ের সাইকেল বাক্স ছেঁড়া! কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে। তাদের জানানোর পর কমপ্লেইন করতে বললো। এরমধ্যে বেলা অনেক গড়িয়ে গেছে। দলের এক অংশ পালনকি হোটেলে যাবো আর বাকিরা চেনাং ভিউ হোটেলে। আমার রুম ঠিক করা আছে বদর ভাইয়ের সঙ্গে। আতাউর ভাইয়ের বাক্সের ঝামেলা না মেটানো পর্যন্ত আমরা বের হয়ে যেতে পারি না। কিন্তু বেলাল ভাই আর ফারুক ভাই কেনো জানি খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পাড়লো; সঙ্গে বদর ভাইও। নাহিদ চট্টগ্রাম থেকে এসেছে তার সঙ্গে আকিকের থাকার কথা, কিন্তু আসবে আরো দুদিন পর, তাই আমি নাহিদ আর বাকি সবার সঙ্গে চেনাং ভিউ হোটেলে চলে এলাম। (চলবে)