লানকাউই একেবারে নতুন জায়গা আমার জন্য। এখানেই আয়রনম্যানের মতো কঠিন রেইসে উত্তীর্ণ হতে হবে। গত এক বছর থেকে যে প্রস্তুতি নিয়েছি তার ফাইনাল পরীক্ষা দুদিন পরেই। লানকাউইতে নেমে হোটেলে গিয়ে আমাদের প্রধান কাজ হলো সাইকেল বাক্স থেকে বের করে এসেম্বেল করা। সাইকেল খুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার পরে অনেক গোলমাল দেখা দেয়। নাহিদ, রাফাত সবাই সাহায্য করেছে। ওদের কাছে দারুণ সব অত্যাধুনিক টুলস আছে! যদিও আমার সাইকেল খুব সাধারণ রোডবাইক। মুজাহিদ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, তিনি লন্ডন থেকে সাইকেলটা এনে ঢাকা থেকে জামালপুর হয়ে সিলেট গিয়েছিলেন, এরপর যাবার সময় আমাকে দিয়ে যান। সেই সাইকেল ঠিকঠাক করে আয়রনম্যানের জন্য প্রস্তুত করি।
আয়রনম্যানের জন্য আমাদের আন্দামান সাগরে সাতরাতে হবে ১.৯ কিলোমিটার। সাগরে রেকি করে দেখতে হবে। যেখানে রেইস শুরু হবে সেই জায়গাটা আমাদের হোটেল থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পেরদানা কোয়াই লাইট হাউসের পাশে কোক বিচ, সেখান থেকে শুরু হবে সাঁতার। ‘দি ডানা লানকাউই’ নামে বিশাল আলিশান রিসোর্টে আয়োজকরা সব বন্দোবস্ত করেছে। বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা সেখাও কেউ কেউ অবস্থান করছেন।
সকাল বেলা সাকলাইন ভাইয়ের ঠিক করা গাড়িতে আমরা চলে গেলাম সাগরের কাছে। তখনো আরো ৫ দিন হাতে আছে। সাগরে দড়ি, বয়া লাগানোর কাজ চলছে। সমুদ্রে সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা নতুন এমন কয়েকজনও রয়েছেন আমাদের মধ্যে। ঠিক হলো ৫০০ মিটার গিয়ে আবার ফিরে আসবো। পীযুস কিছুটা সংকোচ করছিলো, রাফাত আর আতাউর ভাইয়ের জন্যও প্রথমবার, তবে তারা নেমে পড়লো নির্দ্বিধায়। সবার আগে নাহিদ দেখলাম চোখের আড়াল হয়ে গেলো। সাগরে সাঁতার কাটতে বড় কলিজা লাগে। নতুন জায়গায় প্রথম কয়েক মিটার বেশ নার্ভাস লাগছিল। আজকে সমুদ্র কিছুটা উত্তাল, কারণ সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েছে।
এখানে সূর্যের মুখ দেখা যায় সকাল ৭টার দিকে। এই সাগরে জেলিফিশ আছে বলে শুনেছি। বাংলা চ্যানেলে জেলিফিশের আক্রমণের কথা মনে পড়ে গেলো। সামনে একটা পাথুরে দ্বীপের মতো দেখা যাচ্ছিলো, ভাবলাম সেখানে গিয়ে পাড়ে উঠবো। পরে সাকলাইন ভাই সাবধান করে দিলো, সেখানে নামলে হাত-পা ছিলে যাবে। আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। খুব আরাম করে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে বিচে উঠলাম। অন্যরকম এক অনুভূতি হলো। নাহিদকে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পরে তাকে দেখা গেলো, সে সাঁতারের পুরোটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। দেশে থাকতে ইমতিয়াজ ভাই, রিপন ভাই যারা আয়রনম্যানে একাধিকবার অংশ নিয়েছেন বারবার আমাদের বলে দিয়েছেন- কোনো প্রকার ওভার এক্সাইটেড হয়ে কিছু যেনো না করি। কোনোভাবে ইঞ্জুরি হলে আর রক্ষা নেই! এমনকি খাওয়াদাওয়ার ব্যপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
সাইকেলে ৯০ কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে সাঁতার শেষ করেই, তাই পুরো রাস্তা মাথায় থাকলে খুব ভালো হয়। আমরা পরদিন কিছুটা পাহাড়ি পথ সাইকেল চালিয়ে রেকি করলাম। কি সুন্দর মনোরম পরিবেশ! ঘন জঙ্গল আর সমুদ্রের কিনার দিয়ে কি দারুণ রাস্তা! ডাউন হিলে খুব মজা পাচ্ছিলাম। কিন্তু গিয়ার পাল্টাতে গিয়ে হলো বিপত্তি, চেইন গেলো ছিঁড়ে। সবাই বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর আরো প্রায় ৫ কিমি পথ ডাউন হিল আর হেঁটে এসে পথে এক দোকানে সবার সঙ্গে দেখা। গ্রাব কল করে সাইকেল নিয়ে গেলাম হোটেলে। ভাগ্য ভালো চেইনটা রেইসের আগে ছিঁড়ল, না হলে রেইসের দিন হলে বারোটা বেজে যেতো। প্রায় ৭০ রিঙ্গিত দিয়ে নতুন চেইন কিনে সাইকেলে সেট করলাম। চেনাং ভিউ হোটেলে সুইমিং পুল ছিল, সেখানেও আমরা প্র্যাকটিস করলাম। একা এবং সৌরভদার সঙ্গে রানিং করলাম।
আমাদের কিট কালেকশনের দিন চলে এসেছে। মসুরি এক্সিবিশন সেন্টার বিশাল আকারের, আমাদের চীন মৈত্রীর থেকেও অনেক বড়। এখানে এক্সপোর আয়োজন করা হয়েছে এবং আজ রাতে ব্রিফিং ও ডিনারের ব্যবস্থা আছে সবার জন্য। সকালবেলা পরিকল্পনা ছিল ভোরে আমরা সুইমিং এ যাবো এবং ১.৯ কিমি পুরো সুইমিং ট্র্যাক ঘুরে আসবো। এর আগে আমরা স্কুটি ভাড়া নিয়েছিলাম ৩০ রিঙ্গিত দিয়ে সারাদিনের জন্য। সাইকেলের রুট ৯০ কিমি রেকি করেছি, যেনো রাস্তাটা আমাদের মাথায় থাকে। সকালে রেডি হয়ে আমি আর নাহিদ, রাফাত আর আতাউর ভাই দুইটা বাইকে রওনা দিলাম। এয়ারপোর্ট পার হয়ে লানকাউই পুলিশ একাডেমির সামনে এসে নাহিদ বলল স্কুটির তেল শেষ হয়ে গেছে। ঝাকানি দিয়েও চলার চেষ্টা করা হলো কাজ হলো না। রাফাত আমাদের আগে ছিল। আমি গতকাল মালয়েশিয়ান সিম কিনেছিলাম, নাহিদ আমাকে কল দিতে বলল রাফাতকে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল দিলাম। আতাউর ভাই ফোন রিসিভ করলে জানালাম আমাদের স্কুটির তেল শেষ হয়েছে আপনারা দাঁড়ান। ম্যাপে তখন দেড় কিলোমিটার দূরত্ব দেখাচ্ছিল পেট্রোল পাম্প। আমি কি মনে করে ফোনটা ব্যাগে না রেখে জ্যাকেটের পকেটে রেখে বাইক ঠেলতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম রাফাত আর আতাউর ভাই ফিরে আসবে আমাদের কাছে। তাদের দেরি দেখে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। কিছুটা দুশ্চিন্তা, রাগ আর অস্থিরতায় আমাদের মাথা কাজ করছিল না।
কিছুক্ষণ আমি ঠেলছি কিছুক্ষণ নাহিদ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে স্কুটি। ওদেরও দেখা নাই। হঠাৎ করে স্থানীয় একজন লোক বাইক চালিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো কী ঘটনা? এরপর কী মনে করে তিনি নাহিদকে তার বাইকে বসিয়ে আমাকে স্কুটির হ্যান্ডেল চেপে ধরতে বললেন। এভাবে এক পা দিয়ে ঠেলে নিয়ে গেলো প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরত্বে পেট্রোল পাম্পে। তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যখন বিদায় দিলাম তখন টের পেলাম জ্যাকেটের পকেটে মোবাইল ফোন আর নেই! মাথায় হাত দিয়ে স্কুটি ঘুরিয়ে পুরো রাস্তা আপ-ডাউন করলাম প্রায় চারবার। কোথাও কিছু নেই। অথচ তখন রাস্তায় তেমন কোনো মানুষও ছিল না। এয়ারপোর্টে গিয়ে একজনের ফোন থেকে আমার লোকাল নাম্বারে কল দিলাম, দুইবার বাজলো কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করলো না। এরপরের বার ফোন বন্ধ পাওয়া গেলো। তারমানে ফোন কারো হাতে চলে গেছে। রাস্তায় খুঁজেও আর যখন পাবো না নিশ্চিত হলাম, তখন থানায় গিয়ে রিপোর্ট লিখালাম। আমাদের সুইমিং আর করা হলো না। মুসরি সেন্টারে চলে গেলাম মন খারাপ করে।
বিদেশে ফোন হারালে কত যে বিপদ হয়! সব ইনফরমেশন, নাম্বার, যোগাযোগ সব কিছু এক মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেলো। কিটগুলো কালেকশন করলাম। এর মধ্যে খবর পেলাম আমাদের বদর ভাই সাইকেল থেকে পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি ফুল আয়রনম্যানের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রথম বিদেশ যাত্রা ঘুম, খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম- সব মিলিয়ে বদর ভাই সামলে উঠতে পারেননি। পাহাড়ি পথ থেকে নামার সময় মাথা ঘুরে ছিটকে পড়ে যান। মাথায় এবং শরীরে বেশ আঘাত পান। আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই তাকে দেখতে। টিমের সবাই ভারাক্রান্ত আর চিন্তিত হয়ে পড়লাম এ ঘটনায়। আয়রনম্যানের মতো রেইসের আগে এমন দুর্ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক! হাসপাতালে মাথার কাটা অংশ সেলাই করে আর ওষুধপত্তর দিয়ে বদর ভাইকে তারা কমপ্লিট রেস্টে থাকতে বলে দিলো। এরপর তাকে পরবর্তী দিনগুলো হোটেল রুমেই কাটাতে হয়েছে।
আমরা পুনরায় রেইসের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ছোট ছোট জিনিসও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। মানসিক চাপ বাড়তে শুরু করলো। কেউ কেউ বিগড়ে গেলো, আবার কেউ চুপচাপ হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন বেশ আনন্দে সময় পার করেছি বলা যায়। টি-ওয়ান, টি-টু তে ব্যাগগুলো রেখে আসলাম। সুইমিং থেকে উঠে টি-ওয়ান থেকে সাইকেলে যাওয়ার জন্য জিনিসপত্র নিতে হবে এবং সাইকেল শেষ করে টি-টু থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রান শুরু করতে হবে। সব কিছুর খুব সুন্দর আয়োজন! পায়ে একটি অত্যাধুনিক চিপ পরিয়ে দেওয়া হবে যাতে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে ট্র্যাক করা যায়। আগেরদিন বিকালের মধ্যে সাইকেল জমা দিয়ে আসলাম। সবকিছু এখন খুব চরম উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কালকের আট ঘণ্টা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় মনে হচ্ছে। গত এক বছরের সাধনার চরম পরীক্ষা আগামীকাল। এই কুরুক্ষেত্র ঠিকভাবে শেষ হলে এই যাত্রায় উতরে যাব।
সাকলাইন ভাই সবাইকে রাত ৮টার মধ্যে বিছানায় চলে যেতে বলল। ভোর সাড়ে তিনটায় এলার্ম বাজবে। যার যার মতো খাওয়া-দাওয়া করে বাথরুম সেরে ৫টায় বের হয়ে পড়তে হবে। কঠিন পরিশ্রম করলাম যুদ্ধ যেনো সহজ হয় সেই কামনা করে বিছানায় চলে গেলাম।
পড়ুন: আয়রনম্যান: ১ম পর্ব