২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত কিছু লেখার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম। লিখতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে বহন করা ভিকটিমদের বেঁচে থাকার করুণ বর্ণনা যতো শুনেছি শিহরিত হয়েছি- এতোটা বর্বরোচিত হামলা কীভাবে সম্ভব হলো?
একটি গণতান্ত্রিক সমাবেশে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় সমরাস্ত্র দিয়ে হামলার ঘটনা উপমহাদেশে এটিই প্রথম। শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্য নিয়েই বিএনপি ও জামায়াত জোটের প্রত্যক্ষ মদদে এই হামলা চালানো হয়। এজন্য বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাড়াটে খুনীর দলকে নিযুক্ত করা হয়। এবং সহায়তা নেওয়া হয় তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের। ঘাতক দলের সম্মীলিত প্রচেষ্টাতেই সেদিন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউ।
জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজী) কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে পরিচালনা করা এবং কাশ্মির, পাকিস্তান ও মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন, লস্কর-ই-তৈয়বা, তেহরিক-ই জিহাদী ইসলামী (টিজেআই), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-এর জঙ্গী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অসৎ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদী মজুদ এবং সেগুলো পরিবহনের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করার অভিপ্রায়ে এইসব জঙ্গী সংগঠনের দেশীয় প্রতিনিধিরা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সঙ্গে গোপন আতাত গড়ে তোলে।
বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকার সবসময় পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিল। তারা মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে পারলে তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। বিএনপি ও জামায়াতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তারেক জিয়া। তারেক জিয়ার অফিস হাওয়া ভবন। সেখানে বসেই তার আঙুলি হেলনের মাধ্যমেই সরকার পরিচালিত হতো। এগুলো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সুতরাং দেশবাসীর নিশ্চয়ই মনে আছে, সরকারে না থেকেও তখন তারেক জিয়ার সিদ্ধান্তই ছিল খালেদা জিয়া তথা বিএনপি জামায়াত সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
তারেক জিয়ার সহযোগী ছিলেন তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, আলী আহসান মুজাহিদ, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মুফতি হান্নান, মাওলানা আবু তাহেরসহ অন্যান্যরা। এইসব জঙ্গী নেতারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাদের আস্তানায় ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে ও পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড ও গোলাবারুদ এনে মজুদ করে। যেগুলো ২১ আগস্ট হামলার দিন ব্যবহার করা হয়েছিল।
২১ আগস্টের বিভীষিকাময় সেদিনের বিকেলে গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন এবং প্রায় চারশ ব্যক্তি মারাত্মকভাবে আহত হন। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তারাও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার দেহে বহন করে অসহনীয় ও দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছেন।
পরবর্তীতে এই ভয়াবহ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এবং প্রকৃত আসামীদের আড়াল করার জন্য বিএনপি ও জামায়াত জোট তৎকালীন পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সহায়তায় জজ মিয়ার মিথ্যা নাটক সৃষ্টি করে এবং মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন মাওলানা তাজউদ্দিনকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। ঘটনাস্থল ও তার আশপাশ থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত অবিস্ফোরিত গ্রেনেড সংরক্ষণ না করে দ্রুত ধ্বংসের ব্যবস্থা করা হয় যাতে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া যায়। এছাড়াও নিহত বা আহতদের পরিবার থেকে মামলা না নিয়ে দ্রুত পুলিশকে দিয়ে বাদী হয়ে মামলা করা হয়। আমি মনে করি, তৎকালীন ক্ষমতাশীলরা যদি এতে জড়িত না থাকতো, তাহলে ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতো, ঘটনার পর নিরীহ আওয়ামী নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে মামলা দিতো না, উদ্ধারকৃত আলামত সংরক্ষণ না করে ধ্বংস করতো না, এমনকি মামলা ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য জজ মিয়ার নাটক সৃষ্টি করতো না।
বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। সাধারণ মানুষ এমন রাজনীতি চায় না। দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হত্যা মামলার বিচারের রায় হয়। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও তারেক জিয়াসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। বিচারপ্রার্থী লক্ষ লক্ষ মানুষ এতে স্বস্তি প্রকাশ করে এবং এই রায় অবিলম্বে কার্যকর হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমরাও প্রতীক্ষায় আছি, উচ্চ আদালতে দ্রুত আপিল নিষ্পত্তিসহ রায় কার্যকর হওয়ার। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় এই মামলার রায় বিশ্ব ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।