সম্প্রতি গণমাধ্যমে কয়েকটি ধর্ষণের প্রতিবেদন চোখে পড়েছে। পড়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি। তবে সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনা আমাকে প্রচণ্ড মর্মাহত করেছে। আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে, হচ্ছে। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনতাই করে গণধর্ষণ! তাও আবার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে, যেখানে ‘শিক্ষা গ্রহণ করে সেবার জন্য বেরিয়ে পড়ার’ মন্ত্র শেখানো হয় সেখানকার কতিপয় বখাটে দুর্বৃত্ত এভাবেই জাতির সামনে তাদের ধর্ষক-সত্তা তুলে ধরেছে!
আবার সেদিন (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০) জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রবেশ করার সময় দেখি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে মামলা দায়েরকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সাংবাদিকদের সামনে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাচ্ছেন। এখনও আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন ওই ছাত্রী রাষ্ট্রযন্ত্র পুলিশ প্রশাসনের কাছে সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে চেয়েছেন। তাকে নাকি নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন সংবাদকর্মীদের সামনে।
ধর্ষকের পরিচয় তিনি ‘ধর্ষক’। সমাজ, রাষ্ট্রে ঘৃণিত অপরাধী। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা পুলিশ প্রশাসনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ধর্ষণ নির্মূল নিয়ে নানা জনকে নানান কথা বলতে শুনেছি। সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ ক্রসফায়ারের পক্ষে মতামত তুলে ধরেছেন, আবার অনেকে ধর্ষণকাজে ব্যবহৃত পুরুষের বিশেষ অঙ্গহানী করারও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আমার পর্যবেক্ষণ, একটা অপরাধের বিচার কাজের ব্যর্থতায় আরেকটি অপরাধ সংঘটিত করতে দেওয়া যাবে না। আবার শুধু পুরুষরাই ধর্ষণ করে- এটিও এককভাবে মনে করলে কিংবা ধর্ষক হিসেবে শুধু পুরুষকেই নির্ণয় করলে দেশ ও জাতির কাছে ভুল বার্তা দেওয়া হবে বলে মনে করি। কারণ যৌন নির্যাতন শুধু মেয়ে-নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক ছেলে-পুরুষও যৌন নির্যাতনের শিকার। হয়তো সামাজিক লজ্জাবোধ থেকে অনেকেই এটি প্রকাশ করেন না। কারণ আমাদের সমাজে কতিপয় মানুষ উল্টো যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে তার প্রতিবাদ থামিয়ে দিতে চায়। কণ্ঠ রোধ করতে চায়। তারা বিষয়টিকে বিতর্কিত করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার হীন ষড়যন্ত্র করে।
আমাদের মনে থাকার কথা, বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মি-টু আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার মানুষগুলো তাদের নিজেদের ঘৃণা-কষ্টগুলো নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের দ্বারা অনাকাঙ্খিত, অপ্রত্যাশিত যৌন নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনাগুলো আমাদের আধুনিক সভ্যতাকেও মাঝেমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মানুষের আবির্ভাব দুই লাখ বছর আগে হলেও মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে আজ থেকে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগে। অভিধানের ভাষায়, সভ্য জাতির জীবনযাত্রা নির্বাহের পদ্ধতি, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও বিদ্যার অনুশীলনহেতু মন মগজের উৎকর্ষ সাধণ করাই হচ্ছে সভ্যতা। আর মানুষের মন মগজে কী হচ্ছে- এটি দৃশ্যমান নয়, তবে গবেষণার বিষয়। এই মানুষ তার সকল কাজ সম্পাদন করে মন-মগজের নির্দেশনা থেকেই।
অনেকের মতে, মানব সভ্যতার শুরুটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে এটি পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। আর তখন থেকেই এক শ্রেণীর পুরুষ মনে করে, মেয়ে মানুষ হচ্ছে তাদের অন্য আর দশটা সম্পত্তির মতোই ভোগ্যপণ্য। তাই নারীকে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে ভোগ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয় কতিপয় পুরুষের মন-মগজে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সভ্যতার দৃষ্টিকোণে ধীরে ধীরে এটি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তখন নারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে তারা। যেমন শত্রুকে চূড়ান্তভাবে অপমান-অপদস্থ করার একটি অনুষঙ্গ হলো তাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করা। আর এই ধর্ষণ-হত্যার মাধ্যমেই শত্রু পক্ষের পরাজয় বিবেচনা করা হতো। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও আমরা সেই চেষ্টা দেখেছি।
মানুষের মন-মগজে এই ধর্ষণের উপস্থিতি কেন বা কী কারণে হয়ে থাকে এটি খুঁজতে গিয়ে দেখি, ধর্ষণ করার প্রবণতায় ‘শিশু’ কিংবা ‘শত বছরের বৃদ্ধা নারী’ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এ বছরের শুরুর দিকে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার শতবর্ষের অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করেছে ১৪ বছরের কিশোর! অন্যদিকে কয়েক মাসের কণ্যা সন্তানও ধর্ষকের নোংরা থাবা থেকে রেহাই পায়নি! আবার ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশু পর্যন্ত! মূলত, মন-মগজ দ্বারা পরিচালিত ধর্ষণ প্রবণতা ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে। কখনো প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, কখনো সুযোগ পেয়ে, আবার কখনো নিজেই কৌশল নির্ণয় করে ধর্ষণ করছে অনেকে।
একটু বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধর্ষণ করার পেছনে যে মানসিকতা তার উপর ভিত্তি করে এই কৌশল নির্ণয় হয়। যেমন: সুবিধাবঞ্চিত পুরুষ, যার কাছে ধর্ষণ একটা অবলম্বন, বিশেষায়িত ধর্ষক যারা শুধুমাত্র আগ্রাসী যৌনকর্মের মাধ্যমেই যৌন উত্তেজনা পায়, সুযোগসন্ধানী ধর্ষক যারা সবদিক বিবেচনা করে যদি দেখে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই তখনই ধর্ষণ করে, মিলনের তীব্র চাহিদাসম্পন্ন পুরুষ যারা কর্তৃত্বপরায়ণ এবং মনোবিকারগ্রস্ত যেমন: রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা!
আমি মনে করি, ধর্ষণ নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে। এটি একক কোনো ‘বিন্দু’র উপর নির্ভরশীল নয়। আবার কোনো একক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর মধ্যেও ধর্ষণ মনোভাব সীমাবদ্ধ নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসার কতিপয় শিক্ষকও আজ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত। আবার মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত বা ধর্মগুরুরাও ধর্ষণের মতো অপরাধ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেননি। কতিপয় করপোরেট হাউজ থেকে মিডিয়া হাউজগুলোও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। সাম্প্রতিক মি-টু আন্দোলন অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্বের মুখোশ খুলে দিয়েছে।
অপরাধবিজ্ঞানের একাডেমিক আলোচনায় ট্রাভিস হারসি স্যোসাল বন্ডিং তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন: পরিবারে বাবা-মায়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়া, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো, পড়াশোনার পাশপাশি সহ-শিক্ষা পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, সমাজ ও রাষ্ট্রের রীতিনীতি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের যে কোনো ধরনের প্রথা ও নীতি বিরুদ্ধ কাজকর্ম থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে।
কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংসারে সন্তানের সামনেই বাবা মাকে প্রহার করছে। অশ্লীল ভাষায় গালাগালিসহ শারীরিক নির্যাতনও ঘটে। পান থেকে চুন খসলেই নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন- এই শিক্ষাটা পরিবার থেকেই প্রথমে পায় শিশু। অন্যদিকে নারীকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে, তাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি কম, নারী পুরুষের সেবাদাসী, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত, একটা নারী গেলে দশটা আসবে, পুরুষের জন্যেই নারী, পুরুষ ইচ্ছে করলেই দশটা বিয়ে করতে পারে- এ ধরনের পারিবারিক কথোপকথন বা কলহের মধ্যেই ধীরে ধীরে যে ছেলেটি শিশু-কিশোর বয়স পেরিয়ে যুবক হয়, তখন তার মধ্যে নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধাবোধের প্রতিফলন দেখা যায় না।
ধর্ষককে ক্রসফায়ার (বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি নিশ্চয় নয়), মৃত্যুদণ্ড, বিশেষ অঙ্গহানী ধর্ষণরোধ করবে বলে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে মনে হয় না। কারণ ধর্ষণের অপরাধে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ, গুলি করে হত্যা, ঢিল মেরে মেরে হত্যা, ফাঁসি দিয়ে হত্যার দণ্ড নিশ্চিত করা দেশগুলোতে আজও ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি। তাই বলে বিচারের নামে দীর্ঘ সময় পার করা, রাজনৈতিক নোংরা হস্তক্ষেপ, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। সময়ের প্রয়োজনে আইনের ধারাও পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা গুরুত্বপূর্ণ। আর চলমান আইনের ১৮০ কার্যদিনের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার বার্তা মিডিয়ার মাধ্যমে, আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ধর্ষণ, হত্যাসহ সামাজিক অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণ-রোধ করতে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রযন্ত্র ও মিডিয়ার সমন্বয়ে জনসচেতনামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারকে কাজে লাগিয়ে পাড়ায়, মহল্লায় যৌন নিপীড়ন সেল বা কমিটি গঠন করা উচিত। মসজিদগুলোতে প্রতি শুক্রবার খুতবার আগে শিশু-নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-হত্যা নিয়ে ইমাম কর্তৃক আলোচনা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক দ্বারা উঠান বৈঠকের আয়োজনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে আলোচনা এবং তার বিপরীতে প্রচলিত আইনে কী শাস্তির বিধান আছে এসব বিষয়ে স্থানীয়ভাবে সচেতন-সাবধান করতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন ২০০৯ সালে। নতুন করে (১০ জুলাই, ২০১৯) শিশু নির্যাতন রোধে দেশের প্রতিটি স্কুলে অভিযোগ বক্স রাখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু আমরা কি এটি বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?
ধর্ষণের মতো বর্বরতার হাত থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের পুরুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের আরও সচেতন, প্রতিবাদমুখর হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে ‘মানুষের বিবেক’ জাগ্রত করার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে পরিবার থেকে রাষ্ট্রকে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)