উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে চলচ্চিত্র শিল্পের সৃষ্টি। বিশ্বের জন্য এটি একটি অপার বিস্ময়কর বিষয়। মানুষ তখন পর্যন্ত হাজার হাজার বছর পূর্বের নানান পথ্যে তৈরি রঙে আঁকা পাহাড়ের গুহাচিত্র এবং পাথরে, কাঠে বা গাছের বাকলে, কাদামাটিতে, চামড়ায়, কাপড়ে আঁকার সঙ্গে পরিচিত। এরপর আসে মোটা কাগজ। পাশাপাশি অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য দশকে বিজ্ঞানের কল্যাণে আবিষ্কার হয় ক্যামেরা। কাগজে সাদাকালো বাস্তব স্থিরচিত্র দেখে মানুষ তখন বিস্মিত।
এরও শত বছরের অধিককাল পর স্থিরচিত্র যখন বিভিন্ন যন্ত্র ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় চলমান রূপে চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে আবিষ্কৃত হলো তখন বিস্ময়ের সীমা রইলো না। এরপর বিশ্বের চলমান নিত্যদিনের যাবতীয় ঘটনা অথবা চিত্রনাট্যের পরিকল্পনার আলোকে চলমান চিত্র ধারণ করে চলচ্চিত্র শিল্পে রূপায়ণের মধ্য দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করা শুরু হলো। তখন পর্দায় চলমান ট্রেন ছুটে আসার দৃশ্য (ক্যামেরার লেন্সের অভিমুখে ধারণকৃত দৃশ্য) দেখে দর্শক ভয়ে হল থেকে ছুটে বের হয়ে এসেছিলেন। এটাই ছিল বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রথম এক বিস্ময়কর ও অভিভূত হওয়ার মতো ঘটনা। সেই থেকে চলচ্চিত্র শিল্পকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
স্থান-কাল ভেদে এবং পর্যায়ক্রমে চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক হলো। পাশাপাশি দৃশ্য সম্পাদনা পেলো। শব্দ সংগীত ও আবহসংগীত পেলো। বিভিন্ন লেন্স ও ফিল্টারের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের দৃশ্য ও ফটোগ্রাফিতে বৈচিত্র্য এলো। পর্দায় প্রক্ষেপণেও বৈচিত্র্য এলো- ফ্লাট থেকে সিনেমাস্কোপ। এরপর সাদাকালো বিবর্তনে রঙিন চিত্র বা প্রকৃতির অনুরূপ দৃশ্য সিনেমার পর্দায় দেখে মানুষ চলচ্চিত্রকে আপন মনোজগতের প্রতিরূপ খুঁজে পেলো। অতঃপর টু-ডি থেকে থ্রী-ডি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের এক অভূতপূর্ব বিস্ময়কর জগতে নিয়ে গেলো।
সেই চলচ্চিত্র একশ বিশ বছর পর ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক্স-এর প্রযুক্তির আধুনিকায়নে আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে চলচ্চিত্র উপভোগ বা দেখতে দর্শককে আর প্রেক্ষাগৃহে যাবার প্রয়োজন পড়ে না। কেননা দর্শক শত শত দর্শকের সঙ্গে বসে কিংবা তাদের ঠেলে সিনেমা হলে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজেকে বন্দি রেখে চলচ্চিত্র আর দেখবে না বলেই আমাদের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অধিকাংশের ধারণা। আজকাল দর্শক বাসায় বা নিজের কর্মক্ষেত্রে ইচ্ছা করলে একা বসে মোবাইল ফোনে বা কম্পিউটার স্ক্রিনে বা টিভিতে অথবা প্রজেক্টরে হোম-থিয়েটারে চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারছেন। ফলে যে ধারণার জন্ম হচ্ছে, অতি শীঘ্রই সিনেমা হল কালচার বিলুপ্ত হবে। একইসঙ্গে চলচ্চিত্র এখন টিভি বা অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন পোর্টাল বা ওটিটি'তে নাটক বা সিরিয়াল-পার্ট নাটক বা মেগা-সিরিয়াল নাটক বা টেলিফিল্ম বা ওয়েব সিরিজের মতো দর্শকের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ধীরে ধীরে সিনেমা হলের দর্শক কমে যাচ্ছে এবং সিনেমা হলগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আজ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য প্রেক্ষাগৃহের শিল্পকে বাঁচাতে বা রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তবেই প্রেক্ষাগৃহ শিল্প আরো কয়েক শতাব্দী তার বিজ্ঞানসম্মত মান নিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনে দর্শক ধরে রাখতে পারবে। চলচ্চিত্র প্রযোজককে প্রথমে এটা বুঝতে হবে- চলচ্চিত্র শিল্প সত্যিকার অর্থেই প্রেক্ষাগৃহ শিল্পেরই উপাদান। অনলাইন হচ্ছে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তির এক বাড়তি ব্যবসা করার মাধ্যম। এটা প্রেক্ষাগৃহের উপার্জনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রকৃতই চলচ্চিত্র শিল্প যে প্রেক্ষাগৃহের উপাদান বা কনটেন্ট সবার আগে আমাদের এটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। তবেই ঐতিহ্যবাহী চলচ্চিত্র শিল্পের গুণ এবং এর শৈল্পিক মান ও গুরুত্ব আগামী প্রজন্মের প্রধান বিনোদন বা শিক্ষার মাধ্যম হয়ে বেঁচে থাকবে।
এক: দুইশ’র মতো সিট সংবলিত সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড নতুন আদর্শ সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে এবং পাঁচ-ছয়শ বা এর অধিক সিটের চলমান ও বন্ধ সিনেমা হল সংস্কার করে সেগুলোকে সিনেপ্লেক্সে রূপান্তর করতে হবে। এ ছাড়া সংস্কৃত মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের সব শিল্পকলা একাডেমিতে ও তথ্যকেন্দ্রগুলোতে আদর্শ সিনেপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করাতে হবে। অতঃপর প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের চলচ্চিত্র দর্শনে তাদের আইভিউ হতে হরিজেন্টাল স্ক্রিনের ডান দিক ও বাম দিকের দুই প্রান্ত ধরে যে ১০০ হতে ১২০ ডিগ্রি এঙ্গেল হয়, তা বিশাল ক্যানভাসেই চলচ্চিত্র উপভোগের জন্য এক অদ্বিতীয় মাধ্যম।
এ ছাড়া থাকতে হবে সারাউন্ডিং সাউন্ড সিস্টেম। চলচ্চিত্রের দৃশ্য বা অদৃশ্যর সাবজেক্ট বা অবজেক্টের সঙ্গে উপর নিচ ও চারপাশের দৃশ্যের সামঞ্জস্য রেখেই সিনেপ্লেক্সের চারপাশে এফেক্ট সাউন্ড বা আবহসংগীত বা ডায়লগ-এর সিনক্রোনাইজড সারাউন্ডিং সাউন্ডের স্পিকার থাকতে হবে।
দুই: চলচ্চিত্র নির্মাণে চলচ্চিত্রের সব ইভেন্টের শৈল্পিক মাধ্যমের ভাষার যথার্থ প্রয়োগ করেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। যেহেতু দর্শক চলচ্চিত্রটি প্রেক্ষাগৃহে বিশাল ক্যানভাসে দেখবে, তাই গল্প যাই হোক চিত্রনাট্যকারকে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। গল্পের চলচ্চিত্রায়ণে চিত্রনাট্যের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের দেশে সাধারণত সংলাপনাট্যের উপর ভিত্তি করে পরিচালক চলচ্চিত্রের শুটিং করে। দৃশ্য ধারণের প্রয়োজনে পরিচালক চিত্রনাট্যটি নিজের কল্পনা ও স্থান-কাল-পাত্রভেদে অন স্পট চিন্তা করে দৃশ্যের শুটিং করে। এই ট্রেডিশনাল পদ্ধতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সংলাপনাট্য এবং চিত্রনাট্য সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন বিষয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিচালক যেহেতু সংলাপনাট্যের উপর শুটিং করে তাই চিত্রনাট্য এভেন্টের টাইটেলটি পরিচালকের নামেই যায়। আজ চলচ্চিত্র নির্মাণসংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে চিত্রনাট্যই হচ্ছে চলচ্চিত্রের মেরুদণ্ড। অথচ এই মাধ্যমটিকেই আমরা সবচেয়ে অবহেলা বা গুরুত্বহীন মনে করে থাকি। একটি চিত্রনাট্যে দৃশ্য চয়ন নির্ভর করে অভিনেতাদের অভিনয়ের অভিব্যক্তি ও চলাচল, সংলাপ, এফেক্ট সাউন্ড, দৃশ্য সম্পাদনার ইন-আউট পয়েন্ট, আবহসঙ্গীত, দৃশ্যের আলোর ব্যবস্থাপনা। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে দৃশ্যে যে চরিত্র ও বস্তুচরিত্র যা দেখা যাচ্ছে না, তারও অনুরূপভাবে সংলাপ শব্দ এফেক্ট সাউন্ড দিয়ে এর ছায়া বা কৃতকর্মের প্রতিফলনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে এক ভিন্ন ভিন্ন নাটকীয় ভূমিকা তৈরি করা।
চিত্রনাট্যে একটি চোখের মাইক্রো লেন্সে শুট করা পর্দাজুড়ে চোখের দৃশ্য হতে শুরু করে আকাশ বা খুব উঁচু থেকে নিচের বিস্তৃত অঞ্চলের ওয়াইড লেন্সের দৃশ্যকে প্রাণবন্ত করে উপস্থাপন করাই চিত্রনাট্যের প্রধান কাজ। যে চলচ্চিত্রটি ওয়াইড স্ক্রিনে দর্শক উপভোগ করবে তা অবশ্যই দৃশ্য সংলাপ এফেক্ট সাউন্ড, আবহসংগীত ও সুর দিয়ে মানুষের মনোজগতের ভাবনাকে চিত্রনাট্যের ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তুলতে হবে। ‘চলচ্চিত্র’ যে কোনো দৃশ্যে এক মুহূর্ত চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার শিল্প নয়। সেটা টিভি নাটক বা টেলিফিল্ম বা ওয়েব সিরিজ শিল্পের ক্ষেত্রে হতে পারে। চলচ্চিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো যতদিন চলচ্চিত্রে যথাযথ ব্যবহৃত হবে ততদিন চলচ্চিত্র শিল্প আপন মহিমায় বিশ্বের দর্শকদের মাঝে বেঁচে থাকবে।
চলচ্চিত্র-চিত্রনাট্যের উল্লেখিত সার্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো টিভি বা মুঠোফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রদর্শিত প্রডাকশনের বা কনটেন্টের চরিত্র ফুটে ওঠে না বিধায় অনেক দর্শক মিনি স্ক্রিনে চলচ্চিত্র দেখার পরও কিন্তু সেই চলচ্চিত্র বিশাল স্ক্রিনে এবং সারাউন্ডিং সাউন্ড সিস্টেমে উপভোগ করতে প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যায়। এটাই চলচ্চিত্র শিল্পের সবচেয়ে বড় এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
তিন: প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শনকালে অবশ্যই পাইরেসি বন্ধের নিরাপত্তা বা প্রতিরোধ ব্যাবস্থা রাখতে হবে। এমনকি প্রযুক্তির সহায়তায় এর দৃঢ় নিরাপত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এবং কপিরাইট পাইরেটদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে।
চার: বিএফডিসিতে সার্ভারের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং কম্পিউটারাইজড টিকেটিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একইসঙ্গে বিএফডিসিতে পপুলার ফিল্মকে প্রাধান্য দিয়ে একটি নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।
পাঁচ: দেশের অগ্রাধিকার শিল্পখাতের আওতায় চলচ্চিত্র শিল্পকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি গ্রহণ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে অবশ্যই আমাদের ‘চলচ্চিত্র শিল্পনীতি’ প্রণয়ন করতে হবে। ফলে দেশে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের ও চলচ্চিত্র উৎপাদনের ত্রিশ কি চল্লিশ ভাগ বা তারও বেশির ভাগ খরচ কমে আসবে। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণে চলচ্চিত্রের সব প্রযুক্তিগত ও চিত্রনাট্যের উপযুক্ত সার্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়েই একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক বা পরিচালক মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র উৎপাদনে আর কখনোই কার্পণ্য করবে না।
এ ছাড়াও চলচ্চিত্রের বহুমাত্রিক বাণিজ্য ক্ষেত্র সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। চলচ্চিত্রের ওভারসিজ মার্কেট তৈরি করতে হবে। বিশ্বের সব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় চলচ্চিত্রের সুনাম ও বাণিজ্য অর্জনে আমাদের প্রযোজকদের গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে বেসরকারী খাতে ইকনোমি বা মিনি সিনেপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে হবে। চলচ্চিত্র প্রযোজকদের চলচ্চিত্রের কপিরাইট স্বত্বাধিকারী সংরক্ষণ ও স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ কপিরাইট সমিতি বা সিএমও’কে তরান্বিত করতে হবে। এই সমিতির মাধ্যমে সকলকে নিজ সম্পদ রক্ষায় সচেতন করতে হবে।
চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সবাইকে টিভি বা মুঠোফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রডাকশন শিল্প থেকে পৃথক এক অনন্য ভিসুয়াল মাধ্যম হিসেবে উন্নত করে রাখতে হবে। চলমান করোনা মহামারির এই ক্রান্তিকালে আর সময় ক্ষেপণ না করে, চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমানে দাঁড়িয়ে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণা করে এখনই চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়।
লেখক: চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, লেখক ও সংগঠক