করোনাভাইরাসের ভয়ে টানা কয়েক মাস ঘরে আছি, আচার আর কাপড়- কোনোটারই বিক্রি নেই। অথচ আচারের কাঁচামাল এবং কাপড় কিনে রেখেছি কয়েক লাখ টাকার। পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদে বেশির ভাগ বিক্রি হয়। কিন্তু সবই তো থেমে গেছে করোনার কারণে। হাত খালি করে ঘরে জিনিস নিয়ে বসে আছি, খুব অসহায় লাগছে! ঢাকার হাতিরপুলের কাকলী রহমান এভাবেই মন খারাপের কথাগুলো বললেন। বছর তিনেক হলো নিজের তৈরি হরেক রকমের আচার ছাড়াও মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাকও বিক্রি করেন কাকলী। সন্তানের পড়ার খরচ, বাসা ভাড়া ও গ্রামে পরিবারকে অর্থ জোগাতে স্বামীর একার আয়ে হিমশিম খেতে হয়। তাই নিজে যা পারেন ঘরে বসে ছোট উদ্যোগে কিছু আয় করার চেষ্টা করেন। এই মহামারি তাকে ভীষণ সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। অনলাইনে বিক্রির চেষ্টা করছেন, তবে তেমন সাড়া নেই।
কাকলীর মতো সমস্যায় পড়েছেন কাঁঠালবাগানের বুটিক ব্যবসায়ী মুন্নী বেগমও। করোনার আতঙ্কে চার মাস ধরে মিরপুর রোডের দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অথচ দোকান ভাড়া, দুজন কর্মচারীকে বেতন ঠিকই দিতে হয়েছে। মুন্নী বেগম বলেন, এসএমই থেকে ট্রেনিং নিয়ে সাত-আট বছর হলো বুটিকের ব্যবসা করছি, যা আয় হতো তাতে আমরা খুশি ছিলাম। গত কয়েক মাসে আমাদের সংসারের শান্তিটা চলে গেছে। এভাবে কতদিন চালানো সম্ভব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি! অন্যদিকে আমার নিকটাত্মীয় করোনায় মারা গেছেন, সেজন্য দোকান খোলার ঝুঁকি নেব, সেটাও পারছি না।
জীবন বাঁচাতেই সাভারের পার্লার ব্যবসায়ী অনিতা সাহাকে ঝুঁকি নিতে হয়েছে। ব্যবসা একেবারে বন্ধ। করোনার অঘোষিত লকডাউনে কয়েক মাস পার্লারে আসছেন না নারীরা। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। বাধ্য হয়ে পাঁচ বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে সাভার থেকে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় এসেছেন অনিতা। এভাবে কতদিন? কেমন করে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন তিনি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা বা বেসরকারিভাবে কোনো সহায়তা কি জুটবে তার কপালে, কার কাছে যাবেন তিনি? এসব প্রশ্নই অনিতার মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে।
কাকলী, মুন্নী ও অনিতার মতো হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এই পরিস্থিতিতে কারও পক্ষেই সহজ নয়। আমাদের দেশে ১৫ বছর ধরে নারী উদ্যোক্তারা বিশেষ করে নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়েছে। নারী উদ্যোক্তারা কেবল পোশাক, বুটিক ও পার্লারে সীমাবদ্ধ না থেকে স্বল্প পুঁজি নিয়ে বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। পহেলা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় তাদের তৈরি ৫০ থেকে ৬০ ভাগ পণ্য বিক্রি হয়, অনেকের ৮০ ভাগ বিক্রিই হয়ে যায়। এ বছর করোনার কারণে তাদের সেই বিনিয়োগটাও হুমকির মুখে পড়ে গেছে। আগে গ্রামের মেয়েরা কুটিরশিল্পের জিনিসগুলো বিক্রি করতেন মেলা বা দু’একটি জায়গায়। কিন্তু এখন গ্রামের নারী উদ্যোক্তরাও পণ্যগুলো জেলা শহর ছাড়াও বিভাগীয় শহরে বিক্রি করছেন। অনেক উদ্যোক্তা বিদেশেও রপ্তানি করেন। তৈরি পণ্য বাজারজাত করা বা বিক্রি, কলকারখানা চালু রাখা, উৎপাদন বাড়ানো- সব মিলিয়েই নারী উদ্যোক্তারা একটা সংকটে পড়েছেন।
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণীত এই প্রণোদনার সুবিধা নারীরা কতটা পাবেন এবং কীভাবে পেতে পারেন, এ প্রসঙ্গে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বিআইডিএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, এই সংকটকালে বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তা পড়েছেন বেশি সমস্যায়। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয় মাইক্রো ক্রেডিট অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে ঋণটি দেওয়া হবে। এর জন্য ৯ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এখানে মুশকিল হচ্ছে, গ্রামও না আবার শহরও নয়- এমন এলাকায় এসব এনজিও নেই। সেসব এলাকার নারী উদ্যোক্তারা এই ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন না। অন্যদিকে যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার রেজিস্ট্রেশন নেই, তারা সরকার যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে, সেখানেও আবেদন করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পক্ষে অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করা জরুরি।
এক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড নারী উদ্যোক্তারা চার শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। ঋণ নিতে গিয়ে গ্যারান্টার সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নারীদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে এক বা একাধিক গ্যারান্টার প্রযোজ্য হবে। এবারের প্রণোদনায় যদি ব্যাংকগুলো থেকে অতিরিক্ত গ্যারান্টার না চাওয়া হয় এবং অ্যসোসিয়েশনের সদস্যকেও যদি গ্যারান্টার ভাবা হয় তাহলে এই নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে সহজ হবে। অন্যদিকে নারীরা তখনই ঋণ নিতে যাবেন, যখন জানবেন তারা পণ্য তৈরি করতে পারবেন এবং বিক্রিও করতে পারবেন। তাই এখন জরুরি হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের সাপ্লাই চেইন চালু রাখা এবং ঠিক রাখা বা সৃষ্টি করা। এই নারী উদ্যোক্তাদের কথা ভেবে সামর্থ্যবানসহ সবারই আগামী এক বছর দেশীয় এসব পণ্য কেনা উচিত বলে মনে করেন ড. নাজনীন আহমেদ।
ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত করপোরেট কানেক্ট: স্ট্রেংথেনিং মার্কেট এক্সেস ওম্যান বিজনেস ওনার্স ২০২০ কনফারেন্স অ্যান্ড বিজনেস ফেয়ারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইএফসি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ডি জো আর্নার বলেন, বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা পণ্য বিপণনের জন্য চেইন বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে না। এসব কারণে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা খুব কম। বিপণনে সহায়তা করতে আইএফসিও ডব্লিউইসি কানেক্ট ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে পাইলট প্রকল্প চালু করেছে। এর আওতায় ১ হাজার ২০০ নারী উদ্যোক্তাকে দেশীয় ও বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগে ও ব্যবসা বাড়াতে সহযোগিতা দেওয়া হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। এখনো নারীরা বুটিক, তৈরি পোশাক ও পার্লার ব্যবসায় সীমাবদ্ধ রয়েছেন। এসএমই উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাদের অবস্থান মাত্র ৭ দশমিক ২১ শতাংশ। আমরা যদি জিডিপি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতেই হবে। নারী উদ্যোক্তা বিকাশে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। তিন-চার বছরের মধ্যে এসএমই উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীরা ১০ শতাংশে পৌঁছবে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের এসব উদ্যোগ যেন ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন হয়। এর সুবিধা যেন প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তারাও পান, সেটাই প্রত্যাশা করেন নারী উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। কারণ এসব উদ্যোগ যত ছোটই হোক, এর অর্থনৈতিক লাভের মাত্রা যুক্ত হয় জাতীয় অর্থনীতিতে।