আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যাত্রাটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শুরু হলেও ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে কলেজগুলো। ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ যখন দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিএড ট্রেনিং দিতে হিমশিম খাচ্ছিল তখন সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা ছিল প্রাসঙ্গিক।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজগুলো সরকারি টিটি কলেজের ন্যায় একই কোর্স কারিকুলামে বিএড প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কলেজের সংখ্যা এখন ১০৪টি। তখন চাহিদার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে কলেজগুলোর অধিভুক্তি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যে সব শর্তসাপেক্ষে কলেজগুলো পরিচালনার অনুমতি দেয় তা ক্রমশ অনেক কলেজ পালনে অক্ষমতা প্রদর্শন করে। শুরু হয় বেসরকারি টিটি কলেজ নিয়ে বিতর্ক। কিছু কলেজে প্রশিক্ষণের মান বজায় রাখতে না পারায় ছন্দপতন দেখা দেয়। বিএড প্রশিক্ষণের প্রকৃত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে ব্যাহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে গুণগত বিএড প্রশিক্ষণ নিয়ে জাতীয়ভাবে একটি বিতর্কের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
অবশেষে ২০০৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিতর্ক অবসানে গঠন করে একটি উচ্চ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ টীম। অতি গোপনীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব নোটিশ ছাড়াই সারাদেশের বেসরকারি টিটি কলেজগুলোতে একই দিনে একই সময়ে ঝটিকা পরিদর্শন করা হয়। সেই পরিদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশিক্ষণের গুণগত মান বিবেচনা করে সারা দেশের ৩৮টি বেসরকারি টিটি কলেজকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়। বাকি কলেজগুলোকে সবুজ, হলুদ ও ধূসর রঙে রাঙিয়ে একটি পরিদর্শন রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। যারা পরিদর্শন করেছেন এবং যারা পরিদর্শনের আদেশ প্রদান করেছেন সকলের এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল দেশের সকল বেসরকারি টিটি কলেজকে একটা গুণগত মানসম্পন্ন টিটি কলেজে পরিণত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিছু অশুভ চক্রের তৎপরতার কারণে সরকারের এই উদ্যোগ সফল হয়নি।
২০০৯ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকসমূহে বেসরকারি টিটি কলেজের নেতিবাচক সংবাদ ছাপা হলে উদ্যোক্তাগণ নড়েচড়ে বসেন। কলেজগুলোকে মানে উন্নীত করার জন্য নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তৎকালীন বেসরকারি টিটি কলেজের শিক্ষক সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩৮টি কলেজ তাদের অধিভুক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন। শুরুর দিকে ৩৮টি কলেজ মামলার সিদ্ধান্ত নিলেও, সবশেষ ২৩টি কলেজ আদালতে মামলা করে। এইসব কলেজ থেকে বিএড প্রশিক্ষণের সনদ নিতে ১টি অনলাইন পত্রিকায় মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে আসছে বিগত বছরগুলোতে। আবারো ছড়িয়ে পড়ে এইসব কলেজের আসল রূপ। যার কালিমা লেপন করা হয় মামলার বাইরে থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শনের রিপোর্টে মানসম্পন্ন কলেজগুলোর উপরেও। এমতাবস্থায় সরকার নানামুখী চেষ্টা করেও বাতিলের জন্য সুপারিশকৃত ঐ ২৩টি কলেজকে কাঙ্ক্ষিত মানে আনতে পারেনি। ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে সকল কাজ-কর্মে এই ২৩টি কলেজের ব্যর্থতাই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। অন্যদিকে নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে মানসম্পন্ন কলেজগুলোকে আর সামনের দিকে তুলে আনা সম্ভব হয়নি। যা ছিল বেসরকারি টিটি কলেজের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা।
এমন প্রেক্ষাপটে যখন মানসম্পন্ন কলেজগুলো ক্রমান্বয়ে কোনঠাসা অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন সময়ের সাহসী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মানসম্পন্ন বেসরকারি টিটি কলেজগুলোর শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। মানসম্পন্ন কলেজগুলো সবাই ‘বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতি’র ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লাল তালিকাভুক্ত কলেজগুলোর কর্মকাণ্ড জাতির সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। এই সংগঠন সরকারের সাথে আলোচনা করে বুঝাতে সক্ষম হয় মানসম্পন্ন কলেজগুলোর অবস্থানের প্রেক্ষাপট। সরকারের সাথে নানামুখী তৎপরতায় ২০১৭ সাল থেকে মানসম্পন্ন বেসরকারি টিটি কলেজগুলোকে এমপিওর আওতায় আনার জন্য বাস্তবতা তৈরি হয়। বিভিন্ন ওয়ার্কশপের মাধ্যমে মানসম্পন্ন বেসরকারি টিটি কলেজগুলোর ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকরাও বাস্তবতা অনুধাবন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বেসরকারি টিটিস’র পক্ষে একটি নীতিমালা তৈরি করে। সেই নীতিমালায় মানসম্পন্ন টিটি কলেজকে এমপিও দেওয়ার জন্য একটি সুপারিশমালা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সুপারিশটি এখনো আইন মন্ত্রণালয়ে আসেনি। জানি না কবে নাগাদ এই সুপারিশ বিধি হিসেবে কার্যকর হবে। তবুও আশাবাদী এটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হলে বেসরকারি টিটি কলেজের ভাগ্য একধাপ অগ্রসর হবে। দীর্ঘ ২৮ বছরের কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ হবে।
আমরা ২০১৭ সাল থেকে এমপিওর জন্য নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। পেশাগত মর্যাদা আদায়ের জন্য বাংলাদেশে যত প্রকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আছে তার সবগুলো স্তর আমরা পালন করতে সমর্থ্য হয়েছি। সাংবাদিক সম্মেলন থেকে শুরু করে শিক্ষক মহাসমাবেশ পর্যন্ত সকল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এমপিওভুক্তির দাবি আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বারবার আন্দোলন করেও এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। আমরা এখনো অধীর আগ্রহ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সু-দৃষ্টিরঅপেক্ষায় আছি। আমাদের বিশ্বাস আমাদের এই আন্দোলন সংগ্রাম বা দাবি দাওয়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনো ওয়াকিবহাল নন। তিনি বিষয়টি জানামাত্র আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে আশা করছি। কারণ এখানে মাত্র ২ হাজার শিক্ষকের জীবন-জীবিকার ব্যাপার। টাকার হিসাব করলে মাত্র ৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে এমপিওভুক্তির জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লাখ-লাখ শিক্ষকের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন, যেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন ছিল। আর সেখানে আমাদের প্রয়োজনটা খুবই সামান্য। এছাড়াও কলেজগুলো থেকেও অনেক টাকা আয় হবে। এর সাথে আর সামান্য টাকা বরাদ্দ দিলেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন দেওয়া সম্ভব হবে। এমন একটি ইতিবাচক দিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা খুবই জরুরি।
সরকার মুজিববর্ষে ২লাখ শিক্ষককে বিএড প্রশিক্ষণের আওতায় এনে এসডিজি-৪ অর্জন করতে চায়। দেশে মাত্র ১৪টি সরকারি টিটি কলেজে আসন আছে ৬ হাজার। যদি এই কলেজগুলো এমপিও দিয়ে দেয় তবে প্রশিক্ষণের গুণগত মান ফিরে আসবে এবং এসব শিক্ষক জাতীয় শিক্ষা উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এমপিও ছাড়া এইসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটে টিকিয়ে রাখাও যাবে না। কারণ এসব কলেজের আয়ের একমাত্র উৎস প্রশিক্ষণার্থীদের সামান্য কোর্স ফি। আয়ের সিংহভাগ চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। বাকি টাকায় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া কষ্টকর। অনেক কলেজে প্রশিক্ষণার্থী সংকটের কারণে শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও নিয়মিত দিতে পারে না। তারপর করোনা সংকটে এই কলেজগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। প্রশিক্ষণার্থীদের থেকে বেতন সংগ্রহ করতে না পারায় কলেজগুলোর ঋণের বোঝা বেড়েই যাচ্ছে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনায়ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে অচিরেই একটি মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে এই খাতে দৃষ্টি না দিলে বিএড প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। যা কারো কাম্য হতে পারে না।
লেখক: সভাপতি, বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতি