যুদ্ধ চলাকালীন অস্ত্র-গোলাবারুদ আনতে আমাকে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে ৩ বার মেঘালয়ের অন্যতম বৃহত্তম শহর তুরায় যেতে হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার সনট সিং ছিলেন আমার আশ্রয়দাতা। তিনি জুন ও জুলাই মাসে আমার প্রথম ও দ্বিতীয় যাত্রায় যথাক্রমে জেনারেল গিল ও ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার-এর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তৃতীয় যাত্রায় নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ তুরায় জেনারেল গিল-এর অফিসে আমার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মি ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি।
মিটিংয়ে অরোরা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরুর দিকে টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীসেনারা নামতে পারে। তিনি আমাকে দ্রুত টাঙ্গাইল ফিরে গিয়ে সেখানে প্যারাট্রুপস ল্যান্ডিং এলাকার নিরাপত্তা জোরদারের ব্যবস্থা করতে বলেন। তিনি আরো বলেন, ইন্ডিয়ান আর্মির কয়েকজন অফিসার টাঙ্গাইলের শত্রুমুক্ত এলাকায় আসবেন এবং আমাদের সাথে থাকবেন। তাদের নিরাপত্তার দায়ভার আমাদের উপর বর্তায়।
মিটিংয়ের শেষে অরোরা আমাকে ওই মিটিংয়ের গুরুত্ব ও গোপনীয়তা সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কাদের সিদ্দিকী ছাড়া অন্য যে কারো সাথে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেনো আমি এই আলাপের কোনো কথা প্রকাশ না করি। তিনি বলেন, আমিই প্রথম বাংলাদেশি যে এ ধরনের টপ-সিক্রেট মিলিটারি অপারেশনের খবর আগেই জানতে পেরেছে। তিনি আমাকে বারংবার একথার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেন এবং যথাযথভাবে তা পালন করার তাগিদ দেন। আমি তাকে নিজের জীবনের কসম কেটে তা নিশ্চিত করি। আমরা যখন করমর্দনের মাধ্যমে বিদায় নেই তখনও জেনারেল অরোরা বলেন, ‘এটি তোমার মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমার বিশ্বাস তুমি মাতৃভূমির কল্যাণের জন্য তোমার কথায় অটুট থাকবে। আশা করি টাঙ্গাইলে আবার দেখা হবে।’
এই সাক্ষাৎ থেকে আমি বাংলাদেশের আসন্ন বিজয়ের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। কথামতো একজন ভারতীয় অফিসার বর্ডার পার হয়ে টাঙ্গাইল পৌঁছান। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় অফিসার, যিনি যুদ্ধ শুরুর আগে বাংলাদেশের ভেতর ১০০ কি.মি. অতিক্রম করে মুক্তাঞ্চলে আসেন। আমি তাঁর সাথে ৩ ডিসেম্বর ধলেশ্বরী নদীর তীরে ভূঞাপুরের বারইতলা গ্রামে দেখা করি। তিনি নিজেকে ‘পিটার’ বলে পরিচয় দেন এবং আমরা গোপন সাংকেতিক চিহ্ন ঠিক করে নিই। আমি জানতে পারি যে তিনি ইন্ডিয়ান আর্মির একজন ক্যাপ্টেন ও কলকাতার বাঙালি। তিনি আগের রাতেই মুক্তাঞ্চলে এসে পৌঁছেছেন, ৫ জন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সার্বক্ষণিক পাহারায় আছেন, যাদের মধ্যে ৩ জন প্রশিক্ষিত ওয়্যারলেস অপারেটর। তাঁর মিশন ছিলো আমাদের কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং ইন্ডিয়ান ছত্রীসেনাদের অবতরণের জন্য কৌশলগত স্থান নির্ধারণ করা। তিনি সকল প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী কন্ট্রোলিং হেড কোয়ার্টারে পাঠাতেন।
কুশলাদি বিনিময় শেষে আমি তাকে বললাম, ‘আমি আপনাকে আমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব।’ তিনি বললেন, ‘তার কোনা প্রয়োজন নেই। আমি ব্রিগেডিয়ার সনট সিং ও ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার-এর থেকে বিস্তারিত সব জানতে পেরেছি।’ আমরা মুড়ি ও গুড় দিয়ে একসঙ্গে রাতের খাবার খেলাম এবং দুটি নৌকায় ধলেশ্বরী নদীতেই রাত কাটালাম। পরদিন ভোরে পিটার ওয়্যারলেস-এ কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আগের রাতেই যুদ্ধ ঘোঘণা হয়েছে এবং সকালে আমরা দেখতে পেলাম দুটি ইন্ডিয়ান মিগ ফাইটার উড়োজাহাজ ঢাকার দিকে উড়ে যাচ্ছে।
পরের দিন কাদের সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে অবতরণস্থল সম্পর্কে আলোচনা করলাম এবং অবতরণের জন্য তিনটি স্থান নির্বাচন করলাম। এগুলো ছিল ঘাটাইল থানার পশ্চিম দিকে গৌরাঙ্গিহাট, কালিহাতি থানার পশ্চিম দিকে বাংরা-শোলাপুরার প্রশস্ত খোলা ময়দান ও ইছাপুর-শাহদেবপুরের দক্ষিণে পাঠান ময়দান। এই স্থানগুলো ছিলো টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের দু’দিকে, যাতে ছত্রীসেনাদের ভারি অস্ত্র ও বাহনগুলো খুব সহজেই পথে উঠতে পারে। মোর্স কোডের মাধ্যমে পিটার তাঁর বার্তা হাই কমান্ডে জানিয়ে দেন।
পরদিন সকালে কাদের আসন্ন আক্রমণের ব্যাপক প্রস্তুতি তদারকিতে চলে যান। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে পিটার এবং আমি নৌকা ত্যাগ করি এবং নিকরাইল স্কুলের পাশে ক্যাম্প করি। আমরা যখন ওয়্যারলেস সেটগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলাম, কাদেরও তা দেখেছিল। সে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরবর্তী সব আক্রমণের জন্য ইনচার্জ অব কমিউনিকেশন নিযুক্ত করল এবং আমার অধীনে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিযুক্ত করল। আমার কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা ও কাদেরের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা এবং পিটারকে তাঁর কাজে সহযোগিতা করা। আমার কাছে ১০টি সামরিক ও ৪টি বেসামরিক ওয়্যারলেস সেট ছিল। এই যন্ত্রগুলো দিয়ে ভারতের সঙ্গে দূরপাল্লার বেতার যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। কাদের এরপর নিকরাইল স্কুলে কমান্ডারদের সাথে রণকৌশল নিয়ে শেষ সময়ের পরামর্শ করেন। এই সময়ে আমরা খবর পাই যে, আগের দিন ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই খবর তখন স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী ও বিবিসিসহ বেতারগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আমরা দ্রুত আমাদের বার্তাবাহকদের মাধ্যমে এই খবর গ্রামবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকি। কাদের সিদ্দিকীর উপস্থিতি ও ভারতের স্বীকৃতি মানুষের মধ্যে ব্যাপক উম্মাদনার সৃষ্টি করে। মাগরিবের নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ স্কুলমাঠে জড়ো হতে থাকে। কাদের সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
বিরাট লোকসমাগম, জনসমর্থন ও মানুষের আগ্রহ দেখে ক্যাপ্টেন পিটার মুগ্ধ হন। কাদের এরপর ইস্টার্ন জোনের কমান্ডারদেরকে বিদায় দেন, যেনো তারা নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়। তিনি রাত ১১টার দিকে নিকরাইল স্কুল ত্যাগ করেন। তার আগে তিনি পিটার ও আমার সাথে পুনরায় আলোচনায় বসেন। আমি যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি, মুক্তিবাহিনী, পাক-বাহিনী ও ইন্ডিয়ান আর্মি সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। এরপর তিনি গোপালপুরের শত্রু ঘাঁটিতে আক্রমণের জন্য ঝাওয়াইলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এমন একটি জনসমাবেশের পর অনিরাপদ বিবেচনা করে তিনি দ্রুত আমাদের নিকরাইল ত্যাগ করতে বলেন। আমরা দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। কিন্তু এত সরঞ্জামাদি বহন করতে আমাদের আরো লোকবল প্রয়োজন ছিল। আমার অধীনে থাকা ১৫০ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার বাইরে আরও ৫০জন স্বেচ্ছাসেবী পরিবহনের কাজে নিয়োগ করলাম। ২০০ জনের এই বৃহৎ দল সঙ্গে নিয়ে আমরা ঘাটাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ওই রাত ও পরের দিন সারাদিন হাঁটার পর ৯ ডিসেম্বর সকালে আমরা ঘাটাইলের পশ্চিমে পৌঁছাই এবং আব্দুল হালিম চৌধুরীর বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প করি। দুপুরের মধ্যে আমরা আমাদের ওয়্যারলেস সিস্টেম প্রস্তুত করি। আগের রাত থেকে বিভিন্ন স্থানে ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়োজিত করা হয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক যুদ্ধ হয়েই চলেছে। কমান্ডার আতিকের নেতৃত্বে যোদ্ধারা গোপালপুর ও মধুপুরে শত্রুর উপর আক্রমণ চালিয়েছে। মধুপুর মুক্তিবাহিনীর কব্জায় এসেছে, তবে গোপালপুরে তখনো যুদ্ধ চলছে। মধুপুর দখলের সাথে সাথে জামালপুর থেকে টাঙ্গাইলে ভারতীয় সেনা যাতায়াতের পথ উন্মুক্ত হয় এবং ক্যাপ্টেন পিটার এ খবর তার বাহিনীর কাছে জানিয়ে দেন।
গৌরাঙ্গীঘাটের নিকটে আমাদের ক্যাম্পটি কমান্ডার হাকিমের দল নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছিল। এছাড়াও কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে আরেক দল টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কে নিয়োজিত ছিল শত্রু বাহিনীকে অ্যামবুশ করার উদ্দেশ্যে। ওই রাতে কাদের আমাদের ক্যাম্পে আসে এবং মেজর হাকিম ও মেজর হাবিবের সাথে ঘাটাইল অস্থায়ী পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলার ব্যপারে পরামর্শে বসে। ঘাটাইল থানার দু’দিকের দুটি ব্রিজ আক্রমণ ও ঘাটাইল ঘাটিতে মুখোমুখি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। কমান্ডার হাকিমের ৩ ইঞ্চি মর্টারের দ্বারা আক্রমণের কথা ছিল।
ভোর ৪টায় আক্রমণ শুরু হয়। হাবিবের দল বালিয়াপাড়া ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তা উড়িয়ে দেয়। ঘাটাইল থানার উপর মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু হয় এবং কমান্ডার সবুরের নেতৃত্বে তা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। সকালের মধ্যে অপারেশন সফল হয় এবং ঘাটাইল থানা আমাদের হস্তগত হয়। আমরা সেনাসদস্য, মিলিশিয়া ও রাজাকারসহ প্রায় তিন হাজার শত্রুসেনাকে আটক করি। থানার ভেতরে ও বাঙ্কারে বিক্ষিপ্ত অবসস্থায় ১৮টি মরদেহ পাওয়া যায়। কালিদাসপাড়া ব্রিজও আমরা দখল করি। কিন্তু ওই যুদ্ধে কমান্ডার মোস্তফার প্লাটুনের একজন শহীদ হয় ও দুজন আহত হয়। আহতদের আমরা ক্যাম্পে নিয়ে আসি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের তখন কোনো ডাক্তার ছিল না এবং রোগীদের অবস্থা গুরুতর হতে শুরু করে। ভাগ্যিস সেদিন বিকেলে কয়েক মাইল দূরে এক মহিলা ডাক্তার সম্পর্ক জানতে পেরেছিলাম, যে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাকে খবর পাঠালে তিনি দ্রুত ক্যাম্পে ছুটে এসে আমাদের আহত সহযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেন।
ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখ সকালে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী জামালপুর ও ময়মনসিংয়ে পরাজিত হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ইতোমধ্যে ঘাটাইল থানা দখলের পর কাদের ও তাঁর বাহিনী ঘাটাইল থানার পশ্চিম দিকে গোয়ালগন্ডার দিকে যাত্রা শুরু করে। আমরা ছিলাম গেরিলা যোদ্ধা এবং নির্দিষ্ট পজিশন থেকে যুদ্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। একই সময়ে ব্রিগেডিয়ার কাদের খানের বাহিনী জামালপুর ও ময়মনসিংয়ে পরাজয়ের পর লেজ গুটিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পলায়ন করে। এই বাহিনীর একটি অংশ ঘাটাইল থানায় তাদের মূল বাহিনীর প্রত্যাবর্তনের সময় কাভার করছিল। এই বাহিনীর সামনের দিকে কমান্ডার হাবিব অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। কিন্তু শত্রু বাহিনী তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। এতে তুমুল গোলাগুলির মুখে হাবিবের বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
দুপুরের দিকে কাদের ঘাটাইল ও গোপালপুর শত্রু ঘাটিতে বিমান হামলা চালানোর জন্য ইন্ডিয়ান হাই কমান্ডের কাছে অনুরোধ করার নির্দেশনা দিয়ে একটি বেতার বার্তা পাঠায়। আমরা তৎক্ষনাৎ তার নির্দেশনা মোতাবেক এ অনুরোধ করি। ১ ঘণ্টার মধ্যে আমরা বিমান হামলার নিশ্চয়তা পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে কাদেরকে জানিয়ে দিলাম। বিকেল ঠিক ৩টায় তিনটি মিগ-২১ যুদ্ধ বিমান গোপালপুর ও ঘাটাইল শত্রু ব্যুহে একাধারে বন্দুক ও রকেট হামলা চালাতে শুরু করলো। শত্রু ঘাটিতে বিমান হামলা দেখে আমরা খুবই উত্তেজিত ছিলাম এবং আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা খুশিতে নাচানাচি শুরু করেছিলাম। বিমান হামলার পর গোপালপুরে প্রায় তিনশ শত্রুসেনা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঘাটাইলে নিযুক্ত পাকিস্তানি সেনাদেরকেও টাঙ্গাইলে প্রত্যাহার করা হয়। ওই বিকেলে পিটার তাঁর হেডকোয়ার্টার থেকে একটি কোডেড মেসেজ পান এবং তখনই খুশিতে ফেটে পড়েন। সে আমাকে বললো প্যারাট্রুপাররা ল্যান্ড করছে। আমি খবরটি কাদেরকে এভাবে পাঠালাম যে, ‘তারা আসছে’। এবং আমি ৩টি অঞ্চলের কমান্ডারদের সতর্ক করে দিলাম।
বিকেল ৫টায় দুটি ভারতীয় মিগ ঘাটাইল ও কালিহাতির উপর আকাশে খুব নিচ দিয়ে উড়ে গেলো। পিটার চিৎকার দিয়ে উঠল- ‘দেখো! তারা এখানে!’
কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে লেখক
আমরা জানতাম না কোন অবতরণের এলাকা তারা নির্ধারণ করেছে, কারণ মিগ দুটি বিশাল এলাকাজুড়ে ঘুরছিল। এরপর আমরা কার্গো বিমান দেখতে পেলাম যেগুলো ঘূর্ণায়মান মিগ-এর উপর দিয়ে উড়ছিলো। হঠাৎ করে মিগ দুটি উপরের দিকে উঠে গেলো এবং কার্গো বিমানগুলো অবতরণ করতে শুরু করলো। এগুলো ছিলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর পরিবহন প্লেন এএন-১২, সি-১১৯ ও সিডি-৩। প্লেনগুলো ঢেউয়ের মতো করে নামতে লাগলো। যখন তারা সর্বনিম্ন পয়েন্ট পর্যন্ত আসলো তখন সেগুলো ধীর গতিতে উড়তে শুরু করলো। মনে হচ্ছিলো যেনো প্লেনগুলো বাতাসে ভেসে আছে। হঠাৎ সেগুলোর পেট উন্মুক্ত হয়ে গেলো এবং প্যারাসুট পড়তে শুরু করলো।
আমরা প্রচণ্ড উল্লসিত ছিলাম। দিঘলকান্দির আবাল বৃদ্ধবণিতা, নারী-পুরুষ সকলে এ দৃশ্য দেখতে খোলা মাঠে ভিড় জমায়। দক্ষিণপূর্ব দিকের আকাশে দৃষ্টিসীমার মধ্যে শুধু রঙিন বেলুনের মতো দেখা যাচ্ছিল। প্যারাট্রুপাররা প্রথম যখন প্লেন থেকে লাফ দিচ্ছিল তখন তাদেরকে ছোট সাদা লিফলেট-এর মতো মনে হচ্ছিল। এরপর প্যারাসুট খুলে গেলে লিফলেটটি বিশালাকৃতির ছাতায় পরিণত হচ্ছিল। হেমন্তের রৌদ্রজ্জ্বল ও ফুরফুরে বিকেল যেনো ছত্রীসেনারা দর্শনীয় দৃশ্যে পরিণত করল। এ দৃশ্য যাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের সারাজীবনের জন্য স্মরণীয় একটি ঘটনা এটি। এ দৃশ্য ভোলার নয়।
কর্নেল পান্নুর অধীনস্ত প্যারাট্রুপারদের নামতে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় লাগলো। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিামাকাশে ডুবতে শুরু করেছে এবং তারা অন্ধকারে বিলীন হতে শুরু করলো। আসন্ন বিজয়েরর পূর্বাভাসে আমরা সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। ক্যাপ্টেন পিটার প্যারাট্রুপারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলো না। কারণ তারা অবতরণের সাথে সাথে তাদের বেতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তার উপর তারা কালিহাতিতে অবতরণ করেছে, যা ছিল সবচেয়ে দূরে। এছাড়া অন্ধকারে সশরীরে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছিল না। পিটার খুবই অস্থির হয়ে উঠছিল, আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। রাত আটটায় কাদের আমাদের ক্যাম্পে হাজির হলো এবং জানালো যে সফলভাবে ছত্রীসেনাদের ল্যান্ডিং সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে। কাদের আমাদের জানালো যে, হাইওয়ে ঘেষা মধুপুর, গোপালপুর, কালিহাতি ও শোলাকুড়া মুক্তিবাহিনীর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পলায়নপর পাকসেনাদের টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের বিভিন্ন স্থান থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। তারা হাইওয়ের দক্ষিণে ফুলতলা ও পুংলির মাঝামাঝি জায়গাতে পুনরায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জায়গাটি কালিহাতি থানার দক্ষিণেই। ২০টির মতো পাকিস্তানি বাহন ধ্বংস করা হয়েছে ও ৫০ জনের অধিক সৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী বেশকিছু বাহন ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধের ফলাফলে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম।
পরদিন ভোর ৫টায় কাদের তাঁর বাহিনী নিয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল হাইওয়ে ধরে টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হলো। পিটার ও আমি তাঁর সাথে ছিলাম। শত্রুমুক্ত কালিহাতি হেডকোয়ার্টারে আমাদেরকে স্বাগত জানালো কমান্ডার নবী নেওয়াজ, রিয়াজ ও সামাদ গামা। তাঁরা জানালো যে কালিহাতি থানা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং দক্ষিণ দিকে শোলাকুড়া পর্যন্ত টাঙ্গাইল হাইওয়ে মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা আমাদেরকে আগের রাতের পুংলি ব্রিজের যুদ্ধের কথাও বললো। বোঝা গেলো পুংলি ব্রিজে প্যারাট্রুপারদের উপস্থিতি সম্পর্কে অসর্তকতা তাদের জন্য চরম মাত্রার দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে। আগের দিনের যুদ্ধে নাকানি-চুবানি খেয়ে শত্রুদের মনোবলও ছিলো খুবই কম। শত্রুরা তখন মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ইছাপুরের দিকে ছুটতে লাগলো। ক্যাপ্টেন পিটার তখন ইছাপুরে বিমান হামলা চালাতে বললো এবং দ্রুতই ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি দল মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। মুহূর্তেই ৪০টি পাকিস্তানি বাহন ভস্মিভূত হয়ে গেলো ও বিপুল সংখ্যক পাক-সেনা নিহত হলো।
তারপর আমরা শোলাকুড়ার দিকে যাত্রা করলাম কিন্তু শোলাকুড়া ব্রিজে পৌঁছতেই শত্রুর গোলার মুখে থামতে হলো। এমন সময়ে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর পাহারায় একদল ছত্রীসেনা সেখানে পৌঁছালো। আগের রাতের ঝড়ো হওয়ার মুখে তাঁরা লক্ষ্যস্থল থেকে দূরে চলে গিয়েছিল। ফলে তারা আর সে রাতের যুদ্ধে যোগদান করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন পিটার তাঁর সহকর্মীদের দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, যাদের মধ্যে ছিল একজন তরুণ ক্যাপ্টেন। কাদের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দিলেন প্যারাট্রুপারদেরকে টাঙ্গাইল-কালিহাতি হাইওয়ের পূর্বদিকে থাকা প্যারাট্রুপারদের মূল দলের কাছে নিয়ে যেতে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের খাবারের ব্যবস্থা করলো।
ক্যাপ্টেন পিটার এরপর আমাদেরকে ছেড়ে প্যারাট্রুপারদের দলে চলে গেলো এবং আমরা পুনরায় ফুলতলার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। তরুণ ক্যাপ্টেন আমাদের সাথে যোগদান করতে চাইলেন। কিন্তু কাদের তাকে বললো মুক্তিবাহিনী এখানকার শত্রুদেরকে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী। তার বরং ঢাকার জন্য এনার্জি সঞ্চয় করে রাখা উচিত। কাদের মর্টার নিয়ে ফুলতলা আক্রমণ করলো এবং গ্রাম উদ্ধারের জন্য ৩০০ মুক্তিসেনা পাঠালো। বিকেলের মধ্যে শত্রুরা পলায়ন করে এবং ফুলতলা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখানে পৌঁছে আমি ৫০ থেকে ৬০ জন আহত পাকিস্তানি সেনার আর্তনাদ শুনতে পাই, যারা বিক্ষিপ্তভাবে মাটিতে পড়ে ছিল। পাক-বাহিনীর প্রায় ৪০টি বাহন ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক পাকিস্তানি সেনা তাদের যানবাহন ফেলে রেখে হাইওয়ে ছেড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পালিয়েছে। কিছু পাকিস্তানি সেনা সাধারণ ছদ্মবেশে পালিয়ে যায়।
আমরা পুংলি ব্রিজে অবস্থানরত ভারতীয় প্যারাট্রুপারদের সাথে বেতার যোগাযোগ স্থাপন করি এবং জানতে পারি ইন্ডিয়ান আর্মির ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার টাঙ্গাইলের পথে যাত্রা করেছেন। কাদের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সাথে দেখা করতে চলে যায় এবং আমি একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পুংলি ব্রিজে অবস্থানরত প্যারাট্রুপারদের সাথে দেখা করতে যাই। পুংলি ব্রিজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গতরাতের যুদ্ধের বিভৎসতা দেখতে পাই। শত শত শত্রুসেনার মৃতদেহ রাস্তার উপরে পড়ে আছে। ব্রিজের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত সমস্ত জায়গাতে বিক্ষিপ্তভাবে লাশ পড়ে আছে। আমরা সাবধানতার সাথে হাঁটলাম, যেনো মৃতদেহের উপর পা না পড়ে। সমস্ত জায়গায় ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর স্তূপ। আমার জীবনে কখনোই আমি এত লাশ একসাথে দেখিনি। তাদের দিকে তাকিয়ে আমি যেনো নিজেকেই বলে উঠলাম- ‘এদেরকে পাকিস্তান সরকার এদেশের নিরীহ মানুষদেরকে মারতে পাঠিয়েছে। কেনো? এখন তাদেরকে দেখো। নিজেদের ছুরিতে নিজেরাই বধ হয়েছে।’
বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সঙ্গে লেখক (সবার ডানে)
ব্রিজে পৌঁছে আমি পিটারের সঙ্গে দেখা করলাম এবং সে তাঁর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল পান্নুর সঙ্গে আমার পরিচয় কারিয়ে দিলো। আমি তাদের ফুলতলা মুক্ত করার ঘটনা বলছিলাম। এমন সময় একজন সিগনালম্যান এসে বললো ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও কাদের পুংলি ব্রিজের দিকে আসছে। বিকেল ৩টার দিকে কাদের ও ক্লেয়ারের আগমন ঘটলো। পাঁচশ মুক্তিসেনা ও ভারতীয় ছত্রীসেনা তাদেরকে বিরাট করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানালো। ক্লেয়ার তাঁর অফিসারদের জমায়েত হতে বললো এবং শ্যাম্পেনের বোতল ভাঙার মাধ্যমে বিজয় উদযাপন করতে বললো। শ্যাম্পেনের বোতলের ছিপিগুলো শূন্যে ভাসতে লাগলো। প্রত্যেককেই গ্লাস দেওয়া হলো। আমি ও কাদের এগিয়ে গেলাম ও আমরা শ্যাম্পেনের অফার প্রত্যাখ্যান করে আমাদের শুধু সোডা ওয়াটার দিতে বললাম। আমরা সকলে গ্লাসগুলোকে হাওয়ায় তুলে ধরে বিজয় উদযাপন করলাম।
ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আমার কাছে আসলেন এবং মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। তার মাধ্যমে আমি জানতে পারলাম যে জেনারেল গিলের গাড়ি কায়েকদিন আগে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন বিস্ফোরণের কবলে পড়ে তিনি আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। এই খবর আমাকে পীড়া দিলো। কারণ গিল ছিলেন আমাদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র।
ভারতীয় অফিসারদের মাধ্যমে আমি জানতে পারলাম যে পুংলি ব্রিজের যুদ্ধে ৩৭০ জন পাক-সেনা নিহত হয়েছে এবং প্রায় শতাধিক আহত হয়েছে। অন্যদিকে ৬ জন ভারতীয় প্যারাট্রুপার শহীদ হয়েছে ও ১৫ জন আহত হয়েছে। ছয়শ এর অধিক পাকিস্তানি সেনা বন্দী হয়েছে।
কাদের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার-এর সাথে দেখা করার আগে দুই মিত্রপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যায়। ইন্ডিয়ান কমান্ডারের বহর যখন টাঙ্গাইলে মুভ করছিলো তখন কালিদাসপাড়ায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর গুলি ছোড়ে। ভারতীয় বাহিনী অসতর্ক ছিলো, কারণ তাদেরকে আগে থেকে বলা হয়েছিল যে রাস্তায় কোনো বাঁধা নেই এবং ওই সড়ক মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। মেজর হাবিবের নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে কোনো খবর না পাওয়ায় তাদের পাকিস্তানি সৈন্য ভেবে ভুল করে আক্রমণ করে তারা। মিত্র বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত বিষয়টি দ্রুতই নিষ্পত্তি হয় এবং উভয় পক্ষ বন্দুক গুটিয়ে নেয়। এই ঘটনা ছিলো দুর্ভাগ্যবশত এবং উভয় দিক থেকেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। মেজর হাবিব ক্লেয়ারের বাহিনীকে বামুটিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং সেখানে কাদের তাদেরকে স্বাগত জানায় এবং তারপর একসাথে পুংলি ব্রিজের দিকে যায়।
তাদের সাক্ষাতের পর কাদের ও ক্লেয়ার ওই সন্ধ্যায়ই টাঙ্গাইল যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার তৎক্ষনাৎই টাঙ্গাইল যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কাদের তাকে নিবৃত্ত করে বলেন, ওই এলাকা পুরোপুরি নিরাপদ নয়। একদিন কমান্ডার ফজলুর রহমান, রাজ্জাক, মাইনুদ্দিন, নিয়াত আলী ও মতিউর রহমানের নেতৃত্বে দিনব্যাপী যুদ্ধের পর টাঙ্গাইল শহরের অধিকাংশ এলাকা মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। তবে নিউ টাঙ্গাইল শহরের অস্থায়ী ঘাটিতে পাক বহিনীর ছোট একটি দল তখনো আত্মসমর্পণ করেনি। যদিও তারা চারদিক থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিলো। ওইদিন বিকেল ৪টায় ২শ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। খুব দ্রুতই ভেতর থেকে বন্দুকের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় এবং টাঙ্গাইল শহরে শত্রুর প্রতিরোধের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে যায়।
১১ ডিসেম্বরের ওই সন্ধ্যায় সমগ্র টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত হয়। তারপর ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাদের সিদ্দিকীকে দেখতে ও বিজয় উদযাপন করতে টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ প্রাঙ্গণে মিলিত হয়। সমগ্র শহর খুশিতে যেনো নেচে উঠলো। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার তখন বিজয় উদযাপনে যোগ দিলেন। যুদ্ধে সেটিই ছিল আমার সর্বশেষ মেজর অ্যাকশন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পলায়নপর হয়ে উঠেছিল এবং তাদের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কর্নেল জিয়াউর রহমানের অধীনে মুক্তিবাহিনী ব্রিগেড উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর থেকে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের সিলেটে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে আরো দু’টি মুক্তিবাহিনীর স্পেশাল ব্রিগেড ইতোমধ্যে রাখা ছিল- কর্নেল সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স, আর কর্নেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে কে ফোর্স। শুধু কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টরে চলে যায় কমলাপুরের বর্ডার আউটপোস্টে সুরক্ষিত গ্যারিসনে আক্রমণের উদ্দেশ্যে। যেহেতু ভারতীয় বাহিনী এখানে নজর দেয়নি, পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ধারণা করে ভারতীয় বাহিনী এই সেক্টর দিয়ে কোনো বড় আক্রমণের পরিকল্পনা করবে না। তাই ব্রিগেডিয়ার কাদের খান নামে একজন বয়স্ক পাকিস্তানি অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার মতে, এটা ছিল জেনারেল অরোরার শত্রুকে বিভ্রান্ত করার একটা উদ্দেশ্যমূলক চাল, যাতে তারা মনে করে ভারতীয় সেনাবাহিনী কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে ঢাকায় অগ্রসর হবে।
এদিকে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব কলকাতায় একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ভারতীয় ছত্রীসেনারা ঢাকার আশেপাশে অবতরণ করার ঠিক আগের রাতে তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেসের সামনে ঘোষণা দেন। তিনি ঢাকাকে অবরুদ্ধ শহর বলে দাবি করেন যার পতন যে কোনো সময় হতে পারে। রিপোর্টারদের অনুরোধে তিনি অনিচ্ছাবশত প্রকাশ করে ফেলেন যে যৌথবাহিনীর একটি ডিভিশন ঢাকা ঘেরাও করেছে।
যদিও বাস্তবে তিনি যে ডিভিশনের কথা বলেছিলেন তা মূলত ছত্রীসেনাদের একটি ব্যাটালিয়ন; যারা অবতরণ করেছিল। তবে ঢাকাতে না, এর পরিবর্তে ঢাকা থেকে ৭০ মাইল উত্তরে, টাঙ্গাইল জেলায়। পাকিস্তানি কমান্ড এই ধাপ্পাবাজির কারণে ভেঙে পড়ে। এটা জেনারেল নিয়াজির উপর প্রচণ্ড রকমের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে আত্মসমর্পণের জন্য। যৌথবাহিনীর কৌশল পরিকল্পনামাফিক কাজে দেয়। টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনাদের অবতরণ পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দকে ভুল পথে ধাবিত করে এবং যুদ্ধের সমাপ্তিকে তরান্বিত করে। ব্রিগেডিয়ার খানের জন্য এটা ছিল তার সামরিক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় আত্মসমপর্ণ। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমরা জানতে পারি যে, তিনি ১৯৬৫ সালের ইন্দো পাকিস্তান যুদ্ধেও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
ঢাকা বিজয়ে টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীকে মূল যুদ্ধকৌশলের অন্তর্ভুক্ত করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। এই পরিকল্পনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ছিল টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনাদের একটি ব্যাটালিয়নের অবতরণ। তর্ক সাপেক্ষে বলা যায়, আমিই বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি ছিলাম এই গুরুত্বপূর্ণ গোপণ পরিকল্পনা জানার বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। আমি এই নিপুণ যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এবং সম্মানিত বোধ করছিলাম। এটি কাদের সিদ্দিকী এবং টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কাছে একটি মহান সাক্ষ্য ছিল।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা