ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চলচ্চিত্রে সৈয়দ হকের গান

ইমাম মেহেদী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চলচ্চিত্রে সৈয়দ হকের গান

সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) আপন প্রতিভা ও হৃদয়ের সূক্ষ্ম ঝঙ্কারে জয় করেছেন পাঠক-মন। একজন কথাশিল্পীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি পাঠক মনে দীর্ঘস্থায়ী স্পন্দন তৈরি করতে পারা। তিনি সেটি পেরেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পে যাঁদের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ হক অন্যতম। আমৃত্যু তিনি বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রে অবদান রেখেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে।        

সৈয়দ শামসুল হক একাধারে নাট্যকার, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে সৈয়দ হক অবদান রাখেননি। সাহিত্যের এই বহুমুখী বিচরণের জন্যই তিনি সব্যসাচীর আসনে নন্দিত হয়েছেন পাঠকের দৃষ্টিকোণ ও মানদণ্ডের বিচারে। আজ এই সব্যসাচী লেখকের মৃত্যুদিনে চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় সোনালি দিনের সাড়া জাগানো গানে তাঁর অতুলনীয় অবদান স্মরণ করতেই এই লেখা। 

বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অনেক গান সৈয়দ হকের লেখা। যদিও তাঁর লেখা নাটক, গান, কবিতা নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা, আলোচনা হওয়া উচিত। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁকে নতুন করে জেনেছেন, চিনেছেন এমন পাঠক, গবেষক ও শিল্পীর সংখ্যা কম নয়। বহু বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে তাঁর লেখা গান। অথচ অনেক ক্ষেত্রে গানের কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে শ্রোতার পরিচয় থাকলেও গীতিকার হিসেবে হক আড়ালেই রয়ে গেছেন। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না- সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন আপাদমস্তক চলচ্চিত্রের গানের মানুষ। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে গান লেখার মধ্য দিয়ে গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। সর্বশেষ গান রচনা করেন ‘বাসর হবে মাটির ঘরে’ চলচ্চিত্রের জন্য ২০১৬ সালে ‘মাটির ঘরে চাঁদ নেমেছে’ শিরোনামে। তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবশে করেন ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে। তাঁর প্রায় ৮১ বছরের জীবদ্দশায় শেষ চিত্রনাট্য ছিল ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘গেরিলা’। তাঁরই রচিত উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’-এর কাহিনি অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্যও করেছিলেন তিনি। সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলেন নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ।

জীবনের প্রথম গানটি সৈয়দ হক লিখেছিলেন ফরাশগঞ্জে একটি বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ১৯৬১ সালে। গানের শেষ অংশটুকুতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ওই চিলেকোঠায় বসেই তিনি ‘সুতরাং’ ছবির গান লিখেছিলেন। পরবর্তীতে সবগুলো গানই দর্শক নন্দিত হয়েছে। সিনেমার জন্য গান রচনার বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: ‘আমি কখনো গান লিখতে চাইনি। প্রথম গান লিখতে হয়েছিল প্রডাকশনের খরচ বাঁচাতে এবং সুরকার সত্য সাহাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সে গল্প আমি আগেও করেছি। সত্যিকার অর্থে একজন লিখছেন, একজন সুর করছেন- এটা আমার পছন্দ নয়। এতে সুর ও কথার বিচ্যুতি ঘটে। একজনই এই দুটো কাজ করলে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি হয় বলেই আমার বিশ্বাস। এ কারণে আমি গানটা লিখেছি বটে, কিন্তু মন কখনো সায় দেয়নি।’

সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির সবগুলো গানই ছিল সৈয়দ হকের লেখা। একই পরিচালকের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’র জন্যও তিনি ১৯৬৭ সালে ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে’ গানটি লিখেছিলেন। সত্য সাহার সুরে গানটি গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান। বর্তমান প্রজন্মের কাছেও গানটি ভীষণ জনপ্রিয়। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘ময়নামতি’ ছায়াছবির জন্য ‘ফুলের মালা পড়িয়ে দিলে আমায় আপন হাতে’ শিরোনামে গান লেখেন সৈয়দ হক। গানটির সুর দিয়েছিলেন শিল্পী বশির আহমদ। কণ্ঠ দিয়েছিলেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। কামাল আহমেদ পরিচালিত ১৯৬৯ সালে ‘অবাঞ্ছিত’ সিনেমার জন্য ‘কেহ করে বেচাকেনা কেহ কান্দে’ গানটি রচনা করেছিলেন সৈয়দ হক। সুর করেছিলেন আলী হোসেন। কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী আব্দুল আলীম। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন পরিচালিত ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় ‘বড় ভালো লোক ছিলো’। সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও সংলাপের সঙ্গে সবগুলো গান লিখেছিলেন সৈয়দ হক। এই ছবির ‘তোরা দেখ তোরা দেখ দেখরে চাহিয়া’ গানটি শ্রোতাপ্রিয় হয়। একই ছবিতে আলম খানের সুরে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ সকল শ্রেণির শ্রোতার মুখে মুখে আজও গানটি শোনা যায়।

এই গান সম্পর্কে কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘এই গানটা আমার জীবনের অবিস্মরণীয় গান। এই গানের জন্য আমি প্রথমবারের মত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ১৯৮২ সালে। হক ভাই তখন গান লিখতেন না। এই সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘শাওন সাগর’ সে সময় বেশ নামকরা ছিল। তাদের বেশিরভাগ ছবিতে নান্দনিকতা ছিল। এই সিনেমার পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেব অধ্যাপক ছিলেন। সবাই তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করত। বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। যেটা দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে, যাতে শেষ বয়সে তিনি পুরস্কার ও সম্মান পান। আর সত্যি সত্যি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবি। সে হিসেব করে হক ভাইকে গান লিখতে দেওয়া হয়েছিল।’

সৈয়দ শামসুল হক গীতিকার হিসেবে স্বতন্ত্র ছিলেন। গীতিকার ও কবি সম্পর্কে তাঁর নিজের মূল্যায়ন হলো, ‘গান রচনার সূত্রপাত কবিদের হাতে। শুরুর দিকে কবি/গীতিকবি/গীতিকার কথাগুলো অভিন্ন পরিচয় বহন করলেও বর্তমানে ‘কবি’ ও ‘গীতিকার’ কথা দুটির গোত্র পরিচয় স্পষ্টত আলাদা। কালের বিবর্তনে গীতিকার আখ্যাটি এখন কেবল গান সংলগ্ন, পক্ষান্তরে ‘কবি’ অভিধা কবিতা রচনা তথা কাব্যচর্চাকেই প্রতিনিধিত্ব করে।’

‘বড় ভালো লোক ছিলো’ সিনেমায় এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতেছিলাম জগৎ রঙ্গিলা’ সৈয়দ হকের আরেকটি কালজয়ী গান। গানটিতে আলম খানের সুরে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর ও সৈয়দ আব্দুল হাদী। ১৯৬৯ সালে ‘ময়নামতি’ ছবির ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাধন কেটে যায়’ গানটি গ্রিন রোডে পরিচালক কাজী জহিরের বাসায় বসে লিখেছিলেন সৈয়দ হক। সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী বশির আহমেদ। যদিও এই গানটির গীতিকার হিসেবে আসলাম আহসান ‘তুমি আসবে বলে: সৈয়দ হকের গান’ গ্রন্থে যুক্তিতর্ক শেষে গানটিকে গাজী মাজহারুল ইসলামের বলে মত দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে আরো বিস্তর গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। একই সিনেমার ‘টাকা তুমি সময় মতো আইলা না’ গানটিও হকের লেখা। সুর দিয়েছিলেন শিল্পী বশির আহমেদ, কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী আনোয়ার উদ্দীন খান।

এ. জে. মিন্টু পরিচালিত ১৯৮৩ সালে ‘মান সম্মান’ ছবির জন্য সৈয়দ হকের লেখা ‘কারে বলে ভালবাসা কারে বলে  প্রেম’ গানটিও ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়। আলম খানের সুরে গানটি গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। তজিম উদ্দীন রিজভী পরিচালিত ১৯৮৩ সালে ‘আশীর্বাদ’ ছবির জন্য তাঁর লেখা আরেকটি গান ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুল না’। আলম খানের সুরে রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া এই গানটিকে ভাবা হয় দেশীয় চলচ্চিত্রের সেরা ১০টি প্রেমের গানের একটি। ২০১৬ সালে সৈয়দ হক ‘মাটির ঘরে চাঁদ নেমেছে’ শিরোনামে একটি গান লিখেছিলেন ‘বাসর হবে মাটির ঘরে’ ছবির জন্য। আলাউদ্দীন আলীর সুর-সংগীতে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা ও সুবীর নন্দী। গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন বরেণ্য সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী।

২০১৪ সালে স্বাধীনতার ৪২তম বাষির্কী উদযাপন উপলক্ষে সিদ্ধান্ত হয় লাখো কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত পরিবেশনের। এই ঐতিহাসিক আয়োজনেও অসুস্থ অবস্থায় সৈয়দ হক দায়িত্ব নিয়ে রচনা করেন থিম সঙ ‘বাঙালির জয়! জয় বাংলার ধ্বনিতে একাত্তর’। থিম সঙের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন বাপ্পা মুজমদার। কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইসয়াসমিন, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, মমতাজ, এলিটা, বাপ্পা মুজমদার, কনা ও কোনাল। সৃষ্টিশীল জীবনে আমৃত্যু সৈয়দ হক এভাবেই সংগীতের পাশে থেকেছেন। গবেষকদের উচিত নতুন দৃষ্টি নিয়ে এই প্রজন্মের সামনে তাঁর গানগুলো তুলে ধরা। কেননা সাহিত্য, নাটক, কিংবা উপন্যাসে যেমন সৈয়দ হককে বহুভাবে চেনা, জানার সুযোগ রয়েছে, চলচ্চিত্রের গানেও এই সুযোগ কম নেই। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের এই পড়ন্ত সময়ে নবীনরা তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। আর এ কারণেই বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের রুপালি পর্দার গানে সৈয়দ হকের অবদান এবং সেইসব গান নিয়ে বিস্তর আলোচনা, গবেষাণার প্রয়াজন রয়েছে।

তথ্যসূত্র :
০১. আমি কখনো গান লিখতে চাইনি, সাক্ষাৎকার- কবির বকুল, প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ।
০২. তিনি যদি আরও কয়েকটা গান দিয়ে যান, দ্বিতীয় সৈয়দ হক,  প্রথম আলো, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। 
০৩. আসলাম আহসান, তুমি আসবে বলে: সৈয়দ হকের গান, প্রকাশনায়: বাংলাদেশ শিল্পকরা একাডেমি, ঢাকা,  সেপ্টেম্বর ২০১৭, পৃষ্ঠা-১৭।



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়