ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নিবন্ধ

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও আনিসুজ্জামান

ড. এম আবদুল আলীম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৩ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও আনিসুজ্জামান

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গত হয়েছেন। তাঁর জীবন ও কর্মের নানা দিক নিয়ে চলছে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। পা-িত্যের পাশিাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। এদিক থেকে তাঁর শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা যায়। ভাষা-আন্দোলনে আনিসুজ্জামানের অবদান মূল্যায়ন করতে গেলে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে একটু আলোকপাত জরুরি।

আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, জন্মস্থান কলকাতা। পৈত্রিক নিবাস পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার মোহাম্মদপুর  গ্রাম। পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। পিতা আবু তাহের মোহাম্মদ মোয়াজ্জম, মাতা সৈয়দা খাতুন। শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে। এরপর ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। পরে ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এখানে পড়াকালীন তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন এবং ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে দপ্তর সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। আটচল্লিশের ভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি খুলনা জেলা স্কুলের ছাত্র, তখন রাষ্ট্রভাষা কি তা বুঝলেও জনৈক মুসলিম ছাত্রলীগ নেতার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে ভাষা-আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেননি।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো জগন্নাথ কলেজেও ভাষা-আন্দোলনের ঢেউ লাগে। জগন্নাথ কলেজে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আনিজুজ্জামান জগন্নাথ কলেজ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যপদে না থাকলেও, এর কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ও ১১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মঘট এবং পতাকা বিক্রির কর্মসূচি পালিত হয়। তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জের পথে এবং ফিরতি পথে পতাকা বিক্রি করেন। ঢাকা শহরের পোগজ ও সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে ঘর্মঘট কর্মসূচি বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানত যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হিসেবে তিনি ভাষা-আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন। ভাষা-আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ‘ভাষা-আন্দোলনের সময়ে আমি কলেজে পড়িÑ প্রথম বর্ষে। আমার ভূমিকা সামান্য কর্মীর ছিল। নিজেকে গৌরবান্বিত করার ঝোঁক নেই। গৌরব বোধ করি শুধু এই কারণে যে, অনেকের সঙ্গে আমিও এই মহান আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম।’

৫২-র ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা (‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি ও কেন?’ প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ১৯৫২), যেটি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটির রচয়িতা ছিলেন আনিসুজ্জামান। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নবাবপুর রোডে পূর্ব পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ অফিসে আয়োজিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি এবং আহমদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালের ‘থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে’ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে উপস্থিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় বের হতে শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় তাঁদের উপর টিয়ার সেল নিক্ষেপ করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই তুঙ্গ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে পরবর্তীকালে লিখেছেন : ‘এবারে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া শুরু করলো আমাদের দিকে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই, দৌড়ে যাই কলাভবনের পুকুরের দিকে। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, কেউ কেউ পুকুরেই ঝাঁপ দেয়; আমি গেঞ্জি ভিজিয়ে নিয়ে চোখে পানি দিই, শুধু শার্ট পরে থাকি, আর অধিকাংশের সঙ্গে ফিরে আসি রণক্ষেত্রে।’

২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার পরে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনা ঘটলে পরিবেশ আরও থমথমে হয়ে ওঠে। এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১১ নং ব্যারাকে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের মাইকে প্রচারের জন্য তিনি বক্তৃতা লিখে দেন এবং নিজেও বক্তৃতা করেন। এ প্রসঙ্গে এক চিঠিতে লিখেছেন : ‘গুলি বর্ষণের পর মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের একটি ঘরে মাইক্রোফোন বসানো হয়। যিনি পারছিলেন, তিনিই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমাকে একটি বক্তৃতা লিখে দিতে বলা হয়। কিন্তু বলার গতির সঙ্গে লেখার গতি তাল রাখতে পরছিল না। ফলে আমাকে মাইক্রোফোন নিতে বলা হয়। আমি পুলিশদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা দিই...। বেতার-কর্মীরা যে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেকথাও আমি মাইকে ঘোষণা করি আরেক দফায়।’

পুলিশি তল্লাশির আশঙ্কায় ২২ ফেব্রুয়ারি যুবলীগ অফিস থেকে দরকারি কাগজপত্র ও টাইপ রাইটার তিনি বাড়িতে নিয়ে যান। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতার গাড়িতে করে লক্ষ্মীবাজার থেকে একটি মাইক ভাড়া করে জগন্নাথ কলেজ হোস্টেলে নিয়ে যান। এরপর মাইকে কিছুক্ষণ বক্তৃতা করেন। এদিন ফরিদপুর কারাগার থেকে একটি টেলিগ্রাম আসে তাঁর কাছে, যাতে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের অনশন ও একুশের ঘটনার প্রতিবাদ সম্পর্কিত বার্তা ছিল। পরে ঐ বার্তা তিনি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে ‘কাল নিরবধি’তে বলেছেন : ‘২৩ তারিখে একটা টেলিগ্রাম পেলাম ফরিদপুর জেল থেকে। রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে সেখানে কয়েকদিন ধরে অনশন করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ। একুশের হত্যাকা-ের খবর পেয়ে অনশনের কারণ হিসেবে তার প্রতিবাদও তাঁরা যুক্ত করেছেন এবং সে-সংবাদ জানিয়েছেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদককে। এই টেলিগ্রামের ভিত্তিতে একটা খবর তৈরি করে আমি আজাদ পত্রিকায় দিয়ে আসি এবং তা যথারীতি মুদ্রিত হয়।’

২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহিদ মিনার নির্মাণের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারে জনতার শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক ও টাকা-পয়সা নিয়ে ভিড় জমায়। আনিসুজ্জামানের মা সৈয়দা খাতুন শহিদ মিনারের পাদদেশে একটি সোনার চেন দেন, চেনটি ছিল তাঁর মৃত বোনের। ২৫ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের প্রচারপত্র রচনা করেন এবং তা মুদ্রণের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর অলি আহাদসহ নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে গেলে চিরকুটের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ৭ মার্চ শান্তিনগরে ডা. মোতালেবের বাসভবনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের গোপন বৈঠকে তিনি অলি আহাদকে পৌঁছে দিতে যান। বৈঠক চলাকালে পুলিশ অনেতাদের প্রায় সকলকেই গ্রেপ্তার করে, যার জন্য তাঁদের কেউ কেউ আনিসুজ্জামানকে দোষারোপ করেন, তবে তিনি একে ‘অমুলক ও অন্যায় খোঁচা’ বলে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন।    

১৯৫২ সালের পরেও আনিসুজ্জামান একুশের চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিলেন। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন (১৯৫৩) প্রকাশের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এই সংকলনের উৎসর্গপত্রের লেখাটুকু (যে অমর দেশবাসীর মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছেন/একুশের শহীদেরা/যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট হয়ে রয়েছে/একুশের প্রতিজ্ঞা,Ñ/তাঁদের উদ্দেশ্যে) তাঁর নিজের হাতের। ফেব্রুয়ারির শেষে পুলিশ যুবলীগের অফিস সিল করে দিলে তিনি এবং ইমাদুল্লাহ্ মিলে জেলা শাখার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে ‘বাংলা ভাষায় সংবিধান লিখতে, সরকারী কাজকর্মের জন্যে পরিভাষা তৈরি করতেÑ এক কথায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তন করার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে অন্যদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বাঙালির স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আনিসুজ্জামান যুক্ত হয়েছেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়গুলোতে তাজউদ্দীন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় নানা দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ‘১৯৭১-এ তিনি বাংলাদেশের জন্য বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

লেখক: সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়