ঢাকা     বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

তারাশঙ্করের ‘১৯৭১’: অনালোচিত আখ্যান

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৪, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তারাশঙ্করের ‘১৯৭১’: অনালোচিত আখ্যান

|| অঞ্জন আচার্য ||

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জীবনের শেষবেলায় কলম ধরেন বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। আবেগ ও বাস্তবতার শব্দ মিশেলে তিনি উপস্থাপন করেন ‘১৯৭১’ উপন্যাস। এখানে তিনি লিখে গেছেন সরল সমীক্ষণে ঐতিহাসিক ঘটনার মুহূর্ত। তাঁর লেখায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাঠ উন্মোচন অগণিত পাঠককে মুগ্ধ করে।  তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, তারাশঙ্কর যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর এমন এক মর্মস্পর্শী আখ্যান লিখেছেন, তা অনেকেরই অজানা। বইটি কেন এত অনালোচিত রয়েছে এতকাল- আমার কাছে তা রহস্যময় বলেই মনে হয়।

উপন্যাসটি পড়ে জানা যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পূর্বে যখন ‘সুতপার তপস্যা’ এবং ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ বই দুটি প্রকাশের আলোচনা হচ্ছিল তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থার মধ্যেই বলেন, ‘দুটো বই এক হয়ে বেরোবে, তার নাম হবে- ১৯৭১’। যতদূর মনে হয় এটাই মহান শিল্পীর শেষ কথা। একাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনাবলি তাঁকে সেই রোগশয্যাতেও অশান্ত ও উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল, এই কথা তারই সাক্ষ্য বহন করে। এই রচনার মধ্যেও সেই অস্থিরতা ও দুঃসহ বেদনার প্রকাশ রয়েছে।

‘একটি কালো মেয়ের কথা’য় বাংলাদেশের সময় চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন তারাশঙ্কর। ২৫শে মার্চ বিকেল থেকেই ঢাকা শহর অজানা আশঙ্কায় থমথমে। যেন আগুন দেওয়া সলতে জ্বলতে জ্বলতে এগুচ্ছে বোমার দিকে।  শোনা গেছে চট্টগ্রাম নাকি জ্বলছে। এখানে প্রেসিডেন্ট খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ সাহেবের কথা হচ্ছে। চব্বিশ দিন ধরে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছে। আশ্চর্য সে আন্দোলন। একটা দুর্দান্ত প্রচণ্ড বলশালী জন্তু যেন পঙ্গু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। সারা অঙ্গের কোনো একটা স্থানেও কোনো স্পন্দন নেই। চোখ দুটো মেলে চেয়ে আছে। দেখছে কি দেখছে না তাও বলা যায় না। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে এই পর্যন্ত। বাইবেলে সমুদ্র বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা আছে। আমার কাছে এ সত্যাগ্রহ তেমনি একটা miracle মনে হয়েছিল।

তারাশঙ্কর লিখছেন: ‘আমার চোখের সামনে সারা বাংলাদেশের ছবিটা ভাসছিল। আমি তো তিন-তিনবার ঘুরেছি এই দেশটার বুক মাড়িয়ে সেই দেখা ছবিটা যেন নতুন হয়ে ভেসে উঠল আমার মনে। এরা নিষ্ঠুর রকমের গরিব। পরনে লুঙ্গি, খালি গা, খালি পা, গায়ের শ্যামলা রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে, বুকের পাঁজর বেরিয়ে আছে, চোখের কোলে কালি পড়েছে; ছিটেবেড়ার ঘর, টিনের চাল, বছরে বছরে সাইক্লোন এসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, চাপা পড়ে ওরা মরে, নদীর বন্যায় গ্রাম ডোবে গরু-বাছুর ভেসে যায়; এদের বাঘে খায়, সাপে কাটে; এরা ধান ফলায়, পাট ফলায়...।’

এভাবেই তারাশঙ্কর ‘১৯৭১’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন একাত্তরের গ্রামীণ জীবনের চিত্র। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজমা নামের একটি কালো মেয়ে। সে হয়ে উঠেছে একাত্তরের হাজারো নারীর প্রতীক। সেই সাথে সহচরিত্র- রহিম, মি. সেন ও ছায়ার মাধ্যমে সময়ের মুখ খুলে দিয়েছেন এই কথাশিল্পী। যার প্রতি পর্বে রয়েছে হৃদয়ছোঁয়া মা-মাটি-মানুষের ভালোবাসা।তিনি একটি দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: ‘২৫শে মার্চ রাত্রি তখন কত? দশটা কি এগারটা। বিকেলবেলা তিনটে থেকে মিটিং শুনেছি। পুরানা পল্টনে মিটিং ছিল শ্রমিক ফেডারেশনের। তারপর সরকারি কর্মচারীদের মিটিং-এর পর পর মিটিং শুনে পথে পথে বেড়িয়েছি। সন্ধ্যেতে ফিরে এসে মদ খেয়েছি আর ভেবেছি দেশ স্বাধীন হচ্ছে। ইয়াহিয়া খাঁ সে মুজিবুর রহমানের কাছে হার মেনে মিটমাট করে ফিরে যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানিরা ধ্বনি দিচ্ছে- বাংলাদেশ জিন্দাবাদ! বাংলাভাষা জিন্দাবাদ! তাদের হাতে বাংলাদেশের নয়া ঝাণ্ডা। জুলফিকার আলি ভুট্টো ঘাড় হেঁট করে ফিরে যাচ্ছে।’

স্বল্প কথায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত পরিস্থিতি, দিশেহারা সময়ের অস্থিরতা, তারুণ্যের শক্তিকে বাধা, তার উপরে দেশের উপরে মর্মান্তিক আঘাত, এই আঘাত থেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই লেখক দুটি স্বল্প দীর্ঘ উপন্যাস রচনা করেন। ১৯৬৫ সালের পর থেকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায় বিস্তৃত গোপন রাজনৈতিক তৎপরতাকে উপজীব্য করে ‘সুতপার তপস্যা’ রচনা করেছেন তিনি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন চিত্র তথা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন নিরেট অবস্থান থেকে সহজ ও সাবলীল ভাষায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বিষয়বস্তু করে তিনি রচনা করেন তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘একটি কালো মেয়ের কথা’। এতে প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশিদের ত্যাগ ও সংগ্রামের অনন্যতা ।

সাম্প্রতিককালে ‘ডেইলি স্টার বুকস’ থেকে পুনঃপ্রকাশ হয়েছে বইটি। এর ভূমিকা অংশে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন চলছিল তার মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপাল সাহিত্যিকের একজন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে আসার কোনো সুযোগ তাঁর হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিম বাংলার প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকই একবার করে ঘুরে গেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর যে দুজন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ আমরা করি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। তাঁদের তো স্বাধীন বাংলাদেশে আসার প্রশ্নই ওঠে না। তারাশঙ্কর আরো কিছুকাল জীবিত থাকলে হয়তো স্বাধীন বাংলায় একবার আসতেন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের এই মহৎ অর্জনটি কতো রক্তের বিনিময়ে পেতে হয়েছিল তার কিছু পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন। এই বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে সে বিষয়ে তাঁর মনে সম্ভবত কোনো সন্দেহ ছিল না। মৃত্যু শিয়রে রেখে তিনি ‘একটি কালো মেয়ের কাহিনী’ এবং ‘সুতপার তপস্যা’ নামে দুখানি মিলে ‘১৯৭১’ উপন্যাস লেখেন। মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নিধনযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তার বিবরণ একটি কালো মেয়ের কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে। এবং এখানে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’

‘সুতপার তপস্যা’ পড়ে দেখা যায়, স্ত্রীর কাছে লেখা এক অনতি তরুণ যুবকের খোলা ভাষ্য: ‘ভুলটা তোমারও বটে, আমারও বটে, আমাদের অভিভাবকদেরও বটে। তবে বিবাহ করেছি আমরা- ভুল আমাদেরই। এ ভুল চিরকাল, মানে সেই আদিকাল থেকে করে আসছে মানুষ। রাজার ছেলে ঘুঁটেকুড়নীকে বিয়ে করেছে, রাজকন্যে রাখাল ছেলেকে ভালবেসেছে- সব বাধা-বিঘ্ন বুক দিয়ে ঠেলে বেড়ি ভেঙে প্রাসাদের উপর থেকে লাফিয়ে পরিখার জলে পড়ে ওই রাখাল ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাজার ছেলে রাজার মেয়ের বেলাতেও ভালোবাসার পথ মসৃণ ছিল না। সংযুক্তা-পৃথ্বিরাজের বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখ; চৌহাম রাজবংশই শুধু ধ্বংস হয়নি, গোটা ভারতবর্ষ মুসলমানদের পায়ের তলায় এসে গেল। এখানে সংযুক্তার রূপের জন্য যুদ্ধ হয়নি, সংযুক্তার পিতৃপক্ষ কন্যা পৃথ্বিরাজকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বলে মুসলমানদের ডেকে এনেছিল। সুভদ্রা-হরশ, রুক্মিণী-হরণ-এসব পুরাণের কথা। সামাজিক যুগে, বড়লোকের ছেলে গরিব লোকের মেয়ে, বড়লোকের মেয়ে গরিব লোকের ছেলের বিয়ে অজস্র হয়েছে এবং তার ট্র্যাজেডিও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে।”

কথাগুলো এ গল্পের অন্যতম চরিত্র সুতপাকে উদ্দেশ্য করে সুব্রতের লেখা। তবে সুতপা, সুব্রত, শিবানী চরিত্রের মাধ্যমে গল্পটি সামনে এগোলেও সেই সাথে এটি নিরেট পশ্চিম বাংলার অস্থির সময়ের গল্প। আর সেই সময়টা ১৯৭১। ইতিহাসের পাতায় রক্ত ঝরছে দুই জায়গাতেই। মুক্তিযুদ্ধে ঝরছে এই বাংলার মানুষের রক্ত। পশ্চিম বাংলাতেও তাই, কিন্তু তার চালচিত্র আলাদা। সেই অস্থির সময়ের মধ্যে পশ্চিম বাংলায় রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কংগ্রেস শাসনে আস্থা নেই, অথচ প্রায় গোটা ভারতবর্ষেই কংগ্রেস শাসন চলছে। পশ্চিম বাংলায় নকশাল আন্দোলন এবং বাম রাজনীতির নাজুক অবস্থা। প্রাণ দিয়ে সবাই লড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরছে। এই অবস্থাটিকে সামনে রেখেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন ‘সুতপার তপস্যা’।

‘কালো মেয়ের কথা’ ও ‘সুতপার তপস্যা’ দুটোর প্রেক্ষাপট ও সময়ের মধ্যে ভূগোলের পার্থক্য থাকলেও প্রথম গল্পটিকে যেন একটি আরেকটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, পরিপ্রেক্ষিত যতোই আলাদা হোক না কেন। দুটো থেকেই যেন একটিই হাহাকার আকাশ বিদীর্ণ করছে। কোনো হিসাব নেই, দেশের কথা নয়, বিদেশের কথা নয়, কথা একটাই- মানুষ মরছে। জন্মভূমি হয়ে উঠেছে মৃত্যু উপত্যকা। মর্মভেদী দৃষ্টিতে তারাশঙ্কর দেখে গেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যার ফসল উপন্যাস ‘১৯৭১’।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়