ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

ছোটগল্প || ওয়েটিং লিস্ট

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৬, ২২ জুন ২০২০   আপডেট: ১৪:২২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
ছোটগল্প || ওয়েটিং লিস্ট

‘ও গণেশ, কী মাছ নিয়ে যাচ্ছিস বাজারে? ঝাকাডা নামা দিন, দেহি এট্টু।’ মোড়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চির ওপর বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বলে কাশেম।

‘ক্যা, কিনবা নাহি?’ মাছসহ ঝাকাটা মাথায় করে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে গণেশ। ঝাকা নামিয়ে মাছ দেখানোর কোনো উৎসাহ বোধ করে না।

‘কেনবো কি অরে? যে দাম চাইস তুরা! নামা না, কিনি না কিনি এট্টু দেহি। চোহির সুখ।’

আরো পড়ুন:

অনিচ্ছা সত্ত্বেও গণেশ ঝাকাটা নামিয়ে মাটিতে রাখে। ডালা সরিয়ে মাছ দেখায়। ঝাকার ভিতরে উঁকি দিয়ে মাছ দেখতে দেখতে কাশেম বলে, ‘ডিম ছাড়া কৈ, মাথা মুটা গুড়া চিকুন, খ্যাচা ধোনের মতো দেহা যাচ্ছে। ও মাছে স্বাদ নেই। কত অরে বেচপিনি? হাজার না আটশ?’

‘তুমি নিবা? নিলি এট্টা দাম কও, না হলি ছাড়ো। বেলা গড়ায়ে যাচ্ছে, শেষে বাজারে খদ্দের পাওয়া যাবে নানে।’

‘এত দাম দিয়ে কি আর আমি মাছ কিনতি পারি? আর তোরতো খদ্দের বান্দা। ঘুষখোর কিরানি-অফিসাররা সব তোর খদ্দের। ঘুষ খাতি খাতি পেটটা এমন মুটা হইছে যে নিচের দিকি তাকায়ে নিজির ধোন নিজি দেখতি পারে না। বাজারে ঢোকে, কোনো কিছুর দামও করে না, দেহে পছন্দ হলি কয় উঠো। সব যেন জমিদারের বাচ্চা!’

‘জমিদার না জমিদার না কাশেম ভাই, শুয়োরের বাচ্চা।’

চা বানাতে বানাতে দোকানের ভিতর থেকে ফোড়ন কাটে আলেক মুন্সি। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মাছের ঝাকাটা মাথায় তুলে দ্রুত বাজারের দিকে ছোটে গণেশ। কাশেমও উঠে পড়ে। পকেট থেকে চায়ের দামটা বের করে আলেক মুন্সির হাতে দিয়ে বলে, ‘ধরো, যাই দেহি, আইজ চিয়ারমেনরে ধরতি পারি কিনা। ছয় মাস হলো ঘুরতিছি। গিলি শুনি আইজ বাড়ি নেই, আর না হয় ঘুমোচ্ছে এহন ডাকা যাবে না। এইসব আর কি! বয়স্ক ভাতার কার্ডখান এহনো পালাম না।’

‘ও আর পাইছো! চিয়ারমেন মেম্বারগের শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ির আপন, সত-সতালো দিয়ে গুষ্টির সব্বাই বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, পঙ্গুভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সব ভাতার কার্ড করে নেছে। ওগের খাই-ই মেটে না, তার তুমারে-আমারে কি দেবে, কও? মশি যহন চিয়ারমেন হইনি তহন ছেল একরকম, আর চিয়ারমেন হওয়ার পরে আরেকরহম, এক্কেবারে পাল্টে গেছে। তুমারে কি কবো কাশেম ভাই, মাঝে একদিন আসে কল কি, কাকা, ময়রাগের দুকানের ঘিতো খাওয়া যায় না, ডালদা দিয়ে ভেজাল দেয়। তুমার গরুর দুধির সর তুলা ঘিডা টাটকা। তুমার বৌমার বাচ্চা হবে, আমারে কেজিখানেক ঘি দিও। লোক পাঠায়ে সেই ঘি বাকি নিয়ে গেল। ওর বউ বিয়োইছে আইজ প্রায় ছয় মাস। ঘা শুকোয়ে ফিরে পুয়াতি হয়ে যাওয়ার সময় হলো, আমার ঘির টাকাডা আইজও দেলো না।’

তার কথায় কাশেম প্রথমে জোরে হেসে ওঠে, তারপর খকখক করে অনেকক্ষণ কাশে। বেঞ্চের সাথে হেলান দিয়ে রাখা লাঠিটা হাতে করে উঠে হাঁটতে হাঁটতে চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। পিছনে অস্পষ্ট শুনতে পায় আলেক তখনও চেয়ারম্যানের গুষ্টি উদ্ধার করছে।

‘সরো, সরো সব। সকালডা ভালো করে হতিও পারেনা, চোহির ক্যাতর মুছতি মুছতি সব আসে চিয়ারমেনের উঠোনে পুঙ্গা থোয়। চিয়ারমেনের যেন আর অন্য কোনো কাজ নেই, খালি গুষ্টির মানষির এ ভাতার সে ভাতার কার্ড বানায় বেড়াবে।’

চেয়ারম্যানের উঠোনে পা রাখতে রাখতে কাশেম শুনে তার সাগরেদ আজগর আলী সামনে বসে থাকা দুইজন মহিলার দিকে তাকিয়ে খুব হম্বিতম্বি করছে। কাশেমকে ঢুকতে দেখে বলে, ‘ওই যে আর একজন আসে গেছে।’

একথা শুনে কাশেমের মাথা গরম হয়ে যায়, মনে হয় ছুটে গিয়ে হাতের লাঠি দিয়ে এক বাড়ি মেরে মাথাটা ফাটিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। ধীরে ধীরে কাছে এসে বলে, ‘ও আজু, এত ঝাড়ি মারতিছিস ক্যান, বাপ? আমরাতো আর তোর কাছে আসিনি। আইছি চিয়ারমেনের কাছে, তারেই সব কবানি। তুই ডাকে দে।’

‘ডাকে দে, কলিই হলো? স্যার ঘুমাচ্ছে। ওয়েট করো।’

আজগর তেমনি খ্যাচম্যাচ করতে থাকে। তার শেষের কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে কাশেম বলে, ‘কি করব?’

‘ওয়েট করো, মানে সবুর করো।’

তারপর সামনে বসে থাকা দুই মহিলার একজনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রাহেলা খালা, তুমারে না কইছি তুমার বয়স্ক ভাতার কার্ড হবে নানে, এনআইডি অনুযায়ী তুমার বয়স ৬২ বছর হইনি। ওর কম হলি বিটিরা বয়স্ক ভাতা পায় না।’

‘তয় আমারে এটটা বিধবা ভাতার কার্ড করে দে বাজান। বাড়ির জুয়ান ছাওয়ালডা একসিডেন করে পঙ্গু হয়ে বসে রইছে, মায়েডারে দুডো ছাওয়াল-মায়েসহ জামাই ছাড়ে দেছে। ঝিগিরি করে এগেরতো আর বাচায় রাখতি পারতিছি নারে, বাজান। ছাওয়ালডারওতো এটটা পঙ্গু ভাতার কার্ড হয়, হয় না, ক?’

‘হ। তা হয়। তয় একবাড়ি দুই-তিনখেন করে কার্ড দিলি গিরামের আর মানষিরে কি দিবানি। সবারইতো চাই। এমনিতি চিয়ারমেনের বাড়ির মাটি থোচ্চ না, এরপর আসে তো খেমচোয়ে চামড়া তুলে নিবানে।’

‘একখানইতো পাচ্ছি নারে, বাজান, দুই-তিনখেনের কথা আর কি কবো?’

‘পাবানে, আবার দরখাস্ত করতি হবে। আর কিছু খরচপাতি আছে। ওগুলো নিয়ে সামনের দিন আসো, করে দিবানি।’

‘খরচপাতি তো আগেও নিলি, বাজান। আবারও দিতি হবে? ৫০০ টাহার ভাতা, দুইমাসেরতাতো পাওয়ার আগেই দিয়ে দিলাম।’

‘রাহেলা খালা, এ তো আমারে দেচ্ছ না। সমাজসেবা অফিসে খরচ আছে কিছু। তুমরাতো ভাবো চিয়ারমেন মেম্বাররা সব খাইয়ে ফেলায়।’

‘কি জানি রে বাজান, আমিতো অতশত বুঝি না। তুই কাজডা করে দে, বাজান।’ আকুতি ঝরে পড়ে রাহেলার গলায়।

‘আসো দিবানি। তুমি সামনের দিন এনআইডি কার্ডখান নিয়ে আসো। বাকি আমি দেখফানি।’

ধীরে ধীরে উঠে দাড়ায় রাহেলা। ময়লা ফেঁসে যাওয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। অনিচ্ছুক পরিশ্রান্ত এক ভঙ্গিতে উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। প্রতিটা পদক্ষেপই বলে দিচ্ছে আর এগোতে পারছে না সে। খুব কষ্ট হচ্ছে। কাঁধের ওপর জীবনের বোঝাটা বড্ড ভারী। তাকে হাল্কা করা দরকার। সেই চেষ্টাই সে করে যাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে কাশেম। তারপর আজগরকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল তখনই বারান্দার সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে আসে চেয়ারম্যান। চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘কাশেম চাচা কিরাম আছো? করিমন খালা, তুমার খবর কী?’

দুজনেই অস্পষ্ট স্বরে বলে ‘এই আছি’, যা থেকে বোঝা যায় না তারা ঠিক কেমন আছে।

‘কার্ড কার্ড করে সব আমার গার ছাল তুলে ফেলল রে চাচা। কারে থুয়ে কারে দেব কও। যে পায়না সে-ই অসন্তুষ্ট হয়। কয়, তালি চিয়ারমেন বানালাম ক্যা? যে ভোট দেছে সেও কয়, যে ভোট দি নি সেও কয়। আমিতো পারলি সবাইরে দিতাম। টাকাতো আর আমি দেবনা, দেবে সরকার। সবাইরে দিলি আমার ক্ষতিডা কুহানে? তাতো আর পারি না।’

‘সেতো বুঝলাম রে, বাপ। কিন্তু দেহা যাচ্ছে, কোনো কোনো বাড়ি দুই-তিনজন পাইছে, আবার কেউ মোটে পাইনি।’

কাশেমের কথার সূত্র ধরেই হঠাৎ করে চেঁচিয়ে ওঠে করিমন।

‘তুমি খালি ওই কথা কচ্ছো কাশেম ভাই! স্বামী মরার ছয় মাসের মদ্যি বিধবা ভাতা পাইছে। আবার ভাতা পাওয়ার ছয় মাসের মদ্যি ফিরে নিকে করিছে। এহন বিধবা ভাতাও তুলতিছে আবার নতুন স্বামীর ঘরও করতিছে। মজাই মজা।’

তার এই কথায় চেয়ারম্যান কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘করিমন খালা, তুমি কি আজগরের ভাইবউর কথা কচ্ছো? মায়েডা অল্প বয়সে বিধবা হইছেল...’

‘হ। অল্প বয়সী বিধবাগের দিকিইতো তুমাগের নজর বেশি, আর এই যে ৩৫ বছর ধরে বিধবা, তারে তুমরা চোহি দেহ না।’

কথার মাঝখানে কথা বলায় চেয়ারম্যান খুব বিরক্ত হয়। তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আগে কথা শেষ করতি দ্যাও। আজগরের ভাইবউর কার্ড বাতিলের জন্যি সমাজসেবা অফিসাররে আমি লিখিত দিছি। খুব শিগগিরই তার কার্ড বাতিল হয়ে যাবে।’

তার কথার প্রতি খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে করিমন বলে, ‘কারডা রাখফা কারডা বাতিল করবা সে তো তুমাগের ব্যাপার রে বাপু, আমার কার্ডখানের কি হলো?’

একথা শুনে চেয়ারম্যান আজগরের দিকে তাকায়, কাশেম আর করিমন বেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে ইশারায় জানতে চাইলে আজগর বলে, ‘করিমন খালা ও কাশেম কাকা দুইজনেই ওয়েটিং লিস্টি রইছে।’

‘ওয়েটিন লিস!’ বিড়বিড় করে বলে কাশেম।

‘সেডা আবার কিরে, বাপু?’ করিমন বেওয়া জানতে চায়।

‘তুই বুঝোয়ে কইসনি?’ আজগরকে ধমক লাগায় চেয়ারম্যান। তারপর বলে, ‘শোনো, যারা ভাতা পাতি পারে প্রথমে আমরা তাগের কাছেরতে দরখস্ত নিই। সেগুলো পরে সমাজসেবা অফিসারের কাছে পাঠায়ে দিই। ওরা যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন অনুযায়ী আলাদা আলাদা লিস্ট বানায়, লিস্ট মানে তালিকা। আমরা ইউনিয়ন কমিটি সেই তালিকারতে আরেটটা তালিকা বানায়ে উপজেলায় পাঠাই। উপজেলা কমিটি বরাদ্ধ অনুযায়ী এটটা চূড়ান্ত তালিকা বানায় যেডা এমপি সাহেব অনুমোদন দিলি টাকা দিয়া হয়। আরেটটা ওয়েটিং লিস্ট থাহে। ভাতা পাবে এমন কেউ যদি পরে এই গিরামেরতে চলে যায় বা মরে যায় বা ভাতা নিতি না চায়, তহন ওয়েটিং লিস্টি যাগের নাম থাহে তারা আমাগের সুপারিশি ভাতা পায়। তুমরা দুইজন সেই ওয়েটিং লিস্টি রইছ। মানে অপেক্ষমান তালিকা। সুজা কথায় সবুর করা লাগবে। বুঝিছ এবার?’

চেয়ারম্যান এতক্ষণ যে কথাগুলো বলছিল সেই নিয়মকানুনের কতটুকু কাশেম ও করিমন বেওয়া বুঝেছে কে জানে। কিন্তু এটুকু বুঝেছে যে সহসা তাদের ভাতা পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো অদৃশ্য কারণে এদের নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ গিয়ে অপেক্ষমান তালিকায় রয়েছে। অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে কাশেম বলে, ‘আমাগের ভাতা পাতি হলি কাউরে গিরাম ছাড়ে এক্কেবারে চলে যাতি হবে, না হয় মরতি হবে?’

করিমন বেওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছে। তার প্রত্যাশায় এমন ছাই পড়বে সে ভাবেনি। কাশেম নিজেও কি ভেবেছে? কিছুক্ষণ বসে থেকে বলে, ‘করিমন বু, চলো যাই।’

করিমন কিছু বলে না। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দুজনে ধীরে ধীরে চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে এসে মেঠো রাস্তা ধরে এগোতে থাকে। 

‘জীবনের এহনো কত বাকি আছে কাশেম ভাই? কতদিন বাচপানি কও। আর কত সবুর করবো? আমাগেরতো আল্লাও সবুর করায়ে রাহিছে। সেওতো নেয় না।’

‘হরে বুন, সত্তর বছর বয়স হতি গেল, বয়স্ক ভাতা পাতি হলি এহনো সবুর করতি হবে। ওই যে ওয়েটিন লিস না কি কলো, আমাগের নাম সবসময় ওহেনে, আল্লার কাছেও।’

লাঠিতে ভর দিয়ে দুজন বয়সী মানুষ সামনের দিকে এগোতে থাকে। এখনো সামনে কতটা পথ তা তারা জানে না। তারা শুধু জানে তাদের অপেক্ষা করতে হবে। জীবন ও মরণ সবকিছুর জন্যই।



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়