বাংলা একাডেমি আধুনিক অভিধান : বানান-প্রতর্ক
বাংলা একাডেমির একটি উল্লেখযোগ্য কর্ম ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬)-এর কিছু বানান নিয়ে বেশ তর্ক উঠেছে। আমি একে বলি ‘বিতর্ক’ নয়, ‘প্রতর্ক’- প্রকৃষ্ট তর্ক। ভাষা-স্বাস্থ্যের জন্য এমন তর্ক ওঠাই উচিত। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ চলমান প্রতর্কের বিষয়টি লক্ষ করেছেন এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিবৃতিও প্রদান করেছেন।
পত্রিকার ভাষা সাহিত্যের ভাষা
সৃষ্টিশীল লেখকেরা ভাষার সন্ধিগুলো ভেঙেছেন, আবার গড়েওছেন। যুগ যুগ ধরে তাই হয়েছে। কিন্তু তাঁরা জানেন, ভাষাবিজ্ঞান আর ব্যাকরণও মিথ্যে নয়। তাই শামসুর রাহমান ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হিসেবে যখন লেখেন, তখন তিনি ক্রিয়াপদটি দেন ‘দেখে’, আর কবি হিসেবে যখন লেখেন তখন ‘দ্যাখে’ (‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ আছে)। এটি সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ থেকে সচেতন লেখক মাত্রেই পরিদৃষ্ট হয়। তাঁরা সংবাদপত্রে যে ভাষারীতি অনুসরণ করে সংবাদ বা সম্পাদকীয় পরিবেশন করেন, গল্প-কবিতা-উপন্যাসে সেখান থেকে স্বাধীনতা নেন, নিজের মতো করে লেখেন। লেখকের এই বোধ, আশংকা করি, এখন আমাদের দেশে লুপ্ত হতে চলেছে। অনেকে মনে করেন, মুখের কথাই গল্প-উপন্যাস-কবিতার ভাষা এবং সেটাই গবেষণা অথবা পত্রিকারও ভাষা। ভাষা ব্যবহারে এই একরৈখিক যাত্রা না হলে বা ব্যত্যয় হলে স্বাদেশিকতা গেল-গেল বলে তারা হামলে পড়েন! সমাজেও এই চটকদারির সমাদর একটু বেশিই। হুজুগের শব্দমালা বা চা-স্টলের আড্ডার বাক্যাংশ দিয়ে বহুজন পত্রিকায় লিখছেন, ‘কেতাব’ ছাপছেন। বাংলা ভাষা যে বিশ্বজুড়ে থাকা বাঙালির ভাষা এবং এর প্রকাশবৈচিত্র্য যে অফুরন্ত, তা ভুলে গিয়ে এভাবে বাংলাকে শুধু একটি দেশে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। ঠিকঠাক বললে, দেশও নয়, ঢাকাতে সীমিত করা হয়। ভাষাব্যবহার যদি এতোটাই সহজ হতো এবং এটি যদি শিখবার ব্যাপার না-ই হতো, তাহলে ব্যাকরণ, ভাষাবিজ্ঞান এমন কি উচ্চারণরীতি বা হালে আলোচনায় আসা বানানের নিয়মের দরকার হলো কেন?
রবীন্দ্রনাথের নিয়মমানার অঙ্গীকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে সৃষ্টিশীল লেখক কে? তিনিইতো বাংলা বানানের রীতির উদ্গাতা। সেদিন বাংলা বানান নিয়ে এই রীতিনীতির কথা যদি তিনি না ভাবতেন, তাহলে আজ ‘গোরু’ নাকি ‘গরু’; ‘বউ’ নাকি ‘বৌ’ এসব তর্ক হতো না। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, সৃষ্টিশীল লেখকের হাতে ভাষার ঝরনাটি ঝরতে পারে কিন্তু সেটিকে দুকূলে বাঁধ দিয়ে বাংলা ভাষার সাগরে ঠিকঠাক প্রবাহিত করার দায়িত্ব নেবেন ব্যাকরণবিদ আর ভাষাতাত্ত্বিকগণ। তাই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বললেন, বাংলা বানানের নিয়ম করার ব্যবস্থা নিতে। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র শ্যামাপ্রসাদের ছিল ব্যাপক বাংলাপ্রীতি। তিনি বিলেত থেকে উচ্চশিক্ষা নিলেও বাংলাপ্রীতির কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাংলায় সমাবর্তন বক্তব্য উপস্থাপন করান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধ অনুসারে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ স্থির করার জন্য একটি স্বাধীন কমিটি করে দেন, যার সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু ও সম্পাদক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। এই কমিটি প্রায় দুশজন লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত আলোচনা করে একটি নিয়ম-পুস্তিকা ১৯৩৬ সালে প্রণয়ন করে। এই পুস্তিকার নিচে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় [কলিকাতা] নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি।’ এরপর তিনি স্বাক্ষর করেন ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখ দিয়ে। দ্বিতীয় স্বাক্ষরটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের; তাঁর তারিখ ১৭ই সেপ্টেম্বর। এভাবে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক সেই বানান-রীতি মেনে চলবেন বলে অঙ্গীকার করে স্বাক্ষর করেন। ১৯৩৬ সালের বানান-রীতির ধারাবাহিকতাই আজকের বাংলা একাডেমির বানানরীতি।
বাংলা একাডেমি
জাতির মননের প্রতীক হিসেবে বাংলা একাডেমি স্বীকৃত। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান। স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানটির অবদান ইতিহাসস্বীকৃত। মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমিতে এসে বলেছিলেন, গবেষকগণ পরিভাষা তৈরি করতে থাকবেন কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ামাত্র সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, পরিভাষাতৈরির মতো কাজ, অর্থাৎ গবেষণাই বাংলা একাডেমির প্রধানকর্ম। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয় ১৯৫৫ সালে। স্থাপনকালে গবেষণাকেই মুখ্য রাখা হয়েছিল। ফ্রেঞ্চ একাডেমির আদর্শে বাংলা একাডেমির কর্মকাঠামো পরিকল্পিত হয়। গবেষণা, অনুবাদ, সংকলন, প্রকাশনা, গ্রন্থাগার- এই বিভাগগুলির মাধ্যমে একাডেমির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। একাডেমির গৃহীত কর্মসূচি হলো: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা; প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুথি সংগ্রহ ও সম্পাদনা; লোকসঙ্গীত, লোককাহিনি, ছড়া, ধাঁধা ইত্যাদি গ্রাম থেকে সংগ্রহ ও সেগুলির ওপর গবেষণা পরিচালনা করা; বিভিন্ন ভাষার প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ; শ্রেষ্ঠ বাংলাগ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদকরণ; বাংলায় উচ্চতর শিক্ষার পাঠ্য ও সহায়ক গ্রন্থপ্রকাশ; অভিধান প্রণয়ন ও প্রকাশ।
বাংলা একাডেমির প্রথম প্রধান নির্বাহী ছিলেন (তখন বলা হতো ‘স্পেশাল অফিসার’ এখন ‘মহাপরিচালক’) মুহম্মদ বরকতুল্লাহ। এরপর মুহম্মদ এনামুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মুহম্মদ, কবীর চৌধুরী, মাযহারুল ইসলাম, নীলিমা ইব্রাহিম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, মুহম্মদ মনজুরে মওলা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মাহমুদ শাহ কোরেশী, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ, মনসুর মুসা, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, রফিকুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান, হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী বাংলা একাডেমির প্রধান নির্বাহী হিসেবে ছিলেন বা আছেন। নির্বাহী প্রধানদের এই তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, বাংলা একাডেমির কাজ মূলত গবেষণাকর্ম। বাংলা একাডেমির সদস্যও করা হতো গবেষণাকর্ম বা গবেষণার প্রতি আগ্রহের নিরিখে। অধ্যাপক মনসুর মুসার দ্বিতীয় মেয়াদকালে বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের নির্বাচনের নামে নির্বিচারে সদস্যকরণের যে প্রক্রিয়া দেখা গেছে তাতে স্রেফ পুস্তক-প্রকাশকও বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য হয়েছেন; যে-কোনো ধরনের বই থাকলেতো আর কথাই ছিল না। মূলত ২০০১ সাল থেকে দশ বছর সময়ে বাংলা একাডেমি এর প্রতিষ্ঠার মূল চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়। ২০১০ সালের পর আবার বাংলা একাডেমি কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্বমহিমায় উঠে আসতে থাকে জাতির সামনে। বেশ কিছু ধীমান গবেষককে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চাকরিসূত্রে সংযুক্তকরণ, গবেষণাকর্ম সম্পাদন, লোকসাহিত্য বিষয়ক প্রকল্পগ্রহণ, দৃষ্টিনন্দন ও প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো স্থাপন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ সময় সংসদে বহু প্রত্যাশিত বাংলা একাডেমি আইন পাস হয়। কিন্তু গবেষণার বাইরের যে বেনোজল বাংলা একাডেমিতে ঢুকতে শুরু করেছিল ২০০১-এর পর থেকে, তা সর্বাংশে রোধ করা সম্ভবপর হয় না। বরং ভাব ও প্রভাবে সেটি এখন শক্ত ও একাট্টা হয়েছে।
বাংলা একাডেমির বানানের নিয়ম ও অভিধান-কোষ
অন্যান্য কাজের সঙ্গে বাংলা একাডেমির দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি হলো: ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকা প্রণয়ন (১৯৯৪) আর অভিধান ও কোষগ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ। অভিধান ও কোষগ্রন্থ প্রণয়নের ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়। তাই ‘পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’; ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’; ‘উর্দু-বাংলা’, ‘বাংলা-উর্দু’, ‘বাংলা-আরবি’, ‘আরবি-বাংলা’ অভিধান সংকলন; বাংলায় ‘ইসলামি বিশ্বকোষ’, ‘সাহিত্যকোষ’, ‘জীবনীকোষ’, বিভিন্ন পরিভাষাকোষ সংকলন হয়েছে। এগুলো ছাড়াও বাংলা থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান, উচ্চারণ অভিধান, লেখক অভিধান, চরিতাভিধান, সমশব্দ অভিধান, বানান অভিধান, ছোটদের অভিধান প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে বাংলা ভাষার প্রকৃত ব্যাকরণ লেখার যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই ধারণা মতো বাংলা একাডেমি ২০১০ সালের পরে দুখণ্ডে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ গ্রন্থ প্রকাশ করে, তিন খণ্ডে প্রকাশ করে ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ ও ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’। এই ব্যাকরণগ্রন্থ ও অভিধান দুটো নানা কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম প্রকাশের চার বছর পর ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ নিয়ে শুরু হয় প্রতর্ক।
বানানের নিয়ম
বাংলা একাডেমি বাংলা বানান প্রমিতকরণের লক্ষ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে সভাপতি ও বশীর আলহেলালকে সদস্য-সচিব করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তাঁদের দেওয়া সুপারিশ বাংলা একাডেমি প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে ১৯৯২ সালের নভেম্বরে। পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মতামত বিবেচনা সাপেক্ষে পরিমার্জিত নিয়মাবলি চূড়ান্ত করে ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে। এই নিয়মাবলি ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে পুস্তিকায় প্রকাশ করা হয়। স্বীকার করে নেওয়া হয়, বাংলা একাডেমির এই ‘নিয়ম’ ১৯৩৬ সালে প্রণীত এবং রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র অনুমোদিত নিয়মেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে পুস্তিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা একাডেমি জামিল চৌধুরী সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলা বানান-অভিধান’ (১৯৯৪) মুদ্রণ করে, যে অভিধানে শুধু শব্দের বানান প্রদর্শিত হয়, শব্দের অর্থ বা উৎস উল্লেখ থাকে না। শিক্ষিতমহলে ব্যাপক সমাদর পায় এই বানানরীতি পুস্তিকা ও অভিধানটি। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও সুপারিশও আসে। কিন্তু বাংলা একাডেমি দীর্ঘকাল নির্লিপ্ত থাকে এই বানানরীতি নিয়ে। তারা উল্লিখিত ‘বানান-অভিধান’ ছাপা বন্ধ করে দেয়, অন্য অভিধানগুলো প্রকাশ করে। এমন কি, বাংলা একাডেমির কেউ কেউ নির্বাহী প্রধান থাকাবস্থাতেই বাংলা একাডেমির বানানরীতির তোয়াক্কা না করে ‘স্পীকার’, ‘কাহিনী’ ইত্যাদি লিখে শিক্ষিতমহলে সন্দেহ সৃষ্টি করেন। অবশেষে দীর্ঘ দেড় যুগ পর, মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ২০১২ সালে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করায় শিক্ষিতমহল হাতে একটি বানানদিশা লাভ করে।
‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২০১২ সালের সংস্করণে বানানের নিয়মগুলো পূর্বাপেক্ষায় অনেক সরল করে তুলে ধরা হয়। ১৯৯৪ সালের নিয়মে যেখানে তৎসম শব্দ, অতৎসম শব্দ ও বিবিধ এই তিন ভাগে আলোচনা বিন্যস্ত ছিল, ২০১২ সালের নিয়মে তৎসম, অতৎসম, বিবিধ, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সংস্থার নাম, ক্রিয়ার রূপ এই পাঁচ ভাগে আলোচনা সাজানো। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন বা সংযোজিত নিয়মগুলো হলো:
* ১৯৯৪ সালের নিয়মে বলা হয়েছিল: ক খ গ ঘ থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) লেখা যাবে। বিকল্পে ঙ্ লেখাও যাবে। যেমন: অহংকার, অহঙ্কার; সংগীত, সঙ্গীত; ভয়ংকর, ভয়ঙ্কর- এ রকম বানানগুলোতে দুটোই ঠিক। কিন্তু ২০১২ সালের নিয়মে বিকল্প তুলে বলা হলো: সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে। যেমন: অহম্+কার=অহংকার; এভাবে ভয়ংকর, সংগীত, শুভঙ্কর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। আবার সন্ধিবদ্ধ না হলে ঙ স্থানে ং হবে না। যেমন: অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, আতঙ্ক, কঙ্কাল, গঙ্গা, বঙ্কিম, বঙ্গ, লঙ্ঘন, শঙ্কা, শৃঙ্খলা, সঙ্গে, সঙ্গী।
* ২০১২ সালের নিয়মে একটি মারাত্মক বিকল্প বানানরীতি রাখা হয়েছে, তাহলো: প্রাণীবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা; গুণীজন ও গুণিজন; মন্ত্রীপরিষদ ও মন্ত্রিপরিষদ দুটোই ঠিক বানান। বলা হয়েছে, সংস্কৃত ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দের দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপ সমাসবদ্ধ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুযায়ী সেগুলিতে হ্রস্ব ই-কার হয়। তবে এগুলির সমাসবদ্ধ রূপে ঊ-কারের ব্যবহারও চলতে পারে। ১৯৯৪ সালের নিয়মে এ ধরনের বানানে শুধু প্রাণিবিদ্যা; গুণিজন; মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধ ছিল।
* ১৯৯৪ সালের নিয়মে শব্দান্তে বিসর্গ থাকবে না বলা হলেও সঙ্গে যুক্ত ছিল এই কথা: ‘তবে যেসব শব্দের শেষে বিসর্গ না থাকলে অর্থের বিভ্রান্তি ঘটার আশঙ্কা থাকে, সেখানে শব্দশেষের বিসর্গ থাকবে। যেমন: পুনঃ পুনঃ’। ২০১২ সালের পরিমার্জনায় উদ্ধৃতির বাক্যটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে, এখন লিখতে হবে: ‘পুনঃপুন’।
* ১৯৯৪ সালের নিয়মে বলা হয়েছিল, ক্ষীর ক্ষুর ক্ষেত বানান ‘খ’ দিয়ে লেখা যাবে না কিন্তু খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিদে বানান ‘খ’ দিয়ে লিখতে হবে। ২০১২ সালের বানানবিধিতে সর্বক্ষেত্রে ‘খ’ ব্যবহারের কথা বলা হয়। তাই এখন খিরদুধ, পশুর পায়ের খুর, নীলখেত লিখতে হবে।
* ‘জ’ নাকি ‘য’ আরবি-পারসি শব্দে কোনটি লেখা হবে, এই কাজিয়া ২০১২ সালের বানানবিধিতে অধিকতর সরল করে বলা হয়েছে: ‘জ’ লেখাই শ্রেয়। তবে, আযান, ওযু, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান, হযরত শব্দ কয়টি উল্লেখ করে বলা হয়: এগুলোতে ‘বিকল্পে য লেখা যেতে পারে’। ১৯৯৪ সালের বানানবিধিতে এক্ষেত্রে একটু কড়াকড়ি করে বলা হয়েছিল: ‘য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত’।
* না, নি, নাই নঞর্থক অব্যয়গুলি শব্দের শেষে পৃথকভাবে বসানোর বিধান ছিল ১৯৯৪ সালের বানানবিধিতে। ২০১২-তে ‘নি’কে যুক্তভাবে লেখার কথা বলা হলো। যেমন: আগে ছিল: ‘যাও নি’? এখন সেটা লিখতে হবে: ‘যাওনি’?
* ১৯৯৪ সালের বানানবিধিতে সংখ্যার বানান নিয়ে কথা ছিল না। ২০১২ সালের বানানের নিয়মে কয়েকটি সংখ্যার বানান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় এভাবে: এগারো, বারো, তেরো, পনেরো, ষোলো, সতেরো, আঠারো। কিন্তু চৌদ্দকে কেন ও-কার হীন একা রাখা হলো, চৌদ্দো বা চোদ্দো কেন নয়, তার কোনো ব্যাখ্যা থাকল না। আর কেনইবা ‘এগার’ নয় ‘এগারো’ সে ব্যাখ্যাও দেওয়া হলো না।
* ১৯৯৪ সালের বানানবিধির পরিশিষ্টে রচনা সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা ছিল। ২০১২ সালে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থার নাম ‘বানানবিধি’ বহির্ভূত বলে ঘোষণা আছে।
আধুনিক বাংলা অভিধান
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে প্রামাণিক অভিধান হলো বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’। এই অভিধানের সম্পাদক জামিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত-পরিচয় নেই। শুনেছি তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর বাংলাজ্ঞানের পরিধি অনুধাবন করে মুগ্ধ হয়েছি। ‘বাংলা থেকে বাংলা’ এমন অভিধান বাংলাদেশে এর আগে সংকলিত ও মুদ্রিত হয়নি। ১৮৬৪ সালে ঢাকা থেকে মুদ্রিত প্রথম অভিধান শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘শব্দদীধিতি অভিধান’। তারপর অল্প কিছু উল্লেখযোগ্য অভিধান ঢাকা থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ এসবগুলো থেকে সত্যিই আধুনিক। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অবশ্য অনেক অভিধান বের হয়। তার মধ্যে সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গলা ভাষার অভিধান’, রাজশেখর বসুর ‘আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান’ (‘চলন্তিকা’ নামে সমধিক পরিচিত), হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’, শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’ উল্লেখযোগ্য। ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ এগুলোর কয়েকটি থেকে এগিয়ে নিশ্চয়। শুধুই শব্দ ও তার অর্থজ্ঞাপন নয়, লেখন-পদ্ধতিতেও আধুনিক ভাবনা যুক্ত করা হয়েছে এই অভিধানে। যেমন:
* চন্দ্রবিন্দু ও রেফ প্রদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। চন্দ্রবিন্দু সংযোজন করা হয়েছে ব্যঞ্জনের ডানদিকে। যুক্তি হলো চন্দ্রবিন্দু যেহেতু অনুনাসিক স্বরধ্বনির চিহ্ন সেহেতু তা ব্যঞ্জনের পরেই অবস্থিত। আগে লেখা হতো ‘তাঁকে’, অর্থাৎ ত+চন্দ্রবিন্দু+আ-কার; কিন্তু এই অভিধানে লেখা হয়েছে ‘তাঁকে’, অর্থাৎ ত+আ-কার+চন্দ্রবিন্দু। অন্যদিকে কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের পূর্বে র যুক্ত হলে র-এর যুক্ত রূপকে যেহেতু রেফ বলে, সেহেতু ব্যঞ্জনবর্ণের বাম দিকে খানিকটা সরিয়ে রেফচিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও আকর্ষণীয়। এই পথ অনুসরণ করে ভবিষ্যতে বাংলা কম্পিউটার সফট্ওয়ারেও হয়তো পরিবর্তন আসবে।
* অভিধানে শব্দের উৎস নির্ণয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে ভিন্নভাষার শব্দ, যেগুলো বাংলায় এসেছে, সেগুলোর উৎস নির্ণয় করা হয়েছে গভীরে গিয়ে। যেমন, ‘ফোন’ (Phone) ইংরেজি শব্দ হিসেবে জানা ছিল। এই অভিধানেই লেখা হলো এটির উৎস মূলত গ্রিক শব্দ। রোজনামচা অর্থে ডায়েরি বা ডাইরি (Diary) ইংরেজি শব্দ হিসেবে অন্যত্র লেখা হলেও এই অভিধান বলছে, এটির উৎসশব্দ লাতিন। তেমনি ‘পিৎজা’ ইতালীয়, ‘বয়াম’ পর্তুগিজ, ‘ডেঙ্গু’ স্পেনীয়, ‘তন্দুরি’ পারসি, ‘পেট্রোল’ (Petrol) ফরাসি, ‘প্লাস’ (Plus) লাতিন, ‘ভরসা’ হিন্দি, ‘মিস্ত্রি’ পর্তুগিজ ইত্যাদি নতুন উৎসশব্দের ঠিকানা আছে এই অভিধানে।
* শুধু বিদেশি শব্দই নয়, অন্য শব্দগুলোকেও বাংলা ভাষার বানানধারায় যতটা আত্তীকরণ সম্ভব, তা করা হয়েছে এই অভিধানে। বিশেষ করে, যেক্ষেত্রে ই-কার, ঈ-কার এবং উ-কার, ঊ-কার দুটোই বিকল্পে সিদ্ধ ছিল, সেক্ষেত্রে ঈ-কার ও ঊ-কার বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ ‘বিদেশি, বিদেশী’ দুটো শব্দই ঠিক বলে উল্লেখ থাকলেও ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ভুক্তিতে আছে শুধু ‘বিদেশি’। অনুরূপভাবে ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ প্রাতঃকাল অর্থে ‘উষা, ঊষা’ দুটো শব্দই ঠিক বলে উল্লেখ থাকলেও ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ আছে শুধু ‘উষা’। অর্থাৎ বিকল্প পরিহার করে বাংলা শব্দভাণ্ডারে শব্দসঞ্চয়ের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে এই অভিধানে।
* এই অভিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অভিধানটি সর্বজন-ব্যবহারোপযোগী। বিদ্যার্থী থেকে পণ্ডিতজন সবাই অভিধানটিতে দিশা পান। একটি শব্দ দিয়ে কতপ্রকার শব্দ তৈরি হতে পারে এবং কী প্রকারে তৈরি হয়, তা পৃথক করে এই অভিধানে দেখিয়ে দেওয়া আছে। অনেকে বলতে পারেন, এতে পৃষ্ঠা বাড়ানো হয়েছে। এই স্থূলকথা। কোনো কাজে নেমে যখন নির্দিষ্ট শব্দের প্রয়োজনে অভিধানের দ্বারস্থ হতে হয়, তখন অনুসন্ধিৎসুকে ঐ শব্দটি ঠিকঠাক জোগান দেওয়াও অভিধানের কাজ। ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ একাজটির জন্য তৈরি। প্রতিটি শব্দের গঠনগত দিক জানতে চাইলে (বিদ্যার্থীদের জন্য যেটি খুবই প্রয়োজন), আমি বলবো, এই অভিধান ঠিকঠাক দিশা দেয়। যেমন, ‘উচ্চ’ শব্দ থেকে ‘উচ্চকিত’, ‘উচ্চগ্রাম’, ‘উচ্চণ্ড’, ‘উচ্চতা’, ‘উচ্চবাচ্য’, ‘উচ্চবিদ্যালয়’, ‘উচ্চয়’, ‘উচ্চরোল’, ‘উচ্চহাসি’, ‘উচ্চহাস্য’, ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’, ‘উচ্চাটন’, ‘উচ্চাবাচ’ শব্দগুলো তৈরি হয়েছে। শব্দগুলোর গঠন কিন্তু একভাবে নয়। কোনোটি প্রত্যয়ান্ত, কোনোটি সন্ধিযোগে আবার কোনোটি সমাসদ্বারা নিষ্পন্ন। প্রতিটি শব্দের গঠনগত এই গূঢ়ার্থ জানতে অভিধানটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেয়।
* এই অভিধান বাংলা একাডেমির কিছু নিষ্পত্তিকৃত শব্দের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এটি ভালো। যেমন, ১৯৯৪ সালের বাংলা বানানের নিয়মে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল: ‘খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদির মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে।’ আর কোনো একটি শব্দের জন্য এমন নির্দিষ্ট করে বলা ছিল না। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলা বানান অভিধান’-এও শুধু ‘খ্রিষ্ট’ বানানই ছিল; ‘খ্রিস্ট’ বা ‘খৃস্ট’ অথবা ‘খৃষ্ট’ ছিল না। কিন্তু বাংলা একাডেমি নিজের বিধি নিজেই ভঙ্গ করে ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ নিষ্পত্তি হওয়া বানানটির আগে ও পরে যথাক্রমে ‘খ্রিস্ট’ ও ‘খৃষ্ট’ বানান দুটো যুক্ত করে হাজার হাজার কপি অভিধান বিক্রি করে। এতে খ্রিষ্ট, খ্রিষ্টাব্দ ইত্যাদি বানান নিয়ে বিদ্বৎসমাজ বিভ্রান্ত হন এবং এই বিভ্রান্তি এখনো চলমান। ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ এসব বিভ্রান্তিমূলক ভুক্তি বাতিল করে শুধু ‘খ্রিষ্ট’ ও খ্রিষ্টাব্দ’ শব্দ দুটোই রেখেছে।
* আধাশহর জনপদকে আরবি শব্দ ‘মফঃস্বল’ বা ‘মফস্বল’ লেখা হতো। এই বানান থেকে যুক্তবর্ণ তুলে দিয়ে সরল করা হয়েছে এভাবে: ‘মফস্সল’।
বানানরীতি ও অভিধানে সামঞ্জস্যহীনতা
বাংলা একাডেমির ২০১২ সালের ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ অনুসারে ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ প্রণীত হয়েছে বলে এর ‘মুখবন্ধ’-এ ঘোষণা করা হলেও এ দুয়ের মধ্যে অনেক ব্যত্যয় লক্ষ করা যায়। যেমন:
* বানানের নিয়মের ১.৪ ধারায় সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে বলে ‘হৃদয়ংগম’ দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিধানে ‘হৃদয়ংগম’ না লিখে লেখা হয়েছে ‘হৃদয়ঙ্গম’ এবং এটি দেখানো হয়েছে প্রত্যয় সংযুক্ত শব্দ হিসেবে (হৃদয় + গম্ ধাতু + অ)। ফলে, বানানরীতি পুস্তিকা ও অভিধানে বিরোধ সৃষ্টি হলো।
* বানানের নিয়ম পুস্তিকার ১.৬ ধারায়বলা হয়েছে: দুস্থ, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ, নিশ্বাস ইত্যাদি শব্দে শব্দমধ্যস্থ বিসর্গ-বর্জিতরূপ গৃহীত হবে। কিন্তু ‘আধুনিক অভিধান’-এ লেখা হয়েছে: দুঃস্থ, নিঃস্পৃহ, নিঃশ্বাস- পুস্তিকার শব্দগুলো নয়। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলো!
* বানানের নিয়ম পুস্তিকার ২.৯ ধারায় বলা হয়েছে বিদেশি শব্দের মধ্যবর্তীস্থানে যুক্তবর্ণ পরিহার করতে। দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে: মার্কস, শেকসপিয়র, ইসরাফিল। এই তিনটি বানানের কোথাও হস্চিহ্ন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু ‘আধুনিক বানান অভিধান’-এ ভুক্তি আছে ‘ইস্রাফিল’। এইটি বানানরীতি পুস্তিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
* বানানের নিয়ম পুস্তিকায় বানান প্রমাদ লক্ষ করা যায়। যেমন: ‘নির্দেশিত’ বানান লেখা হয়েছে ‘নিদের্শিত’।
* ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকায় বলা হয়েছে: রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন: ‘ঊর্দ্ধ্ব’, ‘বার্দ্ধক্য’, ‘মূর্চ্ছা’ হবে না। সূত্র হিসেবে ঠিক আছে কিন্তু উদাহরণ কি ঠিক আছে? এখানে কোথাওতো ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব নেই: র্দ্ধ্ব > (দ+ধ+ব); র্দ্ধ > (দ+ধ); র্চ্ছ > (চ+ছ)।
* ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর বড়ো দুর্বলতা হলো, ‘ব্যবহারও চলতে পারে’, ‘লেখা যেতে পারে’ ইত্যাদি লিখে বিকল্প বানানের সুযোগ রাখা। বিকল্প বানান যত কম লেখা হবে, বানান বিভ্রান্তি ততো কমবে।
আধুনিক বাংলা অভিধানের বানান প্রতর্ক
সংস্কৃত ‘গোরূপ’ থেকে পর্যায়ক্রমে ‘গরু’ শব্দটি ( গোরূপ > গোরুপ > গোরু > গরু) বাংলায় এসেছে। ‘আধুনিক বাংলা বানান অভিধান’-এই বানানভুক্তিটি নেই। ফলে ইতোমধ্যে বেশ প্রতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অভিধানে আছে: ‘গোরু’। অনেকেই বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি ‘গোরু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। হ্যাঁ, করেছেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘গরু’ শব্দও ব্যবহার করেছেন। তাঁর শব্দ ব্যবহারেরতো শেষ ছিল না? তিনি গাভী, বৃষ, গাঈ (গাই), ধেনু- নানা শব্দই প্রয়োজনানুসারে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘গরু’ ও ‘গোরু’ বানান ব্যবহারের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক্:
‘গরু’- এই বানানে লেখা:
* ‘ কোন দুটি গরু শব্দ করিতেছে? তোমারই দুটি গরু শব্দ করিতেছে।’ (‘সংস্কৃত শিক্ষা’, দ্বিতীয় ভাগ)
* ‘আমার সাহায্য চায়, ফলফুলুরি দেয় এনে, কারও বা ঘরে গরু আছে দুধ জুগিয়ে থাকে।’ (‘চার অধ্যায়’)
‘গোরু’- এই বানানে লেখা:
* ‘ম চালায় গোরুগাড়ি / ধান নিয়ে যায় বাড়ি’। (প্রথম ভাগ: ‘সহজ পাঠ’)
* ‘অভ্যাসের মেঠো পথ দিয়া গাড়ির গোরু আপনি চলে, গাড়োয়ন ঘুমাইয়া পড়িলেও ক্ষতি হয় না।’ (ভাষার কথা: ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’)
এখানে দুটো করে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। একটি শিশুপাঠ্য গ্রন্থ থেকে অন্যটি বড়োদের জন্য রচনা থেকে। লক্ষ করার বিষয়, ‘সংস্কৃত শিক্ষা’ বইতেও রবীন্দ্রনাথ ‘গরু’ বানান লিখছেন, নির্ভেজাল সংস্কৃত শব্দ নির্বাচন করেননি। তাঁর পূর্ববর্তীলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও ‘গরু’ ও ‘গোরু’ উভয় শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন:
‘গরু’ শব্দের ব্যবহার-
* ‘‘বুড়া বলিল, ‘এই বাড়ীতে গোহাল আছে- গোহালে গরু আছে।’’ (‘ দেবী চৌধুরাণী’)
* ‘‘মৃ। তুমি কি ব্রাহ্মণকে দংশন করিয়াছিলে?
গি। তা ক্ষতি কি? বামুন বৈ ত গরু নয়?’’(‘মৃণালিনী’)
‘গোরু’ শব্দের ব্যবহার-
* ‘তোমার পাগলামি রাখ- তুমি এই গোরু চিনিতে পারিতেছ কিসে?’ (‘কমলাকান্তের দপ্তর’)
* ‘রামধনের গোরু মরিয়াছিল- দুধ কিনিবার সাধ্য নাই।’ (‘বিবিধ প্রবন্ধ’)
অতএব, বাংলা শব্দ ‘গরু’ ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ভুক্তি হিসেবে থাকবে না কেন? বিশেষ করে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ যেখানে হিন্দি ভাষায় ‘গোরু’ শব্দের ব্যবহারকে চিহ্নিত করেছেন, সেখানে বাংলা একাডেমির অভিধানে ‘গোরু’ পর্যন্ত থেমে যাওয়া উচিত হয়নি; বাঙালির বহু পরিচিত ও ব্যবহৃত শব্দ ‘গরু’ উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল।
* ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ‘ওষ্ঠ্য’ ও ‘ঔষ্ঠ্য’ শব্দ দুটোর গঠন ও অর্থ একই দেওয়া হয়েছে। [স. ওষ্ঠ + য] যদি ‘ওষ্ঠ্য’ হয়, একই গঠন তাহলে ‘ঔষ্ঠ্য’ হবে কেন? এখানে সম্পাদক মূল বিষয়টি বাদ রেখে যাওয়ায় জিজ্ঞাসার পাহাড় জমেছে। আসলে ‘ওষ্ঠ্য’ হলো ওষ্ঠ সম্বন্ধীয় (এখানে ‘য’ সম্বন্ধ অর্থে) ধ্বনি আর ‘ঔষ্ঠ্য’ হলো ওষ্ঠ জাত (এখানে ‘য’ জাত অর্থে) ধ্বনি। এই সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু স্পষ্ট না করে শব্দ দুটোর ব্যুৎপত্তি ও অর্থ একই দেখানো হয়েছে। এতে গোল বাঁধে।
* বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানবিধিতে (২.১ ধারা) উল্লেখ আছে, সব বিদেশি শব্দে ই বা ই-কার ব্যবহৃত হবে। কিন্তু ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ আছে কম্পিউটার, পিয়ানো প্রভৃতি চালানোর বোতাম: ‘কী-বোর্ড’। প্রশ্ন হলো, এখানে ঈ-কার কেন? এটি ইংরেজি শব্দ এবং এর বানান Keyboard হলে বাংলা একাডেমির নিয়মানুসারেই হবে: ‘কি-বোর্ড’।
* প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে (১.৬ ধারা) বলা হয়েছে, শব্দের শেষে বিসর্গ থাকবে না। কিন্তু ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ অন্ত্যে বিসর্গযুক্ত শব্দভুক্তি দেওয়া হয়েছে। যেমন: নভঃ (আকাশ, গগণ, শূন্য, স্বর্গ, মেঘ, জল); পয়ঃ (পানি); সরঃ (বড়ো পুকুর); ওজঃ (তেজ); উচ্চৈঃ (তীব্রভাবে) ইত্যাদি। অথচ, লেখা হয়েছে: পুনঃপুন(‘পুনঃপুনঃ’ নয়)।
* তাল বা নারকেল গাছের কি ডাল হয়? ‘বাখড়’ অর্থে লেখা হয়েছে ‘ডাল’।
* চরিত্রহীন বা লম্পট অর্থে ‘লোচ্চা’ বা ‘লুচ্চা’ এক জায়গায় (পৃ. ১২০৭) লেখা হলো হিন্দি, অপর জায়গায় (পৃ. ১২১২) লেখা হলো পারসি শব্দ!
* কাঞ্চনবর্ণা অর্থে ভুক্তি দেওয়া হয়েছে ‘হেমাঙ্গিনি’। কিন্তু শব্দটি গঠিত এইভাবে: [স. হেমাঙ্গ+ইন+ঈ]। গঠনের সঙ্গে মিলছে না- হবে, ‘হেমাঙ্গিনী’।
* বিভ্রান্তির একশেষ! ‘উভলিঙ্গ’ ঠিক নাকি ‘উভয়লিঙ্গ’? ‘উভচর’ নাকি ‘উভয়চর’? দুটোই ঠিক। কিন্তু কেন? এর ইঙ্গিত থাকা প্রয়োজন ছিল। উল্লেখ্য, বিদ্যাসাগরের প্রবর্তিত শব্দ ‘উভয়’ অর্থে ‘উভ’।
* ‘একনিশ্বাস’ (পৃ. ২৩০) কিন্তু ‘নিঃশ্বাস’ (পৃ. ৭৩১) কেন? প্রমিত বাংলা বানানরীতির ১.৬ ধারায় কিন্তু লিখতে বলেছে বিসর্গহীন।
* বাংলায় ‘পাস’ বলে কোনো শব্দ রাখা হয়নি। এখন সবই ‘পাশ’ লিখতে বলেছে ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’। আগে ইংরেজি ‘Pass’ বলতে ‘পাস’ লেখা হতো। এখন লিখতে হবে ‘পাশ’। ‘পাশ’ অর্থে পার্শ্ব, গোছা, পাত্রবিশেষ, সাফল্য- সবই বোঝাবে। কিন্তু ‘Passport’ লিখতে হবে ‘পাসপোর্ট’ বানানে। ‘Pass’ এক জায়গায় ‘শ’ অন্য জায়গায় ‘স’ কেন?
* ‘ছোট’ ও ‘বড়’ বানান দুটো পাল্টে এই অভিধানে করা হয়েছে ‘ছোটো’ ও ‘বড়ো’। কেন করা হলো? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে অনেকেই ছোট, ছোটো এবং বড়, বড়ো দু ধরনের বানানই লিখেছেন। এখানে উদাহরণ দিই ‘ছোট’ ও ‘বড়’ শব্দ ব্যবহারের নিরিখে। যেমন:
* মাথায় ছোট বড় কসাইসকল ছুরি হাতে গোরু কাটিতেছে। (‘কমলাকান্তের দপ্তর’ : বঙ্কিমচন্দ্র)
* তখন সমুদ্রে যদি না যাইতে পারে, বড় মাছ হইলে শীঘ্র মরে, ছোট মাছ হইলে কিচু দিন মাত্র টিঁকিয়া থাকে। (‘বাউলের গান’: রবীন্দ্রনাথ)
এ দুজন ছাড়াও ‘ছোট’ ও ‘বড়’ বানানে শব্দদ্বয় ব্যবহারের লেখক-সংখ্যা বাংলা ভাষায় অনেক বেশি। তাহলে শব্দ দুটো পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ল কেন? প্রকৃতপক্ষে ‘ক্ষুদ্র’ শব্দের অপভ্রংশ থেকে ‘ছোটো’ এবং ‘বৃদ্ধ’ শব্দের অপভ্রংশ থেকে ‘বড়ো’ শব্দদ্বয়ের সৃষ্টি। এগুলো মূলত বিশেষণ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন, ‘এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, খাঁটি বাংলায় দুই অক্ষরের অধিকাংশ বিশেষণ শব্দ হলন্ত নহে। প্রথমেই মনে হয়, বিশেষণ শব্দ বিশেষরূপে অকারন্ত উচ্চারিত হইবে, এ নিয়মের কোনো সার্থকতা নাই। অতএব ছোট, বড়, ভাল বিশেষণ শব্দ যে সাধারণ বাংলা শব্দের ন্যায় হসন্ত হয় নাই, তাহার কারণটা ঐ শব্দগুলির মূল সংস্কৃত শব্দে পাওয়া যাইবে।’ (বীম্সের বাংলা ব্যাকরণ) রবীন্দ্রনাথ বিশেষণের বিশেষত্বকে গুরুত্ব দিয়েও নিজে ‘ছোট’ বা ‘বড়’ বানান লিখতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। বঙ্কিমচন্দ্রও লিখেছেন। এই পথের অনুসরণ ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ থাকা বাঞ্ছনীয়।
বাংলা নাকি বাঙলা
বলা যায়, বাংলা একাডেমি নিজেই নিজের নিয়ম মানে না। ‘বাঙলা উচ্চারণ অভিধান’ নামে নরেন বিশ্বাসের একটি অভিধান বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়ে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সেই বইয়ের ‘বাঙলা’সহ আরও দুএকটি ক্ষেত্রে ‘বাঙলা’ বানান দেখা যায়। ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর ২.৪ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে: ‘বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দে অনুস্বার থাকবে।’ নিজের করা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলা একাডেমি ‘বাঙলা’ নামে বই প্রকাশ করলে বিভ্রান্তি ছড়ায় না-কি?
অভিধানের শব্দ ও সাহিত্যের শব্দ
অভিধানের শব্দ দেখে শোরগোল করার কারণ নেই। অভিধান হলো শব্দের ঠিকুজিঘর। এখানে শব্দের আদ্যন্ত, ব্যুৎপত্তি, অর্থবৈচিত্র্য, অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবর্তনের রূপরেখা ইত্যাদি সহজে পাওয়া যাবে। সাহিত্যে স্বভাবতই থাকবে নতুন শব্দ, সৃষ্ট শব্দও। সময় ও সমাজ সেই শব্দরাজির যেগুলো গ্রহণ করবে, অভিধানে ঠাঁই পাবে সেগুলো। আমাদের দেশে একটি ‘সাহিত্য একাডেমি’ স্থাপিত হওয়া খুবই দরকার। এমনটি হলে বাংলা একাডেমির উপর চাপ বোধকরি কমে। তা না-হলে প্রত্যাশার চাপেও মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটে। এই অভিধানের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়েছে বলেই মনে করি। যে দৃষ্টান্তগুলো দেওয়া হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে এর চেয়ে অনেক দৃষ্টান্ত অনুল্লিখিত থাকল। আশাকরি, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’টি নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় সংস্করণের জন্য একটি স্থায়ী ‘সেল’ গঠন করবেন।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম