বঙ্গবন্ধুর নজরুল
সৌমিত্র শেখর || রাইজিংবিডি.কম
২৪ মে, ১৯৭২ ঢাকায় ‘কবি ভবনে’ বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে পুষ্পমাল্যে বরণ করছেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম- বয়সে বঙ্গবন্ধু নজরুলের চেয়ে একুশ বছরের ছোট ছিলেন। বয়সের এই ব্যবধান সত্ত্বেও দুই বাঙালির চিন্তায় ছিল বাঙালির স্বাধীনতা এবং সর্বস্তরের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মিল। যে কারণে বলা চলে, কাজী নজরুল ইসলাম যা চিন্তা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে চিন্তার ধারাবাহিকতা এনেছেন আর বাঙালিকে যথাযোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। সে-সূত্রেই বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আদর্শিক ধ্রুব তারার মতো।
কাজী নজরুলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কবে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল, এ ব্যাপারে কোনো প্রামাণিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। কাজী নজরুল ইসলাম ফরিদপুরে প্রথম যান ১৯২৫ সালের ১ মে। এরপর ১৯২৬, ১৯৩৬, ১৯৩৮ সালে নজরুল ফরিদপুরে গিয়েছেন। এর কারণ ছিল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আবার রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রদের নজরুল-সংবর্ধনায় যোগদান। শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান করেননি। ১৯৪০ সালে বঙ্গবন্ধু নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। এ কারণে নজরুলের এ সব সভায় কিশোর শেখ মুজিবের উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা কম। তবে তাঁর বাড়িতে যেহেতু ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘আজাদ’ পত্রিকা রাখা হতো সেহেতু কাজী নজরুল ইসলামের রচনা ও তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য ও পরিচয় কিশোর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু পেয়ে থাকবেন। ১৯৪১ সালের কোনো একদিন কাজী নজরুলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। সে সাক্ষাৎটি হয়েছিল ফরিদপুরে; ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষ্যে। ঐ সম্মেলনে কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁর মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সরকারের ১৪৪ ধারা জারির কারণে প্রকাশ্যসভা হতে পারেনি। কিন্তু ঘরোয়া সভায় কাজী নজরুল ইসলাম গান শুনিয়েছিলেন; শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্পর্কে বক্তব্যও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন: ‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যে হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।’
কাজী নজরুলের সেই বক্তৃতা ও গানে অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুও ছাত্রাবস্থায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন নিশ্চয়। তা না হলে এই স্মৃতি তাঁর আত্মজীবনীতে ঠাঁই পাবে কেন? নজরুল এর আগেই পূর্ব বাংলার তরুণদের কাছে আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। যে কারণে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে বারবার পূর্ব বাংলায় এসেছেন। ১৯১৪ সালে, পনেরো বছর বয়সে তিনি প্রথম পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন এবং সেটি ময়মনসিংহের দরিরামপুরে। এরপর তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ আরো কিছু জায়গায় একাধিকবার এসেছেন। এসব জায়গায় তিনি লিখিত ও তাৎক্ষণিক অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন এবং যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই বক্তৃতার অনেকগুলোই এখন পাওয়া যায় না, সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালে নজরুল চট্টগ্রামের বুলবুল সোসাইটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভয়ে-নির্ভীক, আনন্দে-শান্ত তারুণ্যই তিনি কামনা করেন।’
একই বছর চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি- শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটও ভাঙছে- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে।’
১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে নজরুল বলেছিলেন, ‘ধর্মের পরিচয়ে নয়, কর্মের পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যৌবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’ ১৯৩৩ সালে ফরিদপুর মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে বলেন, ‘শত বিধি-নিষেধের অনাচারের শিকলে বন্দিনী এই পৃথিবী মুক্তির আশায় ফরিয়াদ করছে যুবকদের প্রাণের দরবারে। মুক্তিকামী পৃথিবীর সেই আর্জি কি বিফল হবে?’
এভাবেই প্রতি বক্তৃতায় যৌবশক্তিকে, বিশেষ করে মুসলিম যুবসমাজকে কাজী নজরুল ইসলাম ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গে আহ্বান জানিয়েছেন। পূর্ব বাংলা ছাড়াও, কলকাতা বা পশ্চিম বাংলার নানা সভাতে নজরুল ইসলাম যে বক্তৃতা দিতেন তা তরুণদের কাছে ছিল আকর্ষণীয়। দুর্ভাগ্য, কাজী নজরুলের সঙ্গে একই সভায় পরিণত শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ সম্ভবপর হয়নি। কারণ, ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি গোপালগঞ্জ থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতার ওয়েলেসলি পাড়ার ‘ইসলামিয়া কলেজে’ যুবক শেখ মুজিবুর রহমান যখন ভর্তি হন, তার কিছু দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে নজরুল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। নজরুল যদি সে সময় ব্যাধিগ্রস্ত না হয়ে পড়তেন, তাহলে নজরুল ও শেখ মুজিবুর রহমানের কর্ম ও পরিচয়ের একটি চমৎকার যুগলবন্দি হয়তো বাঙালির সামনে ইতিহাস হয়ে থাকতো। তারপরও বলতে হয়, নজরুলের সৃষ্টি, কর্ম ও আদর্শ শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম থেকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই নজরুলের কবিতা ছিল বঙ্গবন্ধুর মুখস্থ।
১৯৫৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু করেছেন, যেখানে তিনি নজরুলের একাধিক কবিতা মুখস্থ বলেছেন বলে জানা যায়। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে করাচিমুখো যাত্রাকালে মোটরগাড়িতে কয়েকজন পাকিস্তানি আইনজীবীকে বঙ্গবন্ধু নজরুলের ‘চোর-ডাকাত’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ কবিতা মুখস্থ শুনিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার কাছে তাঁরা [পাকিস্তানি আইনজীবীরা] নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’- আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম।’
লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার, বঙ্গবন্ধু নজরুলের যে কবিতাগুলো মুখস্থ আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন সেগুলো আপাত-তিরস্কৃত চোর-ডাকাতসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ ও অধিকারের কথা বলা হয়েছে; নারীর সমানাধিকারের উল্লেখ আছে, আর জগতে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। নজরুলের আধ্যাত্মিক বা প্রেমপর্যায়ের কোনো কবিতা কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেদিন শোনাননি। অর্থাৎ নজরুলের বিদ্রোহসত্তা, সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতী মনোভাব, নারী-অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার অবস্থান ও সমাজের সর্বস্তরে সমতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুকে আকৃষ্টই শুধু করেনি, এটি তিনি মনে মনে ধারণ করেছিলেন। তাই, স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিতেই উল্লিখিত বিষয়গুলোকে তিনি স্থান দিয়েছিলেন। বলাই চলে, বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় ছিল নজরুলের আদর্শ, রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে আসামাত্র তিনি তা প্রয়োগের উদ্যোগ নেন।
১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন করাচিতে, তখন ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে (১৫০ মোগলটুলি) ২৩শে মে ‘নজরুল দিবস’ পালনের আয়োজন করে। এই আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রবন্ধ উপস্থাপনের কথা ছিল। তিনি করাচিতে থাকায় তা পাঠ করেন ছাত্রনেতা মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। ‘ইত্তেফাক’-এ সংবাদ বের হয়েছিল এভাবে: ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান করাচিতে থাকায় তাঁর প্রেরিত প্রবন্ধ পাঠ করেন মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে নজরুলের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্রোহী জীবনযাত্রার এক নিখুঁত আলোচনারূপে প্রতিপন্ন হয়। প্রবন্ধের উপসংহারে বর্তমান শোণিতলোলুপ জগতের অত্যাচার ও অবিচারের বন্যা রোধের জন্য কবির বৈপ্লবিক জীবনাদর্শ ছাত্র, যুবক ও জনগণের কতখানি প্রয়োজন আছে তাহাই অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়।’
বঙ্গবন্ধুর এই প্রবন্ধটি আজ আর পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে কাজী নজরুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশটি স্পষ্টতর হতো। ১৯৫৪ সালে একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এই সাক্ষাৎ একেবারেই হৃদয়ের টানে। নজরুলকে তিনি মন দিয়ে উপলব্ধি করতেন বলেই এই সাক্ষাৎ তিনি করেছিলেন। কলকাতার তৎকালীন পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের কর্মকর্তা আসাদুল হক লিখেছেন, যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কাজে কলকাতায় গিয়ে কাজী নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ডেপুটি হাইকমিশনার তাঁর প্রেস-এটাচির সঙ্গে আসাদুল হককেও পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে কাজী নজরুলের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। তখন কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন টালা পার্কের পাশে মন্মথ দত্ত রোডের দোতলা ফ্ল্যাটে। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ও মিষ্টির প্যাকেটসহ বঙ্গবন্ধু সেবার কবির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশেষভাবে অনুরক্ত। এই অনুরাগের পেছনে ছিল আদর্শিক ঐক্য, চিন্তার একতা।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বীজমন্ত্র ছিল ‘জয় বাংলা’। এর আগেও অবশ্য শোনা গেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই বীজমন্ত্রটি ৭ই মার্চের তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে গগণবিদারী উচ্চস্বরে বাঙালির সামনে ঘোষণা করেন। এর পর থেকে ‘জয় বাংলা’ হয়ে ওঠে বাঙালির পরিচয়ের অপর নাম। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপন করলে তাঁর ওপর যে দমন-পীড়ন নেমে আসে তাতেও ভীত হননি এই অবিসংবাদিত নেতা। এরপর নানা সময় পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে জেলে নিয়েছে, মৃত্যুর ভয় দেখিয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পাকিস্তানিদের উদ্দেশে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ মৃত্যুর ভয় তিনি করেন না।
অসুস্থ কবির শয্যাপাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাঙালি বলে যে গর্ব, বাংলার জয় নিয়ে যে গগণবিদারী উচ্চকণ্ঠ হওয়া, এটি কাজী নজরুলের মধ্যেও ছিল। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ‘বাঙালির বাঙলা’য় ব্রিটিশশাসিত অবিভক্ত ভারতের মাটিতে নজরুল গর্ব প্রকাশ করেছেন নিজে বাঙালি বলে; বলেছেন: ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও: এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির- আমাদের।’ সব শেষে তিনি উচ্চারণ করেছেন: ‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’
ঠিক এই উচ্চারণই যেন বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ভেসে এসেছে ‘জয় বাংলা’ হয়ে। বঙ্গবন্ধুও আদর্শ ও ভাবনায় কাজী নজরুল ইসলাম না থাকলে তাঁদের বচন ও আচরণে এমন মিল হতো না। তখনো মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়নি- ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে খণ্ডিত করে উপস্থাপনের পাকিস্তান সরকারের অপপ্রয়াসের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয় কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানী করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিলো?’
উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় ইসলামি শব্দ অনুপ্রবেশ করিয়ে তাঁকে ‘খাঁটি মুসলমান’ কবি বানাবার একটি অপচেষ্টা পাকিস্তান আমলে চালানো হয়েছিল। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তারই প্রতিবাদ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে অন্তরীণ রেখে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি করা যাবে। কিন্তু যে জাদুকরী নেতৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর, কারান্তরালে থাকলেও তাঁর আদর্শিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাই বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবি নজরুলের কবিতা ও গান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সহায় হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করা হয় নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’সহ একাধিক গান। স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘চরমপত্র’খ্যাত এম আর আখতার মুকুল লিখেছেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়তই প্রচারিত হলো নজরুলের বিখ্যাত গানগুলো। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি।’
পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে কাজী নজরুল ইসলামের নামে ভাতা বন্ধ করে দেয়, যা ছিল চরম অমানবিক। সে সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে নজরুল ইসলামকে সমহারে ভাতা প্রদান করা অব্যাহত রাখা হয়- যা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক শিক্ষার প্রতিফল। এরপর দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, রণসঙ্গীত নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ সময়ই কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’ গানটিকে রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করে বলা হয়- তাঁর ভাতা অব্যাহত রাখা হবে এবং প্রয়োজনে ঢাকায় এনে চিকিৎসা ও শুশ্রুষার ব্যবস্থা করা হবে। নজরুলকে ঢাকায় আনার উদ্যোগটি কিন্তু বঙ্গবন্ধু মূলত তখন থেকেই।
১৯৭২-এর মধ্য-জানুয়ারিতে এই সিদ্ধান্তের পর মাত্র চার মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এখানে ‘সক্ষম’ শব্দটির ব্যবহার করা হলো এ কারণে যে, কাজটি খুব সহজ ছিল না এবং বঙ্গবন্ধু না হলে নজরুলকে ঢাকায় আনা বোধকরি সম্ভবপরও হতো না। কারণ, কাজী নজরুল ইসলাম তখন ছিলেন সম্পূর্ণ বাকরহিত অসুস্থ ব্যক্তি; তাঁর কোনো পাসপোর্ট ছিল না; তিনি ঢাকায় এসে কোথায় ও কীভাবে থাকবেন সেটি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি আলোচনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব দেন, ১৯৭২-এর নজরুল জয়ন্তীতে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ অনুসারে ২৫ মে, ১৯৭২) কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি বাংলাদেশে চান। ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে বঙ্গবন্ধু বিশেষ দূত হিসেবে পূর্তমন্ত্রী মতিউর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তাফা সারওয়ারকে ভারতে পাঠান। তাঁদের হাতে ‘হে কবি’ সম্বোধন করে একটি পত্রও প্রেরণ করেন। সেই পত্রটি পাওয়া গেলে সেখানে নজরুলকে বঙ্গবন্ধু কী লিখেছিলেন, তা জানা যেত। সে সময় দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. এ. আর. মল্লিক। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিঙের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালনে তৎপর হন। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের কথা শুনে সানন্দে সহযোগিতা ও অনুমোদনের হাত বাড়িয়ে দেন। আর সে কারণেই মাত্র দুদিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় আনা সম্ভবপর হয়। সেই মাহেন্দ্র দিবসটি ছিল ১৯৭২ সালের ২৪ মে।
কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাগত জানাতে এতো লোক বিমানবন্দরে সমাগত হবে, তা আগে ভাবা যায়নি। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন: ‘বিপুল জনসমাবেশের কারণে নজরুলকে বিমানের পেছন দিকের দরজা দিয়ে বের করে একটি এম্বুলেন্সে তুলে অন্য পথে ধানমন্ডিতে আনা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৮ নম্বর সড়কের (পুরাতন) ৩৩০-বি সরকারি দোতলা বাড়িটি আগেই সাজানো হয়েছিল এবং সেই বাড়িতেই কলকাতা থেকে আগত কাজী নজরুল ইসলাম, সঙ্গে আসা সস্ত্রীক দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ আর কবির দুই পৌত্রী খিলখির কাজী ও মিষ্টি কাজী ওঠেন। নজরুল এ বাড়িতে পৌঁছার পরই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক এক হাজার টাকা ভাতা প্রদান ও কবির চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের ঘোষণা দেন। ধানমন্ডির এই বাড়িটির ‘কবি ভাবন’ নামটি বঙ্গবন্ধুরই দেয়া। তাঁরই অভিপ্রায় অনুসারে কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয় এবং কবি ভবনে প্রতি দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পর দিন ২৫ মে প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু আবার কবি ভবনে যান এবং কবিকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। ধানমন্ডির ‘কবি ভবন’ নামের এই বাড়িই পরে ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’, আরো পরে ‘কবি নজরুল ইন্সটিটিউট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে- যে প্রতিষ্ঠানটি নজরুলকেন্দ্রিক গবেষণায় রত।
নজরুলের সাহিত্য ও এর উপযোগিতা নিয়ে আগের মতোই উচ্চধারণা পোষণ করতেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নি-মন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা- আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প। শুধু বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, শান্তি ও প্রেমের নিকুঞ্জেও কবি বাংলার অমৃতকণ্ঠ বুলবুল। দুঃখের বিষয়, বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনো আলোচনাই হলো না। বাংলার নিভৃত অঞ্চলে কবির বিস্মৃত-প্রায় যে-সব অমূল্য রত্ন ছড়িয়ে আছে তার পুনরুদ্ধারের যে কোন প্রচেষ্টাই প্রশংসার যোগ্য।’
‘বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনো আলোচনাই হলো না’- নজরুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এই পর্যবেক্ষণ সে দিন পর্যন্ত ঠিক ছিল। আর তাই বঙ্গবন্ধু নজরুলের চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যগবেষণা ও তাঁকে সম্মাননার ব্যাপারটিতে জোর দেন। স্বাধীন দেশের নানা ধরনের সংকটের মধ্যেও সরকারি অর্থায়নে বাংলা একাডেমি থেকে নজরুল-রচনাবলি প্রকাশ অব্যাহত থাকে। নজরুলকে নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু সাদরে অনুমোদন করেন। ১৯৭৪ সালের শহিদ দিবস স্মরণে ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির সভায় নজরুল প্রধান অতিথির আসনে মঞ্চে বসেন। বাংলা একাডেমিতে নজরুলের কোনো অনুষ্ঠানে আগমন ও অংশগ্রহণের এটিই একমাত্র দৃষ্টান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বরের সমাবর্তনে নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট. ডিগ্রিপ্রদান করে এবং সেই ডিগ্রি ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গভবনে বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠান করে নজরুলের হাতে তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মাহমুদ উল্লাহ। নজরুলকে এই সম্মান প্রদান করে জাতি হিসেবে বাঙালি গর্বিতই হয়েছে। আর এই সিদ্ধান্ত যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুমোদিত, তা বলাই বাহুল্য। জুলাই মাসে কবি নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডা. মেজর এ চৌধুরী নজরুলকে কবি ভবনে দেখতে যান। তাঁরই পরামর্শে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের জন্য তৎকালীন পিজি হাসপাতাল, আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কবি নজরুলকে নিয়ে এসে ১১৭ নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়। প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলতে থাকে- বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।
এরই মধ্যে ঘটে ১৯৭৫-এর সর্বনাশা ১৫ আগস্ট! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মীয়-পরিজনসহ শাহদাত বরণ করেন। এ কারণে নজরুলের চিকিৎসায় পড়ে ঘাটতি আর অমনোযোগ। যে কারণে হাসপাতাল থেকে কবিভবনে আর ফেরা হয়নি নজরুলের। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩) তিনি লোকান্তরিত হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে এবং নজরুলের মৃত্যুর আগে অসুস্থ নজরুলের উপর চলে বেশ জবরদস্তিও। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এ প্রসঙ্গে লেখেন: ‘আমার [গাফ্ফার চৌধুরী] মনে পড়ে, জিয়াউর রহমানের আমলে কবি নজরুল ইসলামের (তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন) জন্মদিনের অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখানো হয়েছিল, অপ্রকৃতিস্থ কবির মাথায় টুপি পরানো হচ্ছে। তথাকথিত ধর্মীয় কালচারের এই প্রহসনটি এখন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র ব্যাপ্তিলাভ করেছে।’
বঙ্গবন্ধু নজরুল-চারিত্র্যের সার্বিকতা রক্ষায় ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, তাঁর ভাবনায় সদাজাগ্রত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের দর্শনও। দর্শনের ঐক্য থাকায় ১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধুহত্যা হলে পরের বছর আগস্টে অভিমান করেই হয়তো চিরতরে দূরে চলে যান বাঙালির চির বিদ্রোহী, চির অভিমানী কবি কাজী নজরুল ইসলাম! দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও এই দুই মহাত্মার অজর-অমর-অক্ষয় আদর্শের সত্যি মৃত্যু নেই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা/তারা