ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

পুতুল: লোকায়ত বাংলার মূল্যবান শিল্প

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৫, ১০ জানুয়ারি ২০২১  
পুতুল: লোকায়ত বাংলার মূল্যবান শিল্প

আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই পুতুল রয়েছে। বাংলাদেশেও পুতুল একটি অত্যন্ত মূল্যবান শিল্প। বলা যায়, লোকায়ত বাংলার লোকজীবনের এক বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে পুতুল।

পুতুল কী? এ সম্পর্কে সামান্য দৃষ্টি দেওয়া যাক। বলা হয়, ল্যাটিন  Pupa (Pupa/Doll)  থেকে Puppet শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ পুতুল। এই পাপেট বা পুতুল হলো একটি সুস্পষ্ট অঙ্গবিশিষ্ট পুতুল, যাকে বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বেশির ভাগ পুতুলই মানুষ বা জীবজন্তুর আদলে গড়া। অনেক সময়, পুতুলগুলো বাস্তব কোনো জড়বস্তু বা বিমূর্ত কোনো ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করে। একটি পুতুল পূর্ণ আকৃতির হলেও মানুষ বা পুতুল নিয়ন্ত্রকের তুলনায় এরা ক্ষুদ্র। অর্থাৎ ‘সাধারণ অর্থে ক্ষুদ্রায়তন মূর্তিকেই আমরা পুতুল বলি’।

এই যে ক্ষুদ্র মূর্তি ‘পুতুল’- এই পুতুলের জন্ম আদিম গুহা মানুষের হাতে। শত্রুকে তাড়ানো, বুনো জন্তুকে পোষ মানিয়ে আপন করে নেওয়া, প্রাকৃতিক বাধা-বিপত্তি থেকে রক্ষা পাওয়া, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ইচ্ছাপূরণ- এসব কিছু জড়িয়ে আছে আমাদের বড্ড কাছের জিনিস পুতুলের মধ্যে। আরও বলা হয়, ‘প্রকৃতিকে পূজা মানে প্রকৃতির এক একটি বস্তুকে পূজা। গাছ, পাথর, বন্য জন্তু- এক একটি প্রতীক হয়ে দেখা দিলো আদিম মানুষের মনে। প্রকৃতিরই উপাদানে মানুষ কালক্রমে তাদের রূপ দিলো। প্রতীকী সেসব ছোট মূর্তিই মানুষের হাতে গড়া প্রথম পুতুল।’ তাই ‘পুতুল’ হলো মানুষের হাতে গড়া ক্ষুদ্র মূর্তি, যাকে তৈরি করে একদিন আদিম মানুষ প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচার জন্য পূজা করত, সেই পুতুলের অস্তিত্ব এখন পৃথিবীর সব জায়গাতেই রয়েছে।

মনে করা হয়, ‘ক্যাথলিক খ্রিষ্টান দেশে শিশু ‘ঈশ্বর’ (যিশুর) মূর্তি ছোটদের খেলার পুতুলরূপে প্রচলিত ছিল। ১৫শ শতাব্দী হইতে বিভিন্ন নমুনার ফ্যাশন পুতুল (Fashion doll)- এর বিনিময়ের মাধ্যমে পোশাক-পরিচ্ছদ গঠন-রীতি দেশে দেশে ছড়াইয়া পড়ে। সম্ভবত প্রাচীনকালের মিশর, গ্রিস এবং রোমের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুতুল খেলার প্রচলন ছিল। ১৭শ শতকে ইউরোপে সাধারণভাবে পুতুলের ব্যবহার আরম্ভ হয়। পাকিস্তান ও ভারতের মহেঞ্জোদারো ও অন্যান্য স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য দ্বারা এই তথ্য উদঘাটিত হইয়াছে। অতীতকালে দুনিয়ার এই অংশেও পুতুল সুবিদিত ছিল।’

অন্য একজন পণ্ডিতের মতে, ‘ভারতে পুতুল নির্মাণের শিল্পটি অতি পুরাতন। উত্তর-পশ্চিমে বেলুচিস্থান এবং মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য মাটির তৈয়ারি পুতুল পাওয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে তমলুক বাঁকুড়ার পোখরানা (প্রাচীন পুষ্করনা) প্রভৃতি স্থানেও অনেক প্রাচীন পুতুল পাওয়া যায়। দিনাজপুরের বানগড় ও চব্বিশ পরগনার চন্দ্র কেতুগড় অঞ্চলেও খননকার্যের সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ অনেক পুতুল পাইয়াছেন।’

এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশে পুতুল তৈরির শুরু বহু বহু বছর আগে অর্থাৎ অতি প্রাচীনকালে। প্রাচীনকালে যে পুতুল তৈরি হতো তা সামাজিক নানা বিবর্তনের সাথে তাল রেখে যুগে যুগে পুতুল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন পুতুলের উপকরণে গঠনশৈলীতে, এমনকি আকৃতি-প্রকৃতিতেও ঘটেছে। এ ছাড়া বিগত প্রায় এক শতকে পুতুল গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের ফলেও এই শিল্পে পরিবর্তন হয়েছে।

সারা পৃথিবীর দেশে দেশে নানা ধরনের পুতুল পাওয়া যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বহু রকম পুতুল রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ছয় ধরনের পুতুল দেখা যায়। যেমন- ক্ষুদ্রায়তন দেবমূর্তি, মনুষ্য মূর্তি, পশু মূর্তি, যো-পুতুল, নাচিয়ে পুতুল ও গৃহসজ্জার পুতুল।

বাংলাদেশেও বহু রকমের পুতুল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো এখানেও বিভিন্ন দেব-দেবী যেমন-রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-মহাদেব। পশুপাখি যেমন- হাতি-ঘোড়া, বাঘ-হরিণ, হাঁস-টিয়া-কবুতর। মানুষ যেমন:  মা ও শিশু, তৈরি হয় পুতুলনাচের কাহিনি ও চরিত্রকে কেন্দ্র করে এ ছাড়া গৃহসজ্জারও নানা রকমের পুতুল রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও নানা রকম পুতুল তৈরি করে থাকেন।

বাংলাদেশে পুতুল নির্মাণের উপকরণ হিসেবে মাটিই প্রধান। পোড়ামাটির বিভিন্ন ধরনের পুতুল বাংলাদেশের পুতুলশিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে। এ ছাড়া কাঠের পুতুল, পিতল বা ধাতুর পুতুল, কাপড়ের পুতুল, শোলার পুতুল, কাগজের পুতুল, ঘাসের পুতুল, গোবরের পুতুল, পাথরের পুতুল, পিটলির পুতুল, সরের পুতুল, ননীর পুতুল ইত্যাদি পুতুলের প্রচলন রয়েছে। আজকাল বিভিন্ন কারখানায় প্লাস্টিক, সেলুলয়েড, চীনামাটি ও কাচের নানা শ্রেণির  পুতুলও তৈরি হতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে মাটির পুতুলই সবচেয়ে আদিমতম পুতুল। কবে, কখন, কীভাবে মাটির পুতুল তৈরি হয়েছে সেটা জানা না গেলেও, নদীমাতৃক এ দেশের মৃৎশিল্পীরা সহজলভ্য ও উপযুক্ত মাটি ব্যবহার করেই পুতুলশিল্পের সূচনা করেন। আর মাটির পুতুল তৈরি শিল্পীরা মূলত পাল, মালাকার, প্রভৃতি বংশভুক্ত। শত শত বছর ধরে উল্লিখিত শ্রেণিভুক্ত মৃৎশিল্পীরা বাংলাদেশের এই প্রধানতম লোকশিল্প ‘পুতুল’ তৈরি করে মানুষের আনন্দ ও চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই মাটির পুতুল পাওয়া যায়। তবে ঢাকা, রাজশাহী, ফরিদপুর, খুলনা, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, জামালপুর, রংপুর ও বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে পোড়ামাটির পুতুল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। মাটির পুতুল হাত অথবা ছাঁচের মাধ্যমে তৈরি করেন শিল্পীরা। কাঠের পুতুল ছুতার বা সূত্রধররা বাটালির সাহায্যে চেঁচে চেঁচে তৈরি করেন। আর অন্যান্য উপকরণ যেমন শোলা, কাপড়, কাগজ, ধাতব ইত্যাদি দিয়েও শিল্পীরা নানা কায়দা, কারুকাজ ও কখনো রঙের ব্যবহার করে চমৎকার চমৎকার পুতুল তৈরি করেন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মেলা, পূজা-পার্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকম পুতুলের পসরা সাজিয়ে বসেন শিল্পীরা। পুতুল বিক্রিও হয়। পুতুল ছোট-বড় সকলের আনন্দের খোরাক জোগায়। কারণ আদিমকালে ভয়-ভীতি দূর কিংবা শত্রু তাড়ানোর জন্য পুতুল তৈরি হলেও সময়ের বিবর্তনে পুতুলশিল্প এখন মানুষকে বেঁচে থাকার সাধ-আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের হাজার হাজার পুতুলশিল্পীর মধ্যে যদি ঢাকার রায়েরবাজারের ও চারুকলার শিক্ষক মরণ চাঁদ পালের কথা বলা যায়, তা হলে দেখা যাবে এই মৃৎশিল্পী পোড়ামাটির পুতুল তৈরি করে দেশে-বিদেশে যেমন অর্থ ও যশ কুড়িয়ে যাচ্ছেন, পাশাপাশি বাংলাদেশের বিশেষ করে পোড়ামাটির পুতুলশিল্পে এনেছেন এক অনন্য ধারা। তাঁর কয়েকটি পুতুল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই গ্যালারিতে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন শিল্পীর পোড়ামাটির পুতুল রয়েছে। যেমন ঢাকা জেলার বলধা সংগ্রহের পোড়ামাটির পুতুলগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি, হাঁস, বধূ, রাঁধুনী, ভিখারি, সন্ন্যাসী, পূজারি, সেতারবাদক, ধূপা, নৃত্যরতা নারী, মাহুত ও হাতি, মাও শিশু, পুরুষ, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি পুতুল খুলনা জেলার গাভি, ঘোড়া, সিংহ, সৈনিক, পাকসেনাদের গণহত্যা, টিয়াপাখি, শিশু কোলে মা, পুতুল বরিশাল জেলার সিংহপুতুল, অপরিকল্পিত পরিবার পুতুল, রাখাল ও ছাগল পুতুল, গাভি ও বাছুর পুতুল। এ ছাড়া ফরিদপুর, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা নাটোর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলার-নারী পুতুল, বানর পুতুল, লক্ষ্মীর পুতুল, বৃদ্ধা পুতুল, বেদেনী-পুতুল বুড়া-বুড়ি পুতুল, কলসি কাঁখে রমণী পুতুল প্রভৃতি পুতুল রয়েছে।

পুতুল তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পীরা বংশপরম্পরায় এগিয়ে এসেছে। পুতুলশিল্পটি এখনো এ দেশে অন্যতম একটি শিল্প। কারণ পুতুল বাংলার লোকজীবনকে আনন্দ রসে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলার নিন্ম শ্রেণির সেই লোকশিল্পীদের হাতেই পুতুলশিল্প যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি হচ্ছে। তাই পুতুলশিল্পের জন্যও প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পুতুলশিল্পীরাও বাঁচবে আর টিকে থাকবে বাংলার লোকশিল্পের অনন্য শিল্প পুতুল।


 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়