শামসুজ্জামান খান: সমকালীন মনীষাদের চোখে
একজন মানুষের জীবন ও সৃষ্টি কত যে বর্ণিল-বিচিত্র হতে পারে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। বাংলাদেশের অগ্রগণ্য লোকশিল্প গবেষক। লোকসংস্কৃতির আধুনিক ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু এই পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার আগেই তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক হিসেবে। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য। সাহিত্যের আবার সবগুলো শাখায়— গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, শিশুসাহিত্য, নাটক, জীবনীসাহিত্য, সাহিত্যের ইতিহাস, ভাষা ও ভাষার ইতিহাস— তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। ছোটদের জন্য গল্প লিখেছেন। খেলাধুলা নিয়ে লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন বিবিধ বিষয়ের গ্রন্থ। শুধু বাংলা ভাষা নয়, তিনি ইংরেজি ভাষাতেও প্রবন্ধ লিখেছেন। সেসব লেখা দেশি বিদেশি পত্রপত্রিকা ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আমরা জানি, শামসুজ্জামান খান বাংলার মনীষী ও লোকমনীষাদের নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, লালন, রবীন্দ্রনাথ, মীর মশাররফ হোসেন, হাছন রাজা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, জসীমউদদীন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, মুনীর চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, অন্নদাশঙ্কর রায়, শাহ আবদুল করিম, জাহানারা ইমাম, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামানসহ বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য মনীষাদের আমরা শামসুজ্জামান খানের লেখায় নতুন ভাবে পাঠ করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বর্তমান গদ্যে আমরা শামসুজ্জামান খানকে তাঁর স্বকালের অন্য মনীষাদের দৃষ্টি দিয়ে পাঠ করার চেষ্টা করব।
শামসুজ্জামান খানের নানামাত্রিক লেখালেখি সম্পর্কে সাহিত্যের সচেতন পাঠকমাত্রেই জানেন। তাঁর কাজের প্রকৃতি ও গভীরতা সম্পর্কে নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন জানাচ্ছেন: "I have been an admirer of Shamsuzzaman Khan's work for a very long time. The critical judgment, historical insights and remarkable scholarship that Shamsuzzaman brings to his analyses and writings are altogether exceptional. He has made us think afresh on many important subjects (particularly on the understanding of folk literature as well as literary texts), and we have reason to be grateful for Shamsuzzaman Khan's well-established intellectual leadership."
শামসুজ্জামান খানের সরাসরি শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আরো নির্দিষ্ট করে বলছেন: ‘মীর মশাররফ হোসেন বা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী বা বিশ শতকের অন্যান্য সাহিত্যিক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রথমেই সে জ্ঞান তথ্যের বাইরে অনুসন্ধান করেছে এবং সৌভাগ্যক্রমে নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছে। তার ভিত্তিতে এরপর সে তৈরি করেছে নতুন ভাষ্য।”
শামসুজ্জামান খান দেশের ফোকলোর চর্চায় দু’ভাবে অবদান রেখেছেন। এক. ব্যক্তিগত চর্চার মাধ্যমে; দুই. প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অবকাঠামো তৈরি করে। দু’ ক্ষেত্রেই তিনি সফল ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর ফোকলোর চর্চার ব্যক্তিগত দিকটিতে আলোকপাত করে আনিসুজ্জামান যেমন জানাচ্ছেন:
বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চায় শামসুজ্জামান খানের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন তাঁর বন্ধুস্থানীয় আরেক পণ্ডিত যতীন সরকার। তিনি বলেন: ”বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগকে কেন্দ্র করে শামসুজ্জামান খানের অসাধারণ কর্মপ্রয়াসের ফলেই বাংলাদেশ বিশ্ব ফোকলোরচর্চার সর্বাধুনিক ধারার সঙ্গে পরিচিত ও সংযুক্ত হতে পেরেছে।”
ফোকলোর চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অবদানের কথা তুলে ধরেছেন লোকগবেষক আবুল আহসান চৌধুরী। তিনি জানাচ্ছেন: “বাংলা একাডেমিতে তাঁর প্রধান সাফল্য বোধকরি ফোকলোর চর্চার আধুনিকায়নের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, আধুনিক ফোকলোর গবেষণার অবকাঠামো নির্মাণ এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রচনা। শিল্পকলা একাডেমিতে তিনি যখন ছিলেন, সেখানেও যাত্রা কিংবা লোকসংগীত-উৎসব ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন এবং ফোকলোর বিষয়ক বই প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়ে লোকজ সংস্কৃতিচর্চার ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। জাদুঘরে তাঁর সময়ে পুতুল, নকশিকাঁথা, বাদ্যযন্ত্র, চারুশিল্প, বস্ত্র ও পরিচ্ছদ ইত্যাদি লোকশিল্পকলার সংগ্রহ আরো সমৃদ্ধ হয়।”
বক্তা হিসেবেও শামসুজ্জামান খান অসাধারণ ছিলেন। সেদিকে আলোকপাত করে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী লিখেছেন: “অত্যন্ত সুবক্তা শামসুজ্জামান খান কখনো শ্রোতার বিরক্তি উৎপাদন করেনি। কারণ বিষয়বস্তুর উপর তাঁর অসাধারণ বুৎপত্তি শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে সক্ষম।
শামসুজ্জামান খানের সফল কর্মজীবন ও প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পর্কে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন: ”বাংলাদেশের তিন তিনটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হতে পারার বিরল সৌভাগ্য একমাত্র তাঁরই হলো। এই ঘটনাটি একই সঙ্গে যেমন তাঁর সৌভাগ্যের স্মারক, তেমনি একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তাঁর যোগ্যতার পরিচয়ও বহন করে।”
শামসুজ্জামান খানের প্রিয় বিষয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি হলেও কবিতার প্রতি তাঁর পক্ষপাত স্পষ্ট। তিনি যখন বাংলার জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল থেকে শুরু করে আফ্রিকার সংগ্রামী কবি লিওপোল্ড সেদার সেঙ্ঘরকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন কিংবা ‘আফ্রিকার কবিতা’ শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনা করেন, তখন নতুন পরিচয়ে তাঁকে আমরা পাই। সেই পরিচয়টার উপর জোর দিয়ে কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন: ”লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি তাঁর চর্চার বিষয় হলেও, সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতা অকৃত্রিম অনুরাগী তিনি, বহু মননশীল গদ্য রচনায় তিনি নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন, কিন্তু কবি ও কবিতাই হয়ে উঠেছে তাঁর অধিক প্রিয়।’’
বাংলা একাডেমিতে শামসুজ্জামান খানের দীর্ঘসময়ের সহকর্মী ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। সহকর্মী হিসেবে তিনি অন্য লেখকদের জন্য কতটা প্রেরণার ছিলেন তা আসাদ চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত বয়ানের ভেতর আমরা অনুধাবন করতে পারি। আসাদ চৌধুরী লিখেছেন: “আমার প্রথম বই ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’ লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম মহাপরিচালক মনজুরে মওলা ও শামসুজ্জামান খানের চাপে পড়েই।... প্রথম বই তাঁর কল্যাণেই বেরিয়েছে। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমি তা স্মরণ করি। লিওপোল্ড সেদার সেঙ্ঘরের কবিতার অনুবাদও করতে হয়েছিল শামসুজ্জামান খানের তাগিদে। এঁদের প্রচণ্ড চাপে লিখেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইটি; ইতিহাসের লোক না হয়েও।”
শামসুজ্জামান খান কেবল লেখক ও সম্পাদকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী সংগঠক। ষাটের দশককে কচিকাঁচার মেলার স্বর্ণযুগ। এ সময় এই সংগঠনের আঞ্চলিক প্রসারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শামসুজ্জামান খানের বন্ধুস্থানীয় চিত্রশিল্পী হাশেম খান জানাচ্ছেন যে, কচিকাঁচার মেলার তিনটি পরিষদের দ্বিতীয় পরিষদের প্রধান ছিলেন শামসুজ্জামান খান। তিনি এই দায়িত্বে থেকে জেলায় জেলায় বিশাল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে মানিকগঞ্জে এক বিশাল শিশুকিশোর তথা সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে তিনি নিজেকে কখনোই সরিয়ে নেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। এই সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই বাংলার খ্যাতিমান লেখক শিল্পী অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলন আয়োজন নিয়ে শামসুজ্জামান খানের সহকর্মী কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন জানাচ্ছেন: “শামসুজ্জামান খানকে আমার দেখার সুযোগ হয় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের মাধ্যমে। সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি ছিলেন মূল কমিটির সদস্য সচিব। বিদেশি কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানানো, তাঁদের সম্মতি গ্রহণ এবং সম্মেলন চলাকালে তাদের দেখাশোনা ও যাতায়াতের যাবতীয় বিষয় তাঁকেই দেখতে হয়েছে। একই সঙ্গে আলোচনা ও অনুষ্ঠানাদির বিষয়বস্তু নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নেও তাঁকে মনোযোগী থাকতে হয়েছে। আমাদের কখনো কখনো মনে হয়েছে, ঐ সম্মেলন আয়োজন করার জন্য তাঁর বিকল্প ছিল না।”
শামসুজ্জামান খান ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে এলেও রাজনীতির প্রতি কমিটমেন্ট তাঁর লেখার মধ্যে প্রকাশ পায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির অনন্য ভাষ্য। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন বর্তমান প্রজন্মের আশ্রয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতি ও রাজনীতি আলাদা মেরুতে অবস্থান করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি বারবার বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতিপ্রেমের কথা তুলে ধরেছেন। বাঙালিত্ব, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গবন্ধু রাজনীতির আদর্শকে ধারণ করে তিনি তাঁর লেখকসত্তার বিকাশ ঘটান। কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই যথার্থই বলেছেন: “শামসুজ্জামান খান অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো রাজনীতিমনষ্কও বটে, কেননা তিনি জানেন রাজনীতির সঙ্গে সামগ্রিকভাবে জীবনযাপন জড়িত। ফজলুল হকের ওপর লেখায় যেমন উঠে এসেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা, আফ্রিকার জননেতা সেনেগালের প্রথম প্রেসিডেন্ট কবি লিওপোল্ড সেঙ্ঘরের ওপর লেখায় একই সঙ্গে আলোচিত হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ এবং সৃজনশীল মানসের বর্ণনা।”
শুরু করেছিলাম শামসুজ্জামান খানের শিক্ষক আনিসুজ্জামানের মূল্যায়ন দিয়ে। শেষ করছি শামসুজ্জামান খানের ছাত্র শাহরিয়ার কবিরের মূল্যায়ন দিয়ে। শাহরিয়ার কবির জগন্নাথ কলেজে শামসুজ্জামান খানের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। শামসুজ্জামান খানই প্রথম তাঁকে দিয়ে শিশুদের জন্য গল্প লেখান। ছাত্রের ভাষ্যে: “শিক্ষকদের আমরা বলি মানুষ গড়ার কারিগর। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান অন্যত্র যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই করুন না কেন, আমার কাছে তাঁর বড় পরিচয় শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য আলোকিত মানুষ তিনি সৃষ্টি করেছেন। এই হাজারও মানুষের সারিতে নগণ্য আমিও একজন।”
জীবনের মাঝামাঝি এসে প্রথাগত শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি ক্রমেই জাতির শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন। তিনি আমৃত্যু বাঙালির ধর্মীয় বহুত্ববাদ, সাংস্কৃতিক উদারতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য লিখে গেছেন। তাঁর কারণেই বাংলার সমৃদ্ধ লোকায়ত সাহিত্য মূলধারায় সংস্কৃতিচর্চার অংশ হয়ে উঠেছে। লোকসংস্কৃতিচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আরো সুদৃঢ় হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিদগ্ধ এই পণ্ডিত গত ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ), মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ঢাকা/তারা