ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

স্রষ্টার পরে কবি সবচেয়ে স্বাধীন সত্তা: নির্মলেন্দু গুণ

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২২, ২১ জুন ২০২১   আপডেট: ১৬:২৫, ২১ জুন ২০২১
স্রষ্টার পরে কবি সবচেয়ে স্বাধীন সত্তা: নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ সমকালীন বাংলা কবিতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। তাঁর কথায়- কবিতা হচ্ছে কাব্যলক্ষ্মী, গদ্য ছত্রবৎ। দুই ধারাতেই নির্মলেন্দু গুণ অনন্য, অসামান্য। বাংলাদেশের জন্ম এবং মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার যে রক্তসিঁড়ি তার সঙ্গেও নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎ শারীরিক এবং আত্মিক। তিনি বেড়ে উঠেছেন বাংলা ভাষা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদ, সমাজ, মানুষ, প্রেম, প্রকৃতির সাহচর্যে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার দুটি ধারা- একটি প্রেম এবং একটি রাজনীতি। দুই ধারাতেই তিনি সমান সার্থক। এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কবির ব্যক্তি পরিচয়, রাজনৈতিক দর্শন, কবিতায় এর প্রতিফলন। কবির জন্মদিনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি শিহাব শাহরিয়ার

শিহাব শাহরিয়ার: কবি হতে চাওয়া এবং আমরা মনে করি যে, এই চাওয়াতে আপনি সাথর্ক। আপনি এক দিক দিয়ে প্রেম, অন্য দিক দিয়ে রাজনীতি অর্থাৎ দ্রোহ পাশাপাশি রেখে এতটা সময় পার করে দিয়েছেন বাংলা কবিতায়- এ বিষয়টি একটু বলবেন কি?

নির্মলেন্দু গুণ: আমার অনেস্ট ফিলিংসের ভেতরে যে জগৎ আমাকে আহ্বান করেছে আমি মনে করি, কবির জন্য একটা মানসিক ধ্যানের দরকার। তার স্থিতি দরকার। একাত্ম হয়ে বসে জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ তৈরি করা দরকার। করোনাকে এই দিক থেকে বলব- করোনা নতুন করে চিন্তা করার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা যারা ক্রিয়েটিভ লোক তারা এবং যারা মানব সভ্যতার শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চান তারা নতুন করে ভাববার অবকাশ পাবেন এই সময়ের মধ্যে। করোনাকাল চলে গেলে আমরা হয়ত একটি অপেক্ষাকৃত সুন্দর পৃথিবী পাব- এরকম প্রত্যাশা আমাদের মধ্যে আছে। কারণ এই করোনার করাল গ্রাসে ইতোমধ্যে দশ লাখের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ফলে করোনার যে ছোবল আমাদের জীবনে এলো সেই ছোবলটা দেখে নতুন করে আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। হয়ত আগামী দিনের মানুষ বোধ করবে- এরকম প্রত্যাশা রাখি।

শিহাব শাহারিয়ার: লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আসলে কতটুকু?

নির্মলেন্দু গুণ: আমি মনে করি, লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। কিন্তু এটাও আমি মনে করি, মানুষের যে ধর্মীয় অনুভূতি, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে আহত করার চেষ্টা করতে পারি না। আমি এই দিক থেকে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে অক্ষত রাখার পক্ষপাতী এবং ভিন্নমত যারা পোষণ করেন, যারা মনে করেন ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করছে এবং রক্তক্ষয়ের কারণ হচ্ছে তারা ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন। তাদের সেই ভিন্নমতকে আমি চাপাতির কোপে নিবৃত্ত করার পক্ষপাতী নই। আমি দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারী যারা আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রকে একটা ন্যায়সঙ্গত অবস্থান গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাব।

শিহাব শাহরিয়ার: বৈশ্বিক পরিক্রমায় একজন লেখক বা কবির ভাবনা কী হওয়া উচিত?

নির্মলেন্দু গুণ: শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রটা এ রকম যে, এর কোনো ইয়ার্ড স্টিক নেই। ইয়ার্ড স্টিক হচ্ছে মাপযন্ত্র। যে যন্ত্র দিয়ে মেপে আমি বলতে পারব- হোপস্টেপ জাম্প দিয়ে তুমি কত দূর গেলে কিংবা তুমি হাই জাম্প দিয়ে কতটুকু উচ্চতা অতিক্রম করলে? ক্রীড়া জগতে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটি যেমন আমরা খুব সহজে নিরূপণ করতে পারি, শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটি খুব কঠিন। শিল্পের মূল্য বিচার করার জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি এখনও তৈরি হয়নি এবং কোনো কালে সেটি তৈরি না হোক সেটিই আমরা চাই। এখানেই শিল্প সাহিত্যের অনন্যতা যে তাকে মাপা যায় না হাত ঘড়িতে।

আমি সুইডেন যখন গিয়েছিলাম- ২০১৩ সালে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশ বছরপূর্তি উপলক্ষে সুইডেনের গোথেমবার্গ বুক ফেয়ারে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। দিবসটি উপলক্ষে আমরা বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ৫২ বছর বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি পুরস্কার পাওয়ার বিড়ম্বনা নিয়ে যে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছিলেন সেটি নোবেল কমিটির জানা দরকার। সেটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা অনেক সময় কুকুরের লেজে শূন্য টিনের কৌটো বেঁধে দেয় এবং কুকুর যখন দৌড়ুতে থাকে তখন তার লেজে বেঁধে দেয়া এই শূন্য কৌটোটি মাটির সঙ্গে আঘাত পেয়ে আরো শব্দ করে। আর সে দৌড়াতেই থাকে, এই দৌড় আর থামে না। আমার হয়েছে সেই দশা।

তার মানে আমি বললাম- নোবেল কমিটির আপনারা মনে করবেন না রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে একেবারে আনন্দে গদগদ হয়েছিলেন। টাকাটা তাঁর দরকার ছিল স্বপ্ন পূরণের, শান্তি নিকেতন নিমার্ণের জন্য, ফলে তিনি এই টাকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার নিলেন। আট বছর পরে তাঁর নোবেল লেকচার দিয়েছিলেন স্টকহোমে গিয়ে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সে স্থানটি পরিদর্শন করার। গোথেমবার্গ শহরে যে বইমেলা হলো সেখানে আমি বলেছিলাম- কোনো সাহিত্যিক যখন ৬০ উর্ধ্ব বা ৭০-এ পৌঁছে যায় তখন তারা পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণের প্রস্তুতি নেন। তখন তাদের নোবেল পুরস্কারের মতো এরকম ভয়ঙ্কর পুরস্কার দিয়ে জীবনের নির্জনতা, বিদায়ের প্রস্তুতিকে ব্যাহত করা, তাদের শান্তি বিঘ্নিত করা অপরাধের শামিল। এই অপরাধ নোবেল কমিটি বহু বছর ধরে করে চলেছে। আমি আহ্বান জানাবো ষাট বছরের অধিক বয়স্ক লেখকদের যেন নোবেল পুরস্কার দিয়ে বিড়ম্বিত করা না হয়। এটা একটা মানবিক অপরাধ।

শিহাব শাহরিয়ার: এই জায়গায় একটু আসি, আপনি লুইস গ্লুকের কথা বললেন, এই যে কয়েক দিন আগে এই মার্কিন কবি ৭৩ বছর বয়সে পুরস্কারটি পেলেন, তাঁর কবিতা বাংলাদেশের অনেকেই উচ্চমানের নয় বলবার চেষ্টা করেছেন- আপনার কাছে কী মনে হয়?

নির্মলেন্দু গুণ: আমি তাঁর একটা কবিতাও পড়ি নাই। আমি নোবেল পুরস্কার দ্বারা প্রভাবিত হতে রাজি নই। নিজেকে এতটা বোকা ভাবতে আমার লজ্জা হয়। আমি যখন আমেরিকা গিয়েছিলাম তখন ফরিদা মজিদ আমেরিকাতে ছিলেন; একটা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন এবং বাংলা কবিতাও ভালো অনুবাদ করতেন। আমার অনেক কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন ১৯৯১ সালে। আমার একজন প্রকাশক ছিল তিনি তাকে এক হাজার ডলার এবং একটা কম্পিউটার, একটা প্রিন্টার দিয়েছিলেন শুধু আমার কবিতা অনুবাদ করার জন্য। তখন তিনি আমার ১৩টি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। ফরিদা আমাকে বলেছিল- তুমি গিন্সবার্গের পেছনে ঘুরতেছ ক্যান? তুমি ডিরেক্ট ওয়ালকটের সঙ্গে দেখা করো। ওয়ালকট নোবেল পুরস্কার পাবে। তখন আমি ফরিদাকে বলেছিলাম- দ্যাখ, কে বড় কবি, কে নোবেল পুরস্কার পাবে এই চিন্তা নিয়ে আমি গিন্সবার্গের সঙ্গে দেখা করছি না। আমি দেখা করছি সেই গিন্সবার্গের সঙ্গে যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছিলেন এবং ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর মতো একটা চমৎকার গীতিকাব্য রচনা করে রেখে গেছেন। তিনি আমাদের ইতহাসের অংশ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি।

শিহাব শাহরিয়ার: আরেকটি প্রশ্ন আপনার কাছে- অন্য দেশে বা অন্য ভাষায় বাংলা কবিতা আদৃত হয় না কেন?

নির্মলেন্দু গুণ: সেটা অবশ্য আমারও খুব অবাকই লাগে! বাংলা ভাষার যে ধারাবাহিকতা সেটি যদি বিবেচনায় নেই তাহলে বাংলা ভাষায় প্রচুর কবি আমরা পাই। আসলে একজন কবির সঙ্গে আরেকজন কবির কৃতির তুলনা করাটা কঠিন। আমি একটা গোলাপ আর একটা পদ্মফুল বা একটা গন্ধরাজ ফুলের মধ্যে কোন ফুলটাকে ভালো বলব? একসময় গোলাপ আমার ভালো লাগবে, একসময় পদ্মফুল ভালো লাগতে পারে, আবার হয়ত ছোট্ট শিউলী ফুলের সুগন্ধে আমার মন উতলা হবে। সুতরাং এই সুন্দরের মধ্যে তুলনা করাটা কঠিন।

শিহাব শাহরিয়া: আমাদের দুঃখ হয়। দুটি দুঃখ- আমাদের যারা খুব মেধাবী কবি তাদের অনেকেই মাইকেল থেকে জীবনানন্দ দাশের কথা বলতে পারি, সুকান্তের কথা বলতে পারি, আবুল হাসান আপনার বন্ধু- এই যে মেধাবী কবির তালিকা; তারা কিন্তু খুব অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন- এইটি একটি দুঃখ। আরেকটি হলো, নির্মলেন্দু গুণ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো সেই শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। কিন্তু আমরা পাচ্ছি না! কেন পাচ্ছি না?

নির্মলেন্দু গুণ: ২০১৩ সালে আমি গোথেমবার্গ শহরে বুক ফেয়ারে গিয়েছিলাম। তখন ওখানকার লেখকদের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। আমি সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে জোর করে একটা হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি বলেছিলাম- আমার অনুষ্ঠানে লেকচার দেয়ার কথা আছে। ইউ আর ভায়োলেটিং মাই হিউম্যান রাইট। সে বলল- ইউ আর এ  পারসন সাফারিং ফ্রম ভাইরাল ডিজিজ। সো ইউ হ্যাভ নো হিউম্যান রাইট। উই দ্য ডক্টরস ক্যানট এলাউ ইউ টু গো এ্যাওয়ে উইথ ইউর ডিজিজ অ্যান্ড স্প্রেড ইট। সো ইউ হ্যাভ টু গো।

যাই হোক, ওখানকার লেখকদের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়নি বা নোবেল কমিটির কোনো বিশিষ্ট লেখক, কর্মকর্তার সঙ্গেও দেখা হয়নি। তবে গ্রন্থমেলার আয়োজকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। তারা প্রশংসা করেছিল। বলেছিল- প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত বলে আমরা বাংলাদেশকে জানি। কিন্তু তোমরা জেনে অবাক হবে এই বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচাইতে দীর্ঘতম গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে। এত বড় মেলা বিশ্বে আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। অর্থাৎ তারা বিষয়টি জানে। আমি আমার কবিতাকুঞ্জে সারা পৃথিবীর কবিদের কবিতাকে একত্র করার যে চিন্তা করেছি এই চিন্তা একজন বাংলাদেশের কবির মাথায় এলো, পৃথিবীর উন্নত দেশের কবিদের মাথায় কেন এলো না? আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পৃথিবীকে জানার যে গভীর আগ্রহ বিদ্যমান রয়েছে সেটা পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের মধ্যে নেই। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স মুলারের যিনি গীতা এবং উপনিষদ অনুবাদ করেছিলেন জার্মান ভাষায়। সেখানে যে হোটেলে তারা ছিলেন আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, তুমি একটা ভারতীয় সঙ্গীত আমাকে শোনাও। প্রিন্স দ্বারকানাথ হোটেল রুমে যে পিয়ানো ছিল সেটা বাজিয়ে গান শোনালেন। তিনি কি গান করেছিলেন সেটা জানা যায় নি। জানলে ভালো লাগতো কারণ তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের পূর্বের মানুষ; তখন কি সঙ্গীত তাকে প্রভাবিত করেছিল সেটা জানা যেত।

ম্যাক্স মুলার তার গান শুনে প্রীত বোধ করেননি। তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন- তোমরা ইউরোপিয়ানরা এতো বেশি আত্মমুখী যে তোমাদের কবিতা, তোমাদের দর্শন, তোমাদের ধর্ম সব কিছুই ভালো। আর আমাদের প্রাচ্যের দর্শন, প্রাচ্যের কাব্য, প্রাচ্যের মিউজিক, প্রাচ্যের কোনো কিছুই তোমাদের ভালো লাগে না। 
পরবর্তীকালে যখন রমা রোলাঁ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন, আপনার ‘গীতাঞ্জলি’র কোনো একটা গান আমাকে গেয়ে শোনান। রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমার কাছে তো হারমোনিয়াম বা বাদ্যযন্ত্র নেই, তবে আমি পায়ে তাল ঠুকে তোমাকে গান শোনাই। তিনি দু’তিনটা গান শোনালেন। শোনানোর পরে রমা রোলাঁ খুব বেশি এ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথকে। এই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন। তিনি বললেন, তোমার গানের সুর তো আমি ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় শুনেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের মধ্যে বিভিন্ন জায়গার সুর ব্যবহার করেছেন এটা আমরা জানি। রবীন্দ্রনাথ গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ সেই গানের সুরের উপর যে গান রচনা করেছেন সেটি তো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ স্কটল্যান্ডের কিছু সুর ব্যবহার করেছেন, ইংলিশ কিছু সুর ব্যবহার করেছেন তাঁর গানে। তো রমা রোলাঁর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ যে নমিত ভূমিকা রেখেছিলেন তার চেয়ে অনেক দুর্বিনীত আক্রমণ ম্যাক্স মুলারকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাঁর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, তোমাদের ইউরোপিয়ানদের সবচেয়ে বড় দোষ তোমরা নিজেদের মহান মনে করো। তোমরা মনে করো আমাদের দেশ শাসন করার অধিকার তোমাদের আছে, তোমরা দয়া করে আমাদের দেশ দখল করেছ।

শিহাব শাহরিয়ার: বাংলা কবিতার দুর্বলতা কোথায়? আপনার কাছে কী মনে হয়?

নির্মলেন্দু গুণ: বাংলা কবিতার দুর্বলতা আমার পক্ষে শনাক্ত করাটা কঠিন, কারণ কবিতা নানা রকমের হয়। আর স্রষ্টার পরে কবিরাই হচ্ছে সবচেয়ে স্বাধীন সত্তা। না হলে কবিতা কেন টিকে থাকবে? আমি কেন কবিতাকুঞ্জ করলাম। কবিতাকুঞ্জের দেয়ালে প্লেটোর একটা উক্তি আছে। আমরা জানি প্লেটো রিপাবলিকের মধ্যে কবিতাকে নির্বাসন দেয়ার কথা বলেছেন। তাঁকে আপাতদৃষ্টিতে সেই রিপাবলিকের পাঠক হিসেবে মনে হবে যে তিনি কবিতাবিরোধী লোক। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি এই জেনে যে- তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে কবিতার পক্ষে। তিনি বলেছেন- পোয়েট্রি ইজ নিয়ারার টু ভাইটাল ট্রুথ দ্যান হিস্ট্রি। কবিতা ইতিহাসের চাইতে মানবজীবনের গভীর সত্যের নিকটবর্তী। জীবনের বড় সত্যের নিকটবর্তী হচ্ছে কাব্য, ইতিহাস নয়। আমরা ইতিহাস বিকৃত হতে দেখেছি।

শিহাব শাহরিয়ার: এখন যারা লিখছে, বাংলা কবিতার যে ধারাবাহিক পর্যায় ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত- আপনি কতটুকু ব্যবধান দেখছেন?

নির্মলেন্দু গুণ: এর উত্তরও আমার জানা নেই। আমি কবিতা লিখি কিন্তু পড়ি না। আমার নিজের অনেক কবিতাই আমি মনে করতে পারি না। 

শিহাব শাহারিয়ার: বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কী?

নির্মলেন্দু গুণ: কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক বা উল্লাস- কোনোটারই প্রয়োজন নেই। কবিতা হচ্ছে মানুষের ভাবাধারা, মানুষের অন্তর্গত আবেগের একটা প্রকাশ। আবেগ শুধু নয়, তার সঙ্গে মেধার সমন্বয়ও থাকে। তার অর্জিত বোধও সেখানে থাকে। তার ন্যায় বোধ, শ্রেয় বোধ, তার প্রেম, প্রীতি, আবেগের প্রকাশ থাকে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য- এই যে মৌলিক রিপুগুলো কিন্তু নানাভাবে, নানা রূপে প্রকাশিত হয়েছে আমাদের কাব্যে। এটা হতেই থাকবে। আমি প্রাচীনকালের কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলাম। আমার একটা অনূদিত কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে গত বই মেলায়। সেখানে কিন্তু খ্রিস্ট পরবর্তী চতুর্থ দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে সংস্কৃত কাব্যের কিছু কবির কবিতা আমি অনুবাদ করেছি। সেখানে দেখেছি আজকে থেকে সেই পনেরশ বছর আগে দুই হাজার বছরের কাছাকাছি আগের কবিরা যে সমস্ত কবিতা রচনা করেছেন সেগুলো আধুনিককালেও প্রাসঙ্গিক। মানুষের বৈষয়িক সম্পদের যতটা পরিবর্তন ঘটে তার অন্তর সম্পদের, তার চিন্তা, ধারণার ক্ষেত্রে এত দ্রুত পরিবর্তন ঘটে না। তার মনোজগতের পরিবর্তন সেইভাবে ঘটে না।

শিহাব শাহারিয়ার: বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে যে বাংলাদেশকে আপনি ধারণ করেছেন, সেই বাংলাদেশের চেতনা আপনার কাব্যে এবং আপনার গদ্যে তুলে ধরেছেন আমরা মনে করি আপনি বহুদিন বেঁচে থাকবেন। আপনার কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে শুনতে চাই।

নির্মলেন্দু গুণ: কিছুদিন আগে আইএমএফ-এর একটা জরিপের ফল বেরিয়েছে। দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশ উপমহাদেশের মধ্যে তার সবকটি উন্নয়ন সূচকে ঊর্ধ্বমুখী। মাথা পিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন সমস্ত ক্ষেত্রে- বাংলাদেশের গড় পরমায়ু ৭২ বছর। যেখানে ভারতের গড় পরমায়ু ৬৯ বছর। আমাদের এখন যে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর ভেতর যে টানেল তৈরি হচ্ছে, যে ইনফ্রাক্টাচারগুলো গড়ে উঠছে- আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সেগুলো আমাদের উন্নতির সূচক। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যে উন্নতির উচ্চতর স্তরে পৌঁছবে এ ব্যাপার সংশয় নেই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের হাই ওয়েতে প্রবেশ করেছে।

শিহাব শাহারিয়ার: বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছেন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, সেটি তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ অবশ্যই।

নির্মলেন্দু গুণ: আমার বন্ধু এবং সহপাঠী বলে নয়, আমি সেজন্য বলছি না কিন্তু আমি যদি নিরপেক্ষভাবে দেখি তাঁর কতগুলো কর্মকাণ্ড আছে যেগুলো খুব ইনোভেটিভ। তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতই কবিপ্রাণ। সে সাহিত্যের ছাত্রী। তাঁর অনেকগুলো বই আছে। একবার আমি তাঁকে সমালোচনা করে বলেছিলাম- আপনি না লিখলে বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষতি হবে না, আপনি এত বড় লেখক নন। সুতরাং আপনি যে সময়টা লেখার পেছনে ব্যয় করবেন, সেটা ব্যয় না করে আপনি রাজনীতির পেছনে ব্যয় করেন। কারণ আমাদের রাজনীতির কাদামাখা মাঠে খেলতে গেলে আপনার প্রতিটি মুহূর্ত রাজনীতিকে দিতে হবে। আপনার সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না কিন্তু আপনার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। সুতরাং আপনার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আপনার প্রতিভাকে ব্যবহার করুন। 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়