বুদ্ধদেব গুহ: তারুণ্যযাত্রার অনুভব নির্মাতা
আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম
মা বলেছিলেন, ‘‘বাবলি’টা এখনই পড়ো না’। তখন গোগ্রাসে বই পড়ি। অর্থাৎ যা পাচ্ছি পড়ছি। সমরেশের ‘সাতকাহন’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীন’ পড়ার পর এ রকম ঢাউস কোনো বই খুঁজছিলাম। এর মধ্যেই ঘরে এই বইখানা মন নাড়িয়ে দিলো!
বেশ ছোট তখন আমি। কিন্তু সমরেশের হাত ধরে জলপাইগুঁড়ি আর দূরবীনে চোখ রাখার পড়ে মায়ের নিষেধ না-শুনেই শুরু করলাম ‘বাবলি’। পরে বুঝেছিলাম মা কেনো বারণ করেছিলেন; মানব চরিত্রের প্রেমকে তিনি কোথাও কোথাও সরাসরি বলেছেন। মা হয়তো চাননি আমি বিষয়গুলো তখনই জেনে যাই বা বুঝে ফেলি। পরে বুঝেছি গত কয়েক দশকে বিশ্বসাহিত্যে ‘ইয়ং অ্যাডাল্ট’ নামে এক বিশেষ ধারা পরিলক্ষিত। এই ধরনের সাহিত্য ‘ইয়ং’-দের ‘অ্যাডাল্ট’ হয়ে ওঠার সহায়ক। আবার পরিণত পাঠকও কৈশোরে ফিরে যেতে চাইলে এমন সাহিত্যে ডুব দিতে পারেন। বাংলায় এমন ধারার অস্তিত্ব সে অর্থে বিরল। যে ক’জন হাতে গোনা সাহিত্যিক সেই রাস্তায় হেঁটেছেন, বুদ্ধদেব তাদের অন্যতম।
‘বাবলি’তে বাড়তি পাওনা ছিলো মণিপুর, ইম্ফল, নাগাল্যান্ড ও দিল্লির প্রাকৃতিক দৃশ্যের চমৎকার বর্ণনা। তখনই ভেবে রেখেছিলাম এসব জায়গায় নিশ্চিত বড় হয়ে যাবো। পড়ার কারণে সেই জায়গাগুলো দেখার বাসনা থেকেই হয়তো আমার ভ্রমণ শুরু।
এরপর ‘কোজাগর’, তারপর ‘মাধুকরী’, ‘সবিনয় নিবেদন’, ‘হলুদ বসন্ত’ ‘জঙ্গলের জার্নাল’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ আরও কত কি!
‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়ার আগে বইটি হাতে নিয়ে লজ্জা পাচ্ছিলাম। নামের কারণে। মনে আছে বাংলা বইয়ের মলাট খুলে এই বইয়ে লাগিয়ে নিয়ে পড়েছিলাম; কেউ যেনো ধরতে না পারে। ‘মাধুকরী’ পড়ার সময়ের কথা ভাবলে এখনও রোমাঞ্চিত হই। শিহরণ জাগে। প্রায় কানে ধরে স্বপ্নের দেশে বাস করাতে পারেন ভদ্রলোক! তিনি প্রেম শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন বনজীবন আর ভ্রমণজীবন কেমন হতে পারে? অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে এখনও! আমাকে যেনো একটু একটু করে বড় করে তুলছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। কৈশোর থেকে তরুণ হয়ে উঠবার অনুভব হাতে ধরে শেখালেন তিনি।
বুদ্ধদেব গুহ পাঠককে সঙ্গে নিয়ে চলেন শব্দের ভেতরে জঙ্গলের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, নানান রকম পাখি–গাছ–পশুপাখিদের সঙ্গে মিতালী করিয়ে দেন। দলবল নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শিকার করা, ডাকাত দলের সঙ্গে লড়াই- সব কিছুই যেনো নিজে করছি এমনি বোধ হতে থাকে। তাঁর শব্দের প্রায়োগিক সাবলীলতায় চরিত্রগুলো যেনো সবার চোখের সামনেই কথা বলছে, খাচ্ছে ,হাঁটছে, হাসছে, অভিমান করছে!
বর্তমানে মানুষ ব্যক্তি স্বাধীনতার, ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মহীনতা এবং নারী স্বাধীনতার নামে যে লাগামহীন জীবনযাপন করছে তার ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হবে বা হতে যাচ্ছে এসব যেনো তিনি জানতেন। তাই ‘মাধুকরী’তে পৃথু-রুষার মেয়ে মিলি তার মায়ের পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে জড়িয়ে যায় এক নিষিদ্ধ সম্পর্কে যেখানে মেয়ে মায়ের প্রতিযোগী। এমনই সূক্ষ্ম অর্ন্তদ্বন্দ্বের এক সীমাহীন পরিক্রমা তিনি দেখিয়েছেন তার লেখায়।
বুদ্ধদেব গুহ’র চরিত্রগুলোর নাম একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে আমার কাছে। বইয়ের বেলায়ও কিছু ক্ষেত্রে তাই। ‘চাপরাশ’ সম্ভবত এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম বইয়ের নাম ‘চারপাশ’। লক্ষ্য করে দেখি ‘চাপরাশ’।
‘চাপরাশ’ যে বহন করে তিনি চাপরাশি। অর্থাৎ চাপরাশি যে তার পরিচয়ের চিহ্ন, তকমা বহন করে, তার নাম চাপরাশ। শব্দের অর্থ তো বোঝা গেলো, কিন্তু বইয়ে কি কোনো চাপরাশির জীবনের গল্প বলা হয়েছে? উত্তর হ্যাঁ এবং না। লেখকের ভাষায় ‘চাপরাশ বহন করার আনন্দ কেবল চাপরাশিই জানে। সে চাপরাশ ঈশ্বরের হোক, কিংবা কোনো নারীর।’
চারণ; কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার, একটা সময় উপলব্ধি করে; এত যশ, মেকি সামাজিকতা আর অর্থের মাঝে, নিজেকে কি ভালো করে চেনা হয়েছে? চারণ ঘুরে বেড়ায় তীর্থে, এ তীর্থ মন্দিরের না, মনের তীর্থ। সাধু সন্তের মাঝে এসে জীবনকে খুব অন্যভাবে দেখতে শেখে। এই ক্যাপিটালিজমের ভিড়ে আমরা সবই পাই, শুধু ভালোমত পাওয়া হয় না নিজেকে, মেকির ভিড়ে আসল আমিত্বর অস্তিত্ব আমরা ভুলে যাই।
অর্থাৎ, চাপরাশ কথাটা এখানে রূপক। আসলে প্রতিটা মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য ‘কিছু একটা’ দরকার। কারও জন্য সেই ‘কিছু একটা’ হয় কাজ, কারও জন্য মদ, কারও জন্য নারী, কারও জন্য কর্ম, কারও জন্য ধর্ম। এই উপন্যাসে লেখক নারী এবং ঈশ্বরের চাপরাশ বহন, অর্থাৎ মনের গভীরে লালন করার বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
অনেকে ‘চাপরাশ’কে ‘মাধুকরী’র সমকক্ষ বলতে চাইতে পারেন। কিন্তু মাধুকরী, চাপরাশের চেয়ে অনেক ঋদ্ধ। কেননা আসলে একটা মাধুকরীর মাঝে কয়েকটা চাপরাশ আছে। যে চাপরাশ, উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেই চাপরাশের সন্ধান মাধুকরীতে মেলে। ঠুঠা বাইগা জানতো সে চাপরাশ বইবার আনন্দ। শেষে সম্ভবত, পৃথুও জেনেছিল।
জীবনানন্দ তার ‘এইসব ভাল লাগে’ কবিতায় লিখেছিলেন:
‘জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রুপসীর মুখ ভালোবেসে’
খুব সম্ভবত বাংলা গদ্যে একমাত্র বুদ্ধদেব গুহ'র ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসটিই জীবনানন্দের সেই কবিতার নিকটতম অনুভূতি দিতে পারে।
‘ভালো লাগা আর ভালোবাসার পার্থক্যটা কোথায়? ভালো লাগলে মানুষ সেই ভালো লাগাকে নিজের ইচ্ছাধীন করে রাখতে পারে। কিন্তু ভালোবাসলে মানুষ নিজেই ভালোবাসার ইচ্ছাধীন হয়ে থাকে, তার নিজের কোনও নিজস্ব সত্তা থাকে না। ভালোবাসা তাকে যা বলে সে পোষা পুষ্যির মতো তাই করে।’ ঋজু-নয়নার জীবনে ঘটে চলা এসব ঘটনার মধ্যে আরও মুগ্ধকর ছিলো লেখকের সঙ্গে পাঠকের জঙ্গলের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া। সামন্তরালভাবে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোকে প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন হয়তো তিনিই করতে পারেন। যেখানে অতীব মাত্রায় কিছু নেই। যেনো সহজ কথা সহজে বলতে পেরেছেন।
বুদ্ধদেব গুহ’র উপন্যাস মানেই জীবন সম্পর্কিত ছোট ছোট এপিগ্রাম। কবি মনের অনন্ত অতল লেখক সায়ন চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ‘কোজাগরে’। কেনো সে রাত জেগে বাইরে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসে থাকে, নীরবে কেন একা একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়- এর উত্তর কেউ জানে না, বোঝে না, জানে শুধু একজন কবিই।
আর তাই হয়তো সে কিছুটা একাকী বোধ করে। কারণ এর অতল স্পর্শ তিতলি কখনো পায় না। প্রকৃতির বর্ণনা বলতে লেখক বরাবরই বিভূতিভূষণের কথা বললেও তিনি নিজেই দারুণ সুন্দর করে লিখেছেন পালামৌ-এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য, নিষ্ঠুর নির্জনতা, মহুয়ার সুবাস, প্রকৃতির নির্মমতা, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্টকর জীবনের কথা। কিছু অ্যাডাল্ট কথাবার্তা থাকলেও তার জন্য বইটাকে অপছন্দ করা যায় না মোটেও।
বিনিময় হতে থাকা যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আবেগ, ভালোবাসা, অনুভূতি, বোধ, উপলব্ধি, পছন্দ-অপছন্দ, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ছোট-বড় ঘটনা, ইচ্ছে স্বপ্ন, টানাপড়েন, এমনকি উপহারও; সেইসঙ্গে চিঠির পরতে পরতে তৈরি হতো কত-শত গল্প! এই ধারণাটি থেকে একটি উপন্যাস লিখে ফেললেন বুদ্ধদেব গুহ। নাম দিলেন ‘সবিনয় নিবেদন’।
‘সবিনয় নিবেদন’ একটি চিঠি-সাহিত্য বা পত্রোপন্যাস। চিঠির জাদুকরী প্রভাব, কত মায়া তা প্রকাশ পেয়েছে এই বইয়ে। চিঠি মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কীভাবে এটি অপরিচিত দুইটি মানুষকে আত্মিক সম্পর্কে বেঁধে দিতে পারে, তা এই উপন্যাস পড়লে বেশ বোঝা যায়।
চানঘরে গান-লেখার ধরণটাও ‘সবিনয়ে নিবেদন’ এর মতোই পুরো উপন্যাস চিঠি লেখার স্টাইলে লেখা, যাকে আমরা বলি পত্রোপন্যাস। এই লেখার স্টাইল বাংলাসাহিত্যে নতুন নয়, আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়– বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের পোনুর চিঠি, কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধন হারা, নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব, মির্চা এলিয়াদের লা নুই বেঙ্গলী, মৈত্রয়ী দেবীর তার উত্তরে ন হন্যতে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রিয়তমাসু।
‘চানঘরে গান’ পড়তে গেলে মনে হয় এই তো আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত সব বিষয় প্রকাশ হয়ে গেল। চানঘরে আমরা যে গান গাই তা একেবারে আমাদের নিজের গান, কাউকে শোনানোর জন্যে নয়। চানঘরে তার নিজের কথা বলেছেন, চিঠি লিখে আর বলতে গিয়ে পাঠককে যুক্ত করেছেন আষ্টেপৃষ্ঠে। উল্টো দিকে ফিরদৌসী বলে লেখকের এক পাঠিকা চিঠি লিখে চলেছেন। তবে লেখক এতো নিজের ঢাক পিটিয়েছেন যে অন্য সব শব্দ চাপা পড়ে গেছে।
নিজের অন্য বইয়ের নাম-ধাম, প্রকাশক ছেপে দিয়েছেন। তবে লেখকের যে বড় গুণ- ঝরঝরে, আবেগ ও যুক্তির চমৎকার মিশেল, সেসব আছে।
অরণ্যকে আলাদা একটি সত্তা মনে করে তিনি বলেছিলেন অরণ্য তো ‘মানুষ’। অরণ্য আমার আরেক জীবন। অরণ্যের মানুষ যেনো তার প্রতিটি লেখায় ছাপ রেখে গেছে জেনে ও না জেনেই।
একজন চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট। বরং একজন শিকারী বললেই ভালো হতো কিংবা একজন ট্রাভেলার, এমন এক যাত্রী যার যাত্রাপথ সুবিস্তৃত। জীবনের ব্যালান্স শিট মেলে না বোধ হয়। অথচ সারা জীবন তাই পরীক্ষা করে এসেছেন। জীবনের শেষ লগ্নে এসে আপনাকে তাই পৃথু ঘোষের মতোই লাগে। ‘মাধুকরী’র পৃথু ঘোষ। এত মানুষের ভিড়েও তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। এই পঁচাশি বছরের ভরা যৌবনে চিরযুবক ঋজুদা যেনো অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন যিনি প্রায় সকলের প্রিয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ।
‘মাধুকরী’ উপন্যাসে তিনি লিখেছিলেন, ‘এমনিতে আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে আর কষ্ট বাড়িও না। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে।’ হয়তো এখন থেকে একা একাই মজা করতে চান তিনি।
অরণ্য পেরিয়ে হতে চাওয়া জীবনকে সঙ্গে নিয়ে, না হতে পারার বেদনাকে সঙ্গে নিয়ে পাঠকও যাত্রী সেই অভিযানে। আর অভিযান যে কখনও ফুরোয় না, তা বুদ্ধদেবের মতো লেখক জানতেন হয়তো!
ঢাকা/তারা