আব্দুলরাজাক গুর্না ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার
যথাবিহিত নানা মুনির নানা মতের তোয়াক্কা না-করে, সবার অনুমান-আব্দার ব্যর্থ প্রমাণ করে নোবেল পুরস্কার কমিটি ২০২১ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিলেন আব্দুলরাজাক গুর্নাকে। বুকার এবং কমনওয়েলথ রাইটার পুরস্কারের মনোয়ন তালিকায় ছিলেন তিনি, কিন্তু পুরস্কার পেয়ে গেলেন একেবারে বিশ্বের সবচেয়ে দামী পুরস্কা— নোবেল।
একেই বলে, লুটি তো ভাণ্ডার, মারি তো গণ্ডার। যদিও ভাণ্ডার লুণ্ঠন আর গণ্ডার হত্যা দুটোরই বিপক্ষে আমি, তবু আব্দুলরাজাক গুর্নার নোবেলপ্রাপ্তি আনন্দদায়ক।
শুধু সাহিত্যে নয়, সব ক্ষেত্রেই অন্যসব পুরস্কারের মতো নোবেল পুরস্কার নিয়েও তর্ক-বিতর্ক কম নয়। একটা সময় পর্যন্ত সুইস একাডেমি স্ক্যান্ডেনেভিয়া আর ইউরোপের বাইরে এ পুরস্কার দিতেও চাইতো না। পুরস্কার প্রবর্তনের ২৯ বছর পর সিনক্লেয়ার লুইস প্রথম আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। আর পুরস্কার প্রবর্তনের ৮৫ বছর পর প্রথম আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান ওল সোয়েঙ্কা। তুলনায় রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই (১৯১৩ সালে) অর্থাৎ পুরস্কার প্রবর্তনের এক যুগের মাথায় প্রথম এশিয়ার লেখক হিসেবে পুরস্কার পান। তারপর ৫৫ বছর কেটে গেলো। আবার এশিয়ায় নোবেল এলো ১৯৬৮ সালে জাপানি লেখক ইয়াসুনারী কাওয়াবাতা’র ঝুলিতে। এটুকু থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের ক্ষেত্রে দেশ, জাতি, ভাষার বৈষম্য প্রবল। এই বৈষম্যের পুরস্কারের দিকে তবু আমাদের চোখ।
নোবেল পুরস্কার পাওয়া মানেই যে উঁচুদরের সাহিত্যিক তা কিন্তু নয়। বরং তলস্তয়, শেখভ, কাফকা, জয়েস, ইবসেন, বোর্হেসের মতো লেখকরা নোবেল পুরস্কার পাননি। সেই ব্যর্থতা অবশ্য নোবেল কমেটির। এইবার ২০২১ সালে আব্দুলরাজাক গুর্নাকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি আফ্রিকার কোটা কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা করলো। যদিও গুর্না জাতে আফ্রিকান হলেও চলনে-বলনে পুরোটাই ব্রিটিশ, তার লেখার ভাষাও ইংরেজি। কিন্তু যতোটুকু খোঁজখবর নিতে পারলাম তাতে বুঝতে পারলাম ব্রিটিশ নাগরিক হলেও, ইংরেজি-ভাষী হলেও, গুর্না মহাশয়ের লেখার গভীরে দেশত্যাগের বেদনা আছে, শেকড় ছেঁড়ার কান্না আছে। যাকে এখনকার তাত্ত্বিকরা ‘ডায়োসপরা’ (অভিবাসী) পরিভাষায় চিহ্নিত করছেন; আব্দুলরাজাক আদতে তাই। মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন, কালো মানুষ আব্দুলরাজাকের নোবেল পুরস্কার পাওয়াকে তাই আনন্দের চোখে দেখছি।
পুরস্কার বরাবরই কেবল সুবিধাবাদীদের দিকে ঝোঁকে। সামান্যতম ব্যতিক্রম হতে দেখলেও তখন ভালো লাগে। এটা আমার মূর্খতা এবং আফসোসের কথা যে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে আমি আব্দুলরাজাক গুর্নার সম্পর্কে জানতে পারিনি। আমাদের দেশের বইয়ের দোকানগুলোয় এখনও ধ্রুপদী লেখকদের বিদেশি বই বেশি। হাতে-গোনা কয়েকজনের বই এ দেশে পাওয়া যায়। গুর্না’র কোনো বই আমার চোখে পড়েনি। অথচ তার বইগুলো সম্পর্কে যতোটুকু রিভিউ দেখলাম, পড়লাম, তাতে আফসোসই হলো যে— কেন পড়া হয়নি?
আমি অবশ্য উপন্যাসের নিবিড় পাঠক নই। আমাকে বেশি টানে নন-ফিকশন আর কবিতা, ছোটগল্পও আমার আগ্রহের জায়গা। হয়তো এসব কারণেও গুর্নাকে চেনা হয়ে ওঠেনি। গুর্না সে অর্থে বিশ্বসাহিত্যে সুপরিচিত নন। তার লেখার ভঙ্গীও জনপ্রিয় নয়, বই বিক্রির কাটতির দিক থেকেও তিনি কখনো আলোচনায় আসেননি। সব মিলিয়েই তাকে আমাদের তেমন চেনা হয়ে ওঠেনি। অথচ তাকে নিয়ে এবং তার লেখা নিয়ে একাধিক পিএইচডি গবেষণার কথা জানতে পারলাম। তিনি নিজেও একাডেমিক লোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তার তত্ত্বাবধানেও একাধিক পিএইচডি গবেষণা হয়। সালমান রুশদিকে নিয়ে তিনি নিজে গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন এবং বই সম্পাদনা করেছেন।
আব্দুলরাজাক গুর্না যে খুব বেশি লিখেছেন তা বলা যায় না। দশটি উপন্যাস আর একটি মাত্র ছোটগল্পের বই প্রকাশ করেই তিনি যেমন গবেষণার বিষয় হয়েছেন, তেমনি নোবেল পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। এক নজরে তার প্রকাশনা তালিকাটি একটু দেখে নেয়া যাক :
১৯৮৭ : মেমোরি অব ডেপারচার
১৯৮৮ পিলিগ্রিম’স ওয়ে
১৯৯০ : ডটি
১৯৯৪ : প্যারাডাইজ
১৯৯৬ : অ্যাডয়ামারিং সাইলেন্স
২০০১ : বাই দ্য সী
২০০৫ : ডেজার্সন
২০০৬ : মাই মাদার লিভড অন দ্য ফার্ম ইন আফ্রিকা (ছোটগল্প)
২০১১ : দ্য লাস্ট গিফট
২০১৭ : গ্র্যাভল হার্ট
২০২০ : আফটার লাইভস
প্রথম তিনটি উপন্যাসের কথা বাদ দিলে দেখা যায় যে, আব্দুলরাজাক গুর্নে নিয়মিত লেখক নন। সর্বনিম্ন তিন বছর, সর্বোচ্চ ছয় বছর সময়ের ব্যাবধান আছে তার একেকটি প্রকাশনার মধ্যে। ৩৯ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮২ সালে তিনি পিএইচডি করেছেন ‘ক্রাইটেরিয়া ইন দ্য ক্রিটিসিজম অব ওয়েস্ট আফ্রিকান ফিকশন’ শিরোনামে। পিএইচডি চলাকালেই তিনি নাইজেরিয়ার বায়রো ইউনিভার্সিটি অব কানোতে পড়িয়েছেন। তারপর ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত।
ধারণা করতে পারি যে, একাডেমিক কাজেও তিনি ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। অন্যদিকে তার লেখার অংশ বিশেষ যা পড়তে পারছি ওয়ার্ল্ড ওয়াই ওয়েবের কল্যাণে তাতে এমন ধারণাও করি তিনি সিরিয়াস ঘরানার লেখক। তার উপন্যাস নেহায়েত কাহিনি বুনন নয় এবং চলতি ধারায় তিনি উপন্যাস বয়ান করেন না। ফলে তিনি সময় নিয়ে একেকটা উপন্যাস লিখেছেন। কোনো কোনো উপন্যাসে রীতিমতো গবেষকের পরিশ্রমও রয়েছে। সে পরিশ্রম চিন্তার, ভাষা ও আঙ্গিক নির্মাণের এবং তথ্য সংগ্রহের। আর পরিশ্রমী লেখক বলেই, তার উপন্যাস পাঠেও মনোযোগী পাঠক দরকার।
একটু উদাহরণ দেই তার সমুদ্রের পাশে (By the Sea) উপন্যাস থেকে, ‘আমি মানচিত্রদের সঙ্গে কথা বলি। আর কখনোবা ওরাও আমাকে কিছু বলে। যতো অদ্ভুত শোনা যাচ্ছে ব্যাপারটা ততো অদ্ভুত নয়, এমনকি অভূতপূর্ব ব্যাপারও নয়। মানচিত্রের আগে এই পৃথিবীটা ছিলো সীমাহীন। মানচিত্র এই পৃথিবীকে আকার দিয়েছে আর একে রাজ্যসীমায় আটকে ফেলেছে, যেন এটা দখল করার উপযুক্ত, কেবল ধ্বংসায়িত আবর্জনাই নয়, লুণ্ঠনও করা যায় একে। মানচিত্র আদতে জায়গাগুলোকে কল্পনার এমন সীমান্তে এনে ফেলেছে যা ধরার উপযুক্ত এবং সহজগম্য।’
এই যে মানচিত্রের সঙ্গে কথোপকথনরত চরিত্র এবং এই যে মানচিত্র সম্পর্কে একটি যথার্থ নৈয়ায়িক ধারণার বিবরণ এটা বাজার চলতি ধারার ঔপন্যাসিকের কলম থেকে বের হয় না। আবার অন্যদিকে একজন উত্তর-উপনিবেশিক লেখক ও এক কালের শরণার্থী, রাষ্ট্রযন্ত্রের সীমা রেখা ছেড়ে আসা মানুষের বেদনা ও বঞ্চনার কথাও কয়েকটি লাইনে ওঠে আসে। এই অল্প দুয়েকটি বাক্যেই আদতে বোঝা যায় আব্দুলরাজাক গুর্ণা খুব সহজগম্য লেখক নন। এবং এ কারণেই আমাদের বই বাণিজ্যের সীমা পেরিয়ে তিনি হাতে এসে পৌঁছাননি।
আশা করা যায় যে, নোবেল পুরস্কারের বদৌলতে ঢাকা বই বাজারে আব্দুলরাজাক গুর্না আবির্ভূত হবেন এবং আমরা যথার্থ পাঠ-পর্যালোচনায় যেতে পারবো।
ঢাকা/তারা