শিশুসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক
আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হাসান আজিজুল হক। অনন্য অসাধারণ ছোটগল্পকার হিসেবে আখ্যায়িত হলেও আমরা জানি তাঁর দুটি উপন্যাস— ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’— সব মিলিয়ে তিনি আমাদের পুরোধা কথাসাহিত্যিক। প্রাবন্ধিক হিসেবেও তিনি সুখ্যাত। তাঁর তুল্য প্রাবন্ধিক আমরা তাঁর সময়ে খুব বেশি পাইনি। তবে এই দুই পরিচয়ের মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর আরো এক সুকীর্তি। তিনি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এক শিশুসাহিত্যিক। উপন্যাসের মতো এখানেও তাঁর সৃষ্টি বিপুল নয়। মাত্র দুটি বই লিখেছেন শিশুদের জন্য— ‘লাল ঘোড়া আমি’ ও ‘ফুটবল থেকে সাবধান’।
‘লাল ঘোড়া আমি’ একটি উপন্যাসিকা বা বড়ো গল্প। অন্যটি একটি গল্পগ্রন্থ, সাতটি ক্ষীণকায় গল্প আছে এখানে। হাসানের অন্য কোনও লেখায় যে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ঘটেনি তা কিন্তু নয়। তাঁর বিখ্যাত ‘শকুন’ গল্পটির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে— ‘কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল’। (‘শকুন’, ১৯৬০) কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুন-কেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রি যাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় গল্প। শেষ অবধি সেখান থেকে যে সত্য বের হয়ে আসে, সে সত্যের নাগাল শিশু-কিশোররা পায় না। এছাড়াও, গল্পটিতে গদ্যের গাঁথুনি, শব্দের সংস্থাপন, উপমার উপস্থাপন কোনো কিছুই শিশু-কিশোর উপযোগী নয়। তাই শেষতক, গল্পটি হয়ে ওঠে একটি সিরিয়াস বড়োদের গল্প।
‘শকুন’ গল্পের কিছুকাল পরেই রচনা করেন ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’ (১৯৬৩) গল্পটি। কিশোর রেজার বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও শারীরিক যে টানাপোড়েন তার উপস্থিতি ঘটেছে এই গল্পে। গল্পটি যথার্থ কিশোর উপযোগী গল্প হয়ে উঠেছে। পরের বছর রচনা করেন আরও একটু গভীর জীবনবোধ সর্বস্ব ‘সারাদুপুর’ (১৯৬৪) গল্পটি। কাঁকন নামক নিঃসঙ্গ এক কিশোরের আত্মোপলব্ধির গল্প এটি। কাঁকন চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। সে অনুভব করে— ‘শীতে গাছের পাতাগুলো বিশ্রী দেখচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠাণ্ডা আর ঘাসের ভেতর রাস্তার রং দুধের মতো সাদা। ঘাস এখনও হলদে হয়নি— হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো— কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না।’ (‘সারাদুপুর’)
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে ওঠে তার হাহাকার, হতাশা ও জীবন সম্পর্কে কৌতূহল। গল্পটি হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এ অন্তর্ভুক্ত। অগ্রগণ্য আলোচকদের পাশাপাশি লেখক নিজেও হয়ত এটাকে বড়োদের গল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আমি হলপ করে বলতে পারি, কিশোররাও এই গল্পের রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবে, চমৎকার এই গল্পের চমৎকারিত্বে চমৎকৃত হবে তাদের জীবনবোধ।
শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ‘লাল ঘোড়া আমি’ (১৯৮৪)। এটি একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এ ধরনের বইকে ইংরেজিতে ‘fictional pony book’ বলা হয়। ঘোড়াটি নিজেই বলে চলেছে আত্মকথা। হাসান আজিজুল হক এখানে একটি ঘোড়ার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, অর্থাৎ তিনি এখানে ঘোড়ার চোখ দিয়ে পৃথিবীর প্রকৃতি ও প্রাণিজগৎ প্রত্যক্ষ করছেন। আর প্রত্যক্ষ করছেন মানুষ। কখনো কখনো মনে হয়, তিনি ঘোড়ার মুখে ভাষা তুলে দিয়ে খানিকটা দূরে সটকে পড়েছেন, দূর থেকে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার চোখ দিয়ে দেখছেন নিজেকে বা টোটাল মানব সমাজকে। আবার কখনো কখনো মনে হয়, তিনি নিজেই ঘোড়ার দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন, সময় ও সুযোগ পেলে টীকা বা টিপ্পনী টুকতে ভুলছেন না। ঘটনা যাই হোক, ঘটানোর কাজটা সহজ না মোটেও।
বিশ্বসাহিত্যে এ ধাঁচের বেশ কিছু রচনার সন্ধান মেলে। কানাডিয়ান লেখক সাউনডার লিখেছেন ‘সুন্দর জো : একটি কুকুরের আত্মজীবনী’ (১৯৩০)। এই উপন্যাসে একটি কুকুরছানার বেড়ে ওঠার কাহিনী ও মনিবের নিষ্ঠুর আচরণের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে গল্প কথকের অবস্থানে অবতীর্ণ হয়েছে জো নামের একটি কুকুর। মিরান্ডা সোয়ান লিখেছেন ‘একটি বিড়ালের আত্মজীবনী’। তবে যে বইটির কথা এখানে বেশ গুরুত্ব সহকারে বলতে হচ্ছে সেটি হলো, আনা সুয়েল-এর লেখা একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘কালো সুন্দর’ (Black Beauty, 1877; Anna Sewell, 1820-1878)। বইটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে যায়।
উপন্যাসটি হাসান আজিজুল হক যে পড়েছেন সে কথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে ‘কালো সুন্দর’ উপন্যাসের সঙ্গে ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের অনেক কিছুই মিলে যায়। কারণ হয়ত এটাই যে দুজনেই একটি ঘোড়ার আত্মজীবনী লিখছেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেরই বাসিন্দা হোক না কেনো, ঘোড়াদের জীবনের যে খুব বেশি হেরফের হয় না তা আমাদের সকলেরই জানা। দুটি উপন্যাসের ঘোড়াই দেখতে পরিপাটি— একটির গায়ের গড়ন কুচকুচে কালো অন্যটির অসম্ভব লাল; তবে দুজনেরই পা সাদা এবং মাথার মাঝখানে সাদা একটি স্পট আছে। দুটি উপন্যাসই প্রথম ব্যক্তির বর্ণনায় লেখা অর্থ্যাৎ বর্ণনাকারী হচ্ছে উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট ঘোড়া নিজেই। ‘কালো সুন্দর’ উপন্যাসে একটি কালো রঙের ঘোড়া হাত বদলের মাধ্যমে মানব সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে থাকে। এই জ্ঞান সবসময় সুখকর হয় না। ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে; শুধু স্থান, কাল, পাত্র ও প্রকাশের পদ্ধতিটা ভিন্ন— পার্থক্য এই যা। দুটি উপন্যাসের মধ্যে আরও অনেক মিল লক্ষ করার মতো। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা শুধু হাসান আজিজুল হকের শিশু-কিশোর উপযোগী রচনাগুলোর মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।
‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসটির উপক্রমণিকা ঘটেছে এইভাবে— ‘সে অনেককাল আগের কথা। তখন আমার চার বছর বয়েস।’ অর্থাৎ হাসান আজিজুল হক মধ্যযুগীয় ‘ফোক টেল’ বা ‘ওরাল ট্রাডিশন’কে অনুসরণ করছেন। সাধারণত শিশু কিশোরদের কোনো অবিশ্বাস্য ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্যে তাকে চিলের মতো ছোবল মেরে অন্য একটি সময়ে নিক্ষেপ করা হয়। তারপর যা বলা হয়, তা তখন তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। আলোচ্য গল্পেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। গল্পের কথক একজন ঘোড়া। গল্পের শুরুতেই সে আমাদেরকে তার বাল্যকালে নিক্ষেপ করেছে। সেখান থেকে এখন আর বের হবার জো নেই। বের হতে হলে গল্পের কথকের হাত ধরেই হতে হবে। মানুষ শৈশবে স্বভাবতই খুব গল্পপ্রিয় হয়। তারা চায়, নাম্বির মতো কিংবা অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনারের মতো কেউ একজন জাদুর জগৎ তৈরি করে গল্পের ফুলঝুড়ি ঝরাতে থাকুক আর তারা তা মন্ত্রমুদ্ধ হয়ে শুনতে থাকবে— এর পরে কি ঘটে, তার পরে কি ঘটে! শিশু কিশোরদের এই মনস্তত্ত্বে মনঃসংযোগ ঘটিয়েই হাসান আজিজুল হক উপন্যাসটি রচনা করেছেন।
আমরা জানি, কিশোররা সাধারণত ভূত-পেতনি, দৈত্য-দানবের গল্প শুনে ভয় পেতে ভালোবাসে, দুঃসাহসিক গল্প শুনে শিউরে উঠতে পছন্দ করে, আর ভালোবাসে গল্পের অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাসির আঁচে ঝলসে যেতে। হাসান আজিজুল হক এর সবটাই জানেন, জানেন বলেই তাঁর এ গল্পে এসব উপকরণ কমবেশি বন্দোবস্তও করেন। তবে এটা আলাদা ভাবে হাসির গল্প না, ভূত-পেতনির গল্পও না, আবার, গায়ে কাটা দেবার মতো কোনো এডভেঞ্চার নেই এখানে, নেই কোনো দানব আর দৈত্য পুরীর গল্প। এই গল্পের প্রটাগনিস্ট হলো একটা ঘোড়া, ঘোড়ায় এখানে একমাত্র কথক বা বয়ন শিল্পী। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমরা এই গল্পে যতটা না ঘোড়াদের সম্পর্কে জানতে পারি তার থেকে ঢের বেশি জানতে পারি মানুষ সম্পর্কে। যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো সরাসরি বললে তো আর শিশু-কিশোররা শুনবে না, তাই হাসান আজিজুল হক একটি ফন্দি এঁটেছেন। গল্প যতো এগিয়ে যায়, বোঝা যায় কিশোররা তাঁর কৌশলে তৈরি করা ফাঁদে ফেঁসে গেছে— তিনি তাঁর পাঠকদের হাসাচ্ছেন, হঠাৎ করে একটু ভড়কে দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য অন্য কিছু। পাঠকরা কিশোর বয়সের স্বভাবজাত উচ্ছ্বাস নিয়ে গল্পটি শুরু করছে বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর কিশোর থাকছে না। হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে একটি ঘোড়ার মুখ থেকে জেনে নিচ্ছে এই জগৎ সংসারের গাঢ় ও গূঢ় রহস্য। ঘোড়ার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু কিশোরদের চিন্তা চেতনারও ট্রানসেন্ড ঘটছে। শেষের দিকে এসে পাঠকদের নির্দিষ্ট বয়স বলে আর কিছু থাকছে না।
‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের ঘোড়াটি দেখতে বেশ আজব। গায়ের রঙ টকটকে লাল, কপাল আর কান দুটো ধবধবে সাদা, হাঁটুর নিচে থেকে পা দুটোও সাদা। এটা একটা শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পের ঘোড়া, তাই আর পাঁচটা ঘোড়া থেকে একটু আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। ঘোড়ার ভাষায়— ‘পায়ের রঙ শাদা ছিল বলে যখন দৌঁড়াতাম লোকে ভাবত আমি বুঝি শূন্যে ভেসে যাচ্ছি।’ ঘোড়াটির কথা বলার পাশাপাশি আর যে সব মানবিক গুণাবলি আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিউমর করবার ক্ষমতা। হাসান আজিজুল হক নিজের আদলেই গড়ে তুলেছেন (personified) করেছেন ঘোড়াটিকে। কাজেই, ঘোড়াটিকে কখনও মনে হয় বড্ড রসিক আবার কখনও মনে হয় প্রচণ্ড সিরিয়াস।
গল্পের প্রধান চরিত্র ঘোড়া হলেও, এটি ঘোড়াদের সমাজের গল্প নয়। ঘোড়ার চোখে দেখা মানবপ্রকৃতির বর্ণনা উঠে এসেছে গল্পটির আদ্যোপ্রান্তজুড়ে। মানুষ সম্পর্কে একটা বলিষ্ঠ ধারণা শিশু-কিশোররা পাবে এই গল্প পাঠ থেকে। তবে এই ধারণা সুখকর নয় মোটেও। গল্পের বিভিন্ন অংশে মানুষ সম্পর্কে প্রথম যে স্টেটমেন্টগুলো প্রদান করা হয়েছে সেদিকে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে বিষয়টি—
‘তবে তারা (মানুষ) প্রায়ই মিথ্যে কথা বলে তা আমি অনেকবার দেখেছি।’
‘বিনা কারণে হল্লা করা মানুষের স্বভাব।’
‘মানুষরা নিজেরা প্রায়ই ভালো হয় না। তবে তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক সময় ভালোই হয়।’
‘মানুষের এই আর একটা বদ অভ্যাস, খালি তোষামোদ করবে আর পিঠ চাপড়াবে।’
‘মানুষের বাচ্চা তো! লাই দিলেই মাথায় চড়ে বসবে।’
‘যে আমার পিঠে চড়বে বলেছিল, সে তখন এগিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে ঠোঁট দুটোকে ছটুচোর মতো করে চটুঅক চুঁঅক শব্দ করতে লাগল। মানুষের মুখের এই শব্দটা শুনতে আমার ঘেন্না লাগে। এমন বিচ্ছিরি শব্দ মানুষ ছাড়া আর কোনো জানোয়ার করতে পারে না।’
মানুষের দৈহিক বর্ণনাও করা হয়েছে নেতিবাচক ভাবে। প্রথম মনিব সম্পর্কে ঘোড়াটির মন্তব্য ছিল— মানুষদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে খারাপ দেখতে। তার মুখ দিয়ে এমন থুথু আর পচা গন্ধ বেরুত যে ঘেন্নায় তার (ঘোড়াটির) গা পাক দিত। দ্বিতীয় মনিব সম্পর্কে তার উক্তি— ‘মুগুরের মতো চেহারা লোকটার।’ ঘোড়াটি দারোগার বিবরণ দিয়েছে এই বলে— ‘লোকটা ভীষণ ভারি। জালার মতো পেট। চর্বির গরমে সব সময়েই হাঁশফাঁশ করছেন।’ ঘোড়াটির পঞ্চম মনিব সম্পর্কে তার উক্তি হচ্ছে— ‘প্যাঁকাটির মতো রোগা লম্বা চেহারা ডাক্তারের। চেয়ারে বসে আছেন যেন নেংটি ইঁদুর।’ এবং ‘ছোটো ন্যাড়া মাথাটি তাঁর ঠিক বেলের মতো...’
মানুষের ভেতর ও বাইরের যে রূপ এখানে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে তাকে কোনো ক্রমেই অস্বীকার করবার উপায় নেই। এজন্যেই, ঘোড়ার মতো প্রাণিকুলের অন্যান্য সদস্যরাও যদি প্রশ্ন করে বসে— ‘মানুষ আবার দেখতে সুন্দর হল কবে?’ তাহলে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানুষের পক্ষে বড়ো মুশকিল হয়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন অন্যখানে। হাসান আজিজুল হক শিশু-কিশোরদের জন্যে একটা উপন্যাস লিখছেন, খুবই ভালো কথা, তো সেখানে মানুষকে এমন নৈরাশ্যজনকভাবে উপস্থাপন করা কেন? শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পে তিনি কেনইবা শিশু-কিশোরদের কথা না বলে হাজার বছর ধরে চলে আসা, বুড়ো, মরচেপড়া মানব সভ্যতার কথা বলছেন? জমিদারের বীভৎস অত্যাচারের অনেক খোলামেলা উপস্থাপন এবং জমিদারের শেষ পরিণতির বিবরণ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে— শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পে এত সাংঘাতিক ঘটনার বিবরণ কেন? কারণ হয়ত এটাই যে তিনি শিশু-কিশোরদের নিছক বিনোদন দেবার জন্যে লিখছেন না। সাহিত্যের কাজ তো সঙ্গীতের মতো মানুষের মনোরঞ্জন করা নয়, আবার ধর্মগ্রন্থের মতো জীবন যাপনের একটি নির্দিষ্ট মানচিত্র এঁকে দেয়াও নয়, সাহিত্যের কাজ হলো মানুষের মানসিক রোগ বা সমস্যাগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করা। কাজেই সাহিত্য-সচেতন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক খানিকটা শিশু-কিশোরদের অবস্থানে নেমে এসে এবং কিছুটা নিজের অবস্থানে অবস্থান করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মানুষের ভেতরকার নোংরামির কথা। মানুষের ভেতর-বাহির নেড়েচেড়ে ওলটপালট করে দেখিয়ে দিচ্ছেন মানুষ হওয়ার যন্ত্রণাটা আসলে কোথায়। এইদিক থেকে গল্পটি একটি স্যোসাল-পলিটিক্যাল এলিগরি।
বরাবরই হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে প্রাণিজগৎ শক্তিশালী ইমেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাঁর সাহিত্যে খুব সাধারণ একটি শকুন, সাপ, ষাঁড়, হরিণছানা এবং আলোচ্য গল্পের লাল ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, বলদ, কুকুর প্রত্যেকে সিম্বলিক অর্থ বহন করে।
‘ফুটবল থেকে সাবধান’ গল্পগ্রন্থে সাতটি গল্প আছে। প্রথম গল্প ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। এই গল্পটি ভল্টু, পল্টু ও লেদু নামক তিনজন কিশোরকে ঘিরে। নামগুলোর মতো গল্পটাও বেশ মজার। ফুটবল খেলতে গিয়ে ভল্টুর পা ভেঙ্গে যায়। ভল্টুর পা ‘টেনিস বলের’ মতো ফুলে ওঠে। সে প্রতিজ্ঞা করে ‘জীবনে আর আমি ফুটবলের চেহারা দেখবো না’। বাড়িতে এই খবরটা ফাঁস হয়ে গেলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না, তাই তো ভল্টু ভান করে বিছানায় পড়ে থাকে আর অন্যদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে— ‘হায়রে, আমার কি এমন কেউ আছে যে দুটো খাবার এনে দেয় এখানে! আমার জন্যে একটু ভাবে এমন কেউ নেই এ বাড়িতে। এই যে এখন আমি অ্যালজেব্রা কষব— আর সেসব কী সাংঘাতিক সাংঘাতিক অ্যালজেব্রা— ভাবলে নাড়িভুড়ি বাইরে চলে আসে— সে সম্বন্ধে কারুর কি কোনো ভাবনাচিন্তা আছে?’ আবার যখন অতি কষ্টে সে বাড়ির বাইরে যাবার চেষ্টা করে তখন বাবা সামনে পড়ে গেলে বলে, ‘ভল্টু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এমন মারাত্মক একটা হাসি ছাড়লো যে আব্বার মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়’। বাবা কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে সে বলে— ‘জি না, আমার কিছু হয়নি’— চোরের মন যে পুলিশ পুলিশ সে কথা আমাদের সকলেরই জানা! এমন সব হাসি-উদ্দীপক সহজ সরল বর্ণনার মধ্যে দিয়ে গল্পটি এগিয়ে যায়। গল্পটিতে মাস্টার মশাইয়ের শরীরের বর্ণনা ও তাঁর গালির ধরন কিশোর মনে হাসির উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য।
‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপাথি’ গল্পটিও বেশ মজার। গাঁয়ে তোরাপ ও অঘোর নামে দুজন ডাক্তার ছিল— একজন হোমিওপ্যাথ, অন্যজন অ্যালোপাথ। তারা কীভাবে ডাক্তার হয়েছে তা কেউ জানে না। অ্যালোপাথ তোরাপ ডাক্তারের চিকিৎসার ধরনটাই এমন যে তাকে দেখলেই রোগীর পিলে চমকে যেত এবং রোগ সটকে পড়তো। আর হোমিওপ্যাথ অঘোর ডাক্তারের ওষুধ হাতে নিয়েই রোগী জিজ্ঞেস করতো— ‘ডাক্তারবাবু ভালো হবে তো?’ তারা আবার একে অন্যের জন্ম শত্রু। দুজনই সুবিধাবাদি ডাক্তার, রোগীর থেকে আয় রোজগারের দিকে নজর বেশি। এ ধরনের হাতুড়ে ডাক্তার গ্রামে গঞ্জে এখনো লক্ষ করা যায়। আর এখনকার শহরের শিক্ষিত ডাক্তাররা তো ডাকাতকেও হার মানাবে। গল্পটির ভাষা বেশ সরল হলেও হাসান আজিজুল হকের সহজাত গদ্য ঢঙ দু’এক জায়গায় চোখে পড়ে; যেমন, তিনি এক জায়গায় বলছেন— ‘তোরাপ ডাক্তারের দেহের কাঠামো ছিল বিরাট— কিন্তু কেমন যেন লোনা-ধরা পুরোনো ইটের বাড়ির মতো। সারা দেহটা তাঁর হলবল নড়বড় করছে!’
এই বইয়ের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের নাম হল ‘চরু’। চরু একটি হরিণছানার নাম। একদল শিকারি চরুর মাকে বন্দুক দিয়ে শিকার করে তারপর মহল্লায় এনে তার মাংস টুকরো টুকরো করে কেটে গাঁয়ে বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়ে, শুধু পড়ে থাকে ‘বাদামির ওপর সাদা ছিটেঅলা চামড়াটা আর দুটো নীল চোখ-অলা শিংসুদ্ধ মাথাটা।’ চরু এসবের নীরব সাক্ষী। মায়ের সাথে সাথে তাকেও ধরে আনা হয়েছে। কারণ, তাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড়ো করে তুলতে পারলে আরও কিছু কামানো যাবে। চরুর শিশু মন এখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করে— হালুম-এর থেকেও দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ সব পশু বাস করে ডাঙায়, হয়ত তাদের হাত থেকে বাঁচতেই তার মার মতো অনেক পশুপাখি আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। তবে চরুর ভাগ্য ভালো যে ঐ বাড়ির বোবা কালা ছেলেটি এখনও পৃথিবীর হালচাল বোঝেনি। তার শিশু মন অবলা হরিণছানাটির মতোই পবিত্র তাইতো তারা প্রকৃতিগতভাবেই একে অন্যের আপনজন হয়ে ওঠে। তাদের সখ্য বোঝবার ক্ষমতা এই নিষ্ঠুর সভ্যতার নেই, ফলত তারা অপেক্ষা করে কবে হরিণছানাটি ভোগ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। তাদের সেই সুযোগ আর হয় না। বোবা কালা ছেলেটি হরিণছানাটিকে জবাই করার ঠিক আগ মুহূর্তে নদীর ওপারে জঙ্গলে রেখে আসে। একটি বোবা কালা ছেলের কাছে পরাজিত হয় তথাকথিত সুস্থ কিছু মানুষ কিংবা বলা যায় আমাদের প্রতিষ্ঠিত এই টোটাল সমাজব্যবস্থা। এখানেই হাসান আজিজুল হকের বিশেষত— সুন্দর ও সত্যের জয় যেনো অবধারিত।
‘ভূতে বিশ্বাস নেই’, ‘গজভুক্ত কপিত্থ’ ও ‘ব্যাঘ্রবধের ব্যাপার’ গল্প তিনটি শিশু-কিশোরদের জন্যে বেশ সুখপাঠ্য হবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই গল্পগুলোতে হাসানের গদ্যের বেশ খানিকটা হেরফের ঘটেছে। তিনি হয়ত সচেতন ভাবেই স্রেফ মজা করার জন্যে এই গল্পগুলো রচনা করেছেন।
হাসান আজিজুল হক আজ আর আমাদের মাঝে সশরীরে নেই। কিন্তু তিনি আছেন তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। বড়োদের লেখক হিসেবে স্বীকৃত হাসান আজিজুল হক বর্তমান ও আগামী দিনের শিশুদের লেখকও হয়ে উঠুন, এটিই প্রত্যাশা করি। তাঁর মতো মহান লেখকের সঙ্গে আমাদের শিশুদের সাক্ষাৎ ঘটুক লাল ঘোড়া আমি কিংবা ফুটবল থেকে সাবধান বইয়ের মাধ্যমে।
আরো পড়ুন: হাসান আজিজুল হকের ভূমি ও ভূমিকা
ঢাকা/তারা