ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

বইমেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা চিরতরে কেটে যাক  

আহমাদ মোস্তফা কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২   আপডেট: ২২:০৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বইমেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা চিরতরে কেটে যাক  

এতগুলো বছর ধরে বইমেলার আয়োজন হচ্ছে, তবু প্রতিবারই মেলা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হয়। আমরা এক রকমভাবে আশা করি, হয়ে যায় অন্যরকম, যেন কোনোভাবেই ঠিক পথে চলবে না এই মেলা। অবশ্য ‘ঠিক পথ’-এর সংজ্ঞাও সবার কাছে একরকম নয়। তবু কিছু কিছু বিষয়ে সম্ভবত ঐকমত্যে পৌঁছানো যেত এত দিনে। যেমন মেলার সময়সীমা।

এটা মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, যা-কিছুই হোক, ফেব্রুয়ারি জুড়ে বইমলো হবে। বাংলাদেশ একসময় প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে গেছে। হরতাল-অবরোধ-ভাঙচুর-জ্বালাওপোড়াও নিত্যদিনের ঘটনা ছিল, তবু ফেব্রুয়ারিতে মেলা হয়েছে। কিন্তু গত বছর থেকে করোনাভাইরাসের নামে এক ভূত যেন আছড় করেছে মেলার ওপর। গত বছর মেলা ফেব্রুয়ারি থেকে পিছিয়ে মার্চ-এপ্রিলে নিয়ে যাওয়া হলো। ওটা হলো গরমের সময়, মাসব্যাপী মেলার আয়োজন ওই সময় করার কোনো মানেই হয় না। তার ওপর, কিছুদিন পর যুক্ত হলো আরো শর্ত। সন্ধ্যার মধ্যে স্টল বন্ধ করতে হবে, মেলা গুটিয়ে ফেলতে হবে!

চৈত্রের খরতপ্ত প্রখর দুপুরে কেউ মেলায় যায়? চাকরিজীবীরা অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে যেতেই তো সন্ধ্যা হয়ে যায়। অন্য পেশাজীবীরাও দুপুর বেলা যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, যান বিকেলে বা সন্ধ্যায়। তাছাড়া, ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, দিনভর ভাইরাসটা আকাশে থাকে, সন্ধ্যা হলেই নেমে আসে মেলার ওপর, সেজন্যই সন্ধ্যার আগে মেলা বন্ধ করে হবে!

আরো পড়ুন:

এবারও মেলা পিছিয়ে গেল। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেলা শুরু হবে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে, শেষ হবে ২৮ তারিখে। কেন পেছানো হলো? কেন সংক্ষিপ্ত করা হলো? হ্যাঁ, আমরা জানি, করোনা সংক্রমণের হার এখন বেশি। কিন্তু তাই বলে তো কিছু থেমে নেই! সব খোলা, সব। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বইমেলা বন্ধ! এর কোনো মানে আছে?

এই করোনা নিয়ে অদ্ভুত এক অবস্থা চলছে দেশে। সংক্রমণ একটু বাড়লেই সবার আগে বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের জীবন তো প্রায় ধ্বংসই হতে চলেছে, সেই সঙ্গে মহা হুমকির মুখে পড়েছে আমাদের প্রকাশনা শিল্প। যে যত কথাই বলুক, বই-বিমুখ এই জাতি যেটুকু বইটই কেনে তা ওই মেলার সময়েই। তাছাড়া, একটু উৎসবের আমেজ থাকে বলে শিশু-কিশোরেরাও মেলায় যাওয়ার আবদার জানায় অভিভাবকের কাছে, বই কেনে, যুক্ত হয় বই-পড়া সংস্কৃতির সঙ্গে। হয়তো মেলায় গিয়ে অভিভাবকদের মনও একটু কোমল হয়, তারাও হয়তো চান, ছেলেমেয়েদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠুক। আর যারা নিয়মিত পাঠক তাদের জন্য বই বাছাইয়ের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় মেলা। বই তো যে কোনো পণ্য নয় যে, অনলাইনে অর্ডার দিয়ে পেয়ে গেলেই হলো। বইয়ের গন্ধ নিয়ে, দু-এক পাতা পড়ে, নানা দিক দেখে একটা বই কেনার কথা ভাবেন পাঠক। এই সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু গত বছর আর এই বছর করোনার অজুহাতে অহেতুক বইমেলা অনিশ্চিত করে তোলা হয়েছে। এসব স্রেফ বাড়াবাড়ি।

একটা কথা খুব শুনলাম কয়েকদিন। কেউ কেউ নাকি মনে করেন, মেলায় টিকিটের ব্যবস্থা করা উচিত, যেন প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা যায়! কেন? যারা বই পড়ে না, তারা কি বইমেলায় যাওয়ার অধিকার রাখে না? এসব টিকিটপন্থি লোকেরা কি ভাবেন না, মেলায় যেতে যেতেই একজন অপাঠকও রূপান্তরিত হতে পারেন পাঠকে? তাছাড়া, প্রায় প্রতিদিনই মেলায় যায় প্রধানত তরুণরা যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। বই কিনতে পারুক আর না-পারুক তারা অন্তত বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয় মেলার সময়েই। প্রবেশমূল্য বেঁধে দিয়ে কেন তাদের নিরুৎসাহিত করতে হবে? কে যাবেন তাহলে মেলায়? আর প্রবেশমূল্যের টাকাই বা যাবে কোথায়? 

এমনিতেই স্পন্সরের নামে পুরো মেলাকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মেলায় ঢুকলে যত বই চোখে পড়ে তার চেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কর্পোরেটের বর্ণিল সব বিজ্ঞাপন। হ্যাঁ, টাকার প্রয়োজন আছে, কিন্তু বইমেলা তো বাণিজ্য মেলার মতো নয়, এর অন্য একটা সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যের হানি করে অতিমাত্রায় কর্পোরেট-আধিক্য যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনই মেলায় প্রবেশমূল্যের ধারণাও অগ্রহণযোগ্য। 

যাহোক, কথা আমরা বলি বটে, তাৎক্ষণিক কিছু সাড়াও পড়ে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এসব কথার কোনো প্রভাব কোথাও পড়তে দেখি না। তবু বলি, এবারও আমরা মেলা বিষয়ক অনিশ্চয়তা মেনে নিলাম, বা মেনে নিতে বাধ্য হলাম। আগামী বছর থেকে যেন এই অনিশ্চয়তা না থাকে। করোনা এত সহজে যাচ্ছে না, আরো বহু বছর আমাদের এর সঙ্গেই বসবাস করতে হবে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে, অন্য সব কিছু যেমন স্বাভাবিক গতিতে চলছে, তেমনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও স্বাভাবিক জীবনধারা ফিরে আসুক, স্বাভাবিক গতি ফিরে আসুক বই-কেন্দ্রিক সমস্ত কর্মকাণ্ডেও। 

পড়ুন এ বিষয়ক স্বকৃত নোমানের নিবন্ধ: বইমেলা ও একটি অসঙ্গত দাবি

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়