জনপ্রিয়তা এবং হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদের আলোকচিত্র : নাসির আলী মামুন
আমার বিবেচনায়, বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তিনটি দল আছে। একদল তাকে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে গণ্য করেন এবং তার যে কোনো লেখা নিয়ে উন্মাদনায় ভোগেন। অন্য দলটি হুমায়ূন আহমেদকে লেখক মনে করেন না। আর তৃতীয় দলটি তথাকথিত নিরপেক্ষ, নির্বিকার দল- তারা হুমায়ূনকে চেনেন না বা চিনলেও পাত্তা দেন না। অর্থাৎ একটা পক্ষ, আরকেটা বিপক্ষ, আরেকটা নিরপেক্ষ দল।
হুমায়ূন-অন্ধ এবং হুমায়ূন-বিদ্বেষী দুটো দলই চরমপন্থী। চরমপন্থীদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। জগতের সকল চরমপন্থীকে আমি বিনীতভাবে বলতে চাই, ঢালাওভাবে কোনো কিছু বিচার করা শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ কিংবা মূর্খতা অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এক চোখা হওয়া ভালো নয়। পক্ষে বা বিপক্ষেই হোক একচেটিয়া মতামত দিলে পরিবেশ নষ্ট হয়।
অন্যদিকে নির্বিকার তৃতীয় পক্ষ নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। কেননা নির্বিকার, নিরপেক্ষ লোকেরা আদতে সুবিধাবাদী। আমি বলবো, এ ধরনের লোকেদের ব্যাপারে আসুন আমরাও নির্বিকার ও নিরপেক্ষ থাকি এবং তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করি। অতএব হুমায়ূন আহমেদের পক্ষের, বিপক্ষের এবং হুমায়ূন প্রসঙ্গে নির্বিকার এই তিন দল সম্পর্কেই আমি কিছু বলবো না। আমি বরং জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে কিছু বলি।
বিপুল জনমানুষের কাছে হুমায়ূন জনপ্রিয় হয়েছেন। মার্কিন-ইতালীয় লেখক, শিল্পী ভান্না বোনটা একটা মোক্ষম কথা বলেছেন, ‘জনপ্রিয়তা কখনোই মানের নিশ্চয়তা দেয় না।’ এ কথা আজকের দিনে এসে আমাদের বাংলাদেশে প্রায়শই দেখতে পাই। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল, মিম ইত্যাদি নয়া ডিজিটাল সংস্কৃতির কল্যাণে যে কেউ রাতারাতি ‘ভাইরাল’ হয়ে যাচ্ছেন। হিরো আলম, অনন্ত জলিল, মাহফুজুর রহমান, কেকা ফেরদৌস এ দেশে জনপ্রিয়। কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রের কাজের মানকে নিশ্চিত করে না। এ কথা লেখালেখির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
হালের অনেক জনপ্রিয় লেখক আছেন যারা নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক শেয়ার দিয়ে বিবেচনা করেন। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা তো তা নয়। পৃথিবীতে অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক উইলিয়াম শেকসপিয়র, ভিক্টোর হুগো, মার্কেজ, বোর্হেস থেকে বাংলায় শরৎচন্দ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং হুমায়ূন আহমেদ একইসঙ্গে জনপ্রিয় এবং উচ্চ মানসম্পন্ন সাহিত্যগুণ ধারণ করেন।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, যে সাহিত্য চর্চার শুরুটা হুমায়ূন করেছিলেন ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নামের বিস্ময়কর দুটো উপন্যাস দিয়ে। এই রচনাসমূহ ড. আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান এবং আহমদ ছফা’র মতো ব্যক্তিদের মুহূর্তেই আকৃষ্ট করেছিল। ড. আহমদ শরীফ তো ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের নামকরণেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এই নামকরণের মধ্যেই হুমায়ূন আহমেদের ‘নতুন জীবনদৃষ্টি, অভিনব রুচি আর চেতনার একটি আকাশ’ দেখতে পেয়েছিলেন। আফসোস, পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির সমালোচকরা এসব দেখতে পাননি। তারা ড. আহমদ শরীফের দেখা ‘সূক্ষ্মদর্শী শিল্পী’, ‘সুনিপুণ শিল্পী’, ‘কুশলীস্রষ্টা’, ‘দক্ষ রূপকার’, ‘প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টা’কে আর অনুসন্ধান করেননি।
এ প্রসঙ্গে কবি ও সম্পাদক শামসুর রাহমানের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, ‘যখন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়, তখন আমি দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বইটি পড়ে আমার এত ভালো লেগেছিল যে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমি আমার কলামে সেই বইয়ের একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করি। সেদিনই আমার মনে হয়েছিল, আমাদের কথাসাহিত্যে একজন নতুন কথাশিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে। এরপর সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ অনেকগুলো উপন্যাস রচনা করেছেন এবং ইতোমধ্যে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কারো কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় এবং কেউ কেউ বাঁকা উক্তিও করে ফেলেন। কিন্তু দেখা গেছে, অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থশ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি, সন্দেহ নেই, বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছেন, যা সাহিত্যের পক্ষে উপকারী। এ কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যে, তিনি ভবিষ্যতে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে কিংবদন্তির মর্যাদা পাবেন।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩ নভেম্বর ১৯৯৮)।
বলার অপেক্ষা রাখে না, হুমায়ূন আহমেদ জীবিত কালেই কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছিলেন।
সমকালে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার সাহিত্য ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে নেহাত প্রশংসা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলেই আমাদের দায় শেষ হয়ে যায় না। আমাদের সময়ের আলোচিত এই ব্যক্তিত্বের সৃষ্টিকর্মের বিশ্লেষণ ও আলোচনা অবশ্যই সময়ের দাবি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা যতো সহজে, হুটহাট একটা মন্তব্য করে ফেলি, একজন লেখকের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে আলোচনা করা, একজন সাহিত্যিকের মূল্যায়ন করা ততো সহজ নয়। এই আলোচনা ও মূল্যায়নের যে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার প্রয়োজন আছে তার চর্চা আমরা কমই করি। ফলে স্রেফ ‘জনপ্রিয়’ এবং ‘জনপ্রিয় বলেই শস্তা’ এমন একটা সহজ সমীকরণে আমরা হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখককে মেপে ফেলি।
আরেকটি দিক উল্লেখ করার প্রয়োজন করি, এই যে হুমায়ূনকে সহজ, পুনরাবৃত্তিতে ভরপুর, চটুল ইত্যাদি তকমা আমরা অনেক সাহিত্য আলোচনাতেও দেওয়ার চেষ্টা করি সেটাও এক ধরনের অজ্ঞতা এবং খানিকটা অভব্যতাও। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি হুমায়ূনের লেখা পাঠের চেয়ে তার টিভি নাটকের দর্শক বেশি। এবং এই বিপুল টিভি নাটক ও সিনেমার দর্শক হুমায়ূনের সাহিত্যকে বিবেচনা করেন তার টিভি ও চলচ্চিত্র কর্মকাণ্ড দিয়ে। আবার কেউ কেউ ব্যক্তি হুমায়ূনের জীবনযাপন দিয়েও তার সাহিত্য প্রসঙ্গে আলটপকা মন্তব্য করেন। এই প্রবণতাটিও শিষ্টাচারভুক্ত নয় বলে মনে করি।
আমি বিবেচনা করি, হুমায়ূন আহমেদের বিপুল সাহিত্য কর্ম নিয়ে সৃষ্টিশীল সাহিত্যালোচনা হওয়া উচিত। তার লেখা গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, আত্মজীবনী, শিশুসাহিত্য, অতিপ্রাকৃতিক অংশ ইত্যাদি নিয়ে আলাদা আলাদা করে এবং সামষ্টিকভাবে মূল্যায়ন হওয়া উচিত। কেবল জনপ্রিয় লেখকের তকমা দিয়ে দিলেই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা সমাপ্ত হয় না। জনপ্রিয়তার অনেক ভ্রান্তি আর ফাঁদ আছে, সেই ভ্রান্তি আর ফাঁদ থেকে নতুন কালের পাঠক, আলোচক, লেখক, সমালোচক এবং গবেষক হুমায়ূন আহমেদকে যথার্থ বিশ্লেষণ করবেন সেই প্রত্যাশা আমার মধ্যে প্রবল।
/তারা/