আনি এরনোর উপন্যাস ‘ঝেড়ে ফেলা’: সূচনা পর্ব
অন্তত এক ঘণ্টা আমি ব্যায়াম করি, সাইকেল চালানোর মতো, কাঁচি চালানোর মতো পা উপর দিকে দিয়ে নাড়াই, উঠ-বস করি, আমার পা দুটোকে দেয়ালে ঠেসে ধরি। ব্যাপারগুলো দ্রুত করতে চাই। আকস্মিক, একটা অদ্ভুত উষ্ণ অনুভূতি আমার নিম্নাংশে পেটের মধ্যে ফুলের মতো বেরিয়ে আসে। বেগুনি ধাচের, বিশ্রী। ব্যথা নয়, কিন্তু ব্যথার বেরিয়ে আসার পূর্ব-ঘোষণা; যেন একটা ঢেউয়ের মতো চারিদিক থেকে আসছে নিতম্বের কাছ থেকে ভেঙে আসছে আর ঊরুতে এসে মারা যাচ্ছে। অনেকটাই মনোরম।
‘এক মিনিটের জন্য এটাকে উষ্ণ মনে হবে, যখন এটা চলতে থাকবে।’ একটা হোতকা লাল টিউব, একদম গরম জল থেকে আসা। ‘এটা ঠিক হয়ে যাবে, ভেবো না।’ আমি টেবিলের উপর শোয়া ছিলাম, আর যা কিছু আমার দুপায়ের মধ্য দিয়ে দেখছিলাম তা হলো তার ধূসর চুল আর লাল সাপটা যা এক জোড়া ফোরসেপ দিয়ে সে আমার ভেতরে সজোরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেটা নাই হয়ে গেলো। অবর্ণনীয় ব্যথা। আমি ওই বুড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম যে কিনা তুলো ভরে দিচ্ছিল ওটাকে জায়গা মতো রাখতে। তুমি নিজে থেকে নিচে ওটাকে ছুতে যেও না, ওটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে... আমাকে আদর করতে দাও ছোট্ট মিষ্টি সোনাকে, ওইখানে... দুই ঠোঁটের মাঝখানে... ক্ষত-বিক্ষত, আঘাতে আহত, অবরুদ্ধ, ওটা কি আর কখনো ব্যবহারের উপযুক্ত থাকবে- আমি ভাবতে থাকি।
তারপর আমাকে পুনরুজ্জীবিত করতে তিনি আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিলেন। তিনি কথা বলা থামাবেন না। ‘তোমাকে অবশ্যই প্রচুর হাঁটতে হবে, ক্লাসে যাবে, যতোক্ষণ না তুমি পানি হারাচ্ছো।’ প্রথমে খুব সহজ ছিল না এসব তুলোর বান্ডিল নিয়ে একা হেঁটে যাওয়া; বিশেষত একটা টিউব প্রায় পেটের ভেতরে শব্দ করে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভাঙতে একবারে এক পা করে। রাস্তায়, লোকের ভিড়ে সূর্য, গাড়িগুলোর ভিড়ে আমি যেন ঝলসে যাচ্ছি। আমার অসাড় বোধ হয়; আমি আমার ডর্মের কক্ষে চলে যাই।
‘তুমি তলপেটে একটা আলোড়ন পাবে।’ গতকাল থেকে আমি অপেক্ষা করছি, দ্বিগুণেরও বেশি করে, প্রথম লক্ষণ দেখার জন্য। ঠিক কী রকম হবে সেটা? আমি কেবল জানি এটা একটু একটু করে মরছে, ধীরে ধীরে ছোট্ট হচ্ছে, রক্তের ছোট্ট দলায় ডুবে যাচ্ছে, আমার থেকে ধীরে ধীরে ফোঁটা ফোঁটা রক্তে বেরিয়ে আসছে... আমি কেবল জানি এটা চলে যাচ্ছে- এটুকুই। আমার মাথা কম্বলের গন্ধে ডুবে যাচ্ছে, সূর্য আমাকে আঘাত করছে কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত, আমার ভেতরে একটা উষ্ণ জোয়ার, একটা তরঙ্গও আর দেখা যাচ্ছে না, ভাঁজের ভেতরে সবকিছু ঠাঁই নিচ্ছে আর উপরিতলের মাইল মাইল নিচে খাঁজের তলায় ঠাঁই নিচ্ছে। ডায়াগ্রামে যেমন দেখো তার মতো কিছুই নয়। আমি যেমন আছি তেমন রবো, এক রকমের যোগ ব্যায়ামের ভঙ্গিতে। সূর্য হয়তো আমার শরীরের উপর দিয়ে চলে যাবে, আমার সব পেশী আর মাংস গলিয়ে দেবে, একটা মণ্ডের মতো করে দেবে যা টিউবের ভেতর দিয়ে আলতো করে বেরিয়ে যাবে... না, তেমন ভাগ্য নেই। ওমন করে ওটা যাবে না। তাড়াহুড়ো বন্ধ করতে হবে, আমার পা দুটোকে দেয়াল থেকে সরাতে হবে। কিছু কাজ তো করতে হবে, অন্তত অর্পিত পাঠগুলো নিয়ে, ভিক্টোর হুগো কিংবা পেগিকে নিয়ে।
এই ভাবনাও আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। আমাকে বলার মতো ওদের কিছু নেই, ওখানে এমন কিছুই নেই যা আমার অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখে, আমি যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তা নিয়ে সাহায্য করারও কিছু নেই। জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু প্রতিটি আয়োজনের উপযুক্ত একটা প্রার্থনা নিয়ে তাদের আবির্ভূত হওয়া উচিত ছিল, একজন বিশ বছরের তরুণী যে সদ্য পেছনের গলি থেকে গর্ভপাত করিয়ে এসেছে তার জন্যও একটা প্রার্থনা থাকা উচিত ছিল। কি সে ভাবছে যখন বেরিয়ে আসছে, বাড়ি ফিরছে আর নিজেকে ছুঁড়ে ফেলছে তার বিছানায়! এর প্রয়োজনিয়তা তো আমি বারবার অনুভব করবো না। কিন্তু বইগুলো এ বিষয়ে নীরব হয়ে ছিল। আমার ভেতরে থাকা টিউবটার বিষয়ে একটা সুন্দর বর্ণনা, গীতিময় ভাষা আর রূপকে রূপান্তরিত করে... পাশের ঘরের মেয়েটির কাছ থেকে আমি যে চিকিৎসা অভিধানটি ধার করেছিলাম সেটা ঠাসা আছে বিভীষিকাময় বিস্তৃত বর্ণনা আর অশুভ শ্লেষে ভরপুর। তারা তোমাকে ভয় দেখাতে ভালোবাসে, তুমি এক চিলতে বাতাস নিয়েও মরতে পারবে না। আর তারপরও তুমি চাইলে একটা ব্যাঙকে বিদীর্ণ করে দিতো পারো নেহায়েত একটা স্ট্র দিয়ে... এই বমির মধ্যে ভাসার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো, বাসি রোগা গন্ধ, আকস্মিক খাবারগুলো জঘন্য মনে হয়, মাইল মাইল জুড়ে সালামির স্বপ্ন, প্রত্যেকটা দোকানের তাকে তাকে রঙিন সব খাবার। মাত্র দুইমাসে আমি তীব্র-গন্ধঅলা কুত্তি হয়ে গেছি যে খালি বিশ্রি খাবারগুলো খেয়ে বমিই করে যাচ্ছে... পচা পালং শাক, টমেটোর মার্কোকোক্রোম-লাল সিরাপ, পুরা মাংসের সন্দেহজনক টুকরা। বোর্ভিলের ক্রমাগত বিস্বাদ, তুমি হয়তো ভাববে এটা পাকস্থলীতে আলসারে পরিণত করছে।
পড়ালেখাও আমাকে ছেড়ে গেছে। আমি ভালো ছাত্রের ভূমিকা নিয়েছিলাম, নোট নিতাম, শোনার চেষ্টা করতাম। আমি কোথাও নেই এখন। ভাবতাম একদা আমি অধ্যাপক হতে চেয়েছি, একজন সমালোচক কিংবা সাংবাদিক হতে চেয়েছি। সম্ভবত আমি জুন কিংবা অক্টোবরের পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে পারবো না... হয়তো সবই ভুল হয়ে যাবে... কাজ করার প্রয়োজনটাই বা কী? ‘জিদকে নিয়ে কে বক্তব্য রাখবে?’’
বর্নি লেকচার রুমের চারদিকে তাকালো। আমি চেষ্টা করেও তিনটা লাইন একত্র করতে পারছি না, আমার কিচ্ছু বলার নেই জিদ কিংবা এ বিষয়ে অন্য কিছু নিয়েও, আমি যেন আমার অভিভাবকের জানালার গরাদে একটা বাতিল আর ফাপা বোতল, বর্নিও বাতিল, মিনমিন করে কথা বলে, একটা কোকড়ানো আকৃতিহীন শিশ্ন, অহেতুক অঙ্গভঙ্গি করে, ও অবশ্যই জানে, এই মোটকা, নোংরা পণ্ডিতকে, সে দৃশ্য থেকে ক্রমশ ঝাপসা হয়, আমি মুখের ভিতরে বিস্বাদ বোর্ভিল টের পাই, আমি দাঁতের মধ্যে বালু টের পাই, যদি আমি চলে যেতাম, সবাই হয়তো জানতো আমি গর্ভবতী। একটা আকস্মিক দুর্যোগ। দ্রুতই মরবে।
একটা তীব্র ব্যথা, প্রথমটি, আমার ভেতর দিয়ে কাটাকাটি করে চলে যায় আর অগণন কোমল কণিকার মধ্যে বিস্ফোরিত হয়। দারুণ এক আতশবাজির প্রদর্শনী আমার ভেতরে চলতে থাকে, সন্দেহ নেই এ এক কুদরতী রঙিন সিনেমা! আকস্মিক আমি উষ্ণ অনুভব করি না, এক ধরনের সূক্ষ্ম পুলক। হয়তো আমি আর কোনো দিনই কামোত্তেজনা পাবো না আবার যদি আমার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঠিক এটাই আমার প্রাপ্য। যদি ওরা এখন আমাকে দেখতে পেতো... ‘তুমি ঝামেলায় ফেসে যাবে।’ আমার মনে পড়ছে না কবে তারা প্রথম এই সুনির্মিত হুমকি দিয়েছিল। একমাস আগে আমি প্রায় তাদের উপর চেঁচিয়ে বলেছিলাম- আমি পোয়াতি, কেবল তাদের মুখভঙ্গি দেখার জন্যই, দেখেছি তাদের বির্বণ, শ্বাসরুদ্ধ, মৃগী রোগীর মতো চিৎকার করতে; মনে হচ্ছিল তারা যেন শহীদ হয়ে গেছে, যখন আমি আনন্দ আর রাগে চেঁচিয়ে বলতে চেয়েছিলাম- তোমরাই এর কারণ, কারণ তাদের কারণেই আমি এটা করেছিলাম, বেহুদা, বেচারা ফিলিস্তিনিদের মতো। না, আমি নিজেকে গোছাতে পারিনি কোনো কিছু বলার মতো করে। আমি চাইনি ওরা হস্তক্ষেপ করুক। আমি কখনোই ওদের সঙ্গে এ রকম কোনো বিষয়ে কথা বলতে পারবো না। এমন ভাবনাও কোনোদিন তাদের মাথায় ঢুকবে না... আমার জন্য নিদেনপক্ষে কম তো তারা করেনি... ডিনার, যেমন বলে থাকে ওরা, একটা প্লাস্টিকের টেবিলক্লথের উপর ছড়িয়ে সব খানাদানা, মুরগি আর বাগানের সেরা মটরশুঁটি, মা বলেছিল- চলো যাই দেখি ওরা সিডারে কী তৈরি করছে, দোকান চলছে, উল্টোদিকেই কাপড়ের দোকান, এটা একটা প্রতিযোগিতা। বাবা বলেছিল- সে এটা বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না আর ওরা ঝগড়া করলো। মনে হচ্ছে ঠিক যেন আমি ওখানে ছিলাম। আমি ওদের কথা ভাবতে চাই না আর ওদের মুদি দোকানের কথাও ভাবতে চাই না। আমি ওদের সঙ্গে আমার ঘরের পরিষ্কার, নতুন সাদা দেয়াল, স্টিলের ওয়াশ বেসিন আর বুক সেলফের সংযোগ খুঁজে পাই না।
এখানে আমি বালি লেস্যু নই, আমি কলেজ ছাত্রী। ক্যাম্পাসে অনেক গাছ, চকচকে, চমৎকার, পথজুড়ে, গাড়িগুলো বেড়ার ধারে পার্ক করা হয়। এগুলো দেখতে যেন মন্তিচেলি’র চিত্রকলা। সাংস্কৃতিক ধারণা পেতে কিছু দেরী হয়, চারুকলা ছিলো শেষ বর্ষে, আর ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এ ছাপা হওয়া ছবি ছাড়া আমি অজ্ঞই ছিলাম। পাতাগুলোকে পিষ্ঠ করে আমি দৌঁড়াতে চাই, সূর্যের রশ্মি আমার পথটাকে আড়াআড়িভাবে কেটে ফেলছে, তীব্র বাতাসে মুমূর্ষু আমি মুক্তি চাইছি বিশ্রি স্বাদ থেকে। কিন্তু আমাকে আমার মেরুদণ্ডের উপর থাকতে হবে, আমার তলপেটের উপর, পা ফাঁক করি, উঠবোস করি, বুক ডন দেই, গর্ভপাত পূর্বকালীন জিমস্ট্যাকি। কেমন করে সে হেসে উঠতো, নোংরা ছোট্ট বুর্জয়া গর্দভটা... আমার পেট অনুভব করি, কল্পনা করি যখন সব ঠিক হয়ে যাবে তখন কেমন অনুভূতি হবে, যেন একটা বোমা বিস্ফারিত হলো, মেলার মধ্যে একটা বেলুন কিংবা একটা স্ফুরিত উষ্ণ প্রস্রবণ।
ঠিক আমার প্রাপ্য ছিল, একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে শান্তি। পুরো ব্যাপারটা আলোড়িত হয়েছিল একটা ছোট লাল টিউবের মাধ্যমে। বিশ বছরে এটুকুতে আসা। কারো দোষ নয়। কেবল আমার নিজেকেই দোষারোপ করা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কে? প্রথমত আমি ছিলাম এক দোকানদারের কন্যা, সবসময় ক্লাসে প্রথম হওয়া। তারপর বিরাট এক পিণ্ড রোববারে মোজা পরে, বৃত্তি পাওয়া ছাত্র। তারপর, এক গলির গর্ভপাতকারীর দ্বারা মাথা নষ্ট হওয়া নারী, আর সেটাই হয়তো সব কিছুর শেষ হবে। দোকানের জানালার গরাদ ঘেঁষে বিনের কৌটার মধ্যে আমি, তিন বছর ধরে পরা তামাটে কোট পরা আমি, এই বইগুলো- তুমি কি এগুলো পড়েছ? জুলাইয়ের মেলার পর মাঠের চেপ্টা ঘাস, নরম কোমল হাত, না, তুমি নিশ্চয়ই তা নয়... চারদিকে লোকজন, ঘুরছে, নড়াচড়া করছে। তারা নিকটবর্তী হয়, বেগুনিমুখো, বুড়োগুলো সবসময় ধারকর্জের মধ্যে থাকে, একাকীত্ব বুড়োদের বাড়ি ছাড়িয়ে পাশের দরজায় চলে যায়, নোংরা বুড়ো লোকগুলো সব সময় তোমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, একজন যে বাকীতে কর্নড-বীফ কিনছে। ওরা জানতো আমি ওদের অবজ্ঞা করি, লেস্যু বালিকা, যে কিনা আলু পরিবেশনে বেশ দক্ষ। এখন তারা প্রতিশোধ নিতে পেরেছে।
সেক্রেটারি, টাইপিস্ট, ওরা বুঝতো, সাদা হাতের লাল নখপালিশের এই মেয়েটি, খানিকটা দেমাগি। কিন্তু সে একজন ছাত্র, সেটা ওদের ভাবনার বাইরে, কী পড়ে এই মেয়ে, সাহিত্য, একটা শূন্যতা, একটা ধোয়াশা, ওরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চিন্তা বাদ দেয়, যেমন আমার পুরনো লোকজন বলতে জানতো না কী করে ওদের বোঝাবে? কোণঠাসা। একটা আকস্মিক নাড়াচাড়া, চিকিৎসা অভিধানের বর্ণনার মতো এক ফোঁটা বিন্দু, তারপর সব শেষ হয়ে যাবে। তারা খুঁজে পাবে, তারা যাবে আর বুলি কপচাবে দোকানে বসে, তৃষিত নয়নে, ‘কী করে এটা হয়েছিল,’ সবাই কাউন্টারের পেছনে লাইন ধরে দাঁড়াবে। এক পাউন্ড আপেল, এক টুকরা চিজ নেবে ঠিকঠাক সব চালাতেই। আমার বাবা-মা ছোটাছুটি করবে, আর কিচ্ছু না জানার ভান করবে। ‘আর কিছু লাগবে?’ সব ক্রেতারা ফাটা টালি-পাথরের দাগের উপর গেড়ে বসেছে, তাদের মিথাইল এলকোহল আর শস্তা ভিনেগারসহ, একে অপরকে ঠেলছে কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। ভুল জায়গায় একটি সিস্ট, একটা টিউমার, একটা শিরা কোথাও ফেটে পড়েছে।
সব গুজব গাদাগাদি করছে। এই ব্যস্ত শরীরগুলো আপনি ছেলেখেলা ভাববেন না। আমি তাদের অত্যন্ত ভালোমতোই চিনি। আমি বহুবার তাদের দেখেছি রাতের খাবার কিনতে এসেছে, এক সপ্তাহের বাকীর জন্য মিনতি করতে, কথা বলতে নিজেদের যতো সমস্যা নিয়ে, মানবিক মর্যাদা, শালীনতা, ভদ্রতা, তাদের শব্দভাণ্ডারেই নেই। আমি তাদের ছোট্টবেলা থেকে কলেজ পর্যন্ত দেখে এসেছি, দোকানের মাছখানে শিকড় গজিয়ে গেছে যেন, বারের বৃত্তাকার টেবিল ঘিরে গেড়ে বসে আছে, বিবর্ণ ওয়ালপেপার, সার্বক্ষণিক বকবক আর সবসময়ই তাকিয়ে আছে। তারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো, আমার শার্ট পরা দেখতে, রান্নাঘরের বেসিনে ধোয়ামোছা দেখতে, টেবিলের এক কোণায় আমার বাড়ির কাজ করা দেখতে। ‘কি মিষ্টি মেয়ে, নীনা, তোমার পোশাকটা কই পেলে? বড় হয়ে তুমি কী হবে? তুমি কি বারের পরিচারিকা হবে? তোমার জিভ বের করো না, নইলে আমি তোমার প্যান্ট খুলে পাছায় পিটাবো।’
বারের সেই সব নিবোর্ধগুলো আমাকে নিষ্পেষিত করতো, হয়তো আমাকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলতো, যদি একটা সুযোগ তাদের দেওয়া হতো। যদি আমি বসের মেয়ে না হতাম, যদি আমি শুরু থেকেই বিতৃষ্ণ না থাকতাম, যদি ওই সব বুড়ো বুড়িদের প্রতি সামান্য ভালো ব্যবহারও করতাম, ‘আমার তোমার অভিভাবক, জেনে রেখো।’
অনুশোচনার বন্যা। আমি সহ্য করতে পারতাম না এ সব। তারপর কবর দেই এসব কিছুর, সব একত্র করি, একটা এসেম্বলি লাইন, একটার পর একটা। ব্যাখ্যা করো কেন আমি চুপ পড়ে আছি এই নোংরা ডরমের ঘরে, মৃত্যু ভয়ে কাতর আর কী হতে যাচ্ছে জানি না। খুঁজে বের করুন এই সংকোচনের, কুঞ্চনের তলায় যান। খুঁজে বের করুন এই পুরো বিশৃঙ্খলার সূচনা কোথায়। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারি না, আমি তো ওদের আমার জন্মকাল থেকে ঘৃণা করিনি, আমি সব সময় আমার অভিভাবকদের ঘৃণা করিনি, এই ক্রেতাদের, এই দোকান... আমি এখন অন্যদেরকেও ঘৃণা করি, যাদের আছে শিক্ষা, অধ্যাপকদের, সম্মান্নিত লোকদেরও। আমার জন্য এরা মরণব্যধির মতো। সব কিছুর উপর বমি করে দেই- আমার শিক্ষা, সংস্কৃতি, যা কিছু আমি শিখেছি। একেবারে আউলা ঝাউলা... (চলবে)
/তারা/