ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

আনি এরনোর উপন্যাস ‘ঝেড়ে ফেলা’: দ্বিতীয় পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২২, ১৮ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ১৯:২৪, ১৮ অক্টোবর ২০২২
আনি এরনোর উপন্যাস ‘ঝেড়ে ফেলা’: দ্বিতীয় পর্ব

লেস্যু’র দোকানটাই যথার্থই গুরুত্বপূর্ণ, ক্লোপাত সড়কে একমাত্র, শহরের কেন্দ্র থেকে বহুদূরে, প্রায় গ্রামের কাছে। চারিদিকে ক্রেতা, বাড়িটি ভরপুর, টাকা পয়সা শোধ দেয়া হচ্ছে, মাসের শেষ দিকে। নিজের গুণেই সে যেন একটা ছোট্ট নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা। এই পুরো বাড়িতে তুমি কোনো একান্ত আশ্রয় খুঁজে পাবে না, কেবল উপরতলায় বিশাল বরফাচ্ছাদিত একটি ঘর ছাড়া। শীতকালে ওটা যেন ঠিক উত্তর মেরু আর আমি সেখানে যেতাম অভিযানে, নাইটগাউন পরে বিছানায় পিছলে যেতাম আর স্যাঁতস্যাঁতে বিছানার চাদর সরিয়ে পথ করে নিতাম কাপড় মোছার তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো গরম ইটের দিকে। 

নিচতলার দিন কেটে যায় ক্যাফেতে আর হপ বাগানের মাঝে। এর মাঝখান দিয়ে একটা পথ চলে গেছে সিঁড়ি আর রান্নাঘরের দিকে, সেটা টেবিলে পূর্ণ, তিনটা চেয়ার, একটা কয়লার চুলা, আর পানি ছাড়া একটা বেসিনও আছে। আমাদের বাগান থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি আনতে হয়। আমরা রান্নাঘরে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাই, আমরা হুড়োহুড়ি করে খাবার নিয়ে নামি বেলা একটার দিকে আর আরেকবার সন্ধ্যায় সব ক্রেতা চলে গেলে নামি। আমার মা ছুটাছুটি করতেই থাকে, পেটের কাছে ঝুড়িগুলো ঝুলিয়ে, তেল কিংবা রামের বোতল থুতনি দিয়ে ঠেকিয়ে, চকলেট, চিনি তিনি ভাড়ার থেকে নিয়ে দোকানের দরজা খোলেন পা দিয়ে। তিনি দোকানে থাকেন আর বাবা ক্যাফে বারে থাকেন।  ক্রেতারা দোকান থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, চারিদিকে, একদল সারি বাঁধে কাউন্টারের পেছনে যেখানে মা আলু, চিজ মেপে দেন, তিনি একা একা নিজের সঙ্গে বকবক করতে থাকেন, আর তারা স্তূপ করে ক্যাফে টেবিল ঘিরে থাকে, বাবা উঠানে একটা শৌচাগার তৈরি করেছেন একটা ব্যারেল দুটো খাড়া তক্তা দিয়ে মুরগির ঘরের পাশেই। 

প্রথম জন সকাল সাতটাতেই এসে পড়ে। যখন আমি আমার নাইটগাউন পরে নীচতলায় যাই, ওরা তখন চলে এসেছে। মোটা চামড়া জ্যাকেটের সাজসজ্জায়, ব্যাগগুলো জবুথবু হয়ে আছে টিনের কৌটায়। তাদের বিরাট হাতে গ্লাস ধরা, তারা খানিকটা কুঁজো হয়ে আসে এর উপরে। তারা রওনা দিয়েছে তাদের কাঠের কল কিংবা নির্মাণ প্রকল্পের স্থানে। পরবর্তীতে, যখন তারা ফেরত আসে, ব্যাপারগুলো যথার্থই চলতে থাকে, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়, যারা পুরোটা দুপুর ওখানেই ছিলো, তুচ্ছ বুড়ো লোকগুলো সেই সব বুড়োদের বাড়ি থেকে তাদের নোংরা হাসি সহ হাজির থাকে, আর নিরাময়ের অযোগ্য, কাজের জায়গায় গিয়ে আহত হয়ে ফিরে আসে ওরা নোংরা ব্যান্ডেজসহ। আমার বাবা তরুণ আর সমর্থ, তিনি তাদের সবার উপরেই অবস্থান করেন। তিনি বোতলগুলো রাখেন আর এর শেষ ফোঁটা পর্যন্ত হিসাব রাখেন, অভিজ্ঞ চোখে। মাকে চিৎকার করে বলেন, ‘তুমি বরাবরই বেশি ঢালো, তুমি ঠিকঠাক করতে পারো না।’ 

তিনি সকল ক্রেতার অথচ কারোরই নন। ‘কারো প্রিয় হতে পারবো না।’ অপরিবর্তনীয়, তিনি ওদের বলেন, ‘তুমি অনেক গিলে ফেলেছো, বাড়ি যাও, তোমার বউ তোমার অপেক্ষা করছে।’ তিনি উগ্র যে তাকেও শান্ত করতে পারেন, যারা কখনোই মনে করে না পর্যাপ্ত পান করেছে, তারা মারামারির চেষ্টা করে : ‘আমি পুলিশ ডাকবো, তারা তোমাকে ঠিক করবে।’ তার উদ্ধত দৃষ্টি স্থির রয়ে যায় ক্রেতাদের উপর, সদা সতর্ক, বাড়াবাড়ি করলেই তাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার জন্য তৈরি। কখনো কখনো এমন হয়ও। তিনি তেমন লোক পেলে তলা থেকে চেয়ারটা টান দিয়ে সরিয়ে দেন, গলার স্কার্ফে ধরে আর ধীরেসুস্থে তাকে দরজায় দিয়ে আসেন। জাঁকালোভাবে। 

আমার পাঁচ বছর বয়সে এইটাই আমার কাছে আমার বাবার চেহারা, এমনকি দশ বছর বয়সেও। আমি সুখি ছিলাম, আমি যেন জলের মধ্যে একটা মাছ ছিলাম। দুই টেবিলের মধ্যে ছুটে চলা, আমি ইচ্ছা করেই একটা বাতিল টিনের কৌটায় পা ফেলে দিয়ে ক্যাঁৎ করে শব্দ করি। ‘বেরিয়ে আসো ওখান থেকে, নিনিস, তুমি তো লোকের পায়ের তলায় পড়বে।’ কোনভাবেই না। আমি বাইরের লোকটাকে অনেক আকর্ষণীয় মনে করি। আমি ঠিক ওখানেই রয়ে ছিলাম। কোন দুইজনই একরকম নয়। আলেক্স, একটা বিরাট মাংস পিণ্ডঅলা লোক, ‘এই খুকি, তুমি কি স্কুলে যথেষ্ট পরিশ্রম করছো?’ তার বিরাট চোখগুলো তার মুখকে ঘিরে খেপার মতো ঘুরছিলো, এক মুখ বিচিত্র রঙের, একটা সত্যিকারের রঙধনু, স্ট্রবেরি, ভায়োলেট, ফিকে লাল থলি যেন তার চোখের নিচে। ও বউকে পেটায়। সে রাত নটার সময় মেয়ে মঁনেকে মদ আনতে বাইরে পাঠায়। বুড়ো লোকটা, লেরয়, চাদরের মতো সাদা, রাজনৈতিক বক্তৃতা দেয়, ‘তারা ক্যাবিনেট ছুঁড়ে ফেলেছে, ওরা গোস্তের দাম বাড়িয়েছে, দ্রুতই আমাদের আর খাওয়ার কিছু থাকবে না...’ সবকিছুরই পতন হয়, যেহেতু দুনিয়াটাই তার ধূসর মুখে গড়াগড়ি খায়। আমি যখন শুনি তখন শিহরিত হই। বাউবল আরেক জাতের কেতলির মাছ। বাউবল যে দেয়ালে লেখে, চেয়ারে ঘোড়ায় চড়ার মতো দু’পা ফাঁক করে বসে, বলে, ‘আমাকে একখান বিয়ার এনে দেও, বস, আর তুমি, এদিকে আসো।’ 

সে আমার একটা কোঁকড়া চুল ধরে টানে। নিকট দৃশ্য, আবহাওয়ার আঘাতে জর্জরিত চামড়া, একটা হাসি যা তার দাঁতের ফাঁকের মধ্যে কুলকুচার মতো শব্দ করে। দুনিয়ার বালক আর পুরুষরা নেহাত কয়েক ফুট দূরে। ‘ওদের ছেড়ে দাও।’ মা বললো।
‘আমাকে যেতে দাও হোৎকা বলদ, তুমি আমাকে ব্যথা দিচ্ছো।’
‘একটা সুন্দর করে হ্যালো বলো। তারপর আমি ছেড়ে দেব।’
কেউ দেখে না, আমি প্রথমবারের মতো নিজের ঠোঁট মুছে ফেলি যা প্রথমবারের মতো ঝাঁঝালো, রুক্ষ্ম, দুর্গন্ধযুক্ত বাউবলের চামড়ার ঘষা খেয়েছে।

তারা আমাকে যে কোনো কিছু করতে দিতো, ওদের পায়ে পারা দিতে দিতো, জঙ্ঘায় লাথি দিতে দিতো, তাদের মাথায় বল আঘাত করতে দিতো, ওরা এসব কিছুতেই আমোদ পেতো। আমি এর পুরো সুযোগ নিতাম, চিমটাতাম, খামচাতাম, ওদের পকেটে গুপ্তধন খুঁজতাম, পুরনো নোংরা নোটবই ঘাঁটতাম, পুরনো সামরিক ফটোগুলো, সিগারেটের কাগজ তাদের পকেটে ঘাঁটতাম। আমি কেবল নতুন মুখগুলোকে ছেড়ে দিতাম, যারা ঘটনাক্রমে এখানে এসে পড়েছে। আমি ওদের চারপাশে ঘুরপাক খাই যখন কয়েক ফুট দূরে আমার বাবা তাদের জন্য মদ ঢালে আর আমি চেষ্টা করি ওরা কে তা বের করার। আমি যদি কিছু একটা বের করতে পারি, তবে সেটা সাধারণ কোন আড়িপাতা আর গুঞ্জন। ক্রমে ক্রমে নবাগতরাও আমাদের একজন হয়ে ওঠে, তাদের সম্পর্কে সব কিছু বলে। যা জানতে চায় তা বলতে আমার ভালো লাগে। সুষ্পষ্ট। আমি যোগ দেই, ‘ওইখানে কোন জন?’ একটা অচেনা শিহরণ খেলে যায় আমার মেরুদণ্ডে যখন আমি আগন্তুকের দিকে তাকাই যে এসেছে শহরের অন্যপ্রান্ত থেকে, ‘বিভাগ’ থেকে, যেখানে কেউই ল্যাস্যু’র দোকান সম্পর্কে শোনেনি।   

কখনোবা তারা আসে একেবারে মজুদ করা ভাণ্ডার নিয়ে, একদল নির্মাণ শ্রমিক। ওরা আমাদের কাছে আসে কারণ আমরাই সেরা। তারা ওদের টিনের কৌটা গরম করতে পারে এখানে, এক কৌটা পাতা কপির আচার অর্ডার দিতে পারে, তাদের হ্যাঙওভার কাটাতে কুঠুরিতে ঘুমাতেও পারে। তারা পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে যায়, আমি ওদের হাঁটুতে বসি, ওরা ওদের ছবি বের করে দেখায় আর আমাকে কমলালেবুর কোয়া দেয়। একবার চাকরি শেষ হয়ে গেলে ওরা চলে যায়। সেটা ছিল আমার জীবনের একমাত্র বেদনাতুর দিক, আমার বাবা-মা আর আমি রয়ে যেতাম, বাকী সবাই চলে যেতো, দ্রুতই অন্য কাউকে দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতো জায়গাটা, একের বদলে আরেকজন। ঠিক যেমন ক্যাফেতে বলা গল্পগুলো হয়, সব সময়ই নতুন, কোনো একটা জায়গায় শুরু হয় আর কখনোই সন্ধ্যা ফুরাবার আগে শেষ হয় না, গল্পগুলো বারবার অভিনয় করে দেখানো হয়, অনুকরণ করা হয় অনুপস্থিত শত্রুদের, সর্দার, মালিক আর শহরের কেন্দ্রের দোকান মালিকের। ‘কি বলতে চাও, আমার অংশটা ঠিক মতো সাজানো হয়নি’ আর কখনোবা আমি বলেছি: ‘আরে শোনো, তুমি কি আমাকে বলতে চাইছো আমি আমার কাজ জানি না, একটা শব্দও বলো না, আমার মাথা খারাপ করাইও না, দেখো,’ উত্তেজনা... আরাম, এলেক্স পারলে তার সর্দারকে ঝুলিয়ে দিতো, কারখানায় আগুন ধরিয়ে দিতো...‘একদল হারামজাদা।’ ও তা করেনি। আর কেউ জানেও না কেমন করে এর সমাপ্তি হয়েছিল, সে আবার তার টেবিলে বসে পড়ে। আমি ওদের জন্য দুঃখ অনুভব করি, আমি আসলে ওদের পক্ষের লোক, গর্দভ মালিকগুলোর বিপক্ষে, আমি এই সাধারণ লোকগুলোর তারিফ করি, আমাদের ক্যাফেতে ওদেরকে আমি দেখি বিস্ময়ের সাথে। ওরা খোলামেলা, আর যতোই ওরা পান করে ততোই খোলামেলা হয়ে ওঠে, আর যথাবিহিত আরো চমৎকার হয়ে ওঠে। 

আমার বান্ধবীরা আর আমি ফাঁকা টেবিলে বসি, ওদেরকে আগাপাছতলা দেখি, যখন নানা নামে চুপিচুপি ডাকি তখন মিটিমিটি হাসি, দেখি ওরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় কি না, বিশেষ করে বুড়োদের বাড়ি থেকে আসা বুড়ো নির্বোধগুলো। কোনো বিপদ নাই, ওরা শুনছে না, ওরা সব একসঙ্গে চেঁচায়, আবার একসঙ্গে চুপ হয়ে পড়ে। ওদের দুর্ভাগ্য ওখানেই, টেবিলের উপরে, তাদের সামনের গ্লাসে, ওরা মাথা নিচু করে বসে থাকে, সেই একই একঘেয়ে কাজকর্ম করতে থাকে, যত্তোসব, ফালতু। মা পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, ‘তোমার নিজের উপর লজ্জ্বিত হওয়া উচিত, জনাব লেরয়, এইভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য।’

আড়ালে হাসি। এইসব কুঞ্চিত বুড়ো লোকগুলো কামুক, ওরা ওদের প্যান্টে হাত রাখে, ভাব করে যেন হিসু করতে যাবো আঙিনার দিকে, নিজেদের উন্মোচিত হতে দেখে তারা একা হেঁটে যায়। আমি এইসব নোংরা বুড়ো আর যৌন বিকারগ্রস্থদের সম্পর্কে সব জানি, এটা জীবনেরই ঘটনা, তোমাকে জানতে হবে এদেরকে উপক্ষো করা, তবে প্রয়োজনে সরে যাওয়ার প্রস্তুতিও থাকতে হবে... এর বাইরেও আমি আর আমার বান্ধবীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করতাম এই সব জল্পনা-কল্পনায়। ওটা নরম, শক্ত, গোলাপি, ধূসর, কারোই সাহস ছিলো না খুব নিকট থেকে দেখার। আমরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে হাসাহাসির চেয়ে বেশি কিছু করিনি। একই ব্যাপার যেমন কোনো একটা বুড়ো ভাম বমি করতে উদ্যত আর দৌঁড়ে যাচ্ছে, খোলা মুখে, বাড়ির বাইরের আঙিনায়। আরও মজা হতো বন্ধের সময়টায়, রাত নয়টার দিকে যখন সবাই পরিপূর্ণ মাতাল। তারা নিজেদের কাপড় সামলিয়ে আর টিনের কৌটা নিয়ে এলোমেলো, বাড়ির পথে খুব কঠিনভাবে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কেউ হয়তো নিজের পায়ে দাঁড়ানো, খাড়া দাঁড়ায় একমিনিটের জন্য, তারপর দরজার দিকে ছুট লাগায় তাদের ঝুলে যাওয়া পাগুলো যতো দ্রুত ছুটতে পারে তেমন করে। অন্যদের দেখে মনে হয় ওরা যেন এখনও বসে আছে, দুই ভাঁজ হয়ে আছে... ক্যাফের  মেঝের দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। 

কিছু কিছু আছে কঠিন জিনিস, শক্ত বস্তুতে তৈরি, যেমন আমাদের এলেক্স, ইয়ার্কিবাজ আর তর্কপ্রবণ, যে ভীষণ ভুল করে অন্ধের মতো আর ধুম করে কিছু একটাতে ধাক্কা খায়। তারা একে একে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়, দূরে, পেঙ্গুইনের মতো হাস্যকর হাত দুটো পেছনে বা কোমরে ঝুলিয়ে। জানালার পেছন থেকে, আমি ওদের চলে যাওয়া দেখি। তারা থামে, সিদ্ধান্ত নিতে চায় ডানে নাকি বামে যাবে, তারপর ডানে-বামে ঘুরে ফিরে আগাতে থাকে আর একসময় ক্লোপাত সড়কের মাথায় হারিয়ে যায়। তারপর আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মোনেত আর আমি লোভির মতো গ্লাসের তলানি ঝাকাই, এক চুমুক উজ্জ্বল রঙকে এনিসের ঘ্রাণের সাথে মেশাই, আমরা দেখি শূন্য পাত্রে মাতালদের ফেলে রাখা জিনিস দিয়ে কি মিশ্রণ বানাতে পারি, কোনো কোনো মাতাল গ্লাসটাকে একদম পরিষ্কার করে রেখে গেছে, শুয়োরগুলো। আমার বাবা গ্লাসগুলো সংগ্রহ করে, চেয়ারগুলোকে একটা কাপড় দিয়ে ঝাড়ে, মদের ফোঁটাগুলো মুছে ফেলে, মোনেত বাড়িতে যায়। আমি টালি পাথরের উপরে লাফাই ওদের বাদামি আর ফিকে লাল মদের রেখার উপর দিয়ে। ওটা পূর্ণ থাকতো উষ্ণতায়, ধোঁয়ায়, লোকের জীবন কথায় ভরপুর, যারা আমাকে হাঁটুতে বসাতো, লোকে যখন প্রচুর মদ খায় তখন তারা শিশুদের পছন্দ করে। 

দোকানে আর কোনো ক্রেতা নাই, আর আমার মা জানালার উপরের কাঠের কপাট টেনে দেন, তার উপরে একটা লোহার রড বসিয়ে দেন আর এসে বসেন, কিচেনের চেয়ারের উপর ধপাস করে। ‘যেই আসুক এখন যতো জোরে খুশি নক করতে থাকুক। সচরাচর দেরিতে আসা লোকগুলা উচ্ছৃঙ্খল হয়।’ প্রত্যেক সন্ধ্যায় সে বলে যথেষ্ট হয়েছে। তার অগ্নিশিখার মতো লাল চুল কাঁধের উপর একটা গোছা তৈরি করে, তার গালের রুজ গড়িয়ে পড়ছে। তার বিবর্ণ ওভারঅলের উপর বাহু দুটো আড়াআড়ি রাখে, তার প্রসারিত ঊরুর উপর টানটান করে রাখে। সে ক্লান্তি আর ক্রোধের ফেনায় ভাসমান। ‘এখনও টাকা দেয়নি, ওই নোংরা কুত্তিটা! কাল আমি ওর কাছে কিছুই বেচবো না! যাক না সে শহরে দেখুক কেউ তাকে বাকীতে কিছু দেয় কি না! একটা পুরা ঝুড়ি ভর্তি করে এসেছিলো সে!’ একটা মিষ্টি গন্ধ, ক্যাডম সাবানের, টক ওয়াইনের, চারপাশের গাদাগাদি বোতল থেকে আসছে। তিনি এতো শক্তপোক্ত যে চেয়ারটাকে তার জন্য ছোট মনে হয়। ওষুধের দোকানের দাড়িপাল্লার মাপে তার ওজন একশ পচাত্তার পাউন্ড। আমি ভাবতাম তিনি চমৎকার। আমি সেই সব অভিজাত কঙ্কালকে অপমানিত করেছি যারা ক্যাটলগে মডেল হিসেবে থাকে, রেশমি চুল, সমান তলপেট, চাপা বক্ষ। আমার কাছে সৌন্দর্য ছিল মাংসের বিস্ফোরণ, নিতম্ব, বক্ষ, বাহু আর পা ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে,  উজ্জ্বল পোশাকের ভেতর দিয়ে আর দেখাবে দেহের রেখা, স্ফুরিত, বাহুর তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে সমতল। যখন সে বসে তুমি তার প্যান্টি পর্যন্ত দেখতে পারবে, এক রহস্যময় পথ অন্ধকার পর্যন্ত চলে গেছে। অন্য দিকটা দেখো। 

যখন সে কথা বলে, আমার বাবা অলসভাবে টেবিলে বসে। তিনিই সবজিগুলো তৈরি করেন এবং বাসনকোসন ধুয়ে নেন, এটা তার জন্য সোজা, দুটো অর্ডারের মাঝখানে কিংবা দুই দান ডোমিনো গেম খেলার মাঝখানে করে নেয়া। রাতের খাবারের কালে, ক্যাফেতে যে সব গল্প বাবা শুনেছে তা মায়ের অভিযোগ আর হুমকিকে সরিয়ে রাখে, এমনকি সন্ধ্যারাতেও আমরা একা নই, ক্রেতা আছে সেখানে, মিনতি করছে, পকেট খালি, আমার বাবা-মা’র অনুগ্রহ আশা করছে, যে হাত ডিনারের জন্য নিয়ে আসবে এক কৌটা মটরশুঁটি, সামান্য আরেকটু পানীয়, প্রত্যাখাত হবার ভয়।

‘অবশ্যই না! আমি ওকে কিছুই দেব না, ওর টেবিল এখনও ভরপুর, কখন ও পয়সা দেবে?’ আমার কাছে আমার পিতা-মাতা যেন ক্ষমতাবান, স্বাধীন, অনেক বুদ্ধিমান এইসব ক্রেতাদের থেকে, ওরা তাদেরকে রক্ষাকর্তা ডাকে, আমার বাবা-মা একটা আরামদায়ক জীবন পেয়েছেন, সবকিছুই তাদের নিজের ছাদের তলায়, হাতের নাগালে, নুডুলস, চিজ, জ্যাম যা আমি বড় চামচ ভর্তি করে খাই রাতের খাবারের পরে এবং তারপর পকেট ভর্তি ডজনখানে সুগন্ধি গাম নিয়ে বিছানায় শুতে যাই। প্রচুর আগুন্তুক ছিল তাদের, সব সময়ই পার্টি ছিল, তবে লোকে টাকা দিয়েই আসতো। তারা ক্যাশ রেজিস্ট্রার ভরে ফেলতো টাকা-পয়সা আর বিলে। আমার বাবা নগদ রাখার ক্যাশ রেজিস্টারটা টেবিলের উপর রাখতেন স্যুপের প্লেট আর সামান্য রুটির সঙ্গে। বিলগুলো হাতে হাতে দেয়া হতো, বাবার হাতে ভিজে যেতো আর মা খোঁজ খবর নিতেন, ‘আজ কতো কামাই হলো?’ 

পনের হাজার, বিশ হাজার, আমার জন্য সৌভাগ্যই বটে। ‘আমরা আমাদের আয়ের জন্য কঠিন পরিশ্রম করি।’ আমার বাবা টাকাগুলোকে তার পকেটে চালান করে দিত, এখন আমরা একসাথে ফূর্তি করতে পারি। আমরা মজা করি, আমি তার চুল আচড়ে দেই, আমরা গান গাই, কাতুকুতু দেই, আগ্রহী আর উত্তেজিত, আমি প্রমাণ করতে চাই যে আমিই সবচেয়ে শক্তিশালী। আমি তার কান টানি আর তার গাল আর মুখ টানি, তার বিকট মুখ আমাকে ভয় দেখায়। ‘আমি কিচ্ছু টের পাচ্ছি না, থামিস না!’ আমি চেয়ারে দ্বিগুণ ঝুকে আসি তার ছোট্ট আঙুলটা মুচড়ে দিতে, সবগুলো আঙুল লাঘ শুধু একটা একটা ভাঙা, শেষপ্রান্তে কালো নখ। ‘কাজ করলে এমনি হয়!’ সে নেহাত তার হাত ঘষে আর আমার মতোই জোরে জোরে হাসে। ‘বাবা, চলো প্রতিভার প্রতিযোগিতা হোক!’ একটা খ্যাসখ্যাসে গান, ‘একদিনের রানি গো,’ আর সে আমার এপ্রোন আমার মুখে বেঁধে দেয়। ‘পাইছি তোরে!’ মা এদিকে মনোযোগ দেয় না, তার পা চেয়ারের উপরে ছিলো যেখানে আগে আমি ছিলাম, সে অর্ধেক ঘুমে কিংবা একটা চিনির দলা চুষে খাচ্ছে আর একটা সত্যিকারের স্বীকারোক্তি পড়ছে। ‘অহেতুক ফাজলামো থামাও তো!’ সে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠতো। আমি সত্যিই ছেড়ে দেই। পুরোটা সন্ধ্যা আমি বারে কি হয়েছে আমি তা দেখে গেছি আর ক্রেতাদের সাথে ইয়ার্কি মেরেছি, আর রাতের খাবারের পর, আমি পার্টিটাকে একটা চূড়ান্ত রূপ দিতে চাই, আমরা তিনজন একা, চিৎকার করছি, হাত আর মাথা একসাথে, কাতুকুতু তোমাকে হাসাতে থাকে যতোক্ষণ না ব্যথা হয়। আমি ক্রেতাগুলোকে যথেষ্ট পছন্দ করতাম, আমি হয়তো তাদের মিস করতাম, কিন্তু আমার বাবা, তিনি ছিলেন আসল বস, সেই মানুষ যিনি হাতের এক ঝটকায় টাকা কামাতে পারেন, তার কাছেই আমি নিজেকে ছেড়ে দিতাম। (চলবে)  

আনি এরনোর উপন্যাস ‘ঝেড়ে ফেলা’: সূচনা পর্ব      

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়