নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ষষ্ঠ পর্ব
বুড়ো লোকগুলো, নারীরা তাদের চপ্পল পরে এসেছে, এই সকালে বাজার করতে। এমনকি বেতন পাওয়ার দিনটিতেও, বুড়ো ল্যাইনার তার কর্জ শোধ করতে পারে না। ভুলে যাও ওদের কথা। এমনকি এই সকালে ওই সব ক্রেতাদের কথা ভাবাটাও বিশ্রি। আমি এখন অন্য জগতে বাস করি, আমার সঙ্গে ওদের আর কোনো কিছুতেই মিল নেই। আর তবুও সেটা ছিলো আমার পৃথিবী আমার সাত বা আট বছর নাগাদ, আমি সেই নারীদের মতোই ভাবতাম যারা ওভারঅল পরে কেনাকাটা করতে এসেছে আর তাদের আঙুল ঢুকিয়ে ক্যামেমবার পনিরের পক্কতা মাপে। একটা নোংরা মুখের মেয়ে, একদম আগাগোড়া পচা, আমি ওদের উপর বসবো, মুখের উপর হিসু করে দিবো। নিনিস লেস্যু, যে বড় হয়েছে সিগারেটের ধোঁয়ায়, টমেটোগুলোকে পাকানো হতো সাটারের নিচে যাতে করে সূর্যের আলো না পৌঁছায়... যেন একটা বিড়াল ছানা আশীর্বাদ পেয়ে তার চোখ ফুটেছে আর দেখছে, যা কিছু আছে সেখানে তার সবই তার নেয়ার উপযুক্ত। আমি নিজেকে মনে করিয়ে দিতে চাই না কী আমার পছন্দ ছিলো আর কী আমার ভালো লাগার।
কিন্তু পৃথিবীটা আমার ছিলো, ক্ষুধার পর, তৃষ্ণার পর, স্পর্শ আর কান্নার পর, সব মিলিয়ে এক সুতো আমার সহস্র টুকরোকে একত্র করে রাখতো, শক্ত, লিকলিকে, বাচাল, ডেনিস লেস্যুকে, আমাকে... মনেটে দোকানের সামনের নোংরা জমাট জলে পিছলা খাওয়া, একে অপরের উপর পড়ে যাওয়া, মুখে যেন আগুন, স্বপ্ন দেখা লম্বা একটা কোল্ড ড্রিঙ্কের কিন্তু বদলে পেতাম ছাদ থেকে পেচিয়ে নামা বরফের বড় তীক্ষ্ম খণ্ডগুলো। ভাঙা একটা সানগ্লাস পরার চেষ্টা করতাম, কণ্ঠরোধ করা অন্ধকারে টলমলে বুড়োর চলা, কালো মাটি, ধূসর মুখগুলো। বিদঘুটে পা আপনি তাকে যেখানে নিতে চান সেখানে সে যেতে চায় না, আমার তাবুতে ক্লাউনের মতো শুয়ে থাকে, একটা ছেঁড়া কম্বল ছড়িয়ে আছে ফাঁকা বাক্সগুলোর উপর। দেখছি মাছিগুলো পিছলে নীরবে চলে গেছে বোতলের ভেতরে আর ডুবে যাচ্ছে তলানিতে। মাঝে মাঝে যেসব বোলতাকে গ্লাসের তলায় আমি ধরতাম তাদেরকে দেখতাম ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে দম বন্ধ হতে। আর তারপর শরৎকাল, একটা মাফলার কুটকুট করতো গলায়, মোজাগুলো খুব আটোসাটো, লাল দাগ তৈরি করতো সন্ধ্যার জলীয় আকাশের নিচে। দড়িটা দ্রুত টান দাও! গুণতে শেখার খেলা, নাবিক সৈন্য, বড়লোক গরিব খেলা, ফকির আর চোর সাজা! দড়িটা শো শো ঘুরতে থাকে, আমার পালা এবার, আবার আমার পালা। আমি চিনি পছন্দ করি, আমি চা পছন্দ করি, আমি চাই মোনেটে আমার ভেতরে চলে আসুক। বারে ফিরে আসতেই আমার কাপড় পিচ্ছিল আর কুটকুটে। আমি আমার কোট আর জুতা খুলে ফেলি, তাদের যে কোনো দিকে ছুঁড়ে ফেলি।
একটা ছোট্ট মেয়ে সে যা খুশি তাই করতে পারে, বাবার প্লেটের মেরিনেট করা হেরিং মাছে ডুবে যেতে পারে। লবঙ্গ আর পিঁয়াজ দিয়ে ঢাকা, মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়, জিভে হুল ফোটায়। ‘বাবার জন্য একটু রাখো!’ ... ‘এই আরেকটু!’ আমরা ঠেলাঠেলি করি আর হাসি, আমি হাত চালিয়ে দেই মাখনের মতো কোমল, ভঙ্গুর মাছের ডিমের শিরা বরাবর... আমি এটাকে গলায় ঢেলে দেই গ্লাসে রাখা ঠাণ্ডা দুধ-কফির সঙ্গে, সাবধানে এর সরটা তুলে নেই চামুচের মাথায় যেন একটা স্যাতস্যাতে কাগজ। শনিবার সন্ধ্যায় ছিলো সাপ্তাহিক স্নান। গ্রীষ্মে চিলেকোঠায়, চিৎকার শোনা যায় শনিবার থেকে, কারণ শনিবার হলো পয়সা দেয়ার দিন। আর শীতে, সিঁড়ির তলার কাপবোর্ডের প্যানগুলো, একটা বেসিনে সাবান পানিতে ধোয়ার অপেক্ষায়, সবকিছুই ধোয়ার অপেক্ষায় শরীর, দাঁত, পরিষ্কার জলে কিছুই ধোয়া হয় না। আর আমার মা আবার এগুলোকে ব্যবহার করে সোমবারে টাইলস ধুতে, কারণ বাকী সাবানগুলো তখনও ওখানে রয়েছে। আমি দোকানের সামনে সব শুকাতে দেই, যে ড্রয়ারে কাপড় রাখা সেখানে আমার পা ডুবিয়ে দেই। ওইখানে নেনিতে সেমিজ পরে আছে, ক্রেতারা বলছে দরজার ওপার থেকে, কিন্তু আমি শুধু সামনের কাপড়ে মুড়িটুকু নামিয়ে দেই আর পেছনে তারা কেবল হিসু করার পথের রেখা দেখতে পাবে। ওদের মুখের লালিমা, হাসি দেখে আমি অনুধাবন করতে পারি যে আমি বড় হয়ে উঠছি।
উপত্যকায় কৃষকেরা,
উপত্যকায় কৃষকেরা,
হি হা ওই দুগ্ধ খামারে।
কৃষকরা বউ নেয়
কৃষকরা একটা বউ নেয়
হি হা ওই দুগ্ধ খামাকে
কৃষকরা একটা বউ নেয়।
সোনালী চুল, গোলাপী গাল, দশ বছরের একটা বড় পুতুল, সব ভিড়ের মধ্যে অনড়, ওর মা ছেলেটাকে নাম ধরে ডাকে যখন আমরা চার্চ ছেড়ে যাচ্ছিলাম... লাজুক তরুণি বধূরা বারে আসার সাহস করে, লেদ্যুর মেয়ে, বুড়ো মার্টিনের কন্যা, আত্ম-সচেতন কুমারী যে লাফ দিয়ে বলছে ওই ছেলেটা তার সারা পোশাকে ব্ল্যাক-কারেন্ট ছিটিয়ে দিয়েছে। বালিকারা তাদের প্রথম ‘হলি কমিউনিয়নে’ এসেছে, লম্বা বরবটি যেন, তরুণী বধূদের মতো, তাদের ব্লাউজের তলায় দুটো স্ফীতি, তারা তাদের বাবা-মাকে নিয়ে ক্যাফেতে আসে সেলিব্রেট করতে। আমি তাদের মুখ পর্যবেক্ষণ করতাম, নীল ওভারল, দক্ষিণ আফ্রিকানরা আসতো তাদের শস্তার কম্বল বেচতে, মদের দাগ, শুঁটকিগুলো অধিক রান্না করা, আর ওদের লোমশ বাহু ও বুক... আমি সব কিছুকে স্পর্শ করতাম, চিজকে আমার হাতের চেটোয়, টাবের আঠালো পৃষ্ঠ যেটা ভরে আছে পাঁচদিনের চটচটে আঠায়, আঙুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে, সব কিছুর মধ্যে উঁকি দিচ্ছি আমি... আমার তরুণ শরীর সব কিছুর রানী, সবকিছু তৈরি জীবনের জন্য, পেশীরা টানটান উরুতে আর পায়ের গোড়ালিতে। তুলনাহীন সুখ। মঁসিয়ে আর মাদাম লেস্যুর রু ক্লোপার্টের খুচরা বিক্রেতারা। একমাত্র কন্যা, ডেনিস। কেমন করে আমি জানবো সব কিছু এভাবে শেষ হবে? কখনোই এটা আমার মনে আসেনি যখন আমি পোশাক তুলতাম আর নিজের উরুসন্ধি দেখতাম ভাঁড়ার ঘরের আয়নায়, উত্তেজিত হতাম এই ভেবে যে অন্য কেউ একজন দেখছে আমাকে। থু করে ফেলে দাও, বমি করে দাও আর ভুলে যাও। আমার ভেতরে প্রাণের মৃত্যু হচ্ছে, আমার পেটের ভেতরে। কখন, কিভাবে। আমি আমার গল্প বলছি। আমি নিজেই তা বুঝতে পারছি না।
গ্রীষ্মমেলায় আমরা একটা অনুষ্ঠান দেখলাম; সেখানে একটা বড় রুপার বাক্স ছিলো মঞ্চে। আমি আমার বাবা মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক নারী এলো আর নাচলো, হাসলো আর নাই হয়ে গেলো, সে বাক্সের মধ্যে হারিয়ে গেলো। কিছু পুরুষ এর প্রান্তগুলো বন্ধ করলো, বাক্সের মধ্যে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলো, যেন একটা পিনকুশনে পিন ঢোকাচ্ছে। এখন আমার মনে পড়ছে না আমরা ওকে বেরুতে দেখেছিলাম কিনা।
ব্লেডগুলো ঝনঝনানি, তার পেটের ভেতরে, তার উরু আড়াআড়ি করে, চুল বরাবর মাথাগুলো বেরিয়ে আসছিলো। রু ক্লোপার্তে ফেরার সময় আমি ভয়ে আটোসাটো, তারা শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছিলো। ‘ভয় পেয়ো না, এটা নেহাত একটা জাদু...’ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমার পাশে হাটা বাবার বিশাল জুতোগুলোতে ঘাস আটকে আছে, মা তার সুন্দর নীল-ডোরাকাটা পোশাকে, আমি তাকে আকড়ে ধরেছিলাম। আমি পাঁচ কিংবা ছয় তখন, আমি তাদের ভালোবাসতাম আর আমি তাদের উপর আস্থা রাখতাম। হায় ঈশ্বর, কখন, কোন সময়ে, কোন দিন আমি ভাবতে শুরু করলাম দেয়ালগুলো স্যাঁতস্যাঁতে, মলপাত্রের দুর্গন্ধ, বুড়ো লোকটা নেহাত মাতাল ছাড়া কিছুই নয়, আর তলানি সব?...
কখন যে আমি আতঙ্ক তাড়িত হয়ে ভাবতে লাগলাম আমার বাবা মার মতো আমি বেড়ে উঠবো? এটা তো মুহূর্তে ঘটেনি, কোনো বিরাট বিরতিও পায়নি... ধীরে ধীরে চোখ ফুটেছে... ফালতু ক্ষুদ্র জিনিসগুলো। পৃথিবীটা একদিনে আমার হওয়া বন্ধ করেনি। বহু বছর লেগেছে আমি আয়নায় তাকিয়ে ভয়ে চিৎকার করার আগে, আমি আর ওদের নিতে পারছিলাম না, সব কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিলো... এটা ধীরে ধীরে ঘটেছে। কার দোষ? এমনকি তখনও কিছু উজ্জ্বল মুহূর্ত ছিলো, আমার কিছু হলেও আনন্দ ছিলো। তারপর হয়ে উঠলাম একটা পচা মেয়ে।
তারপর এলো প্রাইভেট স্কুলের দিনগুলি, এক উজ্জ্বল দুনিয়া, আমার বাবা এমনভাবে সেটা উচ্চারণ করতেন যেন চার্চের কথা বলছেন। ক্যাফের একটা চেয়ারের পাশে বসে আমি বাবাকে ‘কাম অন বেইবি’ গানের সাথে নাচতে উদ্বুদ্ধ করি কারণ ওই একটা নাচই সে জানতো। হঠাৎ সে থামলো আর একদম গম্ভীর হয়ে গেলো, ‘তোমাকে সঠিক আদব কায়দা শিখতে হবে এবং ঠিকঠাক কথা বলতে হবে! একটা প্রাইভেট স্কুল, জানো!’ সে ভয়ে ছিলো আমি হয়তো ভালো ছাত্রী হবো না... ‘তুমি বকা খাবে!’ আমি কোনো কিছুতে ভয় পেতাম না। আমি যা দরকার সবই তো আমি পেয়েছি, একটা চামড়ার ব্যাগ, ওগুলোই সেরা, একটা স্লেট একটা লেড পেন্সিল। ‘তোমার জিনিসপত্র অন্যকে ধার দিও না, ওগুলোর অনেক দাম,’ আর বললো, ‘তোমার সোয়েটার খুলবে না, তুমি ওটা হারিয়ে ফেলবে।’
বাবা আমাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলেন, তার জ্যাকেটের তলায় এপ্রোণ ঢাকা পরে আছে, ইলাস্টিক ব্যান্ড তার প্রাউজারের প্রান্ত আটকে রেখেছে। আমরা একটা লম্বা করিডোর পেরুলাম, এটা লাল সাদা টাইলসে ভরা, আর অনেক অনেক দরজা। আশেপাশে কেউ ছিলো না। আমার বাবা চিন্তিত ছিলো, সে জানতো না কোনদিকে যেতে হবে। আমরা আবার বাইরে গেলাম, আমার অনেক আগে এসে পড়েছি, বাকী ছাত্ররা যখন এলো তখন আমরা ঠিক দরজাটা খুঁজে পেলাম। ওটা ছিলো ইস্টারের ছুটির পরের সময় আর অন্যরা তাদের পথ জানতো। পরে আমি অন্য মেয়েদের সঙ্গে আঙিনায় গেলাম সেখানে তারা আমাকে খেলায় নিতে চাইলো। আমি চাইনি, আমার চামড়ার ব্যাগ আছে, পেন্সিল বক্স আছে, স্লেট মোছার স্পঞ্জ আছে। ওরা সত্যিকারের খেলা খেলছিলো না, তারা কেবল জায়গাজুড়ে দৌঁড়াচ্ছিলো, ঘুরপাক খাচ্ছিলো আর গান গাইছিলো, একে অপরের পিঠে থাপ্পড় দিচ্ছিলো।
কোথাও লুকোচুরি খেলার জায়গা ছিলো না, ঘর বানানোর মতো কাঠের বাক্স ছিলো না, মা মা খেলার উপায় ছিলো না কিংবা রেডিও টেলেন্ট প্রতিযোগিতা খেলার সুযোগ ছিলো না। ওরা একে অপরকে আঘাতও করে না আর চুলও টানে না। তাদের কারো কারো ব্লাউজে আড়াআড়ি পিন দিয়ে গোলাপের মতো নকশা ফুল ছিলো। বেকুবদের খেলা, মুরগির মতো খালি হৈচৈ করে ঘোরা, আমি এখন, আমার দান, ধরছি তোমারে, পুরা সময়টাই এইসব। একটা ঘণ্টা বাজলো। আকস্মিক সবাই চুপ করে গেলো, মনে হলো যেন সবাই বিছানায় যাচ্ছে, ঘুমিয়ে পড়বে, একটু আগেও যে মেয়েগুলো পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলো তারা মিইয়ে আসে আর চুপচাপ লাইন ধরে দাঁড়ায়। আমি একা রয়ে গেলোম, উপচে পড়া আঙিনাটা এখন বড় ধূসর নুড়িময় পুকুরের মতো। ঈশ্বর, আমি খুশি যে এ সব শেষ হয়েছে, সব মেয়েগুলো তাকাচ্ছে আর হাসছে যখন টিচার বললো, ‘এই যে নতুন মেয়ে, তোমার নাম কি?’’ ডেনিস লেস্যু, এমন করে বললাম যেন নামটি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন, আমি হয়তো একই রকম করে মোনেট মার্টিন বা নিকোল ডার্বোস বলতে পারতাম। যাহোক, আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম, তিনি আমার ব্যাপারে আগ্রহী নন। আমাকে আবার নামটা বলতে হলো।
যে বুড়ি আমার গর্ভপাত করেছে সে আমাকে আমার নামটাও জিজ্ঞেস করেনি। আমি তাকে একটা মিথ্যা নাম দিতাম। (চলবে)
পড়ুন: নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: পঞ্চম পর্ব
/তারা/