ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১২ তম পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২০, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২  
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১২ তম পর্ব

আমার ইতিহাস বইয়ের একটা ছবি ‘আঠারো শতকের কৃষক স্যুপ খাচ্ছে’, ঠিক আমার বাবার মতো দেখা যায়। আমি যত বার অপমানিত বোধ করেছি, তত বারই তাদেরকে দায়ী করেছি, তাদের কারণেই লোকে আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করেছে। আমাকে বলা হয়েছে তাদের কাছ থেকে যে সব শব্দ আমি শিখেছি সেগুলো ব্যবহার না-করতে, সেগুলো ‘ব্যাকরণ সম্মত নয়, সেগুলো যথার্থ ভাষা নয়’।

মাদমোয়াজেল লেস্যু, তুমি কী জানতে না কী বলা উচিত? তাদের কথা বলার ধরন নিন্দনীয়, বাসা আর স্কুলের মধ্যে ফারাক রাখার আমার সব চেষ্টা সত্ত্বেও, মাঝেসাঝে আমার বাড়ির কাজে কিংবা কোন উত্তরে সে শব্দরা পিছলে বেরিয়ে যেতো। এই ভাষা তো আমারই অংশ, যে আমি কুকিজের কৌটায় নিমগ্ন কিংবা মাতালদের কৌতুকে, তারই অংশ... আমি এই সব কিছুর জন্যই আমার বাবা-মাকে ঘৃণা করতাম।

একটা দানব, তারা যদি আমাকে ভালো না বাসতো তাহলে এটা অন্য রকম হতো... আমাকে বলার মতো তাদের অতো কিছু নেই, কিন্তু আমি যা চাইতাম তাই তারা আমাকে কিনে দিতো- বই, টেবিল, বইয়ের তাক। আমার মা পা টিপে টিপে আমার ঘরে আসতো : ‘আমরা কি তোমাকে একটা হাতলঅলা চেয়ার কিনে দেবো, যাতে করে তুমি বাড়ির কাজটা আরামে করতে পারো? তুমি এটা নিজে পছন্দ করতে পারো, প্রিয়!’ বই.. বই... আর বই... সে বইয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখতো, সে পারলে আমাকে বই খেতে দিতো, সে এগুলোকে দুই হাতে এমনভাবে ধরে বহন করতো মনে হতো যেন কোন পবিত্র নীতিমালা নিয়ে যাচ্ছে। সে চিন্তিত হয়ে যেতো : ‘তোমার এটা নেই তো, আছে কি?’ সে মনে করতো সে আমার ভবিষ্যতে অবদান রাখছে, আমার জ্ঞানে অবদান রাখছে। সে আমাকে বলতো ওগুলোর দেখভাল করতে, ওগুলো যেন ময়লা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে। যেটা সে বুঝতো না তা হলো, এই বইগুলোই আমার কাছে তার পথ বন্ধ করে দিচ্ছিলো, আমার কাছ থেকে তাদেক সরিয়ে নিচ্ছিলো আর তাদের ক্যাফে আমাকে দেখিয়ে দিতো কী ভয়াবহ সেটা। সে বড়াই করে বলতো: ‘এসব বইই তার! এইসব বিষয়েই তার আগ্রহ আছে!’ হয়তো সেটা সত্য ছিলো। হাতঅলা চেয়ার, বইয়ের তাকগুলো অন্যসব রুচিহীন ফার্নিচারের মাঝখানেই থাকতো, তারা নিজেরা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারতো না, যদিও বইগুলো সব কিছুকে আড়াল করে ফেলতো। আমি একটা পচা জিনিস ছিলাম, আমি এইসব কিছু বর্জন করতে চাইতাম... আরো এবং আরো।    

না, হয়তো সত্যিই আমি তাদের ঘৃণা করতাম না, কনভেন্ট স্কুলে আমি বাড়ির কথা ভাবতাম, বাইরে কাজ করতাম, বাক্সগুলো, একাউন্টস, নোংলা ছবিগুলো... আমি হয়তো নরম হয়ে যেতাম... মা আর বাবা, একমাত্র ব্যক্তি যারা আমার কথা ভাবে, এই পৃথিবীতে। বিশাল আর হাস্যমুখো, আমি কেবল তাদের ভালো গুণের কথা ভাবতাম যদি, তারা চমৎকার মানুষ। তারা আমার ভালো চায়, আমাকে সুখী দেখতে চায়, আর হয়তো তারা সঠিক ছিলেন এমনকি যখন আমার সব কিছু পথের শেষে ঝাপসা, দুঃসহ মনে হয় তখনও। এটা আরো প্রশংসার যোগ্য মনে হয়, কারণ তারা তো স্কুলের পাঠও শেষ করেনি। একদিন আমি তাদের ঋণ শোধ করতাম, তারা তাদের প্রাপ্য ধন্যবাদ পেতো। আমার চোখ ভেঙে কান্না আসে, কেন আমি এতো অকৃতজ্ঞ, যেই মুহূর্তে আমি বাড়ি ফিরি, ব্যাস, আবার সেই অবস্থা, আমি খোলের মধ্যে গুটিয়ে যাই আবার। 

ভালো হতো যদি তারা নড়াচড়া না করতো, বজ্রাহতের মতো বসে রইতো স্তব্ধ, কোন কথা না-বলে, তারা তো যথার্থভাবে কথা বলতে জানে না, আর আমি হয়তো তাদের কানে ফিসফিস করে বলতাম কী তাদের করা উচিত এবং বলা উচিত। আমি তাদের সব কিছু শেখাতে পারতাম, বীজগণিত, ইতিহাস, ইংরেজি আর তারা আমি যতোটুকু জানি ততটুকু জানতে পারতো, আর আমরা হয়তো বৌদ্ধিক আলোচনা করতে পারতাম আর একসঙ্গে হয়তো থিয়েটার দেখতে যেতাম... আমার বাবা-মা, সেই একই মুখ, একই শরীর, কিন্তু একেবারে রূপান্তরিত... তাহলে আমি সত্যিই তাদের ভালোবাসতে পারতাম, তাদের জীবনের ধরনটাকে ঘৃণা করা বন্ধ করতে পারতাম, তাদের আচার-আচরণ, তাদের পছন্দ-অপছন্দ... আমি স্বপ্ন দেখতাম, আমি যেমন চাই তেমন করে তাদের গড়তে পেরেছি, তারপরই আমাকে মর্তের ধুলায় ফিরতে হতো আর তারা যা সেভাবেই তাদেরকে আমার মেনে নিতে হতো... আমার কাছে এটা ছিলো অসহনীয়, আমি আমার বাবা-মাকে ভালোবাসতে পারছি না, কিন্তু আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতেই পারছি না, কেন তা পারছি না। 

আমি কাউকে এটা বলতেও পারছি না, আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি কারণ প্রত্যেক সকালে পার্টিশন ভেদ করে চেম্বার পটের উপরে তার প্রস্রাবের ধারার শেষ বিন্দুর শব্দটুকুও আমি শুনতে পেতাম বলে, আমি আমার মাকে রুচিহীন ভাবতাম কারণ সে মুখ বিকৃত করে স্কার্টের তলা দিয়ে চুলকাতো বলে, নাকি এই কারণে যে তারা ফ্রান্স-ডিমাঞ্চে পড়তো বলে, যেটাকে আমার শিক্ষকরা নেকড়া মনে করতো, নাকি তারা শব্দের ভুল লিঙ্গ ব্যবহার করতো বলে। আর অন্য যা কিছু তা কেবল আপনি বুঝতে পারবেন যদি তাদের সঙ্গে বসবাস করতেন, দিনে বিশবার, ‘কী অবস্থা, আবহাওয়া কেমন রে, এই আর সেইটা কুচকে গেছে, এইটা কী হবে, উফ পাছায় যেন লাথি।’’ অন্য লোকদের, যাদের এইসব কথার সঙ্গে বাস করতে হয় না, যেমন বর্নিনের, তারা কিন্তু সাধারণ লোকের ভাষায় খুব সুখেই কথা বলতে পারে, সাধারণ মানুষের আশ্চর্য সাধারণ জ্ঞান হলো তাদের সাধারণ সরলতা। 

সরল জীবন, কৃষকের প্রজ্ঞা, ছোট্ট দোকানদারের জীবন সম্পর্কে দার্শনিক কথাবার্তা, এইসবই হলো একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ফালতু বোঝার মতো সেই সব লোকেদের জন্য যাদের বাবা মা কাজের মহিলা বা মিস্ত্রি, এইটা একরকম নয়, কাছাকাছিও নয়, মোড়ক খুলে সসেজ খাওয়া, সমুদ্রের পারে বাসের জন্য অপেক্ষা করা, উচ্চস্বরে হাসা যখন ‘লে হ্যারিসন’ পড়তে পড়তে আর ঢেকুর তুলে বলা ‘এসকিউজ মি।’ চৌদ্দ বছর বয়সে আপনি আশা করতে পারেন না যে এ সব কিছুকে পেছনে ফেলে যাবেন, এমনকি এমন আশা করার সাহসও আপনার নেই। এখন এটা সোজা, আমি এখন এ সব নিয়ে কথা বলা সহ্য করতে পারি, আমি বর্নিন ক্যাম্পে আছি, এখানে কেউ বিশ্বাস করবে না আমি তেমন জায়গা থেকে এসেছি। কেবল আমি জানি। 

আমার উগ্র পছন্দ আর অপছন্দগুলো নিয়ে আমার ক্রোধ ফেটে পড়তো। সব তাদের দোষ... না, তারা এ ভাবেই জন্মেছিল। আমার দাদীমা ছিলো ধোপানী আর দাদা ছিলো ক্ষেতমজুর, দৈনিক কাজ খুঁজতো। ‘আমরা ব্যবসায় এলাম, অন্য কোন উপায় ছিলো না’। কিসের উপায়? ‘কারখানাতে আর কাজ করার উপায় ছিলো না, ঘাড়ের উপর বসের নিঃশ্বাস, প্রত্যেকটা চলাফেরায় নজর দিচ্ছে, টিফিনবাটি নিয়ে চলা তাদের ক্রীতদাসের চলাফেরা খেয়াল রাখছে সব সময়...’ তাদের এটা বলতে ভালো লাগতো: ‘আমাদের যা দরকার তার সবই এই স্টোরে আছে কেবল মাছ মাংস ছাড়া।’ আড়তদার, মুদির দোকানদার সেগুলো আরো ভালো ছিলো। আপনি এ রকম করে বুঝ দিতে পারেন। ‘ভুলে যেও না, এই স্টোরকে ধন্যবাদ দাও যে এর কারণেই তুমি স্কুলে থাকতে পারছো!’ তো আমাকেই এখন দোষী বানাচ্ছে, সবসবময় আমি অসন্তুষ্ট, হৃদয়হীন। একদিন, আমি ওদের মুখে থুতু মারবো...এমন তো মনে হয় না যে অন্য কেউ আমার সঙ্গে তার অবস্থান বদল করবে, সেই বুড়ি ডাইনী যে প্রত্যেক রবিবার মদ খেতে আসে, সেই মেয়েরা যারা চৌদ্দ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেয়। এটা আমার বাবা-মার ভাগ্য যে তারা আমাকে পেয়েছে। এখন অবশ্য অনেক দেরী হয়ে গেছে, তারা আমার বদলে কাউকে চাইতে পারবে না। আমি যদি মরি এখন, হয়তো তারা মুক্তি পাবে। তারা নিশ্চয়ই অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত, কোন রকম ধন্যবাদ পায় না আমার কাছ থেকে, কেবল মাত্র বইগুলো আর সেগুলোও সব সময় ধন্যবাদ যোগ্য নয়। 

আমি নিজেকে ঘৃণা করতাম তাদের প্রতি সুন্দর ব্যবহার না করায়, অন্যদের মতো নম্র আর স্নেহময় না-হওয়ায়। কিন্তু দারুণ সব শিশুতোষ বইয়ে যেমন আছে তেমন ভালোভালো কথা যদি তাদের বলতাম তবে আমাকে নির্বোধই মনে হতো কারণ তারা তো নিজেদের মধ্যেই সব সময় গালিগালাজ করছে। সব তাদের দোষ, চৌদ্দ বছর বয়স আমার, অথচ এই পৃথিবীটা আর আমার নয়। আমি আমার বাবা মায়ের কাছে অচেনা এবং আমার চারপাশের সবার কাচে অচেনা মানুষ। আমি তাদের সঙ্গে কিচ্ছু করতে চাইতাম না। এখন তাদের সঙ্গে আমার একমাত্র সংযোগ হলো ঘৃণা কিংবা অপরাধবোধে চিৎকার করা। 

সবচেয়ে বিশ্রি ব্যাপার হলো, আমি স্কুলের অন্য মেয়েদের সাথে আপন বোধ করতাম না। কিন্তু এটা এ জন্য নয় যে আমি চেষ্টা করিনি। ‘উত্তম কর্ম, একজন প্রতিভাধর ছাত্র, ভালো কাজ চালিয়ে যাও, সুন্দর উত্তরণ, চমৎকার ফলাফল’ সব সময়ই একই ধাঁচের মন্তব্য। এটাই একমাত্র কাজ যা আমি পারতাম এবং ভালো করে যেতে পারতাম। ভাবটা এমন যে দুতিনটা খারাপ গ্রেড আমাকে মেরে ফেলবে... ততোদিন অন্য বিষয় আমাকে বিপর্যস্ত আর অপদস্থ করে ফেলেছে। তবে আমি সেগুলোকে আরো তীব্রভাবে অনুভব করেছি, চিন্তাগ্রস্ত এই ভেবে যে আমি যেন ঠিক ম্যারি থেরেস কিংবা ব্রিজেটের  মতো হয়ে গেছি কিংবা অন্য সব নারীদের মতো যাদেরকে আমি নানা কারণে আদর্শ মনে করতাম : নির্বিকারভাবে একটা থলে হাতের সমান ঝুলছে, একটা পনিটেইল, একটা কালো গলাবন্ধ স্যুয়েটার, মুখচাপা, পাতলা বেলিরিনা । যখন তারা কথা বলে, সেটা একটা নতুন দুনিয়া খুলে দেয়, রক এ- রোল , সিডনি বেসেট , পার্টি, পুরুষ নিতম্ব, এইসব বোধহয় আমার কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য দুনিয়া হয়ে উঠছে।

একটা স্যুয়েটার, এক জোড়া জিন্স, এগুলো তাদের সামর্থের মধ্যেই আছে, ক্যাশ রেজিস্টার থেকে কিছু টাকা সরানো... আর কোন সমস্যা নেই, যখন কিনা দোকানে পর্যাপ্ত রসদ আর মদ আছে। অন্যদের মতো আমি হয়ে উঠতে থাকি কথা বলার ধরণে আর পোশাক পরার ধরণে। অন্য মেয়েরা বাবা-মার সঙ্গে ঝগড়া করে একটা চলচ্চিত্র নিয়ে, রাত্রে বাইরে যায়, দারুণ পোশাক পরে। তারা তাদের তর্কের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়, তাদের বাবা কায়দা মতো শুয়ে পড়ে। আমার যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম তার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব কিছুই নির্বোধ আর তুচ্ছ মনে হয়। সমস্ত উপস্থিত স্থানেই, আমি আমার বাবা মাকে এক অর্থে সম্মান করি, আমি কখনোই তাদের বিষয়ে কথা বলি না। অন্তত একটা সময় পর্যন্ত বলিনি। তারপর আমি উপলব্ধি করি, তাদের বিষয়ে অভিযোগ করলে আমি তাদের দলের একজন হয়ে উঠতে পারবো। অন্য মেয়েদের মতো হওয়ার জন্য, আমি আমার বাবা-মার সঙ্গে বিরোধের মিথ্যা কারণ বলি, আমি এমন ভান করি যে তারা আমাকে আমি যা করতে চাই তা করতে বাধা দেয়... এমনকি অনুমতি চাইলেও। অন্য মেয়েদের মতো হতে, ওইসব ভিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে, যেমন আমি একটা পর্যায়ে ল্যাটিন শিখেছিলাম। 

Mihi opus est ami  আমি আর পড়তে পারি না, এটা কঠিন হয়ে ওঠে, ক্রিয়াপদ, সম্প্রদান কারণ, ওহ, আমার হাত, এটা গরম হয়ে ওঠে, আহ, কী হবে যদি আমার মা আসে এখন... Opus est দারুণ। কেন মনে করতে পারছি না সম্প্রদান কারকের ক্রিয়াপদ কোনটা? আমি আশঙ্কা বোধ করি, এটা এমন যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ তোমার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখন মনোযোগ দেয়া উচিত mihi opus est arnica আমি বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যার ক্ষেত্রে এমনটা হয়, ইচ্ছাকৃত করি না এটা। এ এক ভয়ঙ্কর গোপন ব্যাপার। আমি নিশ্চয় শেষে ওই কাউন্টারের পেছনে বসে আলুই বিক্রি করবো, পুরুষরা আমাকে স্পর্শ করবে, কুটিল আঙুল আবার চুলকাচ্ছে পাঁচ মিনিটের উল্লাসের জন্য, একটা পাখি ভারী আর উষ্ণ ডানার, প্রশস্ত আর প্রকাণ্ড, তিনবার ডানা ঝাপটায় আর মরে যায়, ধুলার আবরণে। মর্তের পাপ আমাকে পেয়েছে আবার, ঘিরে ফেলেছে কণ্ঠ, দু’পায়ের মধ্যবর্তী স্থান আর সর্বত্র। আমি কখনোই স্কুলে এই কামনায় পরতাম না। এটা আসলে শূন্য ছুটির বিকালে বাড়িতেই ঘটতো কেবল, বারে তখন কৌতুকের ছটা... এমন কোন পথ নেই যে এটা কনফেশনের সময় বলে ফেলতে পারতাম। যখন আমাদেরকে ধর্মীয় বিধিআজ্ঞা দেয়া হয়, আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখি, আমি যা জানি, আমি যা বুঝি, পাদ্রী হয়তো তার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে, শয়তানী চিন্তা, খারাপ কাজ। নোংরা, কলুষিত, অশ্লীল, উন্মাদনা। বই আর অভিধানে তাই বলা আছে। আর তারপর এক সকালে আমি শুদ্ধ হয়ে যাবো, আমি অন্য মেয়েদের মতো হয়ে যাবো, এটা আমাকে উল্লসিত করে। 

প্রত্যেকবার যখন আমি অপেক্ষারত, আমি ভাবতাম আমি এটা বন্ধ করবো... সকাল বেলা, আমি অনুভব করতাম যে এটা বলক দিয়ে বেরিয়ে আসছে। যখন আমি টয়লেটে যেতাম, আমার সাদা প্যান্টিতে একটা রক্তলাল রেখা, গাঢ় প্রান্তরেখা সহ একটা উপত্যকা যেন, মাঝখানে হালকা রঙ। নরম, কস্তুরি শোভাময় রক্তের ঘ্রাণ যা গভীর থেকে উৎসারিত আর দিবসের আলোতে যা মরতে এসেছে, জার্নিয়াম ফুল থেতানোর ঘ্রাণ... আমি নবীন, পরিচ্ছন আর নব জন্মকে অনুভব করি। আমি নারীদের মহৎ দলে যোগ দিয়েছি। আমার মা কোন বাক্য ব্যয় না করে আমাকে আলমারি থেকে কিছু কাপড় বের করে দিলো, গত তিন বছর ধরে এগুলো তার আর কাজে লাগে না। অবশেষে অন্যদের সঙ্গে বলার মতো কিছু আমার আছে, পেট ব্যথা, কানাকানি। ‘আমি আজ জিমে যাচ্ছি না!’ লাল দাগের কাপড় লন্ড্রিতে যাচ্ছে দেখে আমি ব্যথিত হলাম। এক মাস দীর্ঘ সময়। যদি আর এমনটা না হয়... পনের দিন পর বিশুদ্ধ রক্তধারার কথা আমার স্মৃতিতে ম্লান হয়ে যায় আর আমি চিন্তিত, এমন কোন পাপের কথা ভেবে যা আমাকে গৌরব থেকে পতিত করবে এবং আমার পিরিয়ড বন্ধ করে দেবে। সৌভাগ্যক্রমে সেই লাল দাগের কাপড় একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে ওঠেছিলো আর প্রত্যেকবার আমি নব জন্ম অনুভব করতাম, সূর্যের আলো একটা পশুর রোদ পোহানোর ঘ্রাণ পেতাম...

এক রবিবারে, আমি এটার অপেক্ষায় ছিলাম, আমি ভাবছিলাম পিরিয়ড শুরু হবে। বুধবার নাগাদ আমি বুঝতে পারলাম প্রথমবারের মতো এটা নাও শুরু হতে পারে। এটা অলৌকিক ছয়মাস ধরে এমন চললো, এটা নিয়ে ভাবছিলাম। কিছু ভুয়া পূর্বাভাস, কৌতুকের মতো। সত্যিকারের শাস্তি অবশেষে আমাকে ঘিরে ধরলো, রক্তের ফোঁটা কি আমাকে প্রত্যাখান করলো, দিন চলে যেতে লাগলো আর কেবল সাদা স্রাব। আমি শাস্তির ধারণাটিকে মনের আড়ালে ঠেলে দিচ্ছিলাম যা কিছু নোংরা, অপ্রীতিকর, এই দোকান, এই ক্যাফে, একাকীত্ব আর ঘৃণার ভঙ্গি সহ। আমি ডেনিস লেস্যুকে পিছনে ফেলে এসেছি, সেই জবুথবু মাংসপিন্ড তার প্রথম চার্চ সভায় থাকুক, গোলগাল বয়সন্ধি খিলখিল করছে আর বন্ধুর সঙ্গে হাত চাটছে, অবমাননার গ্রন্থি ছিড়ে এখন আমি আত্মবিশ্বাস আর গৌরবে বিদীর্ণ হয়ে গেছি, লজ্জা, বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা, এ সবের  জন্য আর কোন জায়গা নেই। আমি ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ আমার পড়ালেখার জন্য, বাকী সব ফালতু নীতি আলাপকে বিদায় জানাই। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আমাকে কাঁদিয়ে দিতো চার ঘণ্টার লেকচার, তিন ঘণ্টার লাইব্রেরি আর রুক্ষ চামড়ার ছেলেরা, পরিষ্কার, পরিপাটি আর ফিটফাট ছেলেরা। আমার সৌভাগ্য পালিয়ে গিয়েছিলো। তারা আমার ভালো করার জন্য এতো ব্যস্ত ছিলো যে তারাই দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিলো। এখন ওদের মুখের উপর এটা ছুড়ে মারি। মাচায় শুকাতে দেয়া নরম, মোটা কাপড়গুলোর ফাঁক দিয়ে গ্রীষ্মের আলো দেখা যাচ্ছে... শান্ত, বিশুদ্ধ। আর আমি শাটারের আড়ালে কামনায় পরিপূর্ণ, দীর্ঘ গ্রীষ্মের ছুটিতে আর আমার মা কিছুই সন্দেহ করে না। এখন বলে চলে, ‘ও যা চায় তার সবই পায়, ও কেবল মাত্র পড়ালেখাতেই আগ্রহী।’  

ইতোমধ্যেই স্কুলের শেষ গ্রেডে আমি, আমার ভাবনাগুলো আর আমি সত্যিকারের কাজে সাথে সম্পৃক্ত না। রান্নাঘর থেকে আমি উপযুক্ত পুরুষের দিকে চোখ রাখি যারা মাঝে মাঝে বারে বা স্টোরে আসে। একজন ক্রেতার কাজিন এসেছে প্যারিস থেকে, একজন ভ্রাম্যমান বিক্রেতা এসেছে টাই আর কাফলিঙ্ক পরে। আমি দল থেকে বেরিয়ে আসা একজনের মতো একটা ঘ্রাণের জন্য থামি, ভাবতে থাকি এই কি সেই স্বর্ণকেশী ভাই যার স্বপ্ন আমি দেখতাম... মাত্র এক বছরের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি বাড়ির কাছাকাছি আমার প্রত্যাশিত কিছু আমি পাবো না, আমি এইসব কাজের লোক, রবিবারে পোশাক আশাক পরা শিক্ষানবিশ, গ্রামের ছেলে চাই না। আমি স্কুলে অন্য মেয়েদের কাছে সেই সব ছেলেদের কথা শুনতাম যারা রক এ- রোল পার্টি করে, দ্যুফেল কোট পরে আর যারা জ্যাজ মিউজিক ও ব্রাসেন  পছন্দ করে। কলেজে পড়া ছেলেরা তাদের জন্য স্কুলের গেটের কাছে অপেক্ষা করতো। অন্যদের মতো হতে, আমি এই নতুন গোপনীয়তা জানতে চাই, তাই আমি অন্তত একটা ছেলের সঙ্গে ডেট করতে চাই, একমাত্র জানার এইটাই পন্থা। আমি আবিষ্কার করি যে ক্রমশ আমি স্কুলের গালিগালাজ আর চলতি ফ্যাশন, নিতম্ব, জোস, মধু এইসব শিখতে থাকি। আমার বাবা-মা হতভম্ব।

‘রেকর্ড প্লেয়ার,  সেইটা কি?’ ‘রেকর্ড বাজানোর জন্য একটা যন্ত্র।’ ‘কিছু মনে করো না, এটা তোমার পড়ালেখায় কী কাজে আসবে, এইসব তোমার মাথায় বাজে ভাবনা ঢোকাচ্ছে, সব এই এলভিস প্রিসলি , প্রিসলিই ঢোকাচ্ছে...’ এমনিতেই সব সময় ভীত থাকতাম আমার মাথায় হয়তো ভুল ধারণারা জন্মাচ্ছে : ‘যদি তুমি উপযুক্ত সার্টিফিকেট না আনতে পারো, তোমাকে ওই কাউন্টারের পেছনে কাজ করতে হবে। আমার মা হয়তো কোন ম্যাগাজিনে পড়েছে, স্কুলের পরে ডেটিং করে ছেলে মেয়েরা, ও নিশ্চয়ই এ সব করছে না, সে এমনকি আমার ক্লাসের অন্য মেয়েদেরও আর বিশ্বাস করে না। ‘তুমি কেবল তোমার টিচারদের কথা শুনবে, অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাববে না।’ একবারের মতো অন্তত আমার মনে হলো আমি অন্যদের মতো একই সমান্তরালে দাঁড়াতে পেরেছি... ফ্রিজ, বড় গাড়ি, সমুদ্র সৈকতে ছুটি কাটানো নিয়ে বড়াই করার বদলে তারা তখন কথা বলতো জেমস ডিন , ফ্রাঁসোয়া সাগান  নিয়ে। ব্রাসেনের গান ‘ গোয়াল ঘরের ছায়ায় সুন্দর এক ফুল’। আমি এই সব কিছুর সাথে একাত্ম হতে থাকলাম, আমি চলচ্চিত্র তারকাদের ছবি কেটে রাখতে শুরু করলাম, আমার ডেস্কে জেমস ডিনের নাম লিখে রাখলাম খোদাই করে, একজনের কাছ থেকে ধার করে আমি লোভাতুরের মতো পড়ে ফেললাম ‘বঁজু ত্রিস্তান’। ভেবে দেখুন আমার মা পড়তো ‘ট্রু কনফেশন’ কারণ তার কারণেই আমি ভাবতাম ডেইলি একজন মহান লেখক। আমি তাদেরকে আরো বেশি ঘৃণা করতে থাকি। তারা কোন বিষয়েই কোন কিছু জানে না, আমার বাবা-মা, গান, চিত্রকলা কোন বিষয়েই আগ্রহী না, কেবল তারা লিটারে লিটারে মদ বিক্রি করতে আগ্রহী আর রবিবার দিন মুরগির রান ছিঁড়ে খায় এমনকি একে অপরের সঙ্গে কথাও বলে না। আমার প্রাঞ্জল মুহূর্তেও আমার এমন মনে হতো যে আমি এখনও একটা হাদারাম, আমি নিশ্চিত না কেন এমন মনে হতো। হয়তো আমি আমার বাবা-মায়ের রুচি জন্মসূত্রে কিছুটা পেয়েছি বলেই। অন্য মেয়েরা হাসতো, ‘তুমি সত্যি সত্যি লুই মারিনোকে  পছন্দ করো!’ তারপর সেই সানগ্লাসটা যেটা আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দুর্দান্ত, সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়েটি এটা নিয়েও মজা করে। 

‘এই জিনিস কি ভাঙ্গারি দোকানে পেয়েছো?’ আর আমার মাথার সঙ্গে জট পাকিয়ে থাকা কোঁকড়া চুল সেটাও তাদের হাত থেকে নিস্তার পায় না, যথার্থ পনিটেইল নয় বরং বলা যায় একটা ছোট্ট লেজের গোড়ার মতো চুল... আমার কোন কিছু নিয়ে বলার নেই, আমি ওদের কাছ থেকেই সব শিখি আর বিনিময়ে ওদেরকে শেখানোর কিছু নেই আমার। তারা আর আমার পরীক্ষার খাতার নম্বর নিয়ে প্রভাবিত হয় না। আর কর্নেলিকে নিয়ে নয় ওরা কথা বলে ব্রাককে  নিয়ে, যে সদ্য মারা গেছে এবং যার কথা আমি কোনদিন শুনিনি আগে। ক্রিস্টিয়ানে, আরাধ্য আদর্শ। ওর বাবা সিনেমার ম্যানেজার, ওরা সমুদ্রে পাল তুলে বেড়ায়, সৈকতে চামড়া তামাটে করে, আর ও কথা বলে এক লীলায়িত ভঙ্গিতে, যেন এক দেবদূত। সে হয়তো কোনদিনই আমার মতো মেয়েকে বন্ধু হিসেবে চাইতো না, আমিও কোনদিন তাকে বন্ধু বানাতাম না অপমানিত হওয়ার ভয়ে।

আমার সেরা বন্ধু ছিলো এক ছোট্ট কৃষকের কন্যা, যে তার প্রতিটা পয়সার হিসাব রাখতো, ও স্কুলে আসতো একটা পুরনো বাইকে চড়ে, বাজে পোশাক পরতো। অডেটে ক্লাসে সবসময় দ্বিতীয় হতো। আমরা কখনোই আমাদের বাবা-মাকে নিয়ে কথা বলতাম না। একদিন সে আমাদের দোকান থেকে ওর বাবা-মার জন্য কিছু কিনতে চাইলো, কিন্তু আমি ওকে কোন উপায়ে অনুৎসাহিত করে দিলাম, ও আমাদের দোকানে আসতো আর ওর চাওয়া অর্ধেক জিনিসই খুঁজে পেতো না এটা আমি নিতে পারতাম না। এটা আমার মাথায় কখনো আসেনি সেও হয়তো একইভাবে তার বাবা-মায়ের পরিচয় নিয়ে সংকুচিত ছিলো। আমি এটা বুঝেছিলাম যে আমাদের পছন্দ এবং অপছন্দগুলো একই রকমের, ফলে আমরা একসাথে ঘুরতাম। দুজনই ভালো ছাত্র, রচনা লেখা এবং অন্যান্য লেখাতে সেরা। আমি অবশ্য সত্যিই তাকে অতো পছন্দ করতাম না। আমাদের ফরাসি শিক্ষক মন্তাগিনে থেকে উদ্ধৃতি দিতো, ‘কারণ সে ছিলো সে আর আমি ছিলাম আমি।’ এটা অবশ্য আমার কাছে খুব কষ্টকল্পিত কথা মনে হতো। একদিন, আমি দেখলাম ও তার পবিত্র কমিউনিয়ন উপলক্ষে একটা সোনার ঝরনা কলম পেয়েছে, আমার ভেতরে তখনি তাড়া হলো, ওটাকে মেঝেতে ফেলে দেয়ার, প্রথমেই নিবটা। দুইজনই অনিচ্ছাকৃতভাবে সমাজ থেকে বহিষ্কৃত যেন। আমরা একসাথে ঘুরে বেড়াতাম, মেলার কেনাকাটায়, তরুণ মেলায় মোটর সাইকেল রেসে, হাতে হাত রেখে, না-হেসে আমরা কথাই বলতে পারতাম না, কিন্তু কী কারণে অমন করে ছিলাম আমি তা নিশ্চিত নই। ‘নিজের মতো আনন্দ করো আর ভালো থাকো’ হাতে কিছু পয়সা গুজে দিতে দিতে আমার মা বলতো। কী আনন্দ করবো?

স্টেট স্কুল থেকে আসা ছোট্ট মেয়েরা ধবধবে সাদা পোশাক পরা, প্রত্যেক দশ গজ পরপর তারা থামে, হাওয়া তাদের স্কার্ট উস্কে দেয়, আমাদের পেছনে থাকা লোকেরা চাপা হাসি দেয়, গান বিলাপের মতো ভাসে, জানালার থেকে বিন্দু বিন্দু মাথাগুলো দেখে মনে হয় নীল আকাশের মাঝখানে পিনকুশন। আমরা অপেক্ষা করি। শোভাযাত্রা শেষ অংশ, প্রচুর হৈ হুল্লুড়, যে সব লোকেরা আমাদের চিনতে পারে, যে ছেলেরা চিনতে পারে তারা চেচিয়ে ডাকে। সবাই পোশাক পরা, কোন স্টাইল নাই, ছেলেরা এসেছে গ্রাম থেকে, নির্মাণ এলাকা থেকে, কারখানা থেকে। অডেটে খুব চাইতো ওই ছেলেরা ওর সঙ্গে কথা বলুক। আমার ওদেরকে বলার কিছু নেই: ওদের হাসি, ওদের সুগঠিত বাহু আমি যা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তাকে মনে করিয়ে দেয়, সেই রুক্ষতা, চিৎকার, গালিগালাজ। আমি বইতে যে বিশুদ্ধতার ধারণা পেয়েছি তার সঙ্গে ওরা মানানসই না, ‘লিসেট’ বা ‘বোনেস সোয়ের’ -এ যে বিশুদ্ধ স্বপ্নের কথা আছে তার সঙ্গে মেলে না। ওদের ঠোঁট চাপা। আমি খামাখাই ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করি কোন একটা ইশারা বা ইঙ্গিতের জন্য, যেটা থেকে বোঝা যাবে ওর ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসেছে, হয়তো কলেজ ছাত্রদের ব্যবহৃত কোন গালি কিংবা হার্সেনের গানের এক খাবলা। রবিবারে কোথাও কলেজের ছেলেরা নেই। কেবল গ্রাম্য ছেলেরাই শহরতলীর বিনোদন কেন্দ্রে যায়, টাউন হলের সামনে গুপ্তধনের সন্ধান কিংবা প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য।

আমি বাড়ি যাই, আমার মা চেচিয়ে ওঠে, ‘তুমি সব সময়ই দেরী করো।’ আগামীকাল অন্যরা তাদের পার্টি নিয়ে কথা বলবে, সমুদ্রের পারে রিসোর্টে আনন্দের কথা বলবে, কোন আজাইরা নাচ, দলবেধে যাওয়া নিয়ে কথা বলবে। একটা শোভন ছেলে খুঁজে পাওয়া, তার সাথে ভালো সময় কাটানো মনে হয় না আমাকে দিয়ে হবে। অডেটি কুৎসিত, সে আমার জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। ও নির্বোধের মতো সরিষা ভাঙানির কারখানাতে ছেলেদের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করে। অমার্জিত। আমিও তাই, সন্দেহ নাই, যদিও আমি তা মানতে চাইতাম না। উইন্ডো শপিংয়ের সময় আমি আকস্মিক আয়নায় আমাকে দেখতে পাই, অগোছালো চুল, বিরাট দন্ত কেলানি, একটা ব্যভিচারী মুখ, একগুয়ে দেখতে। অন্য মেয়েরা ছিলো কমনীয়, তারা সহজ আয়েশে চলাফেরা করে, হাসে, দৌঁড়ায় আর চিন্তাভাবনা না করেই উত্তর দিতে পারে। আমার শরীর সবসময় আমার পথের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়, অন্যরা আমাকে যেন দেখছে। আমার মনে হয় যেন একটা পঙ্গু মেয়ে সদ্য হাঁটতে শিখছে, একটা ভুল পদক্ষেপ কিংবা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সদা ভীত। আমার মনে হয় যেন আমার বাবা-মা অচেনা, তবুও আমি যেন আমার মায়ের মতোই হাঁটি আর হাসার সময় মুখে হাত-চাপা দেই যেমন আমার এলাকার মেয়েরা দিয়ে থাকে। আমি আমার স্কার্ট গুজে রাখি যাতে চেয়ারে তা আটকে না যায়। বাড়িতে আমি এইসব কোন রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই করি, কিন্তু যেই মুহূর্তে আমি দরজা পার হয়ে বাইরে যাই, আমি আত্মসচেতন হয়ে উঠি, আমার আচরণ নিয়ে, বুঝতে পারি না কী করবো আমি। স্বাদ তো কোণ আইসক্রিমের প্রান্ত চেটে পাওয়া যায়, হালকা চালে তোমার থলে নামিয়ে রাখছো, নম্রভাবে হ্যান্ডশেক করছো, সব কিছু আমি স্বপ্ন দেখি, যখন আমি অগোছালোভাবে আমার রুটি মাখন খাই, চুকচুক করে কফি খাই, আমি নিজের অবস্থা ভেবে লাল হয়ে উঠি, যেইরকমভাবে আমি বিছানা থেকে ঝুঁকে পেন্সিল তুলি কিংবা জানালা দিয়ে থুতু ফেলি রাস্তার পাশের কোন কিছুর দিকে তাক করে তার যথার্থই বিশ্রি। পনের বছর বয়স হলো আমার আর আমি আরো বেশি করে ডেনিস লেস্যু হয়ে উঠলাম। তবুও কোনভাবে আমার মনে হতো যে আমার ভেতরেও কোথাও কোন লাবণ্য লুকিয়ে আছে, আমার ভেতরে অনাবিস্কৃত এক রাঙা নর্তকী, এই রোমান্টিক নায়িকা হয়তো একদিন দেখবে দিনের আলো...  

একদিন, অবশেষে একদিন, কলেজের এক ছেলে একজনকে বললো আমি নাকি দেখতে ‘জোস’, এই কথা আমাকে এতো খুশি করলো যে আমি অঙ্কে ১০০-এ ১০০ পেলেও এতো খুশি হতাম না। ‘জোস’ কথাটা তো আর মাটির ঢেলা কি বাজে মেয়েছেলের জন্য প্রযোজ্য না। এমনকি অডেটিকেরও এ কথা বলা যায় না, পুরনো বাইকে চরে আসা, তার স্কার্ট, তার নিতম্ব ছড়িয়ে থাকে বাইকের উপরে। আমার দুই বছর লেগে গেলো অন্য মেয়েদের মতো এই দারূণ ‘জোস’ উচ্চতায় পৌঁছাতে, আমার থলে ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া, গালি শেখা, ‘দ্য প্লাটার্স’ , পল আঙ্কা  আর আলবিনোনি’র আডাগিওকে  জানা কাজে দিলো। বাকীটুকু সময়ের ব্যাপার, আমি ঠিকই একজন যথার্থ বয়ফ্রেন্ড পেয়ে যাবো যে আমাকে নিয়ে ঘুরবে আর আমাকে সম্পূর্ণ নতুন একটা পৃথিবী চিনিয়ে দেবে। 

আমি কোন সমস্যা ছাড়াই আমার সার্টিফিকেট অর্জন করলাম আর আরো তিনটা দীর্ঘ বছর কেটে গেলো প্রাইভেট স্কুলে। ‘আমি তখনও স্কুলে আছি...’ কোন কোন ক্রেতা তখনও মনে করতো যে আমি পিছিয়ে আছি। ‘ও কি পাশ করে নাই, সার্টিফিকেট পায় নাই’।  আমার মা তাদেরকে ভদ্রভাবে জানিয়ে দিতো আমি পাশ করার চেয়েও ভালো কিছু করেঠি। ‘এটা কি বিশাল ব্যাপার না যে দারূণ ভালো করেছে।’ তবু এতো কিছুর পরও আমার ঘৃণা অক্ষুণ্ন রয়ে গিয়েছিলো। কেবল যদি তারা একটু ভালো আচরণ শিখতো, পাউরুটি দিয়ে তাদের খাবার প্লেট পরিষ্কার না-করতো, যদি কেবল তারা আমি কী করছি তাতে একটু আগ্রহ দেখাতো, কেবল যদি ওই সব ফলের বাক্সগুলোর দিকে মনোযোগ না-দিতো। তারা তাদের প্রাপ্যই পেয়েছে। যা করেছে তার উপযুক্ত প্রাপ্য পেয়েছে। এখন আমি আমার ‘ব্যাকালুরেট’  ডিগ্রী নিতে যাচ্ছি, তাদের বোঝা উচিত আমি কলেজের উপযুক্ত হয়েছি। অন্য বলয়ে ঘুরছি, একজন উদ্ধত, অচেনা মানুষ। আমি তাদের চেয়ে বেশি জানি, কিন্তু তারা তখনও ভাবে আমি কী করবো সেটা বলতে পারে। (চলবে)

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১১তম পর্ব

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়