ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: শেষ পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৬:৪৩, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: শেষ পর্ব

স্বাভাবিকভাবেই কিছু ব্যর্থতা তো থাকে, দুই তিনজন যখন জায়গা বদলায় যখন কিনা আমি তাদের সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করেছি ঠিক তখনই। এইবার, একটা যথার্থ উন্নাসিক ছেলে, পাতলা গড়নের, তার চুল সোনালী, আগাগোড়াই সোনালী, আমি তাকে নিজের ভেবেছিলাম। তার নিচের ঠোঁটটি তাচ্ছিল্যে কিংবা হামবড়াভাবে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে। বাহাদুরী আর উচ্চ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো সোজাসুজি আমার দিকে তাকাবে, তার নিজের সাথেই তুলনা করলে সে কেবল ম্লান এক ছাত্র, একদম আমিত্বে ভরপুর, নিয়তি নির্ধারিত মহত্বের ভঙ্গি। ‘‘সংবিধানিক আইন’’। চোখ কখনোই সেই হলুদ বই থেকে সরছিলো না। আমার মনে হয়েছিলো সে হয়তো আমাকে খেয়াল করার উপযুক্তই ভাবেনি। খুবই সরু তার হাতগুলো... আমার মনে হলো সে বেশি পরিপাটি পোশাকে, বেশি বুর্জুয়া। আমি ওর পাশে বসা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা শুনেছি, বলিষ্ঠ, বিদ্রূপের ভঙ্গি। কথার বলার একটা ভঙ্গি...

সে আমাকে একটা বেচারার কথা মনে করিয়ে দেয় যে আমার বাবা-মায়ের বারে আসতো, কাঠমিস্ত্রি একটা, গোলাপী গাল, ঢেকে থাকতো তা কাঠের গুড়ায় আর খেয়ে যেতো তার যক্ষা রোগ নিয়ে। কেন, যখন তাদের মুখের আদলে এতোই মিল, কেন তবে তাদের দেহ ভঙ্গিমা আর কথার ভঙ্গিতে এতো ফারাক?... এক শনিবারে যখন সে আমার উল্টোদিকে বসে আছে তার কোঁকড়ানো চুল আর কুঞ্চিত ঠোঁট নিয়ে, তখন তাকে ওরা একটা ভুল বই, ‘এলানসের প্রস্তাবনা’  ধরিয়ে দেয়, যে বইটা আসলে আমি চেয়েছিলাম। নাকি আমিও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল টেবিল নাম্বার দিয়েছিলাম? সে নিশ্চয়ই বইটা আমার দিকে ঠেলে দেবে। ‘‘এলান, একমাত্র দার্শনিক যাকে আমি সইতে পারি!’’ ভাবটা এমন যে সে সব জানে, যেন সে দর্শনের পুরোটাই জেনে বসে আছে, সেই ভঙ্গিতে সে মূল্যবোধের বিচার করছে, তার নিজের মতামত জাহির করছে... অতএব আমি সম্পৃক্ত হই, গভীরভাবেই সম্পৃক্ত হই, ঠিক আমার তলায় একটা টিউব আছে যেমন আমার জরায়ুতে, কেবলমাত্র খুব চতুর মন্তব্য করতে না-পারার কারণে, কেবল আমার নিজের কারণেই হয়তোবা। হয়তো আমার ভেতরে হীনমন্যতার জটিলতা ছিলো। আমার ধারণা সেই কারণেই যখন সে আমাকে ‘ক্যাফে দে লা কারে’-তে পানের প্রস্তাব দেয় আমি খুব খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। ছোট্ট সুন্দর নাইটক্লাবে একসাথে নাচা। একটা উচ্চ-শ্রেণীর বিষ্ঠা, কালো ছাতা, চামড়ার ব্রিফকেস আর হাতে বোনা টাই। একটা বিরাট বাক্যবাগিশ, আমি সবসময় এগুলোর প্রেমেই পড়তাম। সে ছিলো আইনের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আইনের ডিগ্রী থাকলে তুমি যে কোন কিছুই হতে পারো, সব কিছুকে বাস্তব দৃষ্টিতে দেখতে পারো, বাকীটা গোবর। সে কথা বলেই যেতো, আমি জানতামই না কী বলতে হবে। সে মেধাবী, প্রাঞ্জল, তার নিজস্ব তত্ত্ব আছে অর্থ আর ন্যায় বিষয়ে, রাজনীতি বিষয়ে সব জানে আর সে সুনিশ্চিত তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে। আর আমি, আমি, একটা ডাহা মূর্খ, ভুঁইফোঁড় সংস্কৃতিমনা, যে কেবল সাহিত্য সম্পর্কেই একটু জানে। ‘তুমি বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারো না!’ আমি তো নেহাত এক দোকানদারের কন্যা যে কেবল পালানোর পথ খুঁজছে, দুঃশ্চিন্তা করে যাচ্ছে নম্বর, পরীক্ষা নিয়ে, চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালো গ্রেড অর্জন করতে, কী এক তামাসা, চেয়ারের উল্টোদিকে দুই পা দিয়ে সে আমাকে বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে, আমি খানিকটা মাতাল, আমি অনেক বকবক করেছি, তার কারণে ঝলসে উঠছি। আমি প্রণয়াভিলাসী এই বিস্ময়কর আবিষ্কারে যে তার মতো লোকও আছে, হয়তো অনেকই আছে, যারা জীবনকে ভয় পায় না, যারা আত্মবিশ্বাসী এবং অকুণ্ঠ।

সে যা খুশি তাই করতে পারে, সে কিছু সময় কাটাবে নানা রাজ্যে, সে তারপর ‘একুলে নর্মালে দ্য’ এডমিনিস্ট্রেশনে’র  জন্য বসবে, এই তার মৌল উপাদান। আর আমি তো কিছুই না, নেহাতই গরীব ঘর থেকে আসা একটি বালিকা, কাঁধে প্রচুর ভার বয়ে এনেছি, একটা শ্রেণী উত্তোরণের চেষ্টা করে যাচ্ছি, সকল প্রচেষ্টার অপচয় বলা যায় আমাকে। ‘তুমি সত্যিকারের সমস্যার সঙ্গে সামাল দিতে পারো না’ সে ফরমান জারি করে। ফাঁদে পড়ে যাই। আমার পরিস্থিতি, সে, না কখনোই এর থেকে বেরুতে পারবো না। ওই ক্যাফের নানা টুকরো টুকরো কথা আমাকে টানে, আমি তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাই। আমি বরশিতে গেঁথে যাই, সুতা, টানতে থাকে, তার বাবা-মা দারূণ, তারা সেরাটাই করে সাধারণ মানুষের সাথে সংযোগ রাখতে... ‘‘আমার মা একজন অসাধারণ সুর শিল্পী’’ এমনি কতো কি। আমি কিইবা বলতে পারি, তার সঙ্গে মানাসই হতে, আমার আছে কেবল লজ্জ্বিত হওয়ার মতো শৈশব, যার সম্পর্কে তার কোন জ্ঞানই নেই, আমি কেবল বলি : ‘‘আমি একটা শ্রমজীবি শ্রেণী থেকে এসেছি।’’ 

ওর অনেক বিষয়ে আগ্রহ, অনেক কিছু আছে উপভোগ করার, মধ্যযুগের সঙ্গীত, সিনেমা, কার্টুন, নৌকায় পাল তোলা, সমকালের থিয়েটার। বিব্রতকর প্রাচুর্যের এক উদাহরণ। আমার তো কোন আগ্রহ নেই, কেবল সাহিত্য ছাড়া আর এমনকি সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে, আমার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা ভাবলে বলা যয় যে ছেলেরা, হয়তো ছেলেরাই আমার একমাত্র আগ্রহের বিষয়। জীবন নিয়ে আমি যা করেছি তার সবকিছু ঘৃণায় খেয়ে ফেলেছে, নিজেকে ঠেকা দিয়ে যখন যা পেয়েছি তা দিয়ে, আমার সংস্কৃতিও হলো নকল সংস্কৃতি। আমার জন্য কিছুই বাকী নেই কেবল নিজের বিষ্ঠায় নাক ঘষে যাওয়া। এমনকি সাহিত্যও হলো জীর্ণ মনের প্রকাশ, আদর্শ পলায়ন পন্থা। যদি আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত নকলই হই, সত্যিকারের আমিটা কই তবে? ও তো আমার কথা বলছে না, ও বলছে যা কিছু তা তো সাধারণ মন্তব্য, তবুও ও আমাকে তুচ্ছ, মূল্যহীন অনুভব করতে বাধ্য করছে। তিন বছরের আইনের পড়ালেখা, এক বিস্ময়ক প্রতিভাবান পরিবার, সব সময়ই স্বচ্ছল, সুশিক্ষিত, কে পারে এমন বিস্ময়কর কর্মকা- করতে। ওর বাবা সম্প্রতি তার সব টাকা হারিয়েছেন, সেটাও শুনতে ভালো লাগে তাদের কাছে যাদের হারানোরও কিছু নেই। তার কথার পরতে পরতে আমি যেন নগ্ন হতে থাকলাম, সবচেয়ে বিশ্রি ব্যাপার এটাই যে, বিক্ষিপ্ত নাচের তালে তালে, আমি নিজেকে আনাড়ি, নিস্তেজ আর বেখাপ্পা ভাবতে লাগলাম, অন্তত তার তুলনায়। মার্ক। সে যা কিছু বলেছে তার সব কিছুর প্রশংসা করেছি, এমনকি যখন সে কসম কাটে তখনও, সেটাও সে করে কারণ তাকে আমার বাবা-মার মতো সারাদিন একাত্ম থাকতে হয় না। ভাবাবেশে ডুবে যাওয়া একটা মেরুদন্ডহীন নির্বোধ। আমি মাতাল ছিলাম, আমি জানতাম এর শেষটা কীভাবে হবে। তার কর্তৃত্ব দিয়ে এতো অভিভূত ছিলাম যে আমি কোন বাধাই দিতে পারিনি। যেন সে ইতোমধ্যেই সেখানে ছিলো, আমার ভেতরেই নড়াচড়া করছিলো। আমাকেই এর থেকে মুক্তি পেতে হতো। টো আমাকে ভয়ার্ত করে দিলো, আমার প্রচুর রক্তপাত হলো, যেন একটা রক্তের ছোট্ট পিপা বয়ে গেলো, ওয়াইনের মতো রঙ, পিপাগুলো খালি করা ছিলো আমার বাবার কাজ আর বিশাল লোমশ বোতল ব্রাশ দিয়ে তার ভেতরের সব কিছু টেনে আনা। আমাকে পরিস্কার হতে দাও, খালাস হতে দাও, টেনে টেনে আর নিস্কৃতি দাও সব কিছু থেকে, যা কিছু আমাকে টেনে ধরে আমাকে পিছিয়ে দেয়, চাপিয়ে দেয় বারবার। আমি নরাধম, ও কে, কে সে... নরম একেবারে নরম আর মসৃণ। কোন রক্ত নাই, একটা ছোট্ট লিঙ্গ, ছোট ছোট ধাক্কা, শিশুর লাফ যেন, ঘুরে ঘুরে আরো গভীরে গভীরে... 

প্রথমবারের মতো বিদ্ধ হলো, ঈগলের ডানার মতো ছড়িয়ে যেন গাড়ির সিটের উপর। সেটা চলতে থাকলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, প্রসারিত হলো, খুব টানটান, খুব শুকনো। অবশেষে আর্দ্র হয়ে ওঠে, একটা মুক্তির কান্না, মুহূর্তের জন্য সুখের তরঙ্গ রক্ত আর জলে।

এটা একই রকম, আমি দুটোকে একসাথে ভাবতে পারি না। একটা ছিলো ছোট্ট সিঁতোয়ান  গাড়িতে, আর অন্যটা সম্ভবত এইখানে, আমার ঘরে। বুড়িটা জিজ্ঞেস করেছিলো আমার যদি প্রচুর রক্তপাত হয়ে থাকে তবে আমি সতীত্ব হারিয়েছি। তোমার পা ফাক করো, একই রকম। এর সবটাই শেষ হবে বন্যায় আর খানিকটা জেলি। থুথু আর ঘাম ফেরত আসে, আট মাসের শয্যাসঙ্গি, সব নিচ থেকে উপরে বমির মতো বেরিয়ে আসতে চায়। আমি আর কখনোই তার সাথে এটা করতে চাইবো না, আমি পুরোটা যাত্রাই করেছি, স্ফুরিত যোনীদ্বার একটা বিড়ালের মতো, স্বর্ণকেশে ভরপুর। একটা যোনিদ্বারের ফোয়ারা সর্বত্র স্ফুরিত, আমাকে চিরকালেল জন্য আবদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত শুক্রানু। আট মাস। 

প্রথম সপ্তাহে, আমি শূন্য বোধ করি, যদি সে আমার ভেতরেই সবসময় থেকে যেতো। শুধু আনন্দের জন্য নয়। ‘ক্যাফে দ্য মেট্রোপল’-এ আমি তার অপেক্ষা থেকে থেকে কফি খেয়েছি। আমি নিজেকে ফ্রান্সিসকো সাগানের বইয়ের নায়িকা ভাবতাম, একজন ছাত্রী যার প্রেমিক আইন পড়ছে, গি বারেট গাইছে ‘গতকাল ছিলো সেই সকাল’ গান, ভরপুর পরিবেশ। চেয়ারগুলো, ওয়েটার, তিন সারিতে মার্টিনি, স্যু,এপরিটিফ,  কোন একটা সুনির্দিষ্ট পর্দা নয়, পাতা বহুল গাছ জানালা দিয়ে দেয়া যায় আর পথচারিদের দেখা যায়। আমার বাবা-মায়ের নোংরা ক্যাফে থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা, এখানে কোন অস্বস্তিকর স্মৃতি নেই। বিশাল অট্টলিকার সামনে, তাদের বিরাট জানালাগুলো আর বুর্জোয়া বাড়ির পর্দাগুলোর মতো সুরুচিকর পর্দা, যাদের প্রতি আমার একদা বিদ্বেষ ছিলো এখন আমাকে উদাসীন করে। অন্যদিকে, এটাই তো স্বাধীনতাকে প্রকাশ, যেখানে খুশি তুমি যাও, কাউকে পাত্তা দেয়ার কিছু নাই, অথবা ঘৃণা করো তাদের... আমি ওর মতে হতে চেয়েছিলাম, আমার যা কিছুর অভাব ছিলো তার সবই ওর ছিলো, আত্মবিশ্বাস, সুচারু কথাবার্তা, গুরুত্বপূর্ণ সব কিছু দিয়ে জীবন পরিপূর্ণ, রেকর্ড, পাল তোলা নৌকায় সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো, জেনারেল দ্য গলের বক্তৃতা, আকর্ষণীয় বাবা-মা। আমার কখনোই সুযোগ হবে না এই সব উপভোগ করার, ভুলে গিয়েছিলাম যে দু’সপ্তাহ আগেও আমি গেলদেরোদের  নাটকের কথা শুনিনি কিংবা মধ্যযুগের গান শুনিনি আর আমি জানতামই না বঁর্দ্যু আর বার্গেন্ডির  মধ্যে ফারাক। ‘‘শোনো এইটা হলো এই সুরের সবচেয়ে ভালোপ্রয়োগ। তোমার রেডিওটা তো ফালতু, এমনকি সেটা এফএম চ্যানেলও নেই!’ আমি মেনে নেই, ওর সমালোচনা আমাকে বিরক্ত করে না। চুপ করে শোনো, এর পুরো কাজে লাগাও, যেভাবে আসছে সেভাবে গ্রহণ করতে শেখো। মূল্যবান, হজম করি তার সব ভাবনা, পছন্দ, অপছন্দ। কেন আমি নিজেকে এমন করলাম, দলিত হলার একটা নাক উঁচু পাতি বুর্জোয়া দ্বারা, মার্ক, হয়তো সেটাই ছিলো প্রেম। হ্যাঁ, উন্নাসিক সে, নাক উঁচু। ‘আমার ঘরে চলো, আমার ক্যাম্পাসের ঘরটা আমাকে একটা হাউজিং প্রজেক্টের কথা মনে করিয়ে দেয়!’ অবশ্যই ও সেই সব লোকেদের একজন যাদের দেয়ালে কতো না আকর্ষণীয় জিনিস থাকে : অঙ্কের সূত্র সমূহ, পোস্টার, জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠের গুড়ি, নানা রকম সাজ-সজ্জ্বার জিনিস, এমনকি যে সব আমি আগে দেখতাম রু ক্লোপার্তের কুঠুরিতে বা চিলেকোঠায় পড়ে থাকতে অবহেলায় সেই সব পুরনো জিনিসগুলোই আমার কাছে এখন সুন্দর হয়ে ধরা পড়ে। তার ঘরটাকে রুচিসম্মত মনে হয় আমার, আমরা স্কুৎজের ক্যান্টোস  শুনি। আমরা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেয়, পায়ের তলায় হরিণের চামড়া, যেটা তার মা স্কীংয়ের অবকাশে গিয়ে এনেছিলো। হয়তো সেটাই আনন্দ ছিলো, মার্ক। ‘‘কী দুষ্টু মেয়ে তুমি!’’ মার্ক, তোমার উন্নাসিক মুখ আমার ভেতরে এক বেগুনি মিষ্টতা দেয়, তোমার ত্বকের কারণে তোমাকে একটা গোলাপী পুতুলের মতো দেখায়, যে পুতুলটা একটা দুষ্টু মেয়ে জলে ভরে দেয়, যেটা আমার দিকেই গড়িয়ে পড়ে... ও আমাকে নিখাদ পুলক দিয়েছিলো। আমরা যখন আদর করতাম তখন গান বাজতো, মেট্রোপোলে তার বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করতাম, ব্রিজ খেলতাম, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতাম। একটা সন্ধ্যায় তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা, যে কবিতা লেখে, বাকীরা মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে। আমি আমার কবিতা নিয়ে গিয়েছিলাম, যা খুব ভাবুক মগ্ন কায়দায় পাঠ করা হয়েছিলো। আমরা পানাহার করেছিলাম, সেখানেই সবাই বিদ্রোহী। আমি মাতাল ছিলাম আমার নতুন পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে আর আমার খালি হাসি পাচ্ছিলো... ডেনিস লেস্যু এইখানে... একদল লেখক, সৃজশীল শিল্পীদের মাঝখানে, সুনিশ্চিতভাবেই তারাদের মাছে, বিশ্রি ব্যাপারটি হলো আমি তাদের সামনে নত হতে তৈরি ছিলাম এমনকি তাদের পা চাটতেও রাজী ছিলাম। ‘‘চাষা’’ এইটা বলে অপমান করা তার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো। আমি এটা অস্বীখার করতে পারতাম না, আমার কী আসে যায়, কারণ আমি তো আমার চাষা পরিবারকে পেছনে ফেলে এসেছে, যারা আমাকে তেমন কিছুই শেখায়নি, তারা অনেক পেছনে। ও তাদের সম্পর্কে সবই জানে, কিন্তু আমরা এই ব্যাপারে চুপচাপ থাকতাম, এই বিষয়ে কথা বলতে চাইতাম না।   

অন্যদিকে, সে তার পরিবার নিয়ে কথা বলতে খুব পছন্দ করতো, মনে হতো যেন আমি ওদেরই একজন। আট মাস একসাথে, দারূণ সময়, হয়তো সেটা নির্বুদ্ধিতা ছিলো না। আমার মোটেও দুশ্চিন্তা হয়নি যে, আমরা হরিণের চামড়ার উপরে নীড় বেঁধেছিলাম, সেন্ট জন প্যাশন  শুনতাম তার একটা শাস্তি পাওনা হচ্ছে। আমার বাবা-মা এই পরিবেশে আমাকে কল্পনাও করতে পারতো না। এটাও তারা বুঝতো না এইখানে আমার নিজেকে উন্মোচিত করতে কোন দোষ মনে হয়নি। আমি আমার উপযুক্ত স্থান পেয়েছি, যেখানে আমি থাকতে চেয়েছিলাম, চিনির দলা চুরি করা কিংবা সকাল দশটা ব্ল্যাক মেয়ার ট্রেনের চলার স্মৃতি পার হয়ে গেছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে নির্বোধ সব খেলাধুলা আর হাসি-ঠাট্টা ফুরিয়েছে। আমি তাদের প্রতি স্নেহ অনুভব করি এখন, আমি তাদের ভালোবাসি। ‘‘তুমি কেমন করে তাদের ভালোবাসতে পারো যখন তোমাদের মধ্যে এতো ফারাক!’’ না, এটা বলার অধিকার ওর নেই, ও সৌভাগ্যবান, ও কখনো ওর বাবা-মাকে ঘৃণা করেনি। আমি মাসে একবার করে যাই, তাদের দেখে আসি। ‘‘তুমি কি এখনও ভালো নম্বর পাচ্ছো?’’ আমি হাসি না, আমি তাদেরকে অপমান করতে চাই না। আমরা রবিবার গল্পটল্প করি। এখন ক্রেতাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে, কারণ সুপারমার্কেট হয়ে গেছে। স্কুলের ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি, লেকচার হল, তারা এখনও চলছে রুদ্ধশ্বাসে, আমার মা তার বুকে হাত বুলায়। এইসব কিছু ছিলো তাদের কন্যার জন্য, তাদের একমাত্র কন্যার জন্য।

থামো, কোন ঘৃণা নাই। মার্ক আর আমার সত্যিকারের জীবন। তাদের সঙ্গে কেবল একটা দিনের বেড়াতে আসা, তারপর পেছনে ফেলে রেখে চলে যাওয়। ‘‘মেয়েটি এখন আরো ভালো হয়েছে, সে এখন বাড়িতে থাকে না।’’ আমার মা আশ্বস্ত করে... স্বাভাবিকভাবেই, মফস্বল থেকে দেখা, কেউ একজন ‘লে মন্ডে’  পড়ছে, তারা তো নেহাত ছোট্ট দোকানদার অন্য যে কারো মতো, এক দল লোক, তারা অচেনার মতো, তাদের সঙ্গে আমি আগ্রহ নিয়ে কথাও বলি না।

কিছুই আমার আনন্দকে নষ্ট করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার রচনা আর সমালোনাগুলো প্রমাণ করে আমি তাদের একজন। উপলব্ধিমূলক মন্তব্য, উদ্ভাবিত যুক্তি... অধ্যাপক আমাকে বিচার করে আমার নিজের কাজের মাধ্যমেই। সত্যিকারের আমার আমি, যদি বমিটুকু সরিয়ে ফেলা হয় টেবিলের তলা থেকে, তাহলে সত্যিকার আমার আমিকে পাওয়া যাবে, সসেজগুলো বেরিয়ে গেছে, আশেপাশে কোন ক্রেতা না-থাকায় খেয়ে ছিলাম তা। ল্যাটিন অনুবাদের ভুলগুলো বের করায় ভালো আমি, যেমন বলে ওরা, যুক্তির তৈরিতে ওস্তাদ এবং এটা-সেটার বিরুদ্ধে যুক্তি-তর্কেল সুতো ছড়াতে পারে, গম্ভীর ব্যাপার। কিন্তু যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়, তা নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া নয়, আমি এখনও নিজের উন্নয়ন ঘটিয়ে চলছিলো সেটাও নয়, বরং আমি এখনও সবার চেয়ে ভালো সেটাই আনন্দ দেয়। অন্য যে কারো চেয়ে আমি এখনও সেরা। দামী দামী ভিলাতে বাস করা আধা-বুদ্ধির মেয়েগুলো যারা উপর থেকে শহরকে দেখে তারা কিন্তু কেবল লেকচারগুলো মুখস্থ করে মনে প্রাণে আর তোতাপাখির মতো উগড়ে দেয়। আমার ক্ষেত্রে, আমি যতোটুকু চাই, যা চাই তাই কেবল লেকচার থেকে গ্রহণ করি এবং সকল রকমের দিকগুলো পুনর্বিবেচনা করি যা আমাকে আগ্রহী করে, আর আমার চেয়ে জ্ঞানী কেউ হতে পারে না। একটা খুব বিস্তৃত এসাইনমেন্ট, কী একটা কৌতুক! এর পুরোটাই ভাওতা, গ্যালারিতে বসে খেলার মতো, কারখানায় ছাতু ভাঙানোর মতো। যেই মুহূর্তে আমি একটা রচনা বা সমালোচনা শেষ করি, সেই মুহূর্তেই সেটাকে বাইরে ফেলে দেই, আমি কখনোই এটার দিকে আর ফিরে তাকাই না, আমি কেবল গ্রেডটা খেয়াল করি। আঁকড়ে ধরি যে কোন কিছু যেটা আমার গালে রঙ আনে, লাইব্রেরিতে ঠা-া বইগুলোর তলায় বিষ্ঠা সরিয়ে ফেলি, ডিগ্রী, মেট্রোপোলে বসে দার্শনিক আলাপ, মধ্য দুপুরে ক্যাফের মৃদু ঘ্রাণ, যখন কিনা সবাই কাজে ব্যস্ত। আমি সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাও পাস করবো, হয়ে উঠবো ‘এগ্রিগে দ্য লেটার্স’, আমি প্রায় সিমন দ্য ব্যুভার মতোই হয়ে উঠবো। ক্যাফে, আমার বিছানা, হয়ে উঠবো তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র, সেই আজব দারিদ্র নিয়ে কথা বলবো ভোর চারটা পর্যন্ত যা আমাদের জীর্ন, সাধারণ ক্যাফে জুড়ে ছিলো। আমি প্রায় সেই পথে এগুচ্ছি। সন্ধ্যায় আমি আমার প্রথম বর্ষের ‘ঢ়ৎড়ঢ়বফবঁঃরয়ঁব’ এর ফলাফল পাই। বাবা-মাকে খুশি করতে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেই যাতে করে তারা আরামে ঘুমুতে যেতে পারে তাদের বিশুদ্ধ আর পড়–য়া কন্যাটির কথা মাথায় রেখে। আমি সারারাত নাইটক্লাবে উল্লাস করি। আমাকে ঘিরে শ্যাম্পেন খোলা হয়। আলো আর চটুলতা আমার উপরে বর্ষিত হয়, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম জীবন শুরু করতে যাচ্ছে, ‘pro-pe-deu-ti-que’ এর তীব্র বলয় ভেদ করে, প্রথম বাধা পেরিয়ে আমি অগ্রসর হচ্ছি। 

সব কিছু থেকে পতনের ভয় আর নেই, দূর্ভাগ্যের শিকার হওয়ার ভয় আর নাই, আধা-মূর্খ পূর্বসুরীদের মতো। ‘‘আহ সবুজ ভূমি যেখানে আমি জন্মেছিলাম...’’ তোমার জন্য, এমনকি আমি বিয়ের কথাও ভাবতে পারি... আনন্দাশ্রু বয়ানোর কোন দরকার নেই। ‘‘ওকে ছাড়ো মার্ক, মেয়েটা মাতাল হয়ে গেছে!’’ বেঞ্চটি আমার স্কার্টের সাথে আটকে গেছে, আমি গড়াগড়ি খাচ্ছি শ্যাম্পেন, মাংস আর উষ্ণ তরঙ্গ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে আমার পায়ের মাঝে প্যাডও ভিজে উঠছে। একটা সত্যিকারের বন্যার মতো। উষ্ণতা আমার দিকে ছুটে আসে, যদি আমার শরীর টের পায় এটা শেষবার ছাদে ঝুলানো হচ্ছে একটা কাপড় যেন। আমার মন শূন্য। নির্বোধ বালিকা, ক্ষয় হয়ে গেছে, এলকোহলে আঠালো, চেটচেটে, ঘাম আর নিশ্চুপ, অদেখা একটা প্রবাহ। পৌঁছে গেছে।                          

উদযাপন নিয়ে অতো ভেবো না, আবেগকে আবার ঘিরে ধরতে দিও না। সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমি এটা উপলব্ধি করতে পারিনি। ওটা গরম আর গরম হয়ে উঠছিলো ক্রমাগত, চারিদিকেই, ওর ঘরের ভেতরে। আমাদের অনুভূতিহুলো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাচ্ছে, আমরা একে অপরের সাথে অতো দেখা করি না আর। সব কিছু গরম আর আঠালো হয়ে উঠছিলো। ‘‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে আর আমাকে ছাড়ো দয়া করে, আমার অক্টোবরে ম্যাকআপ এক্সাম আছে...’’ বিদ্বেষপূর্ণ, কর্কশ, কারন সে তার আইন পরীক্ষায় ফেল করেছে। আবার পরীক্ষা দিতে হবে। একটা প্রান্তসীমায় এসে আমার মনে হয় আমি যেন দুটো ঝড়েরর মধ্যে আছি। অস্পষ্ট, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনিশ্চিত। কিন্তু ও তার মায়ের সঙ্গে একদিন আমার পরিচয় করিয়ে দেয়, রু দ্যু গ্রোস-হর্খলোজের এক সবুজ রঙা চা-খানায়। সে আমাকে আগে সতর্ক করে দেয়, ‘তার কিন্তু কোন ধারণাও নাই যে আমরা মিলিত হচ্ছি!’’ একটা বেখাপা অনুভূতি আর গরম আমার জিভকে আড়ষ্ঠ করে দেয় আর আমি বোকা হয়ে থাকি। এই অসম্ভব সুন্দর নারীর দিকে তাকিয়ে থাকি, সে আধো-আধো বোলে কথা বলে, একটা পরিচ্ছন্ন আর নির্বিরোধ খরগোসের মতো, তার আর আমার মায়ের মধ্যে বিভেদের কথা ভাবি। এই প্রিয়মুখী নারীর কোন ডিগ্রীর  প্রয়োজন নেই নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য।  

‘‘আমি সব গুলিয়ে ফেলছি, ওয়ালডেক রোসেট  কি সোস্যালিস্ট পার্টির নাকি ট্রেড ইউনিয়নের? আমাকে আলোকিত করো প্রিয়!’’  

তার মধ্যে সব কিছুই ছিলো তার আমি সব সময় কল্পনা করতাম, সেই কারণেই তাকে আমার অবাস্তব মনে হয়, তার মুক্তাদানার হার, নম্র আচরণ, পাখির মতো চটপটে ভাব, ছেলেকে প্রিয় বলে সম্বোধন করা, এ সবই অবাস্তবের মতো। কিন্তু এমন মা তো আমিই চেয়েছিলাম। মনের গহনে। আমি আমার মাকে ঘৃণা। ‘আচ্ছা, তুমি তবে সাহিত্য নিয়ে পড়ছো, আমার কাছে পুরো সিরিজটাই আছে, সেই যে সমালোচক, কী যেন নাম তার, ফাগে?’
স্নিগ্ধ, সুরুচিকর, তার পাশে আমি তুচ্ছ, একটা অশ্লীল, ভণ্ড, তার সামনে চলার পথে একটা স্থুল জিনিস। 
‘‘হ্যাঁ, সে তোমাকে পছন্দ করেছি, সত্যিই, কেবল ভেবেছে তুমি একটু বইপোকা টাইপের।’’ এইটা তো একটা কিছু যা আমার সম্পর্কে ভালোধারণা দেয়, যে কোন অংশের জন্যই আমি কৃতজ্ঞ। 

আট দিন ধরেই কিছুই নাই আর। রু ক্লোপার্টের আলকাতরাগুলো নুড়ির তলায় গলতে শুরু করেছে, ছোট্ট শুকনো দাগগুলো উপরে চকচক করে উঠছে। আমি অসুস্থ বোধ করি। আমি বাড়ি এসেছিলাম কারণ প্রতি মাসের যে সময়টা বাড়িতে আসি সেটা সেই সময়, আমার নোংরা আ-ারওয়ারগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছি, শুটকি মাছের মতো গন্ধ, এটা হলো প্রমাণ যে আমি কোন কিছু খারাপ করিনি, তারা মন শান্ত হবে যে তাদের কন্যা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নাই। রবিবার নাগাদ আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, কী ঘটেছে। আমার মায়ের চোখ থেকে আড়াল করার পন্থা ভাবতে থাকি। আমি দেখি তারা মুরগীগুলোর পেটে মশলা ভরছে, দুই হাতেই কাজ করছে, তারপর সেটাকে নামিয়ে রাখছে, নিস্তেজ, আবার শুরু করছে, প্লেটগুলো পরিস্কার করছে। 

একজন ক্রেতা রান্নাঘরে যাওয়ার পথের ওদিক থেকে কথা বলে তাদের সঙ্গে। মুখভর্তি। আমি বাবা আর মায়ের মাঝখানে টেবিলে আটকে আছি। হ্যাঁ, আমি খুশি, আমি প্রতিশোধের আনন্দে ফেটে পড়ছি, আমি আশা করি যে এটা যেন সত্যিই ঘটে থাকে, একটা বিপর্যয়, হাত কচলাও, চিৎকার করো, ক্রেতারা কী ভাববে, ওরা আর এখানে কেনাকাটা করতে আসবে না। দেখুন, মাদাম লেস্যু, এ মাসে আর কিছু হচ্ছে না, কিছু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমি এখন খুব কমই আমার নিজের ভেতরের অনুভূতিকে বুঝতে পারি, একটা স্ফটিকের দানার মতো আনন্দ, আমার ভেতরে গজিয়ে উঠছে। আর ঘৃণার সেই অনুভূতি আরো গাঢ় হয়ে ফিরে আসছে, রক্তের ঋণ শোধ করতে। ওদের যা প্রাপ্য ওরা তাই পেয়েছে, তারা আমাকে প্রচুর বেদনা দিয়েছে তাদের মতো হয়েই। যখন তুমি সব উলোটপালোট করে ফেলো ভেতরে, তখন সব কিছু দেখা যায় না, কিন্তু সেটাকে অস্বীকারও করা যায় না, না, না, আমাদের নিনিস, না, কিন্তু তারা এটা থেকে পালাতে পারবে না, যদি আমি গর্ভবতী হয়ে থাকি, পা ফাক করে, ভালো সময় চিরতরে গায়েব হয়ে গেছে এখন। আমি প্রায় গৌরবেই ফেটে পড়বো, তারা এবার জটিল কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, সেই ছোট্ট লালমাথা, এবং যদিও তারপর তারা আর কিছু বলেনি আমাকে, কতো কিছুই তো ঘটে এখানকার মেয়েদের ঘিরে, তারা দ্রুত বিয়ে করে ফেলে... এখন এটা তাদের বিলাপ করার সময়। কিন্তু আমি কিছু বলি না, আমি অপেক্ষায় ছিলাম প্রথমে ওকে বলবো বলে।  

আট দিন ধরে আমি উৎফুল্ল থাকি, এক দীর্ঘ, এঁকে ফেলা অশ্লীল আনন্দের ছবি। আমি ওকে আমার অংশ করে ফেলেছি, ভালোভাবে বেড়ে ওঠে, অতি শিক্ষিত, পাতি-বুর্জোয়া। ওই ‘propedeutique’ পরীক্ষায় পাস করার চেয়েও বড় প্রাপ্তি। সে অস্ট্রিয়াতে ছিলো তার বাবা-মার সাথে, সে আমার চিঠি পায়নি। আমি দুই সপ্তাহ তার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কাচা মাংসের স্বাদ আমাকে ভরে রাখে, আমার ভেতরে পচনশীল একটা শরীর, যা কিছু আমি দেখি তাই যেন একটা খাদ্য দ্রব্য হয়ে উঠছে। রূপকথা সেই হ্যান্সেল এ- গ্রেটেলের উল্টা দিক, সব কিছু উচ্চ, আর আমার মনে হয় একটা জলীয় গহ্বর আমি।

স্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে উষ্ণ প্রবাহ, বালিকাগুলো সব হয়ে উঠছে, যা কিছু আমি খাই তার বিস্বাদ আর বাসী লাগে, আমার আত্মা যেন ডুবতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমার পিত্ত হয়েছিলো। আমার বিছানায় শুয়ে থাকি একটা বিরাট চকচকে গ্লাস থেকে কিছু তরল ঢালি আমার পরিপাকতন্ত্রের জন্য, গাছের তলায় জল, যেই মুহূর্তে এটা আমার ঠোঁট ছোঁয় সব কিছু নোনতা লাগে। বিয়ারের স্বাদটা আলাদা লাগে। আমি স্বপ্ন দেখি নরম কলিজার সসেজ, রক্ত লাল স্ট্রবেরির। যে গার্লিক সসেজের জন্য আমি দীর্ঘ অপেক্ষা করেছি সেটা আমি উপভোগ করতে পারি না, এটা খাওয়ার তিন সেকেন্ডের মাথায় আমি মুখের মধ্যে নোংরা জলের অনুভূতি পাই। অবশেষে, আমি সাদা কাপড়ের সঙ্গে একটা সংযোগ খুঁজে পাই। ভেতর থেকেই বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে।
‘‘নির্বোধ মেয়ে, তুমি আরো সাবধানী হলে না কেন!’’ ও আমার ঘরে এলো। ‘‘আমি তোমাকে বেশি সময় দিতে পারবো না, আমার পরীক্ষা...’’
ও ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, অন্যমনস্ক বিরক্তি নিয়ে তাকায়, হারামজাদা। সে এখন পরীক্ষা নিয়ে ভাবছে আর আমি এইখানে, এখনও অপেক্ষারত। আমি ভেবে ছিলাম ও হয়তো একটা উপায় বের করবে, ও হয়তো সব সময়ই তার পরিবারের সঙ্গে একটা কোন উপায় বের করে ফেলবে, এমনই তো সে বলেছিলো, এখন, সে তো তার মাকে বলতে পারে, পোশা খরগোস, কেন সে এটা তার মাকে বলেনি... 

ভীষণ ছাগলামি। আর আমার বৃত্তি টাকাটাও যথেষ্ট নয়। ‘আমি তোমাকে কিছু টাকা ধার দিবো নে...’’ সে উত্তেজিত, আমার দিকে হাত তুলতে আসে। 
শ্বাসরুদ্ধকর, আমার মনে হয় আমি রাগে কাঁদতে পারি। সে কেবল আনন্দ করতে পারে, অপ্রত্যাশিত রঞ্জনের আভা ছড়াতে পারে, নাশপাশি ফোটার ঘ্রাণ, যেটা এখন আমার পেটে বেড়ে ওঠছে, আমার থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিচ্ছে। ও আমাকে ঘৃণা করে, অপমান করে, আমার মনে হয় আমি যেন ওর চুলের উপরে, মাথার উপর সব বমি করে দেই, বালিশের উপরে, মার্টিনির গ্লাসের উপরেও।

যে ভালো সময় আমি পার করছিলাম, তার আকস্মিক সমাপ্তি আসে। সিঁড়ি, রাস্তা, সেতু, আমি মনের মধ্যে একটা কথা রেখেই একা হাঁটতে থাকি, একটা রান্নার করার টেবিলের উপর, যেটার উপর আমার গর্ভ খালাস করা হবে, কোথায় খুঁজে পাবো সেই বুড়িকে যে আমার গর্ভপাত করাবে, কীভাবে তাকে টাকা দিবো। সে কোথায় লুকিয়ে আছে, অন্ধকার সেই নারী, অচেনা বন্ধুর মতো, সৌভাগ্যের পরী যাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজি, যে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করবে এ সব থেকে, আশ্বস্ত করবে...  আমার দুই মাস লেগে যায় সঠিক বাড়িটা খুঁজে পেতে, সেই বাড়ির একটা ঘরে, সেই ঘরের একটা চেস্ট অব ড্রয়ারে, সেই ড্রয়ারে, একটা ব্যাগ ভর্তি যন্ত্রপাতি... খালাসের...

‘‘চিৎকার করা বন্ধ করো খুকি!’’ এর কোন মানে হয় না, একদল বাদামী চুল, লাল মাথা, একটার পর একটা ছেলে, কোমল ত্বক, মুখগুলো যেন ঠোক দিচ্ছে, তারপর, আকস্মিক, কিচ্ছু না! নিনিস, ছেঁড়াখোঁড়া, যা তার প্রাপ্য তাই পেয়েছে। নিয়তি নির্ধারিত শাস্তি নিয়ে ভেবে লাভ নেই বিশেষত তা যখন একই সঙ্গে বেদনা ও আনন্দ নিয়ে এসেছিলো। আনন্দ তার জন্য, কারণ সে ভেতরে প্রবেশ করেছে, ফেটে যায়, টিউবটা নির্মমভাবে চিঁড়ে ফেটে ঢুকতে চায় ভেতরে। ‘‘আমি একটা ভেতরের দিকে যাবো, সব সময়ই যেতে হয়!’’ তার হাত ভর্তি আঁচিল। আহা, ব্যথা, কী তীব্র ব্যথা।

একদম একা, আমি একা অপেক্ষা করি সব কিছু বেরিয়ে আসার, কিংবা হয়তো মৃত্যুর। একটু তাজা বাতাস আসতে দাও, যেন থেতলানো আপেলের ঘ্রাণ পাচ্ছি। তরলগুলো বেরিয়ে আসে আমার ভেতর থেকে একটা মোচড়ে আর বিছানার চাদরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশির সেই বিড়ালের মতো যে আসতো আর আমার বিছানার চাদরে তার বাচ্চাদের রাখতো, কেবল আমার, ছোট্ট গন্ধময় গোলাপী বলটা। ‘‘আর কিচ্ছু বাকী নেই, এইখানেই সমাপ্তি’’ আমার মা বলতো যখন সে একজন বৃদ্ধা নারীর সঙ্গে দেখা করে ফিরতো। আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না, আমাকে সব ঘৃণা আর রক্ত একা একাই বের করতে হবে, ভুল বেমামান জায়গা থেকে আসা একটা ব্যর্থতা। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা আর রাখি না এবং নিজের বাবা-মাকে সব ব্যখা করা আর শুরু থেকে শুরু করা সম্ভব না! আমি আমার ডিগ্রী অর্জন করবো, আমি হয়তো সব নাম্বার ঠিকঠাক পাবো। সে হয়তো বিশ্বাস করবে না, মা, সে হয়তো ভাববে আমি ধর্ষিত হয়েছিলাম। হয়তোবা একজন আর কর্তৃক। যদি আমি বলে ফেলি সব, তারা উন্মাদ হয়ে যাবে, সব কাজই বৃথা গেলো। নিনিস... তারা দোকানটা বন্ধ করে দেবে, বেচারা বৃদ্ধ লোকগুলো, সেই সব পথহারা আত্মা, স্যান্ডেল পরে আসা নারীরা, আর আসবে না তারা কেউ। কিন্তু আমি সেখানে থাকবো না এ সব দেখার জন্য। গরমের সময় সে বাজার থেকে আমার জন্য আইসক্রিম আনতো, অর্ধেকটাই গলে যেতো। তাড়াহুড়ার জন্য তার চোখের নিচে ঘাম জমে যেতো। 

মা-বাবা গোপনে খুন হয়ে যাবে। তারা হেঁটে চলে যাবে বিচ গাছের মধ্য দিয়ে, সূর্য আটকা পড়ে সেখানে অন্ধকারে গাঢ় গাছগুলোর মধ্যে, অদৃশ্য, আমি তাকে অদৃশ্য বলে ডাকবো, ইতোমধ্যেই তার পাউডার মাথা ত্বক মিলিয়ে যাচ্ছে, তার মোটা হলদে জামা, ভারী স্তন। সেটা ছিলো শরৎকাল, আমি বাড়ি এসেছিলাম আর রান্নাঘরে বসে দুধ কফি খেয়েছিলাম। আর প্রথম ক্রেতা দরজা খুলতে খুলতে বলেছিলো, বাতাসে একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। বিভাজিত আনুগত্য। এটাই, আমার বাবা-মা, একজন কারখানার শ্রমিক আর খামারের, আর তারপর স্কুল, বইখাতা, এই পৃথিবীর বোর্ডিং স্কুল। টুলের উপর বসে তোমার নিতম্বের মাঝখানে ঘৃণার শিকার হওয়া, সময় এসেছিলো আমারও বেছে নেয়ার। কিন্তু যদি আমি চাইতামও, আমি তাদের মতো করে কথা বলতে পারতাম না এখন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। ‘‘ও আবার ঠিক হয়ে যাবে, যদি আবার মন দিয়ে আগের মতো পড়ালেখা করে, বুঝছো না’’ মা বলে ছিলো একদিন। 

হয়তো আমার জন্যই। গলে যাওয়া আইসক্রিম ল্যাটিন ক্রিয়াপদের উপর, শব্দরূপের উপর পড়তে থাকে, সে তাড়াতাড়ি ঘরে আসে, এগুলো সব গুছিয়ে দেয়। তারা আমার জন্য সব কিছু করেছে। এতো এতো কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো, আর এখন এই যে অবশিষ্ট আমি বাথরুমে ছুটে যাচ্ছি সব কিছু একা ছুঁড়ে ফেলতে, সেই ব্ল্যাক-পুডিংয়ের টুকরার মতো।  

আবার শুরু করবো। কোত্থেকে? ‘এটা তোমার হাড্ডির মধ্যে আছে,’’ রবিবার ডোমিনো খেলতা আসা লোকেরা বলবো আর আমি বুঝতে পারিনি ওরা কি বলতে চেয়েছে আদতে। ও আসছে না আর, ও আমেরিকা গেছে ছুটি কাটাতে। সিডারের বোতল গরম হাওয়ায় ফার্মেন্টেড হওয়ার জন্য ফেলে রাখা, ছিপিটা এক সময় ঠাস করে খুলে যাবে, কুঠুরির মেঝেতে ছড়িয়ে পড়বে হলুদ ফেনা। 

শূন্য। কী হবে যদি এই সব কিছু তার জন্যই হয়ে থাকে, সব কিছু ওই তথাকথিত ‘সুন্দর’ মানুষগুলোর জন্য, মধ্যবিত্ত লোকজন, যাদের শেষ অবমাননাকর শেকড় আমার পেট থেকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছি, চেষ্টা করছি আমার কাজকর্মকে ন্যায্য প্রমাণ করতে আর প্রমাণ করার চেষ্টা করছি, আমি আলাদা, আমি ভিন্ন। কি হবে যদি পুরো ব্যাপারটাই আমি ভুল বুঝে থাকি... অন্তসত্ত্বা, কোন উৎকৃষ্ট কারণ ছাড়াই।  

আমি মরতে চাই না। নিচে, সিঁড়ি ঘরে কুলি লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, এই রবিবার, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো।

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৫তম পর্ব 

                

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়