নজরুলের গানে চিন্তা ও চেতনা
আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম
‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।’
এই গান মা গুনগুন করে গাইতেন। আর আনমনে কাজ করতেন। বাড়িতে বিদ্যুৎ চলে গেলে মা-চাচীরা গানের আসর বসাতেন। আমি স্কুলের পড়া ফাঁকি দিয়ে জানালা গলে মুখ বের করে ওই গান শুনতাম। তার মধ্যে অনেক গান আজও আমার হৃদয়ে সুরের কান তৈরি করে দিয়েছিল।
‘আমি চির তরে দূরে চলে যাবো, তবুও আমারে দেবো না ভুলিতে’- এই গান গাইতে গাইতে মায়ের চোখ দিয়ে প্রায়ই পানি পড়তো। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম মা কেন গান গাইতে গিয়ে কাঁদেন। ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো, প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের নিশি বুঝি ভোর হলো’- এই গান মা চোখ বুঝে মুগ্ধ হয়ে গাইতেন। গানগুলো যেন ছেলেবেলায় সুরের মোহনায় ভাসিয়ে নিত। তখনও বুঝি না কোনটা নজরুলসঙ্গীত আর কোনটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। অনেক বড় হয়ে জানতে পেরেছি প্রথম গানটি নজরুলের। আর বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি, নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য। এভাবে রবীন্দ্র-নজরুলের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা হলেও নজরুল যেন ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগলেন। আসলেই কি নজরুল সরে গেছেন আমার চিন্তার খোরাকে, মনের খোরাকে? আমার চেতনা তৈরিতে নজরুল কি কম ভূমিকা রেখেছিলেন? আজ বড় সাহস করে নজরুল নিয়ে লিখতে বসেছি। কারণ কতটুকু জানি তাকে!
নজরুল থেকে নজরুলসঙ্গীত। প্রথমে মায়ের কাছ থেকে জানা, তারপর বই পড়ে জানা। গ্রাম কুঁড়েঘর মেঠোপথ ক্ষেত ফসলাদি ধূলোমাখা জামাকাপড়, যুদ্ধ-স্বাধীনতার কখনও ঝাঁকড়া-বাবরি চুল, শান্ত-অশান্ত পরিক্রমণ-বীণা-বাঁশি, আয়তমিশ্র ড্যাবড্যাবে চোখ, শাণিত শব্দের তুবড়ি, ঝোড়োবৈশাখী দখিণ হাওয়ায় বাসন্তীর মিশ্র প্রকাশ- সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে সঙ্গীতের নানান সুর-বাণী। পল্লীগীতি থেকে শুরু করে লোকগীতি, ভাটিয়ালী, বাউল, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, সাঁওতালী, কাজরী কি নেই তার গানে? হাসির গান, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, গজল, ঠুমরী, কাওয়ালি, রাগ-প্রধান গান, দেশাত্মবোধক গান, স্বদেশী, জাগরণী, আগমনী, ইসলামি ভক্তিগীতি, কীর্তন, পালাগানসহ প্রায় ৮০ ধরনের গানের সমাহার। সুরের নতুন মোড়কে গানের মহাপ্লাবন ধারা।
আধুনিক বাংলা গানের পঞ্চপ্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ (১৮৭১-১৯৩৪) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যে এ পঞ্চরত্ন আধুনিক বাংলা গানকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ছিলেন একাধারে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ।
নজরুলই প্রথম আধুনিক বা মর্ডান শব্দ দুটির প্রচলন করেন। নজরুল-পূর্বে সব গানই ছিল নায়কী প্রধান। নজরুল প্রথম যুক্ত করলেন সঙ্গীতে গায়কীর বিষয়টি। নজরুল-পূর্বে যারা সঙ্গীতে ছিলেন তাঁরা সবাই নায়কীতে গান বাঁধতেন। অর্থাৎ ওরা যেমন সুর করেছেন, শিল্পীকে হুবহু তেমনি গাইতে হবে। সুরে বা পর্দার হেরফের করা যাবে না। নজরুল এর থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলেন। তিনি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির পার্থক্যের স্থান রাখলেন। যেমন একই রকম ব্যথার প্রকাশ ব্যক্তি বিশেষে একই রকম হবে এটা না করে ব্যক্তি বিশেষে ব্যথা-বেদনার প্রকাশ আলাদা হবে এভাবে। এরকম হওয়াই তো স্বাভাবিক। গায়কীর যুক্ততায় শিল্পীরাও হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। তারা তাদের কণ্ঠ কিছুটা নিজগুণে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। সঙ্গীতে প্রাণের সৃষ্টি হলো।
এখানে সামান্য বলা প্রয়োজন বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে যারা উপস্থাপনা করেন তারা যে ধরনের ব্যাখ্যা এই ‘গায়কী’ প্রসঙ্গে বলেন তা ঠিক নয়। তারা ব্যক্তি-পার্থক্যকে গায়কী ভেবেছেন। ব্যাপারটি তা নয়। ব্যাপারটি হবে সুরকার যে সুর করেছেন শিল্পী ঠিক সে রকমটি না করে কণ্ঠ ব্যবধানে সুর প্রকাশে তার পার্থক্য হয় না। শিল্পী পার্থক্যে সুর পার্থক্য শ্রুতিতে মোটেও আঘাত করে না। যেমন নজরুলের ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি জল’- গানটি আজ অবধি অসংখ্যশিল্পী কণ্ঠে ধারণ করেছেন। এবং প্রতিটি শিল্পীই তার কণ্ঠ গায়কী’র ব্যবহার করেছেন। তৃপ্ত হয়েছেন। নজরুল কর্তৃক এই গায়কীর প্রবর্তনে শিল্পী স্বাধীনতাও যুক্ত হয়েছে। নায়কী প্রথার গায়কী আর গায়কী প্রথার গায়কী এই দুই ‘গায়কী’কে এক কাতারে শামিল করে দেখাটাই যত দুর্ভোগের কারণ বলে আমি মনে করি। একে ‘অশিক্ষিত সঙ্গীত আচরণ’ বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের আগে তান, পিছে তান, মাঝে গান করে একে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত তান সহ্য করার মতো গান নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁর সঙ্গীতে অলঙ্করণ পছন্দ করতেন না। তার ‘সঙ্গীত-চিন্তা’ গ্রন্থটি পড়লে তা জানা যায়। নজরুলের যে গানে তান-আলাপনেই সে গানেও তান আলাপ যুক্ত করা যায়। কারণ ওতে সহ্য করার শক্তি আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বর্তমানে যেমন-তেমন পরিবেশিত হচ্ছে তা কি রবীন্দ্রসঙ্গীত হচ্ছে? বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পঙ্কজ কুমার মল্লিক ‘আকাশ বাণী’ থেকে সঙ্গীত শিক্ষার আসরে বাধ্য হয়ে যখন ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ গানটি শেখাতে শুরু করলেন তখন বলেছিলেন এ গান তার পক্ষে সঠিকভাবে শেখানো মুশকিল। কারণ এ গানে রেওয়াজি কণ্ঠের দরকার। এ থেকেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের কণ্ঠ আর নজরুল সঙ্গীতের কণ্ঠের আকাশ-পাতাল তারতম্য বোঝা যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রধানত খোল নির্ভর গান আর নজরুলসঙ্গীত তবলা নির্ভর। রবীন্দ্রসঙ্গীত নাসিকা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় একাধিক পরিবেশনে একঘেয়ে হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। কিংবা অতুলপ্রসাদ বা রজনী দিজেন। সুরে উদাত্ত উদার পরিসর কেবল নজরুলেই আছে। নজরুলের গানে সকল ধরনের সঙ্গীতের লীলাক্ষেত্র আছে। নজরুলের গান আর রবীন্দ্রনাথের গান বিচারের কর্ম্ম আমার নয়। তবুও তৈরি হওয়া কান যতটুকু ধর্তব্য ততটুকু বলার চেষ্টা।
নজরুল ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতানুরাগী এবং আধুনিকমনস্ক। সে প্রেরণাতেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে আধুনিকতার রস সংমিশ্রণ করে সৃষ্টি করেন নতুন এক ধারা। গান ও সুরকে নতুনত্ব এবং বৈচিত্র্যময় করে তোলাই ছিল নজরুলের উদ্দেশ্য। বিভিন্ন রাগ রাগিণীর সংমিশ্রণে নতুন সুর সৃষ্টিই ছিল তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য। যেমন রাগ জয়ন্তী ও খাম্বাজ সুর এক করে নজরুল গেয়েছেন ‘ছাড়িয়া পরাণ নাহি চায় তবু যেতে হবে হায়।’ আবার নটমল্লার এবং ছায়ানট রাগ মিলিয়ে লিখেছেন ‘হাজার তারার হার হয়ে গো দলি আকাশ বীণার পলে।’ এ তো গেল রাগের সংমিশ্রণ। তিনি বিভিন্ন রাগের চলনের ওপর তাঁর লেখা অঙ্কিত করেছেন। অর্থাৎ সেই রাগের সুর ও লয় ঠিক রেখে তিনি গানের কথা সাজিয়েছেন। যেমন ‘সাজিয়াছো যোগী বল কার লাগি তরুণ বিবাগী।’ রাগ যোগী আবার রাগ দরবারি কানাড়াতে: ‘আজ ঘুম নাহি নিশি জাগরণ।’ রাগ মালকোষের উপর সাজিয়েছেন: ‘গরজে গম্ভীর গগনে কম্ভু কাটিতে সুন্দর নাচে সয়ম্ভু।’
এছাড়া নজরুলের নিজস্ব সৃষ্টি রাগ খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যেমন তাঁর সৃষ্ট পিলু রাগের: ‘যাক না নিশি গানে গানে/ জাগরণে জাগরণে/ আজকে খুশির বান ডেকেছে/ আমার মনে আমার মনে।’
কাজী নজরুল ইসলাম দুটি রাগ-রাগিনী একদম নিজস্ব বলে অভিমত পোষণ করেছেন। রাগ দুটি হলো বেণুকা ও দোলন চাঁপা। এছাড়া বিদেশী সুর অবলম্বন বিভিন্ন রাগাশ্রিত গান তো রয়েছেই। গায়কী এবং শিল্পী স্বাধীনতা যখন নজরুলের গানে প্রবর্তিত হলো তার সাথে বৈঠকী প্রভাব অবলীলায় যুক্ত হয়ে গেল।
গজল সঙ্গীত পরিবেশনে যে পরিবেশ দরকার সে ধরনটি হবে একটি ঘরোয়া মজলিশ, তাকিয়া, শতরঞ্জি, দরবারি হুকো, গোলাপ আতর দান থেকে হাল্কা ধোঁয়া ঘরময় সুগন্ধি সৃষ্টি করছে, শিল্পী গাইছেন, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে গানের ছন্দে-তালে একাকার হয়ে কখনো অ্যঙ্কোর, কখনো ফিনজুরো বলে শিল্পীকে উৎসাহ যোগাচ্ছেন, বাহবা দিচ্ছেন- আসর একেবারে জমজমাট। সঙ্গীতের এমন বিশাল পথ সৃষ্টি নজরুল আগমনের পূর্বে কোথায় ছিল? জমিদাররা ছিল কিন্তু সঙ্গীত ছিল নায়কী নির্ভর। নজরুল গজল গানের সুরেই প্রথম রাগের ব্যবহার করেন, যা ক্রমশ বিচিত্র ও ব্যাপক হয়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গজল হলো: ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’ (ভীমপলশ্রী), ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ (ভৈরবী), ‘দুরন্ত বায়ু পুরবইয়া’ (কাফি-সিন্ধু), ‘এত জল ও কাজল চোখে’ (মান্দ), ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’ (পিলু), ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে’ (গারা-ভৈরবী), ‘কেন কাঁদে এ পরাণ’ (মিশ্র বেহাগ-খাম্বাজ), ‘চেয়ো না সুনয়না’ (বাগেশ্রী পিলু), ইত্যাদি। নজরুলের প্রথম দিককার গজল অধিকাংশই কৃষ্ণনগরে রচিত। সে সময় নজরুল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। নজরুলের গজল জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে দিলীপ কুমারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দিলীপ কুমার ছিলেন রাগসঙ্গীতে পারদর্শী, তাই তাঁর কণ্ঠে রাগাশ্রিত সুরে নজরুলের গজলগুলি রচয়িতার কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করে।
শুধু গজল নয়, নজরুলের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী স্বদেশী গান ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ বা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ দিলীপ রায় তাঁর সহশিল্পীদের নিয়ে প্রথম পরিবেশন করেন ১৯২২ সালের ২২ মে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীতরূপে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম নজরুলের গান রেকর্ড হলেও (শিল্পী: হরেন্দ্রনাথ দত্ত, গীত: ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’) এবং ১৯২৬ সাল থেকে নজরুল গজল রচনা করলেও ১৯২৮ সালের মার্চ মাসের আগে তিনি প্রত্যক্ষ বা নিয়মিতভাবে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। নজরুল ওস্তাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এবং কলকাতা বেতারে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পরে। কিন্তু তার আগেই যে তিনি রাগসঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন সে পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৬-২৮ সালের মধ্যে রচিত তাঁর গজল ও গান থেকে। তাঁর বুলবুল (১৯২৮), চোখের চাতক (১৯২৯) এবং চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) গীতি-সংকলনের অধিকাংশ গানের সুরই রাগনির্ভর।
কবি ও সাহিত্যিক, গীতিকার ও সুরকার, সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক কর্মী বা ব্যক্তি হিসাবে নজরুলের বিচার ও মূল্যায়ন হয়েছে, অনেকে করেছেন। সেইসব লেখালেখির মধ্যে তাঁকে নিয়ে সমাজের নানান শ্রেণীর, নানান সম্প্রদায়ের ও নানান অংশের চিন্তা ও উৎকণ্ঠা ধরা পড়ে। সেই দিক থেকে নজরুল তাঁর সময়কালে একভাবে আলোচিত হয়েছেন। সেই আলোচনার মধ্যে সেই সময়কালের অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন, সমাজের নতুন পরিগঠন, রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা ইত্যাদির লক্ষণ বা উৎক্ষেপ রয়েছে। তাঁকে নিয়ে আলোচনার সময় সেই লক্ষণ বা উৎক্ষেপগুলোই সামনে আসে সেটাই স্বাভাবিক। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে এখনকার সময় অবধি বাংলাদেশের জনগণের, আবেগ, কল্পনা, আত্মচিন্তা ও আত্মপরিচয়ের টানাপড়েন ও বিবর্তন বোঝার জন্য নজরুল অসামান্য সামাজিক উপাদান। সেইদিকে বাংলাদেশে তাঁর সর্ম্পকে আগ্রহ আছে ঠিকই কিন্তু খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁর গান ও সাহিত্যকর্ম নিয়েই আগ্রহ আমাদের বেশি। তাঁর জীবনকে গান ও সাহিত্যকর্মের আলো ফেলে আমরা বোঝার চেষ্টা করি। এতেও অবাক হবার কিছু নাই, এটাই প্রাথমিকভাবে হবার কথা। কিন্তু উলটো দিক থেকে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করি না। একটি জনগোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে তার লেখালেখি ও সঙ্গীতচর্চা কিভাবে জড়িত সেই দিকটা এখনও অনালোচিতই থেকে গেছে। নজরুল নিয়ে আমাদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও তার তাৎপর্য নিয়ে বাংলাদেশে আমরা যথেষ্ট ভেবেছি বলে মনে হয় না। আরও একটি কারণে তাঁকে একপেশে রেখে চলার প্রবনতা আমাদের প্রকট। তা হলো হিন্দু না তিনি মুসলিম। কিন্তু যে নজরুল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যে-জনগোষ্ঠীকে কল্পনা করতে চেয়েছিলেন সেখানে হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না। অথচ বাস্তবে সেই ভেদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁর লেখালেখির মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের প্রতি আলাদা আবেদন প্রস্তাব করবার তাগিদ ছিল। কখনও তিনি ‘হিন্দু’ হয়ে লিখেছেন, কখনও ‘মুসলমান’ হয়ে। দুই সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় তখন এক বিন্দুতে বা এক কাতারে ছিল, ইতিহাস তা বলে না।
আমরা বাংলাভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি পরিচয়কে হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ থেকে আড়াল করে রাখতে চাই। যা আসলে অবাস্তব ও অনৈতিহাসিক। তাঁর শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তন রচনাকে নিছকই সাহিত্যিক চর্চা হিসাবে গণ্য করবার সুযোগ নাই। কারণ তা ওই ভেদহীন সমাজ করার লক্ষেই। তর্ক করবো না, তুলনাও করছি না, রবীন্দ্রনাথ তো বাঙালি হয়েও ‘ইসলামি সঙ্গীত’ রচনা করেননি। তাই বলে তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এটা কূটতর্ক বলে আমরা পরিহার করতে পারি, কিন্তু এটাই ইতিহাস। হিন্দু মুসলমান ভেদকে বাস্তব ও ঐতিহাসিক বলার অর্থ এই নয় যে, এই ভেদ প্রাকৃতিক অতএব চিরায়ত। অর্থাৎ হিন্দু কিম্বা মুসলমানকে এই ভেদবুদ্ধির জন্য দোষারোপ না করে এই ভেদ তৈরি হবার ঐতিহাসিক কারণগুলোকে বোঝা এবং অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা।
“এখন আমাদের বাঙ্লা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে সর্বপ্রথম আমাদের লেখার জড়তা দূর করিয়া তাহাতে ঝর্ণার মতো ঢেঊ ভরা চপলতা ও সহজ মুক্তি আনিতে হইবে। যে সাহিত্য জড়, যাহার প্রাণ নাই, সে নির্জীব সাহিত্য দিয়া আমাদের কোনো উপকার হইবে না। আর তাহা স্থায়ী সাহিত্যও হইতে পারে না। বাঙ্লা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ছাড়া খুব কম লেখকেরই লেখায় মুক্তির জন্য উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা ফুটিতে দেখা যায়” – বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান (নজরুল ইসলাম, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা-৮২০)
যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই ছিলেন নজরুলের প্রেরণা সেখানে আজ আমাদের কেন গান রচনা- ‘একদিকে রবীন্দ্রনাথ, একদিকে নজরুল’। সাহিত্যে, সঙ্গীতে বাঙালীর চেতনায় এই দুই মহীরুহ আমাদের কেবল প্রেরণা নয় মূল শেকড়। হিন্দু-মুসলমানে মিলনে বিশ্বাসী নজরুল নিজেই বলেছেন: ‘বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য, এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানদের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুদেরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্য-প্রলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্য দেখে ভ্রু কুঁচকানো অন্যায়।” তিনি অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁকে লিখিত এক পত্রে উল্লেখ করেন, “আমি হিন্দু-মুসলমানদের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী...। তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নেই।” তাই আমাদের মনে রাখতে হবে বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু পরাধীনতার বন্ধন মুক্তির, পুরানো সমাজ ভেঙে নতুন ও উন্নত সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখেননি, তিনি বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভেদের এবং সঙ্কীর্ণতার আগল ভেঙে নতুন ঐতিহ্য গড়ার ধারা সৃষ্টি করে গেছেন, রেখে গেছেন অনুপ্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত।
বিশ শতক পেরিয়ে আমরা একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রবেশ করেছি। এরই মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের বদলে এসেছে বিশ্বায়ন, উপনিবেশিক শোষণের স্থান নিয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, জাতীয় সংস্কৃতিকে গ্রাস করে ফেলেছে আকাশসংস্কৃতির বিকিরণে অপসংস্কৃতির বাতাবরণ। আজ তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সমস্যা ওই প্রভুত্ব থেকে স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রাখা। আর সে জন্য প্রয়োজন একই সঙ্গে স্বদেশি ও আন্তর্জাতিক হওয়া। নিজের জাতিসত্তার ও সংস্কৃতির প্রতি অবিচল থেকে আন্তর্জাতিক হওয়া। আজকের পৃথিবীতে কোন দেশ-জাতি নির্জন দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আজ তাকে নিজের মাটিতে আপন ঐতিহ্যের শেকড় গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত করে দাঁড়াতে হবে। নজরুলের মতো বলতে হবে, “বল বীর/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারি নতশির ওই শির হিমাদ্রির।” আমাদের বেলা অবেলা আর চেতনাবোধে নজরুল হয়ে উঠুক আরও ব্যপক চর্চাকেন্দ্র।
দোহাই
আব্দুল কাদির. (১৯৬৬). নজরুল রচনাবলী. ঢাকা: বাংলা একাডেমি
ইসলাম, কাজী নজরুল. (১৯৮৪). নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড. ঢাকা: বাংলা একাডেমি
চক্রবর্তী, জ. (২০০৩). বাঙলা ভাগ হোলঃ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাও দেশবিভাগ ১৯৩২ -১৯৪৭. ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড.
নজরুল ইসলাম. (১৯৬৬). নজরুল রচনাবলী, প্রথম খণ্ড. ঢাকা: বাংলা একাডেমি
বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান নজরুল প্রসঙ্গ : বাংলা একাডেমি
তারা//