ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

ছোটগল্প || দুর্ঘটনা

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৭, ২৭ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৭:৩৯, ২৭ জুন ২০২৩
ছোটগল্প || দুর্ঘটনা

খোলা রিকশাটাকে পাল তোলা নৌকা মনে হচ্ছিল। মেশিনের রিকশাটা যেন বাতাস আর দুরন্ত ঢেউ কেটে চলছে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে। আজ বিকালের বাতাস কোন দিক থেকে এসেছে কে জানে? তবে বাতাসে মহুয়ার গন্ধ আছে! এই রকম বাতাসে পাষণ্ডেরও প্রেমিক হতে মন চায়, অথচ বুবুন বিরক্ত। সে চোখমুখ কুঁচকে গুগলিং করে যাচ্ছে। মোবাইলের স্ক্রিনে একের পর এক ফ্রি এমপি-থ্রি খুঁজে যাচ্ছে। 

বুবনের মেজাজ ভালো নেই। ইদানিং বাইরে বেরুলেই তোতাকে সঙ্গে জুড়ে দেয় মা। বুবুন বুঝতে পারে না ৯ বছরের এই পিচ্চি ছেলেটা তার কি কাজে দেবে! নাকি মা তোতাকে রেখেছে ওর উপর নজরদারি করতে! বুবুনের বিরক্তিটা আরো বাড়ে তোতার পা নাচানো দেখে।

বুবুন রিকশায় হুড তোলা পছন্দ করে না। সঙ্গে ফেউ রাখাও পছন্দ করে না। মানুষ কি আর সব পছন্দ-অপছন্দ মানতে পারে? বুবুন তখন রিকশায় হুড তুলে বসা, মোবাইলে গুগলিং করছিল আর ফেউ হিসাবে পাশে বসে থাকা তোতা পা নাচিয়ে যাচ্ছিল। মানুষ কেন পা নাচায়, ‘হোয়াই পিপল মুভ দেয়ার লেগ’, ‘শ্যাকিং লেগ হেভিট’ ইত্যাদি লিখে গুগল সার্চ দেয় বুবুন। কিন্তু সার্চ ইঞ্জিনের দিকে মনোযোগ দিতে পারে না। কারণ রিকশাটা চলছিল বেয়ারার মতো। ইদানিং এই মেশিনের রিকশায় ভরে গেছে ঢাকা শহর। আর অশিক্ষিত রিকশাঅলাগুলো হাতে গতি পেয়ে ট্রাক ড্রাইভারদের মতো বেপরোয়া হয়ে গেছে। বুবুন ইতোমধ্যেই কয়েকবার রিকশাঅলাকে বলেছে, বামে চাপিয়ে চালাতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ছুটির দিনে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে, সে সমানে ওভারটেক করে যাচ্ছে। একটু জ্যাম দেখলেই রং সাইডে রিকশা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এমনতিই মেইন রোডে তার আসার কথা না। নিজেই বলেছিল, আপা টাইট হইয়া বসেন, চিপাচাপা দিয়া যামু গা। 

আরো পড়ুন:

পল্টনের বাঁকটা নিতে গিয়েই ঘটনাটা ঘটলো। অনেকক্ষণ আটকে থাকার পর সিগনাল ছেড়ে দিতেই মেশিনের রিকশা হুড়মুড় করে টান দিলো, আর অন্যপাশে সিগনাল পড়ে যাচ্ছে দেখে মিনিবাসটা টান দিলো চরম তাড়াহুড়ায়। একটা বোমা ফাটার মতো আওয়াজ হলো। সম্ভবত রিকশার চাকা ফাটা কিংবা রিকশাঅলার খুলি ফাটার শব্দ। 
বুবুন ছিটকে পড়লো আইল্যান্ডের উপর। 
তোতা রাস্তায় পড়ে থাকলো পরিত্যক্ত কলার খোসার মতো। 

২.
সড়ক দুর্ঘটনা এই ঢাকা শহরে নতুন কিছু না। প্রতিদিনই ঘটে। তবে আজকের দুর্ঘটনা এক কথায় মারাত্মক! একদম ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এতো বড় দুর্ঘটনা কমই ঘটে। দুর্ঘটনার ছোট-বড় মাপা হয় আদতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ দিয়েই।

বাসঅলা পালাতে পারলো না। উৎসাহী জনগণের হাতে সে প্রথমেই এক চোট মার খেলো। বাসের যাত্রীরা অবশ্য গাইগুই করছিল। তারা রিকশাঅলার দোষ দিচ্ছিল। একজন বলে উঠলো, আশ্চর্য! মেশিনের রিকশা কেন এখানে ঢুকেছে। এদের লাইসেন্স নেই, ট্রাফিক রুলস জানে না। কিন্তু এদের হাতেই মেশিন চালিত বাহন! কে চালু করেছে এই ঢাকা শহরে মেশিনের রিকশা, কেন চালু করেছে? আরেকজন বলে উঠলো, ওই মিয়া, খালি ফুটানি কথা, গরিব মানুষ খাইবো কি? এতো যে আইন কানুন দেখান, বাসের ফিটনেস আছে? হে না হয় অশিক্ষিত, তাই বইলা আপনে চাপ দিয়ে দিবেন!

হইচই শুরু হয়ে গেলো। নানা জনের নানা বিশ্লেষণ, মতামত বর্ষণ শুরু হলো। ট্রাফিক সার্জন এগিয়ে এলো। সে এসেই বাসঅলাকে উদ্ধার করলো মারমুখি জনগণের হাত থেকে। জনতার ভিড় থেকে এক সুযোগে চৌকস একজন বুবুনের পার্স ও মোবাইল সরিয়ে নিরীহ মুখে সরে গেলো। একজন তোতাকে তুলে ধরলো। সে গলা কাটা গরুর মতো গো গো করছে। বুবুন অবশ্য অজ্ঞান। রিকশাঅলার থ্যাতলানো শরীর আর ছিটকে পড়া মগজের দিকে কেউ তখনও মনোযোগ দেয়নি। যখন মনোযোগ দিলো তখন আবার সবাই বাসঅলার দিকে ছুটে যেতে চাইলো। রিকশাঅলার থেতলানো মাথাটা আর বাসঅলার মুখটার মন্তাজ তাদেরকে ক্ষুব্ধ করছিল হয়তো। 

একদল উৎসাহী লোক ধরাধরি করে বুবুন আর তোতাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলো। তোতার পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে কয়েকটা, পা দু’জায়গায় ভাঙা, হাত এক জায়গায়। মাল্টিপল ফ্র্যাক্সারে ইনজিউরি। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তোতাকে পঙ্গুতে নিয়ে যেতে বলা হলো। ঢাকা মেডিক্যালের অর্থোপ্যাডিকে সিট খালি নাই। অচেনা দুই তরুণ নিজ দায়িত্বেই একটা সিএনজিতে করে তোতাকে পঙ্গুতে নিয়ে গেলো। আর বুবুনের ইতোমধ্যেই জ্ঞান ফিরেছে। তার কপালে তিনটা আর কনুইয়ের কাছে দুটো সেলাই পড়েছে, আর দুয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে। ব্যস, এর বেশি কিছু হয়নি। জ্ঞান ফিরতেই সে চিৎকার করতে লাগলো, আমার মোবাইল, আমার মোবাইল! একজন ওয়ার্ড বয় ছুটে এলো, আপনের সঙ্গে তো কিছু আছিলো না বইন, আপনের একসিডেন্ট হইছে। 
বুবুন বললো, প্লিজ, আমাকে একটা মোবাইল ফোন যোগাড় করে দিন, আমি ফোন করবো। 
: আপনে নাম্বার বলেন, মিনিট কিন্তু দশ টাকা।
বুবুন নাম্বার বলল। 

৩. 
জাকির সাহেব ফোন পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন। প্রথমেই সব রাগ গিয়ে পড়লো বউ মিথিলার উপর। তিনি গাড়িতে বসে বউকে ফোন দিলেন।
: কতোদিন বলেছি, মেয়েকে একা বের হতে দেবে না!
: কেন, ও তো তোতাকে নিয়ে বের হয়েছে।
: তোতা, হু ইজ তোতা? ননসেন্স! একটা গ্রাম্য বাচ্চা ছেলে সঙ্গে দিয়ে দিলেই হলো! গাড়ি ছাড়া কেন বের হতে দিয়েছ?
: মার ড্রাইভার না আসলে আমি কী করবো? কিন্ত হয়েছেটা কী?
: বুবুন এক্সিডেন্ট করেছে।
: কি!
: উত্তেজিত হয়ো না। তেমন কিছু হয়নি। আমি যাচ্ছি।
: আমিও যাবো।
: আমিন সাহেবের গাড়িটা পাঠিয়েছি। ওটায় আসো।
ফোনটা রেখেই তিনি পিএস নীলাঞ্জনাকে একটা ধমক দিলেন। দাঁড়িয়ে কী দেখছো! হাসান সাহেবকে খবর দাও, তৌহিদ সাহেবকে খবর দেও। হাসান সাহেব তাদের লিগ্যাল অফিসার আর তৌহিদ সাহেব তাদের কোম্পানির নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার। নীলাঞ্জনা বুঝতে পারছে না, এখানে হাসান সাহেবের কাজ কী! 

৪.
ইমার্জেন্সির নোংরা স্ট্রেচার আর সহ্য হচ্ছিলো না বুবুনের। সে উঠে এসে পায়চারী করছিল। এখন তার শরীরে ব্যথা নেই। কিন্তু রিকশাঅলা আর তোতার কথা মনে পড়ছে তার। কে যেন বলেছে, রিকশাঅলাটা মারা গেছে। তোতাকে পাঠানো হয়েছে অন্যত্র। সে কি বেঁচে আছে?
জাকির সাহেব ইমার্জেন্সিতে ঢোকার মুখেই বুবুনকে দেখে ছুটে আসেন।
: কী হয়েছে, দেখি মা।
তিনি বুবুনের কপাল আর হাতের ব্যান্ডেজ দেখলেন। 
: কোথায় ডিউটি ডাক্তার কোথায়? এই তুমি কে?
: বাবা ওকে বিশটা টাকা দাও।
: এই যে আপনি এইদিকে আসুন। এইটা কি হাসপাতাল? ছিঃ! ডিরেক্টর কোথায় তাকে ডাকুন।

সদ্য এন্টার্নি করা ডিউটি ডাক্তার মামুন এগিয়ে আসে। সে জহির সাহেবকে চিনতে পেরেছে। দুর্ঘটনার এই এক সমস্যা। বড় মানুষরা অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে চলে আসে। আর তারা আসা মানেই হম্বিতম্বি, হইচই। মামুন মনে মনে আতঙ্কিত হয়। এখনই হয়তো সাংবাদিক, মন্ত্রী ফন্ত্রী চলে আসবে। তার আজ একটু আগে বাসায় যাওয়ার কথা, ছেলেটার শরীর ভালো নেই। ক’দিন আগে ডেঙ্গু থেকে ভুগে উঠলো তার চার বছরের ছেলেটা। আজ বায়না করেছে, তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। দুর্ঘটনা হলো ভুল জায়গায় ভুল সময়ে ভুল মানুষের উপস্থিতি। এখন এইসব ভুলগুলো জোড়াতালি দিতে হবে তাকে। মামুন মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। 
: স্লামালেকুম। আমি উনার স্টিচ দিয়েছি। আমি ডাক্তার মামুন।
: কী স্টিচ দিয়েছেন?
: স্যরি?
: কসমেটিক স্টিচ দিয়েছেন? ওর কপালে কি দাগ থেকে যাবে?
: না, আমরা তো সাধারণত কসমেটিক স্টিচ দেই না, তবে উনার...
: সাধারণত! আমার মেয়ের ব্যাপারটি আপনার কাছে সাধারণ মনে হয়েছে! 
: বাবা, তোতা...
: হ্যাঁ, ওর সঙ্গে যে আমাদের কাজের ছেলেটি ছিলো সে কোথায়?
: ওকে পঙ্গুতে রেফার করা হয়েছে। ওর বাম পা হাঁটুর উপর থেকে একদম ফেলে দিতে হবে। ডান পা’র অবস্থাও ভালো নয়। পাজরের দুটো হাড় ইনজিউরড। ব্লিডিং হয়েছে প্রচুর, লাইফ থ্রেট আছে।
: আচ্ছা, সেটা পরে দেখছি। এখন বলুন, আমার মেয়ের পরবর্তী চিকিৎসা কী?
: ওকে আপনি বাসায় নিয়ে যেতেন পারেন, শি ইজ আউট অব ডেঞ্জার।
: কী বলছেন আপনি? পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে! আপনি ব্যাপারটাকে আমল দিচ্ছেন না? সিটি স্ক্যান করিয়েছেন?
: জি না।
: জি না! মাই গড! কী পাশ আপনি? না, না, আপনার সঙ্গে কথা বললে হবে না। আপনার ডিরেক্টরকে খবর দিন, ইমিডিয়টলি আসতে বলুন। ওকে আমি বামরুগাদে নিয়ে যাবো। 
: স্যার, আপনি শান্ত হোন। উনার তেমন কিছু হয়নি। আমরা যতটুকু করেছি সেটাই উনার জন্য যথেষ্ট। 
: ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি... যা বলছি তাই করুন। ডিরেক্টরকে আসতে বলুন।
ডিরেক্টরকে আর আসতে বলা লাগলো না। কীভাবে যেন তার কাছে খবর চলে গেছে। তিনি সঠিক সময়ে হাজির হলেন। ডাক্তার মামুন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। 
: এই যে মাজাহার ভাই, হাসপাতালটাকে কী করে রেখেছেন? মেয়েটা মাথায় আঘাত পেয়েছে, অথচ কোনো সিটি স্ক্যানই করানো হয়নি! আমি এসে দেখি সে বাইরে হাঁটাহাটি করছে!

হাসান সাহেব আর তৌহিদ সাহেব দুই কাঁধের পাশে মুনকারনাকিরের মতো দণ্ডায়মান। তৌহিদ সাহেব একটা নীরব সালাম দেন মাজাহার সাহেবকে। 
: জাকির সাহেব, আমার রুমে আসুন।
: না, না, ফর্মালিটির সময় এখন না। আচ্ছা, বল তো, এতো জায়গা থাকতে তুই এখানে এলি কেন? 
: আমার তো জ্ঞান ছিল না। কারা যেন... পাপা, আমার মোবাইল, ব্যাগ এইসবও...
: মিসিং! কী একটা জাত হয়েছি আমরা! যাক, ও সব নিয়ে পরে ভাবলেও হবে, আইজিকে বললেই সব বেরিয়ে যাবে। হাসান সাহেব আপনি একটু আইজিকে ফোন দিন। মোবাইলটা ট্র্যাক করতে বলুন। মাজহার ভাই, আমি ওকে বামরুগাদে নিয়ে যেতে চাই, এয়ার এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে, আপনি কি কোনো রেফারেন্স দিতে পারেন।
: ব্যস্ত হবেন না। আমি দেখছি। তোমাকে দেখেছে কে মা?

ডাক্তার মামুন পাশেই ছিল। সে বড় বড় বোলচালে একটু বিরক্তই হচ্ছিল। আমাদের দেশের বড় লোকদের একটু হেঁচকি উঠলেই বিদেশে চেকআপ করার খায়েশ জাগে! দেশের সব ডাক্তার, সব হাসপাতাল, সব চিকিৎসাই তাদের কাছে খারাপ? অথচ তাদের কবর তো দেশেই হয়?
: স্যার, আমি উনার স্টিচ দিয়েছি। টোটাল ছয়টা বাইট লেগেছে। লোকাল দিয়ে স্টিচ করেছি। 
: হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক।
: সি ইজ ওকে, কমপ্লিটলি ওকে। আমার মনে হয় না...
: আপনার কি মনে হয় না হয়, দ্যাটস নট ইম্পর্টেন্ট এট অল। আই ডোন্ট বিলিভ ইন ইউর ট্রিটমেন্ট প্রসিডিওর। ভেরি আন হাইজিনিক এনভায়রমেন্ট। আয় মা, তুই গাড়িতে ওঠ। 

জাকির সাহেব এগুতে নেন। এরমধ্যেই একজন ইন্সপেক্টর এসে সেল্যুট ঠোকে।
: স্যার, বাস ড্রাইভারটা ধরা পড়েছে। মালিককেও ধরেছি আমরা। ওরা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজী। দুর্ঘটনার উপর তো আর কারো...
: টু হেল উইথ ইউর ক্ষতিপূরণ! আই ওয়ান্ট টু সি দ্যা ড্রাইভার হেংগড। এটাকে কোন দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা হলো একটা হত্যাকাণ্ড। এই ড্রাইভারগুলো একেকটা কিলার।
: স্যার, রিকশা ড্রাইভার মারা গেছে।
: দেখলেন ইন্সপেক্টর! আমি আগেই বলেছি, এটা মার্ডার কেস। আপনার নাম কি?
: স্যার, ইমরুল। ইমরুল হুদা। 
: ঠিকাছে হুদা সাহেব, আমি আপনার কথা বলবো আইজিকে। হাসান সাহেব আপনি আইজির সঙ্গে কথা বলুন। ব্যারিস্টার ইমদাদকেও একটা ফোন দিন। শুনুন ইমরুল সাহেব এ সব নিয়ে পরে কথা হবে, আপাতত আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আই নিড ইউর হেল্প। আমি মামনিকে নিয়ে কেয়ার ক্লিনিকে যাবো, দয়া করে সাইরেন টাইরেন বাজান, রাস্তা ক্লিয়ার করতে করতে এগুন। যে জ্যাম ঢাকা শহরে- ডিজগাসটিং! আয় মা। তুই কি গাড়িতে যেতে পারবি? নাকি এম্বুলেন্সে?

মাজহার সাহেব কী একটা যেন বলতে নিলেন। কিন্তু কাউকে আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বুবুনকে নিয়ে জাকির সাহেব গাড়িতে উঠলেন। সেক্রেটারি এবার পুলিশের গাড়িতে উঠলো। ম্যাডামকে ফোন করে সে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে তারা প্রাইভেট ক্লিনিকে যাচ্ছে। পুলিশের হর্নে রাস্তা পরিষ্কার করে তারা এগুতে থাকেন আর এদিকে ডাক্তার মামুন একটু রিলাক্স হওয়ার জন্য জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস ফেলেন। তবু তার একটু নার্ভাস লাগে যখন দেখেন ডিরেক্টর মাজাহার স্যার তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
সে মিনমিন স্বরে বলে, স্যার, আমার মনে হয় না আমরা কোনো গাফিলতি করেছি। সিম্পল এক্সসিডেন্ট কেইস। স্টিচটাও যত্ন নিয়ে দেয়া হয়েছে, কোনো স্কার থাকবে না। তবে কাজের ছেলেটার অবস্থা ভালো নয়...
: ইটস ওকে ড. মামুন, ইউ ডিড ইউর বেস্ট। প্লিজ গো টু ইউর ডিউটি। 
ডাক্তার মামুন এতোক্ষণে একটা নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস নেয় বুক ভরে। মাজহার স্যারের এই একটা বিশাল গুণ, তিনি দিন শেষে তার ডাক্তারদের উপর আস্থা রাখেন। 
ডাক্তার মামুন এইবার হয়তো নিজের ছেলেটার একটু খোঁজ নিতে পারবে।  

৫. 
জাকির সাহেবের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। তারা কেয়ার ক্লিনিকে পৌঁছানোর আগেই সিটি স্ক্যান থেকে শুরু করে ওটি পর্যন্ত সব রেডি। সৌভাগ্যক্রমে বুবুনের শরীরে আর কোনো আঘাত বা বড় সমস্যা কোনো পরীক্ষাতেই ধরা পড়লো না। প্রফেসর মর্তুজা অবশ্য বন্ধু জাকিরকে জানালেন, মেয়ে শক পেয়েছে, বড় ধরনের শক, বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসলে ভালো হয়।  
ইতোমধ্যে মিথিলাও এসে হাজির। তিনি মেয়েকে আগেই বাড়ি থেকে বার হতে দিতে চাচ্ছিলেন না। এখন সে জন্য বকতে নিলেন। কিন্তু প্রফেসর মতুর্জা বললেন, ভাবী, ডোন্ট বি হার্স উইথ হার। লেট হার বি চিয়ার আপ।
হাসান সাহেব বললেন, চিয়ার আপ তো হতেই হবে! শোনো বুবুন, আমার একটা কথা মন দিয়ে শোনো, লাইফ ইজ আ জার্নি। আ বিগ জার্নি। আর চলার পথে দুর্ঘটনা হবে, কেউ আহত হবে, কেউ নিহত হবে...
: পাপা, নিহত কী?
: নিহত মানে মারা যাওয়া।
: পাপা,  তোতা কি মারা গেছে?
: ডোন্ট ওরি এবাউট দ্যাট। তোতাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। হাসান সাহেব আর তৌহিদ সাহেব পুরো ব্যাপারটা দেখবে। যেটা তোমার জানা দরকার সেটা হলো, জীবনে দুর্ঘটনা থাকবে। তোমার কাজ হলো দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা। 
: থাক না জাকির, মেয়েটাকে এ সব জ্ঞান পরে দিও। 
: ঠিক, চলো, আমরা আগে বাড়ি যাই। ইউ নিড টু হেভ সাম ফ্রেস জুস। 

মুর্তজা বললো, আরে তাড়া কিসের বন্ধু, বসো! জুস আমি আনাচ্ছি মেয়ের জন্য, এখানে ভালো ফ্রেশ জুস পাওয়া যাবে। একটা অরেঞ্জ জুস খাও মা। জাকির, তুমিও একটু কফি খাও? ভাবী কি খাবেন বলুন? আমার এখানে তো আর আপনারা এমনি এমনি আসবেন না। 
: না বন্ধু, অন্য সময় আসব। বাসায় যাই। ইউ নিড টু ফ্রেশেন আপ। কাল ক্লাবে এসো। কথা আছে। 
জাকির সাহেব মিথিলাকে আর বুবুনকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আর ডাক্তার তৌহিদ ও লিগ্যাল এজভাইজার হাসানকে নির্দেশ দিলেন পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে তোতার খোঁজ নিতে। 

৬. 
পঙ্গু হাসপাতালে তিন জন ডাক্তার থাকলে ত্রিশ জন রোগী থাকে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যে কোন ব্যাপার না শুধু এই একটি হাসপাতালে আধ ঘণ্টা দাঁড়ালেই বোঝা যায়। হাত-পা কেটে ফেলা এখানে এতো অবলীলায়  আর এতো ঘন ঘন হয় যে টুকটাক এম্পুটিউশন নার্স-বয়রাও করে ফেলতে শিখে গেছে। 
তৌহিদ পঙ্গু হাসপাতালের সাথে পূর্ব পরিচিত। কিন্তু হাসান সাহেব এখানে ঢুকে দিশেহারা হয়ে যান। ইমার্জেন্সিতে তোতা নামে কারো এন্ট্রি নেই। অন্য আরেক রোগীর আত্মীয় সূত্র ধরে সে জানতে পারে একটি বালককে দুজন লোক এখানে ধরাধরি করে এনেছিল দুয়েক ঘণ্টা আগে। তার অপারেশন হয়েছে, এখন আইসিইউতে আছে। 
কিন্তু আইসিইউতেও গিয়ে তোতাকে পাওয়া যায় না। নার্স-ডাক্তার সবাই ব্যস্ত। তৌহিদ সাহেব নিজের ডাক্তার পরিচয়টা দিলেন, সেই সঙ্গে জাকির সাহেবের নামটাও শুনিয়ে দিলেন। পরিচয়ের মাহাত্মেই তারা এক মিনিটের ব্রিফিং দিলো। যা জানা গেলো তা খবরের ভাষায় এমন: ‘আজ সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ নয়-দশ বছরের অজ্ঞাতনামা একটি বালক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসে। বাসের চাকায় তার দুটো পা পিষ্ট হয়ে যাওয়ায় তা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু দুর্ঘটনাকালে এবং পরবর্তীতে রক্তপাত বন্ধ করতে না পারায় তার মৃত্যু হয়। এই লাশের মালিকানা এখনও কেউ দাবি করেনি।’

এই তথ্য জানার পর, হাসান সাহেব ভাবতে বসে, খবরটা এক্ষুণি স্যারকে জানাবে কি না। হাসান সাহেব আর তৌহিদ সাহেব কথা বলে।
: কী বলেন হাসান সাহেব, স্যারকে ফোন দেব?
: আমার মনে হয় এখনি ফোন দেয়ার দরকার নেই। দেখলেনই উনার মেজাজ ঠিক নেই। একটু শান্ত হোক। যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। 
: ঠিক বলেছেন। তাছাড়া এখানে অনেক ফর্মালিটিজ আছে। ছেলেটার পোস্টমর্টেম হবে। রিকশাঅলার লাশ খুঁজে বের করতে হবে। বাস ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। 
: চলুন আমরা বরং দুকাপ চা খেয়ে নেই। ঠান্ডা মাথায় একটা প্ল্যান অব একশন করে ফেলি।
শুধু চা নয়, তারা দুজন দুপিস করে কেকও খেয়ে ফেলল। তারা শরীরে এনার্জি সংগ্রহ করে নেয়। দুটো সিগারেটও ফুঁকে নিল। চা, সিগারেট আর কেকের কল্যাণে তাদের মনোবল কিছুটা বাড়ল। হাসান সাহেবই একটা ফোন দিলো জাকির সাহেবকে।

জাকির সাহেব অবশ্য ভীষণ দয়ালু মানুষ। তিনি খবর শোনামাত্র হাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে দেন। নির্দেশনা মোতাবেক হাসান সাহেব বাস মালিক সমিতির সাথে ক্ষতিপূরণের জন্যে যোগাযোগ করেন, তৌহিদ সাহেব লাশ মর্গ থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন এবং তাদের যৌথ উদ্যোগে তোতার লাশ দেশের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

উল্লেখ্য, এই সকল ব্যবস্থাই সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হয় এবং মৃতের চাচা আব্দুল হামিদ ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ এক লক্ষ টাকা পেয়ে যান। এটা ভালো দিক ছিল যে, মরহুম তোতার বাবা-মা আগেই মারা গিয়েছিল। আব্দুল হামিদ এতিম শিশুর লাশ জড়িয়ে খুব কাঁদলেন। কিন্তু লাখ টাকার নোটগুলো দেখেই তার শান্তি লাগল। তার একসময় মনে হলো, আহা এতিম ছেলেটাকে তিনি বা তার স্ত্রী কোনো দিন এক ফোঁটা আদর যত্ন দেখান নাই। খোদার কি লীলা, সেই এতিম ছেলেটা মরে গিয়ে তাদেরকে লাখপতি বানিয়ে দিয়ে গেলো। তিনি দু’হাত তুলে ছেলেটার জন্য দোয়া করলেন আর দোয়া করলেন জাকির সাহেব ও তার পরিবারের জন্য। তিনি এমনও ভাবলেন, ঢাকা গিয়ে জাকির সাহেবের মেয়েটাকেও একটু দেখে আসবেন। এরা দিল দরাজ মানুষ, এদেরকে দেখলেও পুণ্য হয়।

৭.
আব্দুল হামিদ সযতনে  তোতার দাফন-কাফন শেষ করেন। তার চারদিন পর আব্দুল হামিদ ঢাকায় রওনা দেন। নিজের গাছের এক কাঁদি কলা, দুইটা দেশি মুরগি আর পাঁচ কেজি কালিজিরা চাল নিয়ে তিনি ঢাকা চলে এলেন। জাকির সাহেবের গুলশানের বাড়িতে এসে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হলো, বেহেশতের বাড়িঘর নিশ্চয়ই এমনই হবে। এখানেও দুইজন দ্বাররক্ষী দাঁড়িয়ে আছে বেহেশতের পাহারায়। তাদের একজন ছুটে এলো। ধমকের সুরেই জানতে চাইলো, কাকে চায়, কী চায় এসব। তারা তো দেখেই বুঝতে পারে, কোন লোকটি বেহেশতে ঢুকতে পারবে আর কোন লোকটি পারবে না। আব্দুল হামিদকে জেরা করে, কোথায় ঠিকানায় পেয়েছে, কেন এসেছে, কী চায় ইত্যাদি সব জেনে নেয় বিশালদেহি দারোয়ান। ভেতর থেকে চিকচিকে কালো একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। তার মুখ আর পায়ের কাছটা খয়েরি বাদামী, ঘেউ ঘেউয়ে বিরতি দিয়ে মাঝে মাঝে সে জিভ বের করে হাপাচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাচ্ছে। কুকুরটা লেজ কাটা। এমন চিকচিকে, পুরষালি পেটানো কুকুর আব্দুল হামিদ তার এক জীবনে দেখেনি।

যাহোক, আব্দুল হামিদ যে এবার বাড়ির একসময়ের বাচ্চা চাকর তোতার চাচা এটুকু জানতে পেরে দারোয়ানের দিল ঠাণ্ডা হয়। সে তাদের ঘরে ফ্যানের পাখার নিচে আব্দুল হামিদকে বসতে দেয়। বেহেশতের দুয়াররক্ষী বলেই হয়তো তাদের দিলেও রহম আছে কিছুটা। আব্দুল হামিদকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি তারা, তবে দারোয়ানের ঘরে বসিয়েছে- এইবা কম কী! 
: শুনুন, স্যারেরা কেউ দেশে নাই। তারা গেছে সুইজারল্যান্ড। বুবুন আপায় তো আঘাত পাইছে। তার শরীর মন ঠিক করতেই বিদেশ গেছে।
: ও। তাইলে এই যে মুরগিগুলা, কলাগুলা এট্টু চাইলও আনসিলাম, মনে বড় খায়েশ আছিলো, বড় মানুষটারে একটু দেখতাম।
: এইগুলা রাইখা যান, উনারা ফিরলে পাইবো। কলা থাকবো না, কিন্তু মুরগি জব করে ফ্রিজে রাইখা দেওন যাইবো। চাল নিয়া তো সমেস্যা নাই।
: কলাডি তাইলে আপনেরা খাইয়েন ভাই। তা কোন দেশ গেছে কইলেন? 
: সুইজারল্যান্ড। বিদেশ। সেইখানে বরফ পড়ে। ঝরনা, পাহাড় এইসব আছে। বড় সুন্দর জায়গা! বিরাট বড়লোকি সব কারবার। বড় বড় লোকেরা টেকাও রাখে সেই দেশে।

আব্দুল হামিদ আন্দাজ করে, এইটা যদি বেহেশত হয়, তাইলে সেই দেশটা কি! আদতে বেহেশতেরও মধ্যেও নানা নাম ধাম আছে। শুনছে সে, জান্নাতুল ফেরদৌসই সেরা। 
যাহোক, কলার কাঁদি, চাল, মুরগি দারোয়ানের হাতে দিয়ে আব্দুল হামিদ চলে আসতে নেয়। কিন্তু দারোয়ান তাকে নাস্তা খাওয়ায় যত্ন করে। আব্দুল হামিদ বুঝতে পারে, বড় মানুষের কাজের লোকেরাও বড় হয়। আল্লা তাদের সবাইকে ভালো রাখুন- এই দোয়া করতে করতে তিনি আবার গ্রামের পথে রওনা দেন। ফিরতি পথে ভাবতে থাকেন,  তোতার কবরে একটা বেড়া দিতে হবে। কালই বেড়াটা দিয়ে দিবেন। বেড়া দিতে আর কয় টাকায়ই বা লাগবে। তোতার কারণেই তিনি তো এখন লাখপতি। সারা জীবন পরিশ্রম করলেও তো আব্দুল হামিদ লাখ টাকা কামাই করতে পারবেন না। অথচ তোতা মরে গিয়ে লাখ টাকা কামাই করলো- সবই মাবুদের লীলা!
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়