ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ২১ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের গল্পে মৃত্যু ও প্রেম চিন্তা  

অদিতি ফাল্গুনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৬, ৬ আগস্ট ২০২৩  
রবীন্দ্রনাথের গল্পে মৃত্যু ও প্রেম চিন্তা  

বছর ঘুরে আবার আসছে বাইশে শ্রাবণ। খানিকটা জ্বর গায়েই তাই লিখতে বসেছি রবীন্দ্রনাথের গল্পে মৃত্যু চিন্তা বিষয়ে। কিন্তু খুব পছন্দের কয়েকটি গল্প নাড়া-চাড়া করতে গিয়ে দেখছি, মৃত্যু বিষয়ক তাঁর একাধিক গল্পেই যেন মৃত্যুর সাথে কোথাও তীব্রভাবে এক ‘ত্রিকোণ’ বা ‘ত্রিভুজ’ প্রেমের বিষয়ও জড়িত। বিশেষত: ‘কঙ্কাল’, ‘মণিহারা’ ও ‘মধ্যবর্তীনী’ গল্পত্রয়ের কথা। মৃত্যু চিন্তা আশ্রয় করে গোটা গল্পগুচ্ছে আরও কিছু গল্প থাকার কথা, কিন্তু  খুব দ্রুতই লিখতে হবে বলে যে কয়েকটি গল্পের কথা মাথায় আসছে, তার ভেতর এক ‘ছুটি’ ছাড়া তিনটি গল্পের দুটো গল্পে-ই (‘কঙ্কাল’ ও ‘মধ্যবর্তীনী’) ত্রিভুজ বা ত্রিকোণ প্রেম এক গভীর অনুষঙ্গ।

অন্যদিকে ‘মণিহারা’ এর নায়ক-নায়িকা স্বামী-স্ত্রী এবং নায়ক নিঃসন্তান স্ত্রীর প্রতি তীব্র অনুগত হওয়া সত্ত্বেও নিঃসন্তান তবে রূপবতী স্ত্রীর কাছে বরসহ গোটা পৃথিবীর কারো প্রতি কোন প্রেম বা স্নেহ-উত্তাপের বদলে শুধুই অলঙ্কার ও ঐশ্বর্য সংগ্রহের চিন্তাই প্রধান এবং সম্পদের প্রতি অনিঃশেষ বাসনা তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। এবার খুব সংক্ষেপে এই গল্প কয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কাজকে ভাগ করলে তাঁর চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং গল্প/উপন্যাসে তিনটি প্রধান ধারা পাওয়া যায়। সঙ্গীতে যদি রবীন্দ্রনাথ ‘সত্ত্ব’ গুণের অধিকারী বা ফ্রয়েড কথিত মানব চৈতন্যের ‘সুপার ইগো’-র অধিকারী, গানে যদি উপনিষদের ভাবনায় আস্থাশীল রবীন্দ্রনাথ ‘আকাশ জল বাতাস আলো/সবারে আমি বাসিব ভাল’ হতে চান, সেই একই রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলায় যেন ঘোর তমস অন্ধকার বা ফ্রয়েড কথিত মানব চৈতন্যের ‘ইড’-এর অধিকারী। আর গল্প-উপন্যাসে? এখানে যেন মানব চরিত্রের আলো ও আঁধার দুটোই এসেছে। ‘ইড’ ও ‘সুপার ইগো’  সহযোগে সে মানুষের ‘ইগো’- স্বাভাবিক মানুষ যেমন। দানব ও দেবতার সম্মিলনে নিতান্ত মানব।

আরো পড়ুন:

আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কি তাঁর কোন কোন গল্পে এডগার এ্যালান পোকে দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন? প্রবন্ধটি লিখতে লিখতেই অন্তর্জালে পরীক্ষা করলাম। হ্যাঁ, এ্যালান পোর জন্ম ১৮০৯ ও মৃত্যু ১৮৪৯-এ। তাহলে ১৮৬১ সালে জন্ম ও ১৯৪১ সালে মৃত্যুবরণ করা রবীন্দ্রনাথ কি পড়েছিলেন পো-কে?

‘কঙ্কাল’ গল্পে ত্রিভুজ প্রেম, একটি নারীর মৃত্যু, জীবনে দ্বিতীয় নারীর প্রবেশ এবং প্রথম নারীর ছায়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘কঙ্কাল’ গল্প ব্যক্তিগত ভাবে আমি এত অল্প বয়সে পড়ি যে সেটা এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার নিজের মেজো দাদা ডাক্তারি পড়তেন বলে ওর মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে গিয়ে পড়ার টেবিলে কঙ্কাল দেখে খুব ভয় পাই এবং পরে ‘গল্পগুচ্ছ’-এ ‘কঙ্কাল’ নামে গল্প দেখে পড়া শুরু করি। যদিও সেই বয়সে গল্পটা পড়েছিই শুধু, বুঝিনি। গল্পে বোর্ডিংয়ে থাকা এক  ছাত্রের মাথার কাছে টেবিলে রাখা ‘কঙ্কাল’ ছাত্রটির সাথে এক রাতে গল্প করা শুরু করে: ‘তোমার কাছে কী করিয়া প্রমাণ করিব যে, সেই দুটো দুটো শুন্য চক্ষুকোটরের মধ্যে বড়ো বড়ো টানা দুটি কালো চোখ ছিল এবং রাঙা ঠোঁটের উপরে যে মৃদু হাসিটুকু মাখানো ছিল এখনকার অনাবৃতদন্তসার বিকট হাস্যের সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না।’ 

হ্যাঁ, উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের শুরুর কোন বাল্যবিধবার কাহিনি এটি। বিয়ের দুই মাসের মাথায় বাল্যবিধবা হওয়া একটি মেয়ের বড় দাদা শপথ করলেন যে বিধবা বোনকে রেখে তিনি বিয়ে করবেন না। ভাই-বোনের সংসারে একদিন দাদার বন্ধু শশিশেখর তাদের ‘পারিবারিক ডাক্তার’ হিসেবে আসে। যুবক শশিশেখর তখনো অকৃতদার: ‘তাঁহার বন্ধুর মধ্যে এক শশিশেখর। এই জন্য বাহিরের যুবকদের মধ্যে আমি এই শশিশেখরকেই সর্বদা দেখিতাম। এবং যখন আমি সন্ধ্যাকালে পুষ্পতরুতলে সম্রাজ্ঞীর আসন গ্রহণ করিতাম তখন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষজাতি শশিশেখরের মূর্তি ধরিয়া আমার চরণাগত হইত।-- শুনিতেছ? কী মনে হইতেছে।’ আশ্চর্যজনকভাবে রবীন্দ্রনাথের গানেও ‘বধূ, তোমায় করব রাজা তরুতলে/বনফুলের বিনোদ মালা দেব গলে’ বা ‘অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে’র কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই শাস্ত্রনিগড়ে বাঁধা। বিধবা মেয়েকে বিয়ে করার সাহস হয়নি শশিশেখরের।

উল্টো বারো হাজার টাকা যৌতুকে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করতে যেদিন সে যাবে, মেয়েটি তার দাদার কাছ থেকে সেটা জানতে পেরে শশিশেখরের সাথে অনেক ঠাট্টা করে। বোনের পিড়াপীড়িতে দাদা অনুষ্ঠান আয়োজনেরও ব্যবস্থা করে। বিয়ের পিঁড়িতে বর হিসেবে যাবার আগে মেয়েটির সাথে মদ খাবার সময় মেয়েটি এর আগে শশিশেখরের কাছ থেকে বিষ হিসেবে জেনে নেওয়া একটি ওষুধের কিছু গুঁড়ো শশিশেখরের মদের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে নিজেও বিষ খায়। যে শশিশেখরের সাথে বিধবা মেয়েটির প্রথম পরিচয় হয় মেয়েটির জ্বর হবার পর তাকে দেখতে এসে এবং তরুণীর নাড়ি দেখতে গিয়ে যুবক ডাক্তার লাজুক ও কম্পিত হয়ে উঠছিলেন, সেই শশিশেখর বিষ মাখা মদ খেয়ে ‘তবে চলিলাম’ বলে বিয়ে করতে গেলেন। 

‘বাঁশি বাজিতে লাগিল, আমি একটি বারাণসী শাড়ি পরিলাম, যতগুলি গহনা সিন্দুকে তোলা ছিল সবগুলি বাহির করিয়া পরিলাম- সিঁথিতে বড়ো করিয়া সিঁদুর দিলাম। আমার সেই বকুলতলায় বিছানা পাতিলাম।’ 

বিধবা মেয়েটি তার ধর্মমতে বিয়ে হওয়া স্বামীকে দুই মাসের একটি মুহূর্তেও সহ্য করতে পারেনি বা ভয় পেত। কিন্তু যে প্রেমিককে সে হৃদয় দিয়েছে তার মদে বিষ মিশিয়ে নিজেও মৃত্যুর আগে সিঁথিতে সিঁদুর পরলো যেন ‘সহমরণে’ই সে যাবে। কিন্তু বারবার কেন এই প্রেমিকের অন্যত্র বিয়ে, আগের মেয়েটির মৃত্যু? ‘মালঞ্চ’ নাটকেও অসুস্থ স্ত্রী নীরোজা, দূর সম্পর্কের কোন বোন তথা প্রেমিকা সরলা বা ‘নষ্টনীড়’-এ অমলের বিয়ের পর চারুলতা মরে না গেলেও জীবনমৃত হয়ে থাকে। লেখকেরা নাকি বাস্তবে সারাজীবন ধরে নিজের জীবনকেই লেখেন। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের পরই কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কি সারাজীবনই বাংলা সাহিত্যের এই দীর্ঘতম মহত্তম মানুষটিকে তিলে তিলে ভুগিয়েছে? কোনদিনই ‘অপরাধবোধ’ থেকে মুক্তি পাননি? জাপানি কবি কিমি ইয়ুকেরির লেখা সেই হাইকুর কথা মনে পড়ে: ‘ইউ ম্যারেড/ইটস লাইক আ ডেথ নোট/ফ্রম ফার এ্যাওয়ে (বিয়ে করলে তুমি/আর দূর থেকে সেই খবর এলো/মৃত্যু চিরকূটের মতো)।’

‘মধ্যবর্তীনী’ নিয়ে বিশদ বা নতুন করে বলার কিছু নেই। বহুল আলোচিত এই গল্পে আট বছর বয়সে বিলিতি কোম্পানির কেরানী নিবারণের বধূ হয়ে আসা হরসুন্দরী ৩৫ বছর বয়সে ৪০ দিনের গুরুতর রোগে, স্বামীর সেবায় সুস্থ হয়ে উঠে এবং রোগশয্যার কারণেই কিছু বিশ্রামের অবসর পেয়ে, বাড়ির সামনের গাছপালা দেখে স্বামীর প্রতি প্রেমে তীব্র ত্যাগের মনোবাসনা থেকে নিঃসন্তান ঘরে সন্তান আনার আশায় জোর করে কিশোরী শৈলবালার সাথে নিবারণের বিয়ে দেয়। কিশোর বয়সেই বিয়ে হওয়া নিবারণ স্ত্রী হরসুন্দরী কখন তরুণী হয়েছে তা  খেয়ালও করেনি। দুজনেই শৈশব-কৈশোর থেকেই বর-বধূ হিসেবে পড়শির ছেলের বিয়েতে তত্ত্ব পাঠানো, তরকারির পাঁচফোঁড়ন জাতীয় নানা আলাপে জীবন পার করেছে। সেই নিবারণ কিশোরী শৈলবালাকে পেয়ে বঙ্কিম চন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসও পড়া শুরু করে। লুকিয়ে কিশোরী বউকে বিলিতি কাঁচের পুতুল (গাউন পরা মেম), এসেন্স বা মিষ্টিদ্রব্য কিনে দেয়। হরসুন্দরী কিশোরী স্ত্রীকে ঘরের কাজ শেখাতে গেলে নিবারণ মানা করে।

শৈলবালার কথায় হরসুন্দরী তার বিয়ের সব গয়না শৈলবালাকে পরিয়ে ২৭ বছরের দাম্পত্য শয্যা পরিত্যাগ করে অন্য কক্ষে যায়। নানা ঘটনার পাকে-চক্রে কাউকেই ভাল না বাসা, দাপুটে কিশোরী শৈলবালা মৃত সন্তান প্রসব করে মৃত্যুর পর আবার ‘...একদিন গভীর রাত্রে সমস্ত শহর যখন নিদ্রিত, নিবারণ ধীরে ধীরে হরসুন্দরীর নিভৃত শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল।...হরসুন্দরীও একটি কথা বলিল না, নিবারণও একটি কথা বলিল না। উহারা পূর্বে যেরূপ পাশাপাশি শয়ন করিত এখনও সেইরূপ পাশাপাশি শুইল, কিন্তু ঠিক মাঝখানে একটি মৃত বালিকা শুইয়া রহিল, তাহাকে কেহ লঙ্ঘন করিতে পারিল না।’ 

অদ্ভুতভাবে রবীন্দ্রনাথের এই ধাঁচের প্রায় প্রতিটি গল্পেই দুজন নারী এবং একজন নরের সমীকরণে একটি না একটি নারীর মৃত্যু হচ্ছে। ‘মধ্যবর্তীনী’-তে খানিকটা যেন ‘মায়ার খেলা’র মতো আভাস পাওয়া যায়। শৈলবালার মতো আত্ম-গর্বী প্রমদা নয়, সুখে-দুঃখে-অপমানে পাশে থাকা ‘শান্তা’ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়: ‘প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।’ 

এবার আসব ‘মণিহারা’ গল্পে। এই গল্পের তৃতীয় পংক্তিতেই বোঝা যাচ্ছে এ গল্প বিশেষভাবে পূর্ব বাংলার: ‘সেই জীর্ণপ্রায় বাঁধাঘাটের ধারে আমার বোট লাগানো ছিল। তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। বোটের ছাদের উপরে মাঝি নমাজ পড়িতেছে।’ ঠিক এ সময় উত্তম পুরুষে কাহিনি শুরু করা মানুষটির কাছে এলাকার ইস্কুল মাস্টার আসেন যাকে দেখে ‘ইংরাজ কবি কোলরিজের সৃষ্ট প্রাচীন নাবিকের কথা আমার মনে পড়িল।’ 

রাঁচি থেকে আসা ও বোটে ভাসমান ব্যক্তিকে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজের নাম না বলে অন্য একটি নাম বলেন এবং জানান যে তিনি ‘হরীতকী, রেশমের গুটি এবং কাঠের ব্যবসা’ করেন। স্কুলশিক্ষক তখন তাঁকে এই এলাকায় ছিলেন এমন এক ফনিভূষণ সাহার কথা বলেন যিনি তাঁর অপুত্রক পিতৃব্যের বিপুল সম্পত্তির মালিক, নিজে ইংরেজি শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড অনুগত। তবে ঠিক বঙ্কিমের ‘মুচিরাম গুড়’-এ ইংরেজি পারলেই যেমন সাহেবরা কোন দক্ষ বাঙালিকে চাকরিতে নিতে চাইতেন না, ফনিভূষণও জুতা পায়ে সাহেবের দপ্তরে ঢুকে খাঁটি ইংরেজি বলায় ‘তাঁহার উন্নতির সম্ভাবনামাত্র ছিল না।’ এছাড়াও ‘নব্য শিক্ষায়’  শিক্ষিত পুরুষ ‘পৌরুষের বর্বরতা’  হারানোয় নারী ‘অতি ভদ্র পুরুষ’কে যেন তত বেশি পাত্তা দেয় না। এখানেই রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি: ‘সাধারণত স্ত্রীজাতি কাঁচা আম, ঝাল লঙ্কা এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুর্ভাগা পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত সে-যে কুশ্রী অথবা নির্ধন তাহা নহে, সে নিতান্ত নিরীহ। স্ত্রীলোক পুরুষকে ভুলাইয়া নিজের শক্তিতে ভালোবাসা আদায় করিয়া লইতে চায়, স্বামী যদি ভালো মানুষ হইয়া সে অবসরটুকু না দেয়, তবে স্বামীর অদৃষ্ট মন্দ এবং স্ত্রীরও ততধিক। অভাগা ফণিভূষণ আধুনিক সভ্যতার কল হইতে অত্যন্ত ভালোমানুষটি হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছিল-ব্যবসায়েও সে সুবিধা করিতে পারিল না, দাম্পত্যেও তাহার তেমন সুযোগ ঘটে নাই। ফণিভূষণের স্ত্রী মণিমালিকা, বিনা চেষ্টায় আদর, বিনা অশ্রুবর্ষণে ঢাকাই শাড়ি এবং বিনা দুর্জয় মানে বাজুবন্ধ লাভ করিত। এইরূপে তাহার নারী প্রকৃতি এবং সেইসঙ্গে তাহার ভালোবাসা নিশ্চেষ্ট হইয়া গিয়াছিল।’

কি ভালোবাসে মণিমালা? চব্বিশ বছরের এই নারীকে দেখতে চৌদ্দ বছরের কিশোরীর মতো সুন্দর ও সজীব। নিঃসন্তান এই নারীর পৃথিবীতে স্বামীসহ কারো প্রতিই কোনো প্রেম বা মমতা নেই। একমাত্র প্রেম স্বামীরই দেওয়া সিন্দুক ভর্তি অসংখ্য সোনা-রূপা-হীরে-জহরতের গয়নার প্রতি। তবে সে এতটাই ‘সম্পদ সঞ্চয়ে সচেষ্ট যে ঘরে গৃহকর্মীকে বেতন দিতে হবে বলে দক্ষ হাতে ঘর-সংসারের কাজ করে, তবে সিন্দুকের সব গয়না ছাড়া আর কিছুই সে ভালোবাসে না। পড়শি মহিলাদের সাথে আলাপ, কাউকে দুটো চাল ভিক্ষা দেওয়াসহ কিছুই না করা মণিমালার সব উন্মত্ততা সম্পদের প্রতি। তারপর? একদিন স্ত্রীর একান্ত অনুগত বর ফণিভূষণের ব্যবসায় টান পড়লে সে লাখ দেড়েক টাকার জন্য স্ত্রীর কাছে কয়েকদিনের জন্য গয়না বন্ধক দেবার অনুরোধ করলে স্ত্রীর নীরবতায় অপমানিত হয়ে কয়েক দিনের জন্য এলাকা ছাড়ে- টাকা যোগাড়ের আশায়। স্ত্রী তার এক দেশতুতো দাদা মধুসূদনকে (যাকে স্বামী ফণিভূষণের সেরেস্তায় চাকরি দেওয়া হয়েছিল) ডেকে পরামর্শ চাওয়ায় মধুসূদন তাকে বিপথগামী করে যে ফণিভূষণ অর্থ-সঙ্কটে পড়ে তার গয়নায় হাত দেবেই এবং সুতরাং এ অবস্থায় ‘বাপের বাড়ি’ যাওয়াই ভালো। গহনা বাঁচাতে আর্ত মণিমালা তার পুরো দেহে সব গয়না পরে এক রাতে মধুসূদনের সাথে নৌকায় ওঠে। নিজের এই দূর সম্পর্কের দাদাকেও ‘ভরসা’ করতো না বলে সে গয়নার বাক্সে হাতে না নিয়ে সব গয়না পরে, নিজেকে মোটা চাদরে ঢাকে।

তারপর? ফনীভূষণ প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় করতে পেরে খুশি মনে ঘরে এসে দেখে স্ত্রী নেই। শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ করে জানে মণিমালা সেখানে নেই। কোথায় গেল সে? না, নিষ্প্রেম মণিমালা মধুসূদনের সাথে পরকীয়ার জন্যও বাড়ি ছাড়েনি। যে অলঙ্কার বাঁচাতে তার পলায়ন, সেই অলঙ্কার নিতেই মধুসূদন তাকে খুন করে।

হতাশ ফণিভূষণ এক শ্রাবণের রাতে দ্যাখে ‘...ঘরে নবোদিত দশমীর চন্দ্রালোক আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মুখে একটি কঙ্কাল দাঁড়াইয়া। সেই কঙ্কালের আট আঙুলে আংটি, করতলে রতনচক্র, প্রকোষ্ঠ বালা, বাহুতে বাজুবন্ধ, গলায় কণ্ঠি, মাথায় সিঁথি...।’ 

এ যেন এডগার এ্যালান পোর গল্প পাঠের মতই অতীন্দ্রিয় অনুভূতি জন্ম দেয় পাঠকের মনে। দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেত্তির কবিতার সেই ‘অবগুণ্ঠিতা’ নারীটির মতো রবীন্দ্রনাথের গল্পেও ‘কঙ্কাল‘ হয়ে যাওয়া নারীরা রসেত্তির কবিতার নারীটির মতই বলছেন, ‘বিহোল্ড, দেওয়ার ইজ নো ব্রেথ/আই এ্যান্ড দিজ লাভ আর ওয়ান/এ্যান্ড আই এ্যাম ডেথ (দ্যাখো- সেখানে নেই এতটুকু নিঃশ্বাস/আমি ও প্রেম হই এক/আর আমিই মৃত্যু তোমার)।’

সবশেষে ‘ছুটি‘ গল্পের কথা বলতে হলে সেটা ঠিক নারী এবং মৃত্যু সম্পর্কিত নয়। বিধবা মায়ের বড় সন্তান ফটিক কলকাতা শহরে মামার বাড়িতে ‘মানুষ হতে আসে’ তেরো-চৌদ্দ বছরের ঠিক সেই বয়ঃসন্ধিকালে যে সময়পর্বকে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসন বর্ণনা করেছেন ‘আগলি ডাকলিং’ হিসেবে। না শৈশব, না যৌবনের মধ্যের এই অনিঃশেষ ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে মামীমার অনাদর, শহরের বদ্ধ পরিবেশ এবং নতুন স্কুলে খাপ খাওয়াতে না পারা ফটিক একদিন মা’র কাছে যাবার জন্য শ্রাবণের বৃষ্টিতে মামা বাড়ি থেকে বের হয়ে, পরের দিন সন্ধ্যায় পুলিশের সাহায্যে মামা বাড়িতে ফিরে আসে এবং ফটিকের মা-ও শেষ মুহূর্তে ছেলেকে দেখতে আসে, জ্বরগ্রস্থ ফটিক কখনো বলছে ‘মা- আমাকে মারিস নে, মা!’ আবার কখনো কলকাতায় আসার পথে জাহাজের খালাসিদের জল মাপতে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলছে, ‘এক বাঁও মেলে না/দো বাঁও মেলে না!’ মা এসে ছেলেকে দেখে কাঁদতে থাকলে সে শুধু পাশ ফিরে বলে, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’

একই রবীন্দ্রনাথের একটি গানে ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে/কূলে যখন এলেম ফিরে/তখন অস্ত শিখর শিরে/চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে’, তিনি কি কোন ‘অপ্রাপণীয়’  নারীর চলে যাওয়ার কথাই বলেছেন? সমাজ-সংস্কারের প্রচলিত নিগড়ে যে নারীদের তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দেওয়া হয় না, তারা কি এভাবেই অভিমানে চলে যায়?

সময় এখন বদলেছে। আজকের নারীও ‘কাদম্বরী দেবী’ বা ‘চারুলতা’দের মতো কষ্ট পায়। কিন্তু  শুধুই পুরুষ-সন্তান বা মণিমালিকার মতো ‘গহনা’-য় আজ তার জীবন আটকে নেই। ভূপতি ও অমলদের দোলাচলে কষ্ট পেলেও বাইরের বিশাল কাজের পৃথিবী আজকাল তাকে বাঁচিয়ে দেয়। ‘মণিমালিকা’র চরিত্রটি আজ পুনরায় পড়তে পড়তে একটিও সোনার গয়না না পরা আমি কি তার ভেতরে আমার নিজের ছায়াও খানিকটা দেখলাম? সম্পদ নয়-তবে ভালোবাসার কাজের প্রতি তেমন আবেগ বা উন্মাদনা সম্পন্ন যা কখনো কখনো মানুষের প্রতি ভালোবাসাকেও ছাড়িয়ে যায়?

উনিশ শতকে নারীদের জীবন পুরুষ, সন্তান ও বড়জোর অলঙ্কারের নিয়ন্ত্রণ বাসনা ছাড়িয়ে বেশি দূর প্রসারিত হতে পারেনি বলে এত বেশি মৃত্যুমুখী বা মৃত্যুআশ্রয়ী হতে হয়েছে তাদের। 

/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়