ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

গীতিকবি আনিসুল হক চৌধুরী ও তাঁর গান

কাজী জাহিদুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৩:৩৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
গীতিকবি আনিসুল হক চৌধুরী ও তাঁর গান

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় দেওয়া ভাষণে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন- ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ 

২৪শে মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালেও তিনি রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে পুনরায় মত ব্যক্ত করেন। ছাত্ররা ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদী মিছিল স্লোগান চলতে থাকে। রচিত হয় ভাষা-আন্দোলনের উপর প্রথম গান।
‘ওরে ভাইরে ভাই
বাংলাদেশে বাঙালী আর নাই। 
যারা ভীড় করে এই পথে ঘাটে
    বাঙাল যাদের বল,
তাদের স্বদেশে যে নিজের দশা
    করে টলমল ॥

বাঙালী তো হিন্দুরা বাংলা ভাষা তাদের,
হুজুর যা কয়, ঠিক কথা, আলবৎ হইবে জরুর,
-বলে বাঙালী খান পাঠান ওরা ,
        মীরজাফরের চাঁই॥
আজব কথা-
    গাঁজার নৌকা পাহাড় দিয়া যায়, 
    জলে ভাসে শিলা কিবা বানরে গীত গায়,
    ওরা ধানের গাছে খেজুর খোঁজে
        লাজে মরে যাই!
শোনে হুজুর-
    বাঘের জাত এই বাঙালেরা
    জান দিতে ডরায় না তারা,
    তাদের দাবী বাংলা ভাষা
        আদায় করে নেবে তাই॥

মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বাঙালির মনে কী আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল গানের বাণীর মধ্যে তার বর্ণনা শ্লেষাত্মকরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন গীতিকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম গান এটি। প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী শেখ লুৎফর রহমানের (১৯২২-১৯৯৪) আহ্বানে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদী এই গানটি রচনা করেন কবি ও গীতিকার আনিসুল হক চৌধুরী (১৯১৯-২০০৭)। লক্ষণীয় বিষয় ১৯৪৮ সালের মার্চেই তিনি এই ভূখণ্ডকে ‘বাংলাদেশ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শেখ লুৎফর রহমান সুর করে গানটি গেয়েছিলেন। গানটি তখন একদিকে বাঙালির মনে যেমন ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, অপরদিকে শাসকগোষ্ঠী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। গানের শেষ পঙ্‌ক্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে দৃঢ়ভাবে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন- ‘শোনে হুজুর- বাঘের জাত এই বাঙালেরা/  জান দিতে ডরায় না তারা,/ তাদের দাবী বাংলা ভাষা/ আদায় করে নেবে তাই।।’- ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার মধ্য দিয়ে সে চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়। কিন্তু তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী আনিসুল হকের এই সাহসী উচ্চারণকে মোটেই সহজভাবে নেয়নি।

এ সম্পর্কে গানটির সুরকার ও গায়ক শেখ লুৎফর রহমান তাঁর ‘জীবনের গান গাই’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন: ‘গানটি আমি প্রথম গাই জগন্নাথ কলেজের এক অনুষ্ঠানে।... সেদিনকার ওই অনুষ্ঠানে অনেকের সাথেই উপস্থিত ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা আতাউর রহমান খান। গানটি পরপর কয়েকবার দর্শকের অনুরোধে গাইতে হয়। গানটি শুনে আতাউর রহমান খান এতোটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে. হঠাৎ করে ছুটে এসে তিনি আমাকে গভীরভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পরে এই গানটি [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের] এস.এম. হলের এক অনুষ্ঠানে গাইবার পর সাদা পোশাকধারী পুলিশ এসে গানের কপিটি নিয়ে যায় এবং সাবধান করে দিয়ে বলে, গানটি যেন আমি আর না গাই। ভবিষ্যতেও যাতে আর কোনোদিন এ গান না গাই সে ব্যাপারে কাগজে বন্ড সইও নিয়ে যায় পুলিশ। এবং এই হুঁশিয়ারি দিয়ে যায় যে, দ্বিতীয়বার এ গান আর গাইলে এ দেশ থেকে চলে যেতে হতে পারে।’ 

মূলত ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলাগানে প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে আবির্ভূত হন আনিসুল হক চৌধুরী। তিনি বাংলার প্রতিবাদী গানের অন্যতম স্রষ্টা। ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে তাঁর রচিত প্রতিবাদী গান মানুষকে অনুপ্রাণীত করেছে। গণসংগীত শিল্পী শেখ লুৎফর রহমানের অনুপ্রেরণায় ১৯৪৮ সালে রচনা করেন তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম গণসংগীত- 
‘শুধু ঘুম পাড়ানী গান আজি নয়
কর্মের আহ্বান এলো আজ ধরাময়॥
জড়তার ঘোর রজনীর
ঘুম হতে জাগো আজ বীর
হের লৌহ কঠিন জিঞ্জির হলো ক্ষয়॥’

শেখ লুৎফর রহমান গানটিতে সুরারোপ করে গাইবার পর তখন ব্যাপক সাড়া পড়ে এ দেশে। ঢাকার বিভিন্ন মঞ্চে ও অনুষ্ঠানে গাইবার পর রেডিওতেও তিনি গানটি পরিবেশন করেন। গানটির কথা ও সুরে আকৃষ্ট হয়ে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদও গানটি গেয়েছেন। 
একই বছরের এপ্রিল মাসে দেশবিভাগের পর প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের জন্য আনিসুল হক চৌধুরী লেখেন:  
    ‘ওগো বৈশাখী ঝড়,
জাগো জাগো আজ সাথে লয়ে বাজ
    জয় রথে ঘর্ঘর ॥ ...

এ-দেশে বাংলা বর্ষবরণ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের জন্য রচিত প্রথম গান এটি। তারপর ১৯৫১-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে আনিসুল হক চৌধুরী লেখেন:
‘হিংসায় গড়া আজিকার ধরা
    ভরা শুধু হাহাকার
মানুষে বধিতে মানুষ শানায়
    হেরি অসি ক্ষুরধার ॥
... 
মানুষের তরে তাই ধরা তলে
মুত্যুর চিতা গেরি শুধু জ¦লে;
বাঁচিবারে তাই এসো গান গাই
    ভালোবাসা-অহিংসার।’
দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রথম গান এটি।

এই গান দুটিও সুর করে গেয়েছিলেন শেখ লুৎফর রহমান। এ ছাড়াও ঐতিহাসিক আরও নানান বিষয় নিয়ে তিনি তাৎক্ষণিক গান রচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের সংগীতের অন্যান্য শাখা সমৃদ্ধ করে গেছেন।

শেখ লুৎফর রহমান ও আনিসুল হক চৌধুরী

খ্যাতিমান গীতিকার, সুরস্রষ্টা, কবি ও গবেষক অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরীর জন্ম ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মে, মোতাবেক ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৭ই জ্যৈষ্ঠ তাঁর মাতুলালয় মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার শামসপুর গ্রামে। পৈতৃক নিবাস একই জেলার সিরাজদিখান থানার বিক্রমপুর খিলগাঁও গ্রামে। পিতা বজলুল হক চৌধুরী, মা ওম্মে কুলসুম যোবেদা খাতুন ওরফে যমুনা। এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন তিনি। শৈশবেই কবিতা ও গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। যা পরবর্তীকালে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের ভুবনে তাঁর চলার পথ সুগম করে। তিনি আমাদের উপহার দেন অনেক কালজয়ী গান, কবিতা ও গবেষণামূলক গ্রন্থ। 

আনিসুল হক চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ স্মাতক (১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) ও স্মাতকোত্তর (১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ) পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে। নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন কবিতায় হাতেখড়ি। ঢাকায় সর্বপ্রথম রেডিওর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা (১৯৩৯-এর ১৬ই ডিসেম্বর) হবার পর থেকেই গীতিকার হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। প্রথমদিকে রেডিওর শিল্পীদের চাহিদামতো তিনি আধুনিক গান ও পল্লিগীতি রচনা করতে থাকেন। দেশভাগের পর প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী শেখ লুৎফর রহমানের আহ্বানে গণসংগীত ও অন্যান্য প্রতিবাদী গান লিখতে শুরু করেন। এবং অচিরেই রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রের একজন সফল গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। একই সময়ে কবি হিসেবেও তিনি বৃহত্তর পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, তখনকার দিনে এই ভূখণ্ডে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের গান, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেনের গানের সঙ্গে আনিসুল হক চৌধুরীর গানও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে হিজ মাস্টাস ভয়েস-এর প্রতিনিধি শ্রী হেমচন্দ্র সোম ঢাকা আসেন। উদ্দেশ্য তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের যারা নতুন গীতিকার, যারা নতুন শিল্পী তাদের প্রায় শ’ দুয়েক গান ঢাকা থেকে রেকর্ড করে নিয়ে গিয়ে, কলকাতায় প্রচার করবেন। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ দায়িত্ব নেন গীতিকার, শিল্পী ও সুরকার নির্বাচনের। অন্যদের সঙ্গে তখনকার তরুণ গীতিকার আনিসুল হক চৌধুরীকেও তিনি নির্বাচন করেন। তখন ঢাকা রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানের অনুষ্ঠানসূচিতে Selection of Rabindranath, Selection of Kayi Nayrul Islam- এর পাশাপাশি Selection of Anisul Haque Chowdhury-ও অন্তর্ভুক্ত হন। 

পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতা ও গান যেমন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তেমনি তাঁর গান বেতার, টেলিভিশন, গ্রামোফোন রেকর্ড, সিনেমা এবং ক্যাসেটেও প্রচারিত হয়েছে। প্রতিবাদী ও আধুনিক গানের পাশাপাশি বাংলাদেশের পল্লীসংগীতের যতরকম বৈচিত্র্য আছে আনিসুল হক চৌধুরী প্রায় সবই চর্চা করেছেন। তিনি ভাটিয়ালি, সারি, ভাওয়াইয়া, বিচ্ছেদি, বাউল, কীর্তনসহ বিভিন্ন শ্রেণীর গান রচনা করেছেন। আবার কৃষি, দেশপ্রেম, বাংলা ভাষা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, মুক্তিযুদ্ধ, বন্যা, ঝড়, তুফান ইত্যাদি সাময়িক বিষয় নিয়েও অনেক গান লিখেছেন। পল্লীসংগীতের ভাষায় ও সুরে বেশ কিছু ইসলামী গানও তিনি রচনা করেছেন। 

বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক সত্য সাহার অনুরোধে চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন আনিসুল হক চৌধুরী। সত্য সাহার সুরে ও সংগীত পরিচালনায় গান দুটি গেয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। প্রখ্যাত মরমি শিল্পী আব্দুল আলিমের গাওয়া ‘রূপালী নদীরে রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার তিনি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচিত গান যাঁদের কণ্ঠে প্রশংসিত ও জনপ্রিয় হয়েছে তাঁদের মধ্যে শিল্পী শীতলচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিরীন চক্রবর্তী, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন (খসরু), আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবদুল আলিম, শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল হালিম চৌধুরী, মফিজুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, সত্যসাহা, সুধীন দাশ, মাহমুদুন্নবী, খালিদ হোসেন, সোহরাব হোসেন, নিত্য গোপাল সাহা, শৈলেশ দে, দেবু ভট্টাচার্য, জয়শ্রী মিত্র, মমতাজ আলী খান, সৈয়দ আব্দুল হাদী, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, শামসুন্নাহার, ধীর আলী মিয়া, মনসুর আলী, ফেরদৌসী রহমান, সুলতানা চৌধুরী, কানিজ ফাতেমা, ডালিয়া নওশিন, দিলরুবা আনাম, সাদিয়া আফরিন মল্লিক, রওশন আরা মুস্তাফিজ, লতিফা হেলেন, রোকেয়া সিদ্দিকা, ফাতেমাতুজ জোহরা, হাসিনা মমতাজ, রওনক আরা রাসেল, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান (রানা), মানস কুমার দাস, হাসান আলী খান, পিলু মমতাজ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। 

খ্যাতিমান এই গীতিকারের রচিত সব গান ও কবিতা যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। দীর্ঘদিন গ্রন্থাকারে প্রকাশও হয়নি। জীবদ্দশায় তাঁর দুটি গানের বই ‘রূপালী নদীর গান’ ও ‘গানে ভরে মন’ এবং একটি কবিতার বই ‘নিশি ভোরের ফুল’ প্রকাশিত হয়।

আজীবন প্রচারবিমুখ আনিসুল হক চৌধুরী কখনো নাম, যশ, খ্যাতি, টাকার পেছনে ছোটেননি। নিজের ভুবনে মনের আনন্দে সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন থেকেছেন। শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করে সারাজীবন সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংগীতের ভুবনে সত্য ও সুন্দরের দুর্লভ পরশপাথর খুঁজেছেন। দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রতি আজীবন নিবেদিত থেকে সংস্কৃতির সেবা করে গেলেও তিনি তাঁর কাজের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। তাঁকে নিয়ে কোনো গবেষণাকর্মও হয়নি। তছাড়া আমাদের দেশে গীতিকবিরা সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যান। তাঁদের গান আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। চলচ্চিত্রে, টেলিভিশনে ব্যবহৃত হয়। শিল্পীর নামে সেগুলোর পরিচিতি পায়। অনেক সময় হয়তো সুরকারের নামও আসে। কিন্তু গীতিকার আড়ালেই থেকে যান। আনিসুল হক চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। তাঁর লেখা অনেক জনপ্রিয় গান এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হলেও গীতিকার আনিসুল হক চৌধুরী আড়ালে থেকেই এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন ২০০৯ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। ২০১৯ সাল ছিল আনিসুল হক চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ। একেবারে নীরবে-নিভৃতেই পার হয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষ।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক যে বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা নাটক যাকে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বলে অভিহিত করি, তার যে ইতিহাস সে ইতিহাসে আনিসুল হক চৌধুরী নামটি অত্যন্ত উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকা রেডিওর অধিকাংশ অমুসলিম শিল্পী ও গীতিকার দেশ ত্যাগ করে কলকাতা চলে গেলে সেই শূন্যস্থান পূরণে আনিসুল হক চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমাদের সংস্কৃতিতে তাঁর যে ভূমিকা, তাঁর যে অবদান, তা আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। আনিসুল হক চৌধুরীর লেখা বিভিন্ন গান এখনো নানান মাধ্যমে প্রচারিত হলেও তাঁর রচিত বইগুলো দুষ্প্রাপ্য ছিল। সম্প্রতি ‘আনিসুল হক চৌধুরী রচনাবলি’ ও আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সংগীত, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির একটি সময়কার একজন লেখকের পরিচয় নতুন প্রজন্মের পাঠক-গবেষকদের জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে দেশবিভাগের পরে বাংলা গানে তাঁর যে অবদান আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণের ইতিহাস নির্মাণে তা গবেষকদের বিশেষ সহায়ক হবে। 

আনিসুল হক চৌধুরীর আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলা গানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে গেছেন। তাঁর গান বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়