ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

ঘরে ফেরা সোজা নয় : আসাদ চৌধুরী

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৭ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ২০:২৪, ৭ অক্টোবর ২০২৩
ঘরে ফেরা সোজা নয় : আসাদ চৌধুরী

‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ তাঁর একটি গ্রন্থের নাম। তিনি নিজেও আর ঘরে ফিরতে পারলেন না! ঘর থেকে হাসপাতালে গেলেন, কিন্তু কিছুতেই ঘরে ফেরা হলো না তাঁর। সোজা তো নয়ই, কিছুতেই নয়! কবিতার বইয়ের নামটি জীবনের সঙ্গে সত্য করে দিলেন তিনি। 

কবি তো সৃজন-ঈশ্বর, তাই তারা আগেভাগেই অনেক কিছু বলে দেন। বলে দিতে পারেন। তিনি যেন কোথায় গেলেন, আর দেখা যাবে না তাঁর ঘরে, মঞ্চে, পর্দায়, পথে, আর খাবেন না ‘তবক দেওয়া পান’। রবীন্দ্রনাথের মতো আশি বছরের সমান বয়সী হয়ে অনন্তলোকের দিকে যাত্রা করলেন তিনি। তিনি সমকালীন বাংলা কবিতার খ্যাতিমান কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, জীবনীলেখক, ভ্রমণলেখক, ভারী কণ্ঠের বক্তা, আবৃত্তিশিল্পী, দেশসেরা উপস্থাপক, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা একাডেমির ফেলো, সাবেক পরিচালক, রসিক, বাংলাদেশের অসাধারণ প্রকৃতি ও ঐতিহ্য-রঙের এক দীর্ঘ সাক্ষীসুতো আসাদ চৌধুরী। 

নদী মেখলা বরিশালে জন্ম নেয়া কবি, শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন তাঁর দ্বৈত নাগরিকের দেশ কানাডার অশোয়া শহরের লে’ক রিজ হাসপাতালে। মরণব্যাধি ব্লাড-ক্যান্সার কেড়ে নিলো তাঁকে। রোগকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই, তাঁর জীবন এখানেই শেষ হবে হয়তো লেখা ছিল। জীবনের বাতি সবারই নিভে যাবে। কিন্তু কিছু মানুষের চিরতরে চলে যাওয়া অনেকের মন ভীষণ খারাপ করে দেয়! আমিও বিষণ্ন, বিমর্ষ, বিস্মিত, বিপন্ন বোধ করছি। কারণ কবি তো বটেই, তাঁর চেয়ে বেশি বড় আমাদের প্রজন্মের অভিভাবক, আরো খুলে বললে, স্নেহদড়ি লাগিয়ে রাখা যেন একজন সিনিয়র ফ্রেন্ড অর্থাৎ একসঙ্গে দীর্ঘ পথ চলা বন্ধু। 

এই বন্ধুবৎসল কবি ও অভিভাবকের সঙ্গে শেষ দেখাটি হলো না। যদিও শেষ দেখা বলে কিছু নেই। কিন্তু প্রথমবারের মতো কানাডায় গিয়ে, ঠিক এক মাস আগে তাঁর শেষ অবস্থানের খুব কাছের মহাসড়কের দিয়ে অর্থাৎ টরেন্টো থেকে মন্ট্রিয়েল দু’বার যাতায়াত করেও দেখা করতে পারিনি সময়ের অভাবে। এমনি কি সর্বশেষ বাংলাদেশ থেকে যখন অসুস্থ হয়ে কানাডা ফিরে যান, তাঁর ক’দিন আগেই আমাকে সেল ফোনে কল করেছিলেন। আমি সময়ের অভাবে ধরতে পারিনি? হায়রে সময়! পরে যখন তাঁকে ফোন করবো, তখন তিনি হাসপাতাল থেকেই চলে গেছেন স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের কাছে। টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত আমার অগ্রজ কবি ও সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের বড়কন্যা অনাদি নিমগ্নের বিয়েতে এসেছিলেন তাঁর বড় পুত্র আসিফ ও কন্যা শাওলি। তাদের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো, তাঁর খোঁজখবর নিলাম। ওরা বললো, একদিন এসে বাবাকে দেখে যান। কিন্তু যাওয়া হলো কই? সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে কানাডা থেকে উড়াল দিলাম বাংলাদেশে। আর ঠিক এক মাস পর ৫ অক্টোবর তাঁর সুদূরের দেশে ফিরে যাবার খবর পেলাম... মনটা বৃষ্টির জলে যেন ভিজে গেল। অথবা তুষের আগুনের মতো ভিতরটা পুড়তে থাকলো। 

কানাডায় পাড়ি জমানোর পর, যখনই ঢাকা আসতেন, এসেই আমাকে ফোন করতেন। বলতেন, শিহাব আমি ঢাকায় এসেছি। আমি বলতাম, জি আসাদ ভাই, চলে আসুন শাহবাগে জাদুঘরে। চলে আসতেন।  কখনো তাঁর প্রাণের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি হয়ে অথবা যাবার পথে অথবা কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে যাবার পথে। এসেই হ্যান্ডশেক করে কাঁধ থেকে কাপড়ের ব্যাগ বা ভারী ঝোলাটি চেয়ার অথবা সোফায় নামিয়ে রেখেই বলতেন, কেমন আছো শিহাব? কি খাওয়াবে? কফি না চা? আমি বলতার আপনার যেটি পছন্দ। কফিই দাও। কফি খেতে খেতে আমার খোঁজ নিতেন। আমি তাঁকে বলতাম, ক’দিন থাকবেন? বলতেন, আছি বেশ কয়েক দিন। কেন কোনো অনুষ্ঠান আছে? আমি বলতাম, জাদুঘরে একটি সেমিনার আছে। আপনি মূল বক্তা অথবা সভাপতি, অথবা কবিদের বিশেষ কবিতা পাঠ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতেন। বলতেন, আমি আসবো। আসতেন, স্বভাবসুলভ চমৎকার বক্তৃতা করতেন। শ্রোতাদের হাসাতেন। চিন্তার খোরাক দিতেন। 

অনুষ্ঠান শেষে সম্মানীর খাম হাতে দিলে রসিকতা করে বলতেন, খামে কি শিহাব? বলতাম সম্মানী।  সম্মানীও দিলে! বাহ, তারপর তাঁর সেই জগত বিখ্যাত হাসি, হা হা হা হা...। এই হাসি বাতাসে মিশতে অনেকক্ষণ সময় লাগতো। গত কয়েক বছর জাদুঘরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ও সেমিনারে আমন্ত্রণ জানাতে পেরেছি। জাদুঘরের কথ্যইতিহাস কার্যক্রমের আওতায় বরেণ্য ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। কানাডা থেকে একবার আসার পর তাঁর কয়েক ঘণ্টার দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে আর্কাইভে সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছি।

আমি যখন আশির দশকে টেলিভিশন দেখা শুরু করি, তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় অসাধারণ বাচনভঙ্গি, শুদ্ধ উচ্চারণ, স্বতঃস্ফূর্ত থ্রুয়িং দিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতেন যারা, যেমন সাংবাদিক ফজলে লোহানী, কবি আবু হেনা মুস্তফা কামাল, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রমুখ এবং তাঁদেরই সঙ্গে অপরিহার্য একটি নাম কবি আসাদ চৌধুরী। সে সময় একটি টিভি চ্যানেল বিটিভিতে ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি। আমিও এখন টেলিভিশন, বেতার ও মঞ্চে উপস্থাপনা করি। যার মূলমন্ত্র এবং আমার আইকন উল্লিখিত উপস্থাপকগণ। এর মধ্যে আসাদ চৌধুরী তো অবশ্যই। আর একটি নাম যুক্ত করি যিনি এঁদের পরে অত্যন্ত চমৎকার উপস্থাপনা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি আনিসুল হক (যিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন)। বিটিভি’র পর অনেকগুলো প্রাইভেট হয়েছে, সেখানেও তিনি গানের অনুষ্ঠান, সাহিত্যের অনুষ্ঠান কিম্বা সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। দেখা গেছে, রাত গভীরে বিভিন্ন চ্যানেলে এই প্রজন্মের গানের শিল্পীদের সরাসরি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। মনে পড়বে আপনাদের টিভি চ্যানেল বাংলা ভিশনের একটি আউটডোর প্রোগ্রাম, যেটি আবার রাতে বিভিন্ন পার্কে, খোলা জায়গায় নিয়মিত করতেন, ভাবেন তখন তাঁর বয়স সত্তর অথবা সত্তর উর্ধ্ব! অনুষ্ঠানকে কীভাবে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়, জনপ্রিয় করা যায়, তাঁর মধ্যে সেই মেধা ও মনন ছিল। 

আগেই বলেছি তাঁর উপস্থাপনা দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়ে বিটিভি’র নানা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি এবং করছি। বর্তমানে সাহিত্য বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান আমার পরিকল্পনা, গ্রন্থণা ও উপস্থাপনায় প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানে তাঁকে বেশ কয়েকবার অতিথি হিসেবে নিয়েছি। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম, সেটি বিটিভি’র আর্কাইভে আছে কি না জানি না? বাংলাদেশে শেষ আসার আগে যখন এলেন, সেই সুন্দর করে ফোন করলেন, বললেন তোমার ওখানে আসছি। আসলেন। আমি বললাম, আসাদ ভাই আমার বিটিভি’র সাহিত্যের অনুষ্ঠান ‘কথা ও কবিতা’র রেকর্ডিং আছে, আপনি যেতে পারবেন? বলো কি যাবো না মানে? তোমার সঙ্গে সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালোই লাগে। বলে রাখি, ষাটের দশকের প্রায় অধিকাংশ কবিই প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। আসাদ চৌধুরীও তাঁদের অন্যতম। যে কারণে তাঁর সাহিত্যালোচনা খুব সমৃদ্ধ হতো। অনুষ্ঠানের মান বেড়ে যেতো। 

তিনি কি আর আসবেন ঢাকায়? ফোন করে বলবেন, শিহাব আমি ঢাকায়। এখানে বলে রাখি, কানাডা থেকে একবার বোধহয় একাই এসেছিলেন। উঠেছিলেন তাঁর কল্যাণপুরের বাসায়। একদিন আমার অফিসে জাদুঘরে আসলেন লাঠি ভর করে। আমি দেখে অবাক! জিজ্ঞেস করলাম আসাদ ভাই, লাঠি কেন, শরীর খারাপ? আর বলো না শিহাব, বাসায় বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি কাছে গিয়ে সোফায় বসিয়ে বললাম, এখন কেমন লাগছে? তাঁর কণ্ঠস্বর খুব নেমে গেল, শিশুর মতো করে বললেন, খুব চোট পেয়েছি, ভয়ও পেয়েছি। চোখটা যেন একটু ছলছল হয়ে গেল। খারাপই লাগলো। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, হায়রে বয়স আর হায়রে স্বদেশ, হায়রে বিদেশ, হায়রে জীবন? বললাম, আসাদ ভাই দুপুরের খাবার আনাই? আনাও। খাবার আনিয়ে একসঙ্গে দু’জন খেলাম। বিকেল পর্যন্ত আমার অফিস কক্ষেই রেখে দিলাম, তারপর ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম।

মঞ্চে কবি আসাদ চেীধুরী, তাঁর ডানে কবি জয় গোস্বামী, বামে কবি শিহাব শাহরিয়ার

বাংলা একাডেমি, কবি আসাদ চৌধুরীর দীর্ঘ দিনের কর্মক্ষেত্র। যতটা মনে পড়ে, ১৯৮৪ সালে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়, আমার সহোদর কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিনই দেখেছি, খুব আন্তরিকভাবে আমাকে নিলেন, যেন এক ধরনের স্নেহছায়ায় ভরিয়ে দিলেন। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। কবিতা লিখতে শুরু করেছি। ভাইয়ের কাছে বললেন, বাহ ভালোই তো! জিয়া হায়দারদের মতো একই পরিবারে দুই ভাই লেখক, বেশ। তারপর যখনই বাংলা একাডেমিতে গেছি, যখনই দেখা হয়েছে, নানা কুশলাদি, লেখালেখি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন। বিশেষ করে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রতিদিনই প্রায় দেখা হতো। লম্বা বাবরি চুলের পাঞ্জাবি পরা, কিম্বা শার্ট-প্যান্ট পরা কিম্বা কখনো ফতোয়া পরা কিম্বা কখনো টি-শার্ট পরা আসাদ চৌধুরীকে দেখে খুব আপনজন মনে হতো। ১৯৯৫ সালের কথা বলি, আমি বাংলা একাডেমি আয়োজিত ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে জুনিয়র ফোকলোর ফেলোশিপ করছি। একাডেমির পরিচালক ও বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশের পুতুলনাচ’ বিষয়ে এক বছরের ফিল্ডওয়ার্ক ভিত্তিক গবেষণার কাজ করছি। তখন নিয়মিত দেখা হতো একাডেমির কর্মকর্তা ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক শামসুজ্জামান খান তো বটেই, তারপর রশীদ হায়দার, রফিক আজাদ, সেলিনা হোসেন, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, ফরহাদ খান, হান্নান ঠাকুর প্রমুখদের সঙ্গে। কাজের ফাঁকে এঁদের সঙ্গ পেয়ে এবং আড্ডায় থাকতে পেরে বিশেষ করে বাইরে থেকেও অনেক লেখকরা আসতেন, বেশ সমৃদ্ধ হতাম। 

যাহোক ঐ এক বছরে প্রায় দিনই আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো। তো কোর্স শেষ হলে ডিসেম্বরে, পাণ্ডুলিপি জমা দিলাম। ’৯৬ সালে পাণ্ডুলিপিগুলোর প্রিভিউ হলো। যেদিন প্রিভিউ কমিটি বসেছে, সেদিন আমি ও লোকসংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর বর্ধমান হাউজের নিচে বসে আছি এবং ফোকলোরের উপর অন্য একটি নিয়ে কাজ করবো, এ বিষয় নিয়ে কথা বলছি। তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, এমন সময় উপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে কবি আসাদ চৌধুরী নিচে নামছেন। নিচে আসবার পর আমি সালাম দিতেই তিনি কাছে এসে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, অভিনন্দন শিহাব। আমি বললাম, কি বিষয়ে আসাদ ভাই? বললেন, আরে ভাই প্রিভিউ কমিটির মিটিং শেষ করে নামলাম, তোমাদের জুনিয়র ফোকলোর ফেলোদের পাণ্ডুলিপির গ্রন্থ চূড়ান্তকরণ, সেখানে আমি সভাপতি ছিলাম, পর্যালোচনায় তোমার পাণ্ডুলিপি প্রথম হয়েছে। আমি এ খবর শুনে আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠলাম। পরে ১৯৯৭ সালে ‘বাংলাদেশের পুতুলনাচ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, যেটি আমার লেখক জীবনের প্রথম বই। এই স্মৃতি সারাজীবন মনে থাকবে।  

আমার অগ্রজ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল একদিন বললেন, চল আসাদ ভাইয়ের বাসায় যাই। বললাম, কেন? গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। বললেন, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকায় এসেছেন, উঠেছেন পান্থপথে আসাদ ভাইয়ের বাসায়। তাহলে, চলো। শাহবাগ থেকে রিকশায় যেতে যেতে আমি বললাম, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এই অমর গানের গীতিকার গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছে লন্ডনে, ব্রেডি আর্ট সেন্টারে, ২০০৬ সালে কবি শামসুর রাহমানের স্মরণ সভায়। ভাইয়া বললেন, তুই কি জানিস, গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে আসাদ ভাইয়ের সম্পর্ক? বললাম, না। তারা দু’জন চাচা-ভাতিজা। আমি একটু চমৎকৃত হলাম। আমাদের রিকশা গিয়ে আসাদ ভাইয়ের বাসার গেটে থামল, নেমে উপরে উঠলাম। ভিতরে ঢুকেই দেখলাম গাফফার ভাই একটা হাফশার্ট ও লুঙ্গি পরে ডাইনিং চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন। অন্যান্য চেয়ারগুলোতে আসাদ ভাই, ভাবী ও তাদের একমাত্র কন্য শাওলি বসে আছেন। সালাম দেয়ার পরেই গাফফার ভাই বললেন, দুলাল কেমন আছো, শিহাব কেমন আছো? আমরা বললাম ভালো। তখন আসাদ ভাই বললেন, আপনি কি জানেন, দুলাল ও শিহাব সহোদর। গাফফার ভাই বললেন, না তো জানি না! যাহোক সেদিন আসাদ ভাইয়ের বাসায় অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে ফিরে আসি। আসার সময় ভাইয়া বললেন, আসাদ ভাই জার্মানীতে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগে দু’বছর কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তার কন্যা শাওলিও কাজ করেছে। যেমন করেছে ষাটের দশকের আরেক কবি জাহিদুল হক। 

আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন ‘বাসায় এসো’। তিনি প্রথম এলিফ্যান্ট রোডের অর্থাৎ সায়েন্সল্যাবের ওপোজিটে ফ্ল্যাট কিনলেন, সেখানে একদিন গিয়েছিলাম। আসাদ ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন, সেদিন ভাবী চা-নাস্তা দিলেন, অনেকক্ষণ তাঁর বাসায় থেকে শিল্প-সাহিত্য, বেতার-টেলিভিশন, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। একজন লেখকের বাড়িতে বই থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, আসাদ ভাইয়ের বাসায় তাই-ই দেখলাম, শোকেস ও আলমারিতে অসংখ্য বই সাজানো আছে। আগেই বলেছি আসাদ ভাই, প্রচুর পড়াশোনা জানা মানুষ। যখন সাহিত্য নিয়ে কথা বলতেন, তখন তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতাম, শিখতাম। বাংলাদেশ বেতার আমরা নানা ধরনের অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলাম। তবে বেতারের সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ’ মাসে চারটি অনুষ্ঠান হতো। আসাদ ভাই দুইটি এবং আমি দুইটি গ্রন্থণা ও উপস্থাপনা করতাম। টেলিভিশনেও কবিতা পড়তে গেলে দেখা হতো, দেখা হতো  বইয়ের পাড়া শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে। প্রায় নিয়মিত কাঁধে কাপড়ের সেই লম্বা ব্যাগ ঝুলিয়ে আসতেন। যে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ দিয়ে বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন অর্থাৎ হৃদয় জয় করেছেন; মাঝখানে বেশ কিছুদিন প্রচুর পান খেতেন। মসলাসহ সেই পানের ডিব্বাটি সঙ্গে নিয়ে চলতেন। যেখানেই বসতেন পানের কৌটাটা বের করে মসলা দিয়ে পান তৈরি করতেন আর কথা বলতেন। তাঁর পান খাওয়া দেখলে মনে হতো পৃথিবী শান্তি ও তৃপ্তিময়। আমিও অনেক সময় বলতাম, আসাদ ভাই পান খাবো, তখন জিজ্ঞেস করতেন, চুন-সুপারি খাও কিনা, জর্দা খাও কিনা? বলে, নিজেই সুন্দর করে পান বানিয়ে দিতেন। এবং খাওয়া-খাওয়ির মধ্যেই তিনি অনেক মূল্যবান কথা বলতেন। রসিকতা করতেন। 

একদিন আজিজ মার্কেটে আমার অগ্রজের বইয়ের প্রকাশনা ও সেল সেন্টার ‘পাঠশালা’য় বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমি বললাম, আসাদ ভাই, পাঠশালা থেকে সুকুমার বড়ুয়ার একটি ছড়াগ্রন্থ করতে চাই। নাম ‘ঠিক আছে ঠিক আছে’। আপনি একটু ভূমিকা লিখে দেন। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন এবং পরদিন সকালে নিজেই এসে দিয়ে গেলেন এবং এজন্য তাঁকে সম্মানী দিলাম। এখানে জানিয়ে রাখি এই বইটি অসংখ্য কপি বিক্রি হয়েছে।

একবার মৌলভীবাজার যাচ্ছি একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে। প্রধান অতিথি হিসেবে কবি আসাদ চৌধুরী, অন্যান্য অতিথি হিসেবে আমি, কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন ও আরো কয়েকজন। আমরা একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা থেকে যাচ্ছি। আসাদ ভাই খুব মজার মানুষ, গাড়িতে উঠেই নানা ধরনের রসিকতা, ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকদের দারুণ দারুণ ঘটনা বলতে বলতে জমিয়ে তুললেন। তারপর বললেন, হাইওয়ের পাশে টঙের দোকানে লোকেরা চা বেঁচবে আর আমরা চা খাবো না, তাতো হয় না? যেই কথা সেই কাজ। নরসিংদীর বেলাবোর কাছে আমাদের গাড়ি থেমে গেল। আমরা নামলাম। বাইরে শীতের মিষ্টি রোদ। চায়ের দোকানে গিয়ে কাঠের বেঞ্চে আরাম করে সবাই বসলাম। আসাদ ভাই পান সাজাতে থাকলেন। চা এলো, খেলাম। আসাদ ভাই বললেন, আমরা যেখানে বসে আছি তার পিছনেই উয়ারি-বটেশ্বর পাশাপাশি দুটি গ্রাম, প্রত্নতাত্ত্বিকরা লাল মাটি খনন করে আড়াই হাজার বছরের আগের বাঙালিকে আবিষ্কার করেছেন। এটি না দেখে কি চলে?

এখানেও যেই কথা সেই কাজ। গাড়িতে উঠে চললাম বটেশ্বর গ্রামের দিকে। মাত্র পনের মিনিট সময়ের মধ্যেই গিরিশচন্দ্র মহাশয়ের বাড়ির সন্নিকটে উয়ারি গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং গাড়িতে যেতে যেতেই আসাদ ভাই এই গ্রামের একজন কীর্তিমান লেখক, শিক্ষক ও ফোকলোর গবেষক হাবীবুল্লাহ পাঠানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি এসে হাজির এবং আমাদের রিসিভ করে খননস্থল ঘুরে দেখালেন এবং এখানে পাওয়া আড়াই হাজার বছর আগের কিছু নিদর্শন দিয়ে তাঁর বাড়িতে গড়ে তোলা একটি জাদুঘরে নিয়ে গেলেন। আমরা সেই নিদর্শনসমৃদ্ধ জাদুঘরটি দেখে অনেক কিছু জানলাম। আসাদ ভাইয়ের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এই প্রত্নস্থান দেখে চললাম মৌলভীবাজারের দিকে। বিকেলে গিয়ে পৌঁছালাম এবং অনুষ্ঠানে আসাদ ভাইয়ের একটি দারুণ বক্তৃতা উপভোগ করলাম, এরপর রাতে আড্ডা অবস্থানশেষে পরদিন ঢাকা ফিরে এলাম।

কবি আসাদ চৌধুরী তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মের জন্য ৮০ বছর বয়সেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি। তাতে কি- মরণোত্তর হয়তো পাবেন? পেয়েছেন তো একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশের অসংখ্য সেরা সেরা পুরস্কার ও পদক। তবে ইতিহাসের অপরিহার্য গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ ও জাতির পিতার জীবনীগ্রন্থ ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থদ্বয়ের অসাধারণ পরিশ্রম ও মননের জন্য জীবিতাবস্থায় স্বাধীনতা পুরস্কারটি পেলে তৃপ্তি পেতেন একথা বলা যায়। আসলে প্রকৃত লেখকরা কোনো প্রাপ্তির আশায় সৃজনে থাকেন না, কিম্বা বলা যায় তাঁদের আকাঙ্ক্ষা কম। সেই আসাদ চৌধুরীও নির্লোভ। তাঁর মুখ দেখলে কখনো মনে হয়নি তাঁর এটি পেতেই হবে। কিন্তু তিনি লিখে গেছেন নিরন্তর। তাঁর ১৮টি কবিতার বইসহ মোট গ্রন্থেও সংখ্যা প্রায় ৪১টি। কয়েকটি বইয়ের নাম দেখুন কি সুন্দর: তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)। এই শেষ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েই লেখা শুরু করেছিলাম, দেখুন তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামগুলো যেমন সুন্দর, তেমনি তাঁর কবিতা অসংখ্য পাঠকে সুন্দরের শীর্ষে নিয়ে যায়।

তাঁর লেখা একটি প্রেমের কবিতা দিয়ে শেষ করি: আপনার শুধু কবি আসাদ চৌধুরীর এই ক’টা কবিতা পড়ুন, দেখুন কতটা আপনাকে নাড়াবে? ‘রিপোর্ট ৭১’, ‘শহীদদের প্রতি’, ‘প্রথম কবি তুমি প্রথম বিদ্রোহী, ‘বারবারা বিডরালকে’, ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম সত্যি ফেরারি’ ‘সত্যি ফোরি’। শেষ করি তাঁর একটি কবিতার চরণ দিয়ে: 
‘কোন ঘাসে ছিল 
দুঃখ তোমার     
কোনে ঘাসে ছিল
প্রেম
কোথায় ছিলেন 
রূপালি জ্যোৎস্না
ঢের সূর্যের হেম
কখনো নদীতে 
সোনালি গীতিকে
একথা বলেছিলেম।’

বাকেরগঞ্জের ঘাস, নদী, গীতি, ঢাকার প্রেম আর অসোয়ার জ্যোৎস্না গায়ে মেখেই কবি আসাদ চৌধুরী হারিয়ে গেলেন সুদূরের কোন নদীতে কিম্বা ঘাসের বিছানায়। আর হবে না দেখা, কথা। বুকে হাহাকার লাগছে আসাদ ভাই- বিদায়।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়