যুদ্ধদিনের গল্প
ডানা মেলবার দিন
আমির মুহম্মদ খসরু || রাইজিংবিডি.কম
এক.
পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করার আগেই দূরে কোথাও একটি কি দু’টি কাক ডাকে। বিছানায় লেপ্টে-থাকা মাহিনের ঘুমন্ত অলস দেহটা তাতে সামান্য নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমের তেমন ব্যাঘাত হয় না। হঠাৎ কাছেপিঠে ডেকে ওঠে আরো দু’একটা কাক। শব্দের উৎস এবার খুব কাছে হওয়ায় ওর দু’কানের পর্দায় ফাটাফাটি ধাক্কা লাগে। ঘুম টুটে গিয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায় মাহিন।
ঘরের মধ্যে, জানালার ওপাশে তখনো প্রায় মিশমিশে অন্ধকার। অতএব, বাইরে আবছা আলো ফুটে ওঠা পর্যন্ত বিছানায় চুপচাপ শুয়ে অপেক্ষার পালা। তারপর একসময় যখন চারপাশ থেকে সহস্র কাকের কা কা চিৎকার মুহুর্মুহু কানে বাজতে থাকে, পুবের আকাশটাও তখন অল্প অল্প আলোকিত হতে শুরু করে এবং মাহিনও তখন নেমে পড়ে বিছানা থেকে। জুতো জোড়া আর ব্যায়ামের পোশাক পরে ওহাব কাকার সঙ্গে মাঠে বেরুনোর জন্য তৈরি হয়।
এভাবে কাকডাকা ভোরে প্রতিদিন প্রায় এক নিয়মে ঘুম ভাঙে ওর। ‘কাকডাকা ভোর’— বেশ মিষ্টি দুটি শব্দ। এই যুগল শব্দের মধ্যে ধরা আছে এক অভ্যস্ত শান্তির সুর। কিন্তু একদিন হঠাৎ রাত ও দিনের এই মিলন-মুহূর্তের চিরচেনা রূপটি আমূল পাল্টে গেল! কাকডাকা ভোরে সেদিন কাক ডাকল না। মাহিনের ঘুম ভাঙিয়ে দিলো সম্পূর্ণ অচেনা আর বিদঘুটে যত শব্দের তাণ্ডব। অবিরাম কানফাটানো সেই শব্দ যেন রূপকথার সব দৈত্য গল্পের পাতা থেকে একযোগে উঠে এসে ঠা ঠা হাসি হাসছে আর চোখের সামনে যা পাচ্ছে তাই দুমড়ে-মুচড়ে, ভেঙেচুরে ছত্রখান করে দিচ্ছে। শব্দগুলো অবিরাম একটা চক্র পূরণ করে চলেছে— ঠা-ঠা-ঠা-ঠাস্… গুড়ুম গুড়ুম…দ্রিম-দ্রিম… ঠা-ঠা-ঠা-ঠাস্…গুড়ুম গুড়ুম…
বিছানায় খানিকটা নড়েচড়ে উঠল মাহিন। তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জানতে চাইল, কী হচ্ছে এসব?
চুপ! চিৎকার করিস না। বিছানা থেকে নেমে যা। ফ্লোরে শুয়ে পড়। জলদি— ওর বাঁ হাত ধরে হালকা টান দিলো বড় ভাই অয়ন। ফ্লোরে মাদুর বিছিয়ে এইমাত্র শুয়েছে সে। মাহিনের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ওর বালিশটা টেনে নিয়ে পেতে দিলো নিজের বালিশের পাশে। বলল, একদম মাথা তুলিস না। শুয়ে থাক্। গুলি লাগতে পারে।
কিসের গুলি ভাইয়া? বড় বড় চোখে অয়নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল মাহিন।
পাকিস্তানি আর্মি অ্যাটাক করেছে। বাঙালিদের মারছে ওরা।
কেন মারছে?
বাবা বলেছে, ওরা বাঙালিদের শত্রু।
চুপচাপ কী যেন ভাবতে থাকে মাহিন। কৌতূহল চাপতে না পেরে হঠাৎ আবার প্রশ্ন করে— বাবা সেদিন বলেছিল, পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হবে। এটা কি সেই যুদ্ধ, ভাইয়া?
বলতে পারব না। অস্ত্র ছাড়া কি যুদ্ধ হয়? বাঙালির হাতে তো অস্ত্র নেই।
অস্ত্র নেই, তুমি কী করে জানলে?
বাবা বলেছে।
অস্ত্র নেই অথচ যুদ্ধ হবে! সাত বছরের শিশু মাহিনের কাছে বাবার কথাগুলো মাঝে মধ্যে কেমন যেন গোলমেলে মনে হয়। দুই ভায়ের বয়সের ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছর। দুজনেই ওরা শিশু। দুজনের কেউই আসলে জানে না কী হচ্ছে, কেনই বা হচ্ছে। বাবার মুখ থেকে বিভিন্ন সময়ে যা শুনেছে, টুকরো-টাকরা সেইসব কথাই পরস্পরের মধ্যে কিছুক্ষণ চালাচালি করে ওরা। তারপর চুপচাপ পাশাপাশি শুয়ে থাকে। চারপাশে বিচিত্র পাখির কলগুঞ্জনের বদলে শোনা যায় টানা উৎকট গোলাগুলির আওয়াজ। সেইসঙ্গে হঠাৎ কেঁপে ওঠে ঘরের দরজা-জানালা।
রিনি কই? প্রশ্ন করে মাহিন।
মাঝখানের রুমে।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রিনি সবচেয়ে ছোট। বয়স মাত্র তিন মাস। ওর জন্য মাহিনের খুব টেনশন হচ্ছে। ওকে দেখার জন্য শোয়া থেকে উঠতে যাচ্ছিল। হাত ধরে টেনে ওকে আবার বসিয়ে দিল অয়ন। খবরদার। দাঁড়াবি না। হামাগুড়ি দিয়ে যা।
নির্দেশমতো হামা দিয়ে এগোতে লাগল মাহিন।
আরে! এভাবে না। হাঁটু ভাঙিস না। পা টান কর। কনুইতে ভর দে। মাথা আরো নিচু কর। — চিৎকার করে উঠল অয়ন। ছোট ভাইকে দেখিয়ে দিলো কীভাবে হামা দিতে হবে। তর সইছিল না মাহিনের। পাশের ঘরের দরজার কাছে এসে উঠে দাঁড়াতে যাবে এমন সময় মাথার উপরে বোমা ফাটার মতো শব্দ হলো একটা। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুম শব্দে ভীষণ কেঁপে উঠল ঘরের দেয়াল ও দরজা। দ্রুত মেঝের সমান্তরালে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মাহিন। কয়েক সেকেন্ড এভাবে থাকার পর ধীরগতিতে হামা দিয়ে ভেতরে ঢুকল।
খাটের পায়ার কাছে মেঝেতে তোশক এবং তার উপর কম্বল বিছিয়ে কাঁথা দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢেকে শুইয়ে রাখা হয়েছে রিনিকে। দুই কানে তুলো দেওয়া। ঘুমাচ্ছে। চারপাশে কি ঘটছে, কিছুই জানে না। পাশে শুয়ে মাহিনের পিঠাপিঠি বড় বোন অর্চি। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘরের পশ্চিম পাশের দেয়ালের কাছে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ধাতব জিনিসের দিকে। এইমাত্র দেয়ালে বাড়ি খেয়ে নিচে পড়েছে ওটা। দেয়ালের মধ্যে ছোটখাটো একটা গর্ত তৈরি হয়েছে।
মাহিনকে দেখামাত্র দ্বিগুণ আতঙ্ক নিয়ে ওর দিকে তাকাল অর্চি। কিরে! তুই এখানে কী করছিস? বাবা বলেছে যে-যার রুমে ফ্লোরের উপর শুয়ে থাকতে। তোর দেখি অনেক সাহস! মরতে চাস বুঝি? বলেই তর্জনী তুলে ঘরে ঢোকার দরজার কাছের দেয়ালে মাহিনের মাথা সমান উচুঁতে একটা জায়গা দেখাল।
বেশ বড়সড় একটা গর্ত তৈরি হয়েছে দেয়ালের ওই জায়গাটায়। ফ্লোরের ওপর এখানে-সেখানে পড়ে আছে ভাঙা ইট আর সিমেন্টের টুকরো। বলল, দেখ, গুলি করেছে আমাদের ঘরে। ব্যাপার বুঝতে মাহিনের দেরি হলো না। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল ওর দেহ। উত্তরের দেয়ালটা যেখানে দরজার কাঠের সঙ্গে মিশেছে, ঠিক সেই জায়গা ভেদ করে গুলিটা এসে বাড়ি খেয়েছে পশ্চিমের দেয়ালে। দরজার কাছে এসে মাহিন যে-মুহূর্তে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, তখনই ওর মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে গুলিটা। আরেকটু হলেই ও মরত।
রাবেয়া বেগমও বেঁচে গেছেন অল্পের জন্য। গুলিটা তাঁকেই লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল। বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বড় মেয়ে রীতিকে সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং রুমের জানালাগুলো বন্ধ করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। কলোনির উত্তর-পূর্ব কোণে খাকি পোশাক আর হেলমেট পরা অস্ত্র-হাতে একজনকে দেখে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে উঠলেন, দেখ্ দেখ্, রীতি। একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই জানালার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো খাকি পোশাকধারীর দেহ বিদ্যুৎগতিতে একটা পাক খেল। হাতে তাক্ করা অস্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল সেই খুনে বুলেট। তবে একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সেটা।
দুই.
বন্ধ ঘরের ভেতর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সারাদিন পাক বাহিনীর তাণ্ডব নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। ঘরের দেয়ালে লেগে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া পাক সেনার ছোড়া গুলিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আতঙ্কিত গলায় ভোরবেলাকার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন মাহিনের মা রাবেয়া বেগম। আমি তো ভেবেছিলাম, ও একজন মুক্তিযোদ্ধা! কলোনির মধ্যে পাক সেনা কেন আসবে? গুলিটা আমার কানের এত কাছ দিয়ে গেছে, আরেকটু হলেই মরতাম। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ডান কানের লতি ছুঁয়ে বললেন মাহিনের মা।
মাথা নাড়লেন সাঈদ আহমেদ। কলোনি বাদ দেবে কেন? শহরের সব এলাকাতেই ঢুকে পড়েছে ওরা। আর যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই মারছে। আমরা তো বাঙালি। ওদের চোখে আমরা দুশমন। এ-মুহূর্তে যারা বেঁচে গেছে, মনে করো লটারিতে পুরস্কার জিতেছে তারা। গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলার পর একটু থেমে যোগ করলেন— তবে জীবনটা তো আর লটারি নয়। এটা একটা লড়াই। বাঙালি লড়বে। লড়াই করেই বাঁচবে।
‘লড়াই’ শব্দটা মাহিনের কানে কেমন একটা মন্ত্রধ্বনির মতো বাজে। বিছানায় দু’কনুইয়ের ভর দিয়ে দুই হাতের তালুতে থুঁতনি রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনছিল ও। বাবার কণ্ঠের উদ্দীপনা সংক্রামিত হয়েছে ওর মধ্যে। মনের ভেতর খচ্খচ্ করতে থাকা প্রশ্নটা জিজ্ঞেস না করে পারল না। কিন্তু তুমি তো বলেছ, বাঙালির কাছে অস্ত্র নেই। অস্ত্র ছাড়া কিভাবে যুদ্ধ হবে?
হুম! ওরা রাতের আঁধারে শান্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা করেছে। নিজেকে রক্ষা করার অধিকার তো সব মানুষেরই আছে। আর এটা তো গোটা জাতির টিকে থাকার প্রশ্ন। কোটি কোটি বাঙালির আত্মরক্ষার যুদ্ধে অস্ত্র পাওয়া কঠিন হবে না। তবে শুরুটা হবে হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। আর তাই গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে হবে আমাদের ছেলেদের
গেরিলা যুদ্ধ কী, বাবা? কৌতূহলী মাহিন আবার প্রশ্ন করে।
হানাদার বাহিনীর সৈন্য অনেক। তাদের আছে প্রচুর ভারী অস্ত্র। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গোপন জায়গা থেকে ওদের উপর হঠাৎ আক্রমণ চালাতে হবে। এটাই গেরিলা যুদ্ধ।
এতে কি গেরিলারা সফল হবে? রাবেয়া বেগমের কণ্ঠে সংশয়।
মুক্তি আর স্বাধীনতার যুদ্ধে সফলতা পায় নি এমন কোনো দেশ আছে, বলো? গোটা দেশ হানাদারদের বিরুদ্ধে একাট্টা। অস্ত্র ছাড়া পাক সেনাদের আর কোনো শক্তি নেই। শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হয় না।
এমন সময় আবার প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলো। দু’চার সেকেন্ডের জন্য কথা থামালেন মাহিনের বাবা। তারপর শান্ত গলায় বক্তব্য শেষ করলেন, তাছাড়া শত শত মাইল দূর থেকে এসে এখানে ওরা বেশিদিন টিকতে পারবে না।
কিছুদিন পরই মাহিনের কাকা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। ঘরে নতুন বিয়ে-করা বউ। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা যেদিন স্ত্রীকে জানালেন, সেদিন ঘরের পরিবেশটা আরো ভারী হয়ে উঠল।
ওহাব কাকা বললেন, এখন যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই, জলি।
কেন?
আমার যে বয়স, তাতে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানো আমার জন্য জরুরি। তাছাড়া এটা এমন এক পরিস্থিতি যখন নিরপেক্ষ থাকা যায় না। এমনকি নিরপেক্ষতার ভাণও করা যায় না। হয় আমাকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে হবে, নয়তো পাক সেনাদের সহযোগী হয়ে কাজ করতে হবে। কোন বাঙালির পক্ষেই হানাদারদের সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। ধর, যুদ্ধে গেলাম না। আবার ওদের সাপোর্টও দিলাম না। সেটা কি সম্ভব? না। কারণ আমি যুদ্ধে না গেলেও হানাদার পাকবাহিনী আমাকে জ্যান্ত রাখবে না। একই পরিণতি হবে আমার মতো আমার বয়সী যারা, তাদের সবার। অতএব কী চাও তুমি? জিজ্ঞাসু চোখ মেলে ওহাব কাকা চাইলেন স্ত্রীর অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে।
জলি কাকি কিছু বললেন না। আরো বেশি করে কাঁদতে লাগলেন। ওহাব কাকা এবার তাঁর মাথায় হাত রাখলেন— আমাকে তো জ্যান্ত রাখবে না। সেই সঙ্গে তোমাদেরও মেরে ফেলতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে পরদিনই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত চলে গেলেন ওহাব কাকা। তিনি যখন ঘর ছেড়ে যাচ্ছিলেন, পরিবারের সবার চোখ তখন ছল ছল করছিল যেন চিরবিদায় দিতে হচ্ছে তাঁকে।
ওহাব আহমেদের বয়স তখন ২৫। চেহারায় জ্বলজ্বলে তারুণ্য। লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ শরীরটা খাঁটি অ্যাথলেটের মতো। মাথায় ছোট ছোট মিলিটারি-ছাঁট চুল। প্রশস্ত কপালের নিচে উঁচু ধারাল নাক। লম্বাটে গোল ভরাট অথচ টানটান মুখটা গাম্ভীর্যে ভরা। বড় গোল গোল দুই চোখের চাহনি আশ্চর্যরকমের জীবন্ত আর অন্তর্ভেদী। সেইসঙ্গে ঠোঁটের উপর একজোড়া পুরুষ্টু গোঁফে তাঁকে পুরোপুরি সেনাবাহিনীর এক জাঁদরেল অফিসারের মতোই লাগে। পাক সেনারা তাঁকে নাগালে পেলে সঙ্গে সঙ্গে খুন করবে, এতে আর সন্দেহ কি। কিন্তু ওহাব আহমেদ ভালোবাসেন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতি। চমৎকার গানের গলা তাঁর। রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্ত করো ভয়’ আর নজরুলের ‘যত ফুল তত ভুল’ গান দুটি বহুবার তাঁর কণ্ঠে শুনেছে মাহিন। শিশুদের সঙ্গে মিশতে পারেন একজন শিশুর মতো। হাসেন অবশ্য কদাচিৎ। কিন্তু ওই হাসিতে বোঝা যায় ভেতরের মানুষটিকে। তাঁর চলে যাওয়ায় মাহিন একজন বন্ধু আর অভিভাবকের অভাব বোধ করতে লাগল।
ভারতে গিয়েই মাহিনের কাকা চিঠি লিখলেন। চিঠিতে ছিল তাঁর জন্য দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ। আরো লিখলেন, সীমান্ত পার হয়ে প্রতিদিনই তরুণরা আসছে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। চিঠির ইতি টানা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আশাবাদ দিয়ে।
মে মাসেই দেশের ভেতরে গেরিলাদের অ্যাকশন শুরু হয়ে গেল। এদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দেখাতে চাইছে, দেশের অবস্থা স্বাভাবিক। সরকারি অফিস-আদালতে প্রতিদিন উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে তারা। মাহিনের বাবা ডাক বিভাগে চাকরি করেন। তাঁকেও প্রতিদিন অফিস করতে হচ্ছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অফিস যাচ্ছেন। বাসায় ফিরে একদিন সন্ধ্যায় শোনালেন লোমহর্ষক এক কাহিনি।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় পোস্টামাস্টার আরিফ আহমেদের অফিস। সকাল ৯টায় অফিসের ভেতর ঢুকল গুটিকয় পাক সেনা। ওদের একজন পোস্টমাস্টারের সামনে এসে কর্কশ গলায় জানতে চাইল— অফিসে লোক এত কম কেন? চেয়ারে বসে কাজ করছিলেন আরিফ আহমেদ সাহেব। জবাবে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে কিছু একটা বললেন। তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে তাঁকে গুলি করল ওই পাষণ্ড। গুলিটা তাঁর কপাল ফুটো করে মাথার পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভয়ঙ্কর এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত এক কর্মচারী দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। তাকেও গুলি করে ঐ পাক সেনা। দরজার চৌকাঠ পেরুনোর আগেই হতভাগ্য লোকটার দেহ আছড়ে পড়ে ফ্লোরের উপর।
দখলদার বাহিনীর হাতে এরকম আরো মৃত্যুর সংবাদ আসতে লাগল প্রতিদিন। ওদিকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রতিরোধ যুদ্ধের তীব্রতা। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদার সৈন্যরা এখন পাগলা কুকুর। যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই মারছে। বাইরে যখন এই অবস্থা, তখন ব্ল্যাক আউট রাতে জানালায় খয়েরী কাগজ সেঁটে হারিকেনের আলোতে গোল হয়ে বসে সাঈদ আহমেদের পরিবার শোনে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ। শোনে যুদ্ধের গান— ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’।
তিন.
অর্চি ও মাহিনের বয়সের ব্যবধান মাত্র দু’বছর। পিঠাপিঠি ভাই-বোন হওয়ায় প্রায় সব ব্যাপারে ওদের একটা যুগল অংশীদারি আছে। প্রায় সব কিছুতেই ওদের সমান উৎসাহ, সমান মনোযোগ এবং সেই সঙ্গে সম অধিকার। এর ফলে খিটিমিটি বাঁধতেও বেশিক্ষণ লাগে না। নালিশ আর প্রতি নালিশে মাঝে মধ্যে ব্যাপার এমন জট পাকিয়ে যায়, দুজনের মধ্যে সত্যিকার দোষীকে বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে। মায়ের দরবারে অর্চি কোনো নালিশ রুজু করে তো মাহিন তৎক্ষণাৎ তারস্বরে চেঁচিয়ে এমন পাল্টা এক অভিযোগ খাড়া করে দেয় ওর বিরুদ্ধে যেন আগের নালিশটা একেবারেই অযৌক্তিক আর অসার। অমীমাংসিত বিবাদ কখনো-সখনো সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ওই আদালতের বিচারক পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে দুজনকেই খুশি করে রায় দেন। ফলে বাদী ও বিবাদী উভয়ের উত্তেজনা প্রশমিত হয়। ঝগড়া মিটে গিয়ে দুজনের মধ্যে ক্ষণিকেই ভাব জমে ওঠে। ভাব জমতে জমতে আবার ঝগড়া বাধে। মোটামুটি এই হলো ওদের সম্পর্কের চেহারা যেখানে সংহতির বদলে রেষারেষিটাই চোখে পড়ে বেশি।
কিন্তু বাইরের শত্রু এসে যেদিন হানা দিল, সেদিন থেকে ওদের দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল ঐক্য। একের জন্য অপরের উদ্বেগটা বেশ স্পষ্ট প্রকাশ পেতে লাগল। যে-কোনো ব্যাপারে একজন আরেকজনকে ছাড় দিতেও আর কার্পণ্য করল না। বিশেষ করে ছোট ভাই-বোন দুটির জন্য অর্চির প্রাণের মমতা যেন সব দুয়ার খুলে বেরিয়ে এল। শিশু অর্চি আর শিশু ‘রহিল না’। তবে মাহিনের নিরাপত্তা নিয়ে ওর দুশ্চিন্তাটা বেশি। কারণ সুযোগ পেলেই যখন-তখন ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মাহিন। অর্চি ওর পথ আগলে দাঁড়ায়।
বাইরে যাচ্ছিস কেন? ভয় নেই তোর ? ওরা গুলি করবে তো!
আরে, কিচ্ছু হবে না। বলেই বোনকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় মাহিন।
পাক সেনারা এরপর আর সরকারি কলোনিতে ঢোকেনি। তবে তাদের গাড়িগুলো নিয়মিত কলোনির পশ্চিম পাশের প্রধান সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়া করছে। অদূরে জাম্বুরি মাঠে ওদের ক্যাম্প। মাহিন ঘরের বার হলেই আতঙ্কে ধুকপুক করে অর্চির ছোট্ট বুকটা। মা আর বড় ভাইকে তাগিদ দেয় ওকে শাসানোর জন্য। কিন্তু মাহিন কারুর কথাই শোনে না। ঘরে বেশিক্ষণ বন্দি থাকতে মন চায় না ওর। বাইরে গিয়ে সমবয়েসী বন্ধুদের সঙ্গে লুকোচুরি আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে। পাক সেনা আর মুক্তিবাহিনীর এ যুদ্ধে বরাবরই জয়ী হয় মুক্তিবাহিনী। দুর্ধর্ষ এক গেরিলা যোদ্ধার অভিনয় করে মাহিন। গোপন জায়গা থেকে হঠাৎ আক্রমণে পাক সেনাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেয়।
এদিকে ওহাব কাকা যুদ্ধে যাওার পর থেকে জলি কাকি শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণে চলে কখন শেষ হবে যুদ্ধ। কখন ফিরে আসবে ওহাব কাকা। কিন্তু কোথায় কীভাবে আছেন তিনি, সেই সংবাদ কেউ দিতে পারে না। শহরে থাকা খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তাই কলোনি ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে পাঁচ-ছয়টি পরিবার। বাকিরা ঘোর অনিশ্চয়তা আর ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। যখন-তখন কাছে-ধারেই গর্জে উঠছে ধাতব দানব।
ভোর রাতের সুনসান অন্ধকারে কখনো আচানক গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর নৈঃশব্দ্যের দেয়াল। দক্ষিণ দিকে বন্দরের জাহাজঘাটা থেকে তখন দাউ দাউ করে আকাশের দিকে উঠে যায় আগুনের লেলিহান শিখা। ঘন কালো উদ্গীর্ণ ধোঁয়ার মেঘ ক্রমশ ঢেকে ফেলতে থাকে চেনা আকাশের রঙ।
পাক সেনাদের জাহাজ। অস্ত্রবোঝাই। ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিলো আমাদের ছেলেরা। ওই দেখ।
আগুনের শিখার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বলেন সাঈদ আহমেদ।
সত্যি! রাবেয়া বেগমের প্রশ্নে সন্দেহ আর বিশ্বাসের দোলা।
হ্যাঁ, তাই। জাহাজগুলো তো পাকিস্তানিদের। বাঙালি মারতে অস্ত্র আর গোলাবারুদ আনছে ওরা। ওগুলো আর কারা ধ্বংস করবে, বলো? বলতে গেলে খালি হাতে লড়ছে মুক্তিযোদ্ধারা। তবু ওরা সফল।
এরকম একটা সময়ে আশাভরা কথা শুনতে ভালো লাগে। রাবেয়া বেগমও আশান্বিত হন। এক ধরনের সাহসও অনুভব করেন। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে আশা আর হতাশা দুই-ই আছে। দৈনন্দিন জীবন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে যুদ্ধের কারণে। একে তো সবাই নিজ নিজ ঘরে প্রায় অবরুদ্ধ, তার ওপর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব আর চড়া মূল্য। দোকানিরা সব দোকানঘর ফেলে চলে গেছে। সময়মতো দরকারী জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছে চালের দাম। ভাতের বদলে একবেলা রুটি খাচ্ছে সাঈদ আহমেদের পরিবার।
একদিন লবণ ছাড়াই রুটি বানালেন রাবেয়া বেগম। কারণ কোথাও লবণ মেলেনি। যুদ্ধের আগে সের প্রতি লবণের দাম ছিল ১০ পয়সা। এখন এটি দুষ্প্রাপ্য। দাম ১০ টাকা। মানে ১০০ গুণ। তাও এতে মেশানো থাকে প্রচুর বালি আর ময়লা। লবণ চাষীদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, কেউ কেউ পালিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ছেড়ে। দাম তো বাড়বেই। কিন্তু ১০ টাকা দিয়ে এই ময়লা জিনিসটা কেনার ক্ষমতা ও ইচ্ছা দুটোই থাকা দরকার।
রাতে রুটি খাওয়ার সময় মাহিন মাকে বলে, আর একটা রুটি দাও, মা। মাত্র দুটি রুটিতে পেট না ভরায় মায়ের কাছে এই আবদার। নিজের ভাগ থেকে একটা রুটি মাহিনের পাতে তুলে দেন রাবেয়া বেগম। শেষ রুটিটার অর্ধেক খেয়েছিল অর্চি। ছোট ভায়ের জোর আপত্তি সত্ত্বেও বাকি অর্ধেকটা ওকে দিয়ে দিল।
এদিকে যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে কিছু মানুষের মনে— কী হবে! কী হবে! এরকম অবস্থায় হঠাৎ একদিন শুরু হয় বিমান আক্রমণ। আকাশের বুক চিরে ডানা মেলা পাখি নয়, ভয়ঙ্কর গর্জন তুলে উড়ে যায় যুদ্ধবিমান। তার পেট থেকে লম্বা লম্বা চোখামুখ কী সব জিনিস নেমে আসতে থাকে ভূপৃষ্ঠের দিকে। ভূমি থেকে আকাশে মুহুর্মুহু ছোড়া হতে থাকে কামানের গোলা। যুদ্ধবিমান আর কামানের উচ্চশব্দে টুটাফাটা হতে থাকে আকাশ-বাতাস।
গোলাগুলির আওয়াজ যখন বন্ধ থাকে, মাহিন এবং ওর সমবয়েসী ছেলেরা ঘর ছেড়ে মাঠে খেলতে নামে। সাইরেনের শব্দ কানে এলেই আবার যে যার বাসার উদ্দেশ্যে ভোঁ দৌড় দেয়। ঠিক মুহূর্তেক পরেই গর্জন তুলে আবার ধেয়ে আসে যুদ্ধবিমান, আবার কামানের গোলা উড়ে যায় আকাশ লক্ষ্য করে। ধোঁয়ার মেঘে ঢাকা পড়ে আকাশের বুক। মাথার উপরে, দিগন্তে ভারী হয়ে ঝুলে থাকে ছাই রঙের বিষাদ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই ছাই রঙ কাটতে না কাটতেই বাতাসের বুক ফালা ফালা করে আবার জাগে ধাতব তীরের শব্দ। একের পর এক।
রাত ১০টায় আগ্রাবাদ সরকারি কলোনির উত্তরে সার-বেঁধে তৈরি দোকানঘরগুলোতে আগুন লাগানো হয়। আগুনের লাল রাঙিয়ে দেয় পুরো আকাশ। তার আঁচে তেতে ওঠে দু’বর্গমাইল এলাকার বাতাস। কে নেভাবে এই আগুন! পুড়তে পুড়তে ক্রমশ ভস্মে পরিণত হয় সব দোকান আর আশপাশের সব বাড়ি-ঘর। আগুন-বারুদের এই খেলায় দিন-রাত এখন সমান। একে একে মাটিতে মিশে যাচ্ছে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠামোগুলো। লাশ পড়ছে, লাশ পুড়ছে। শবদেহের গন্ধ চাপা পড়ে যাচ্ছে বারুদের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে।
ধ্বংসের করাল মূর্তিটা কী এক তৃপ্তিহীন পিপাসায় গিলে খেতে চাইছে সব ওর জ্বলজ্বলে ভয়ঙ্কর চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে এক অশুভ হিংস্র আগুন দুই দিগন্ত পর্যন্ত ছড়ানো ওর লকলকে রক্তপিপাসু জিভটা দ্রুত এগিয়ে আসছে কাছে … আরো কাছে … পালানোর পথ নেই।
চার
বেশ ক’দিন ধরে মাহিন ঘরের ভেতর আটকে আছে। তিন ভাই-বোন মিলে ওকে সারাক্ষণ রাীতিমতো পাহারা দিচ্ছে। বাইরে যাওয়া এখন এতটাই বিপজ্জনক। ঘরের নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ। তবু বাইরে যাওয়া কোনোমতেই চলে না। ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির হয়ে উঠেছে মাহিন। ভারী অস্ত্রসজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ এবং সাফল্যের খবর পরিবেশিত হচ্ছে রেডিওতে। গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই খবর শোনে সবাই। তারপর এ নিয়ে আলোচনা চলে অনেক রাত পর্যন্ত। কিন্তু যুদ্ধ কবে শেষ হবে সেই খবর কারো কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
জলি কাকির শরীরটা ফ্যাকাসে আর রোগা হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছেন না। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কি না কে জানে, একদিন সন্ধ্যায় মাহিনের বাবা বলেন, ‘ওহাব ভালো আছে, সুস্থ আছে, এই খবর আমি পেয়েছি, কোনো চিন্তা কোরো না।’ জলি কাকি সেকথা বিশ্বাস করেছেন কিনা জানা যায়নি।
একরাতে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি আর শহরের অবস্থা নিয়ে আলোচনা শেষে মাহিনের বাবা-মা ঘুমাতে গেলেন। তখন প্রায় মধ্যরাত। অয়ন ও মাহিনও নিজেদের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। ভোর রাতের দিকে হঠাৎ মাহিন স্বপ্নের ভেতর কাকের ডাক শুনতে পায়। বহুদূর থেকে, যেন মহাকালের ওপার থেকে সে ডাক আসে; খুব ক্ষীণ হয়ে সে ধ্বনি প্রবেশ করে মাহিনের কানে আর রূপকথার রহস্যময় এক জগতের মতো হাতছানি দিয়ে ওকে ডাক দেয়। ঘুমের ভেতর মৃদু আন্দোলিত হয় ওর শরীর। ওই ধ্বনি যেন ওর পিপাসার্ত হৃদয়ের গান। ঘুমের ভেতরেই ব্যাকুল হয়ে কান পাতে ও— যদি আবার শোনা যায়!
আরে! এই তো! একবার নয়, দুবার নয়। পর পর তিনবার— কা-কা-কা। জেগে ওঠে মাহিন। চোখ কচলে তাকায়। চারপাশে ভোরের আবছা আলো। বাইরে সত্যি সত্যি কাক ডাকছে দুটি-একটি। তাহলে ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেনি!
বিছানায় চুপচাপ শুয়ে কিছু সময় পার করে দেয় মাহিন। ইতোমধ্যে অয়নও ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। রেডিও স্টেশনের সামনের রাস্তা থেকে হঠাৎ ভেসে আসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। তক্ষুনি জানালা খুলে পুবে নজর বোলায় ওরা। পাক সেনাদের চিহ্ন নেই কোথাও। তার বদলে চোখে পড়ে ছুটন্ত খোলা জিপে দাঁড়িয়ে হাতের অস্ত্র উঁচিয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিচ্ছে কয়েকজন যুবক। ওদের বহনকারী জিপটি ছুটে যাচ্ছে উত্তর দিকে।
দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় ওরা। পেছন পেছন আসে আরো তিনজন। অর্চি, রীতি আর ওদের বাবা সাঈদ আহমেদ। রিনির ছোট্ট শরীরটা বাবার কোলে নড়াচড়া করছে। সবার সঙ্গে চোখ মেলে সে-ও তাকায় পুবে। ওর খুদে স্বচ্ছ চোখ দুটোর মধ্যে অপার কৌতূহল। মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী জিপটা তখন আরো উত্তরে চলে গেছে। হারিয়ে গেছে দৃষ্টির আড়ালে। রাস্তা এখন ফাঁকা। বেশ কিছুক্ষণ আর কিছু চোখে পড়ে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কয়েক জোড়া চোখ। দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসে আরো কয়েকটি জিপ। বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনি উঠতে থাকে- জয় বাংলা। তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।- খোলা জিপে দাঁড়িয়ে অস্ত্র কাঁধে মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলে স্লোগান দিতে দিতে ওরা চলে যায় উত্তরে।
দক্ষিণের জানালাগুলো খুলে দে, হানাদাররা সব পালিয়েছে— ধীর গম্ভীর গলায় বলেন সাঈদ আহমেদ। তৎক্ষণাৎ অর্চি ও রীতি ঘরের ভেতর চলে যায়। একে একে দক্ষিণের সব ক’টা জানালা খুলে দেয় ওরা।
রেডিও স্টেশনের সামনের রাস্তায় এবার চোখে পড়ে অনেকগুলো ট্রাক আর লরি। মাঝে মধ্যে দুয়েকটি মাইক্রোবাস। পেছনে আবার খোলা জিপ। ক্রমশ বেড়ে চলে ওগুলোর সংখ্যা। ছুটন্ত যানগুলোর উপর অস্ত্র হাতে, অস্ত্র কাঁধে ইউনিফর্মবিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান-তোলা মুখগুলো সব দেখতে একইরকম লাগে।
ওমা! ওটা আবার কী? হঠাৎ প্রশ্ন করে অর্চি।
এতক্ষণ সবার নজর রাস্তার উপর থাকায় কেউ খেয়াল করেনি। অর্চির প্রশ্নে সবাই সচকিত হয়ে তাকায়। দূরে থমকে থাকা বিস্তীর্ণ সবুজের সীমানার ওপরে মাথা তুলছে কী যেন একটা— টকটকে লাল, গোলাকার আর আশ্চর্যরকমের বড়। দৃশ্যটা অন্য কোনো সাধারণ দিনের মতো নয়। অবাক চোখে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সবাই।
কী আবার! এ তো সূর্য! — নীরবতা ভেঙে এক সময় জবাব দেয় রীতি।
কিন্তু এত বড় সূর্য তো কখনো দেখিনি! অর্চির গলায় বিপুল বিস্ময়।
ঠিক বলেছিস! সূর্যটা যখন ওই গাছগুলোর মাথার উপর আসে, তখন তো ওটা হয়ে যায় সোনালি। এরকম লাল আর এত বড় তো থাকে না। আমি বহুদিন দেখেছি— ব্যাখ্যা দেয় অয়ন।
হ্যাঁ, তাই। সমর্থন করে অর্চি।
কেউ আর কিছু বলে না। সবাই আবার রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয়। ছুটে চলা যানগুলো থেকে সমানে ভেসে আসতে থাকে স্লোগান, আর আরোহীদের অপসৃয়মান মুখগুলো একই ভঙ্গীতে আঁকা হয়ে যায় মাহিনের হৃদয়ে।
টকটকে লাল বিশাল সূর্যটা খুব ধীরে সবুজের সীমা ছাড়িয়ে উপরে উঠে আসে। সেদিকে তাকিয়ে মাহিন বলে, আজ সূর্যটা এত লাল কেন, বাবা? আর এত বড়?
হুম! এত লাল আর এত বড় তো হবেই। ধীরে ধীরে আরো উপরে যখন উঠবে তখন সোনালি আলো ছড়াতে শুরু করবে। লাল তখন স্মৃতি হয়ে থাকবে সবার মনে।
বাবার কথা সত্যি মাঝে মধ্যে খুব হেঁয়ালিভরা। সামনে বড় রাস্তার দুপাশে তখন লোক জমতে শুরু করেছে। মাহিন আর স্থির থাকতে পারে না। আমি চললাম বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। খালি পায়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে বড় রাস্তার দিকে। ডানা মেলে দেওয়া পাখির মতো দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে কখনো বাঁয়ে, কখনো ডানে দেহটাকে কাত করে ছুটতে থাকে।
মাহিন যখন বড় রাস্তার দিকে ছুটছে, ঘরের মধ্যে রাবেয়া বেগম তখন সবাইকে একটা সুসংবাদ শোনালেন, জলির মেয়ে হয়েছে। সাঈদ আহমেদ ভাতিজিকে দেখার জন্য রাবেয়া বেগমের পিছু পিছু এলেন। তাঁর পেছনে এল অর্চি, রীতি আর অয়ন। জলি কাকি বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর পাশে নতুন অতিথি। বিছানার কাছে মোড়ায় বসে আছে ধাই। নতুন অতিথিটি সুস্থ-সবল নয়। দেখে বোঝা যাচ্ছে, বড় করে তুলতে অনেক যতœ আর পরিচর্যার প্রয়োজন হবে।
ও টিকবে তো, ভাবী? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন জলি কাকি।
তাঁর কথার প্রতিবাদ জানাতেই হয়ত সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁচ্চো’ করে খুব জোরে হাঁচি দিল নবাগত অতিথি। হাঁচির ভঙ্গিটা এমনই অদ্ভুত আর অসাধারণ যে তা দেখে উপস্থিত সবাই তো হেসেই খুন। এতটুকুন মেয়ের এটা এক মহাকীর্তি যেন। সাঈদ আহমেদ হাসতে হাসতে বললেন, দেখো জলি, তোমার কথার প্রতিবাদ করেছে মেয়ে। ওর এই হাঁচিটার দাম সহস্র কোটি টাকা। অবশ্যই টিকবে এই মেয়ে! জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা যে আছে ওর, সে প্রমাণ ও দিয়ে দিল। সবাই মিলে যত্ন কোরো।
কী নাম রাখবে ওর, বাবা? উৎসাহিত গলায় প্রশ্ন করল অর্চি।
দেশ আজ হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই দিনে ওর নাম রাখলাম ‘মুক্তি’।
হাততালি দিয়ে সমর্থন করল অর্চি আর রীতি। খুব সুন্দর নাম। একসঙ্গে বলে উঠল দুজন।
এদিকে মাহিন ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার দুপাশে জড়ো হওয়া জনতার কাতারে। একের পর এক ছুটে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী গাড়িগুলো। সমবেত জনতার উদ্দেশে হাতে নাড়ছে ওরা। জবাব দিচ্ছে অভিনন্দনের। জনতার ভেতর থেকে কেউ কেউ গাড়ির মধ্যে ছুড়ে দিচ্ছে ফুল। চালকেরা কমিয়ে দিয়েছে গাড়ির গতি। এই সুযোগে উৎসাহী অনেকে হাত মেলাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। রাস্তার দুপাশ থেকে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠছে— জয় বাংলা। বাংলা মায়ের দামাল ছেলে, লও-লও-লও সালাম।
অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষগুলো সব ছুটে আসছে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো। রাস্তার দুপাশে এখন প্রায় তিলধারণের জায়গা নেই। উত্তরে-দক্ষিণে, দুপাশে মাইলের পর মাইল অন্তহীন মানুষের সারি। তাদের প্রাণখোলা হাসি, কোলাহল আর সেই কোলাহল ছাপিয়ে জেগে ওঠা স্লোগান — সমবেত মানুষের এরকম উল্লাস, এমন প্রাণের উৎসব মাহিন আর কখনো দেখেনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য সেও ছুটে যায় গাড়ির কাছে। হঠাৎ চলমান জিপ থেকে লাফিয়ে নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা। দু’হাতে ওকে কোলে তুলে নেন। মুখভর্তি ঘন গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলের ভেতর থেকে হেসে ওঠে দুই সারি রূপালি দাঁত। থেমে যায় চলমান জিপের সারি।
কেমন আছিস, মাহিন? কণ্ঠটা ঘ্যাসঘেসে। অবাক হয়ে তাকায় মাহিন। ঘন গোঁফ-দাড়ি, লম্বাটে গোল মুখটা আগের চেয়ে শীর্ণ, কপালের বাম পাশে ক্ষত আর গলার স্বর পাল্টে গেলেও ওহাব কাকাকে চিনতে দেরি হয় না ওর।
কাকা, তুমি! খুশির চোটে কাকার দাড়ি ধরে টান দেয় মাহিন।
করছিস কী? আরে ছাড়! ছাড়! লাগছে তো।
জিপে দাঁড়ানো ওহাব কাকার সহযোদ্ধারা হেসে ওঠে হা হা করে। মাহিন এবার ওহাব কাকার কাঁধের অস্ত্রটার গায়ে হাত বুলায়— এটা কী অস্ত্র, কাকা?
স্টেনগান। বেশ ক’টা দৈত্যকে সাবাড় করেছি ওটা দিয়ে। কেমন আছে বাসার সবাই?
ভালো। এখানে কী হয়েছে? কাকার কপালের বামপাশে ক্ষতচিহ্নটার কাছে আঙুল রেখে জিজ্ঞেস করে মাহিন।
ও কিছু না। দৈত্যের আঁচড়। কাবু করতে পারেনি। যা, বাসায় গিয়ে বল্ আমি আসছি।
কখন আসবে? এখনই চল আমার সঙ্গে।
এখন না। বলিস্ দুদিন পর আসব।
মাহিন আর ওখানে দাঁড়ায় না। ভিড়ের মধ্যকার ফাঁক-ফোকর গলে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসেই দে ছুট্।
কলোনির ভেতরের বড় মাঠটার কাছে পৌঁছতেই কানে আসে ড্রাম বাজানোর শব্দ। স্কুলে খেলার দিন বয় স্কাউটের ছেলেরা যেরকম বাজায়, ঠিক সেরকম। প্রথমে ধীর, তারপর দ্রুত লয়ে, ছন্দে ছন্দে – দ্রিমিকি-দ্রিমিকি-দ্রাম, দ্রিম-দ্রাম-দ্রাম— কারা বাজাচ্ছে, কে জানে।
বাসায় এসে হাঁপাতে হাঁপাতে খবরটা প্রথমে মাকে জানাল মাহিন। তারপর অন্যদের। আনন্দে লাফিয়ে উঠল রীতি, অয়ন আর অর্চি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। হাওয়ায় উড়ছে দু’বোনের খোলা চুল। কতদিন ওরা এরকম মুক্ত হাওয়ায় এসে দাঁড়ায়নি! বাতাসে মিশে যাচ্ছে ওদের মুক্ত হাসির শব্দ।
বড় রাস্তার দু’পাশে তখন মানুষের ভিড় আরো বেড়েছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে কোলাহল। মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী ছুটন্ত খোলা জিপগুলোতে পতপত করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা।
পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা তুলে জেগে উঠেছে নতুন এক দেশ, নতুন অনুভূতি!
চারিদিকে মুক্তির উল্লাস। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি।
তারা//