ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

অগ্রন্থিত রচনা

আনুর গল্প

সৈয়দ শামসুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫৩, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১১:৩৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩
আনুর গল্প

প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

আনু এখন বড়ো হয়ে গেছে। এই খবরটা কেবল আনু ছাড়া সবাই জানে। কেবল আনু জানে না, সবাই জানে, আনু এখন বড়ো হয়ে গেছে। 

আগে বেলা করে উঠতে ইচ্ছে করত না তার। সালু আপা একদিন যদি ডাকতে দেরি করত, তাহলে সেদিন সারাদিন তার বেণি আস্ত থাকত না। এখন সালু আপা বেণি করে না, মা-র মতো খোঁপা করে। আনু এখন ভোরে ওঠে। ভোরে উঠে আর ফুল কুড়োতে ছুটে বেড়ায় না। সবার আগে উঠে, কেবল মা-র পরে উঠে, আনু বড়ো বড়ো পা ফেলে বাসা থেকে বেরোয়। মা তখন কুয়োতলায় ওজু করছেন, তার সংগে একটা কথা পর্যন্ত হয় না!

পথটা ভারি নির্জন হয়ে পড়ে থাকে। যেন কালরাতে কার গা থেকে ছাই-রং একটা শাল পড়ে গেছে, আর তোলা হয়নি- আকাশটা তেমনি। যেন মোটা আম গাছটার আড়াল থেকে বাবাকে এখুনি দেখা যাবে পায়চারি করতে করতে আনুর দিকে আসছেন। তার সমস্ত মুখ সূর্য ওঠার লাল রংয়ে ছবির মতো। তার হাসির ভেতর থেকে যেন সূর্য উঠছে।
খুব গম্ভীর হয়ে একা একা হাঁটতে থাকে আনু। ডাকবাংলোর পুকুরে এসে পদ্ম দেখে পাতায় পাতায় একটুও পানি দেখা যাচ্ছে না। একটা দুটো পাতা সরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মুখ ধোয় আনু। রাতভর ঠান্ডা হয়ে আছে। ঠান্ডা পানিতে চোখের ভেতরটা যেন কাটতে থাকে। 

কোনো কোনো দিন আনু সেখান থেকে আসে নদীর দিকে। ধরলার দিকে। ধরলার পাড়ে দাঁড়িয়ে কোনো কোনো দিন হিমালয় দেখা যায়। একেবারে সারা আকাশজুড়ে নীল মেঘের মতো। তারপর, কখন যেন, একটা মেঘের চূড়া ঝকঝক করে ওঠে। আনুও তখন হাসতে থাকে। তার মনের মধ্যে আর কিছুই মনে থাকে না। না বড়ো আপার ছায়ার মতো মুখ, মেজো আপার কান্না, সেজো  আপার এটা নেই ওটা নেই বলে মুখ ভার, মা’র রাত জেগে জেগে নামাজ, মিনু আপা বখাটে হয়ে যাচ্ছে, সালু আপার জামা ছিঁড়ে শাদা কাঁধ বেরিয়ে পড়েছে, বাবাকে জেলে নিয়ে গেছেন, পানু ভাই রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে, কিছুই মনে থাকে না। সব ভুলে গিয়ে সে দেখতে থাকে-ঝকঝক করছে, হাসছে।

তারপর দপ করে নিভে যায়। বাবা বলতেন, সূর্য একটু উঠে গেলেই আর রোদ পড়ে না, তখন কাঞ্চনজংঘা আবার নীল হয়ে যায়। সেটাও মজা লাগতো। দপ করে নিভে যেতেই বাবার হাত ধরে আনন্দে লাফিয়ে উঠত আনু। দৌড়ে বাসায় এসে বাকুম বাকুম করে সেই গল্প শোনাতো। মিনু আপা যদি ঠোঁট উলটে বলত, ‘যা, আমিও দেখেছি’ তাহলে মনটা ভারি ছোটো হয়ে যেত আনুর। বাবা সেটা লক্ষ করে মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলতেন, মিশু আর কি দেখেছে? আজকের মতো কোনোদিন হয়নি। কী বলিস আনু?

এখন আনু কাঞ্চনজংঘা নিভে যাওয়া পর্যন্ত আর দাঁড়ায় না। তার আগেই চলে আসে। এসে আর গল্পও করে না। আসবার পথে দেখতে পায় ইস্টিশানের দোকানগুলোয় ডালপুরি বানাচ্ছে গরম গরম। ভারি ইচ্ছে করে একটা কেনে। পকেটে হাত দিয়ে দেখে হয়ত চারটি পয়সাও আছে। কিন্তু কেনে না। পকেটের মধ্যে হাত দিয়ে শক্ত করে পয়সাটাকে অনুভব করতে থাকে, ঘোরাতে থাকে, হাতের তেলো ঘামতে থাকে। কিন্তু কেনে না। বাসায় এসে শুধু এক পেয়ালা চা খেয়ে নাশতা করে। বারান্দায় বসে বসে দেখে, রান্নাঘরে গতরাতের বাসি ভাত নিয়ে বসেছে মেজো আপা, সেজো আপা; বড়ো আপা বড়ো এক গেলাস পানি খাচ্ছেন। কেউ তাকে পড়তে বলে না। একটু পর আনু নিজেই পড়ার বই নিয়ে বসে। আবৃত্তি করে পড়ে না। মনে মনে, মাথা নিচু করে, বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে এস্কিমোদের কথা পড়ে আনু। 

পানু ভাই রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে। সেদিন হঠাৎ অফিস থেকে পিয়ন এসে বলল, আনুমিয়া মাস্টারসাহেব আপকো বোলায়া। 
মাস্টারসাহেব? কে মাস্টারসাহেব? আনু জানে না পোস্টমাস্টারকেও মাস্টারসাহেব বলে। তাদের বাসায় জায়গির থেকে পড়ত মাস্টারসাহেব, বাবা যখন জেলে গেলেন, তিনি চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় তাকে সব সাদা খাতা, দুটো গল্পের বই, একটা টাকা, কাচের দোয়াতদান, পেতলের একটা ছোট্ট বক দিয়ে গিয়েছিলেন। আনু এখন বুঝতে পারে- বাবা যে নেই, তারা খেতে দিতে পারবে না, তাই চলে গিয়েছিল মাস্টারসাহেব। পানু ভাই বুঝি আগেই টের পেয়েছিল- ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়বেন বাবা, জেলে যাবেন, তাই রেলে কাটা পড়ে ফাঁকি দিয়ে গেল। পানু ভাইয়ের কী? বড়ো হয়েছে, বিএ পাশ করেছে, ঢাকা দেখেছে, ভালো ভালো জামা আর জুতো কিনেছে, বড়ো বড়ো জংশনে কাজ করেছে।  তার মরে যেতে কী? মরতে একটুও দুঃখ নেই তার।

পিয়নের ডাক শুনে মা এসে দাঁড়িয়েছিলেন দরোজার ওদিকে। নিচু গলায় তিনি জিগ্যেস করলেন, আনু জিগ্যেস কর, ওরা ডাকছে কেন?
পিয়নটা উত্তর করে, মা-জি, হামারা মালুম নেহি।  
আনু ভেতরে আসে। একটা কথাও বলে না। আলনা থেকে বেছে একটা ধোয়া শার্ট বের করে গায়ে দেয়। সুন্দর করে শার্ট ধুয়ে রাখেন মা। নোখ দিয়ে দিয়ে কালারে, বোতামের জায়গায় কুচিগুলো সমান করে রাখেন।
মা বললেন, বুলুকে নিয়ে যা।

বুলু পাশের বাড়ির ছেলে! এবার নাইনে পড়ে। বুলুর মাকে খুব ভালো লাগে আনুর। বুলুর বাবাকেও! বুলুকেও। বুলুদের সবাইকে ভালো লাগে আনুর। বুলুরা কেউ কখনো বলে না, আনুর বাবা ঘুষ খেয়ে জেলে গেছে। সারা শহরে শুধু বুলুরাই বুলুরা বলে না। আর সবাই বলে। বলে, আর দাঁত বার করে হাসে। কেবল বুলুরা বলে না। আর বলে না ইয়াসিন সিপাহী। বাবা যখন এখানে দারোগা ছিল, তখন ইয়াসিন বাজার করে দিত। ইয়াসিন এখনো মাঝে মাঝে হাট করে দিয়ে যায়। আর ইয়াসিন বলে না। ইয়াসিন আনুকেও বলত, দারোগা সাহেব। বলত আনু যখন দারোগা হবে তখন তার ঘোড়া রাখবে ইয়াসিন। আনু দারোগা হবে না। আনু হবে গার্ড সাহেব। পানু ভাই তো ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশনমাস্টার। সে হবে গার্ড। রাত দুপুরে ঝকঝক্ ঝিক্ঝিক্ করতে করতে তার গাড়ি বোনার পাড়া টোনার পাড়া ছাড়িয়ে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা চলে যাবে। বুলুর বাবা মাসে দু’মাসে রোজ ঢাকা যান। দোকানের জিনিস কিনে আনেন। পিন, কলের গান, রেডিও, রেকর্ড, কাচে বাঁধানো বিলেতের রাস্তাঘাট সমুদ্রের ছবি। একটা ছবি খুব ভালো, যেটাতে দুটো ছেলে বসে মাছ ধরছে। আনুও মাছ ধরে। আনুর জন্যে বুলুর বাবা গেল মাসে এক সেট বড়শি আর মুগা সুতো এনে দিয়েছেন। আনু কাল যখন মাছ ধরতে যাবে বুলুর বাবাকে অনেকগুলো মাছ দেবে।

বুলুকে সংগে করে আনু পোস্ট অফিসে এলো। মাথার ওপরে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘পোস্ট ও টেলিগ্রাম অফিস’। পানু ভাই যখন মরে গেল তখন টেলিগ্রাম এসেছিল একটা। পোস্টমাস্টার বললেন, রেল কোম্পানি তোমার বাবাকে টাকা পাঠিয়েছে পানুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে। কে নেবে টাকা? তোমার বাবা তো জেলে। তোমার মাকে নিতে হলে দরখাস্ত করতে হবে সাতদিনের মধ্যে। নইলে টাকা ফেরত যাবে।
বেরিয়ে এসে বুলু বলল, কি বোকা তুই! বুঝতে পারলি না? তোর ভাই ডিউটিতে মারা গেছে কিনা, তাই টাকা দিচ্ছে।
তবু আনু বুঝতে পারে না। ভাবে, রেলের লোকজন খুব লজ্জা পেয়ে গেছে তার ভাই মরে যাওয়াতে, তাই টাকা দিয়ে ভাব করতে চাইছে। দরকার নেই তার টাকার। নেবে না সে টাকা। টাকা দিয়ে কী হবে! 

বাবার খুব টাকার দরকার ছিল না? আনু যেন স্পষ্ট শুনতে পায়, একদিন মা রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সব ভাইবোনকে নিয়ে দুঃখের গল্প করছিলেন। বাবার খুব টাকার দরকার ছিল। চিন্তায় চিন্তায় মাথা ঠিক ছিল না বাবার। বড়ো আপা, সেজো আপা, ছোটো আপা সবগুলোকে বিয়ে দিতে হবে। তাই বাবা ঘুষ নিয়েছিল। শুনে মুখ কাচুমাচু করেছিল আপারা। তাদের দেখাদেখি সালু আপা, মিনু আপাও- ওরা বড়ো নয় তবু। বাবা বলতেন, আনুকে বোর্ডিংয়ে রেখে পড়াবেন। তার দারোগার চাকরি, খালি বদলি আর বদলি। বোধ হয় আনুর বোডিংয়ের জন্যেও মেলা টাকা দরকার ছিল বাবার। মুখ ছোটো করে আনুও মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।

বাসার কাছাকাছি এসে গিয়েছিল ওরা। দেখা যাচ্ছে বকশীদের বাড়ির মাঠে আনুদের ছাগলের বাচ্চাগুলো খুব লাফাচ্ছে। মা এবার কোরবানির সময় বিক্রি করবেন বলেছেন। ততদিনে ওরা বড়ো হয়ে যাবে।
আনু কম্পিত গলায় জিগ্যেস করে, বুলু ভাই?
কীরে?
কত টাকা দেবে পানু ভাইয়ের জন্যে? 
কি জানি।  
বুলু ভাবতে থাকে। আনুর কাঁধে হাত রেখে আচমকা বলে, টাকা পেলে, এবার তোর সালু আপাকে ভালো জামা কিনে দিস্।
আনু মুখ তুলে দেখে, বুলুর মুখটা হঠাৎ খুবই ঝকঝকে দেখাচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিলো বুলু। তাড়াতাড়ি বলল, তোর মা সেদিন আমার মাকে বলছিল ও নাকি কিছু চেয়ে নেয় না।

আনমনা হয়ে যায় আনু। কাল বিকেলে ওদের বাসার পেছনে সরু গলিটায় সালু আপাকে দেখেছিল কী যেন বলতে। বুলুকে বলতে। বুলুকে বোধ হয় জামার কথা বলেছে। আনু বলল, ওর একটা ভালো শাড়ি ছিল। সাইত্রিশ টাকা দাম। বড়ো আপা সেদিন বেড়াতে যাবে, ওর ভালো শাড়ি নেই দেখে দিয়ে দিলো সালু আপা। আর নেয়নি।
দরোজার পাট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বড়ো আপা। আনু কাছে আসতেই সে জিগ্যেস করল, কীরে? 
আনু বলল, টাকা এসেছে। 
কার?
পানু ভাইয়ের।
কি ভেবে আনু আবার বলল, আমাদের।

পাঁচ হাজার টাকা এসেছিল। বুলুর বাবাই সব ব্যবস্থা করে ছিলেন পোস্টমাস্টারের সংগে দেখা করে। মাস্টারসাহেব নিজে এসে নিজে হাতে টাকা দিয়ে গেলেন আনুর মাকে। সইটা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন, চশমা পরে দেখলেন, চশমা ছাড়া দেখলেন। তারপর বুলুদের বাড়িতে চা খেয়ে ছাতা খুলে মাথায় দিতে দিতে চলে গেলেন। 
বুলুর বাবা গলা বড়ো করে ভেতর বাড়িতে আনুর মাকে বললেন, কাল পোস্টাফিসে একটা পাশ বই করেন। এত টাকা কাছে রাখা ঠিক না। আনু, সকালে দোকানে যাবার সময় আমাকে মনে করিয়ে দিও।

রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে ছিল আনু। এই ঘরটাতে ও থাকে একা চৌকিতে। বাবার বড়ো পালংকে থাকে মা, মিনু আপা আর সালু আপা। ওপাশের ঘরে বড়ো আপারা। আসলে ঘর একটাই, মাঝখানে হাত তিনেক পথ রেখে বেড়া দিয়ে পার্টিশন করা। ও ঘরে হারিকেন। এ ঘরটা অন্ধকার। শুয়ে পড়েছে সালু মিনু আপা। ও ঘরে মেজো আপার চুল আঁচড়ানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেজো আপা গুনগুন করছে, বোধ হয় মুখে সর মেখে শোবে। যেদিন রাতে ও মুখে সর মাখে সেদিন অমনি গুনগুন করে। আছ কতদিন মাছ ধরতে যায়নি। মা বকে, বলে, মাঝি পাড়ায় গিয়ে থাক, এ বাড়িতে আসিস কেন? হাত নিসপিস করতে থাকে আনুর। বুলুর বাবার দেয়া সুতো বড়শি যে-কে-সেই পড়ে আছে। কাল যদি মাছ ধরতে যায় বুলুর বাবাকে অনেকগুলো মাছ দেবে। কাল যদি মাছ ধরতে যায়, আনু তাহলে কটা মাছ পাবে? তিনটে, না পাঁচটা জিয়োল, এক গন্ডা বাচা, একটা বড়ো শোল, দুটো বেলে। বড়ো আপা বেলে মাছ ভালোবাসে। আর সবাই জিয়োল। মা, যেদিন শোল মাছ হয় খুব সুন্দর করে রাঁধেন। বাচা মাছ দেবে বুলুর বাবাকে। একটা রুই মাছের বাচ্চা যদি পাওয়া যেত, হাত দেড়েক, ঝাল ঝাল মাখা মাখা করে রান্না হতো, মাথাটা দিয়ে একটুখানি ডাল রান্না করত যদি মা! কিন্তু হাফিজ মিয়ার পুকুর ছাড়া রুই পাবে কোথায় আনু? দেখলে আর কথা নেই। জবাই করে ফেলবে আনুকে। আনুর ঘুম পায়। হাফিজ মিয়ার পুকুরে রুই মাছগুলো যেন দেখতে পায়; কাচের মতো পানির নিচে ছবির মতো সব মাথা গুঁজে পানির মধ্যে পড়ে আছে। মাথার পরে খুব রোদ উঠেছে কিনা!

লণ্ঠনের আলো সারামুখে টের পায় আনু। দ্যাখে, মা। মা লণ্ঠন তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ঘুমিয়েছিস?
না।
কিন্তু মা লণ্ঠন নাবিয়ে নেন। যেন যাবার উদ্যোগ করেন। বলেন, থাক, তাহলে ঘুমো। আমু কান পেতে শোনে, এখন আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অনেক রাত হয়েছে নিশ্চয়ই। বড়ো আপাদের ঘরে বাতিটা নেভানো। আনু উঠে বসে। বলে, কী? 
মা খুব দ্বিধা করে আদর নিয়ে বলেন, একটা চিঠি লিখবি আনু? আয়, আমি পোস্টকার্ড কলম বার করে রেখেছি।
আনু তখন উঠে দাঁড়ায়। যেন পড়ার টেবিলে যাবে লিখতে। তারপরই মনে হয়, টেবিল তো এ-বাড়িতে আনা হয়নি। ঘুমিয়ে গিয়েছিল আনু, সব ভুলে গিয়েছিল আনু।
কলম-টলম নিয়ে এসে মা বসলেন চৌকির এক কোণে। মাঝখানে লণ্ঠন রেখে মনোযোগ দিয়ে ছোটোবড়ো করে আলো ঠিক করলেন মা। পোস্টকার্ডটা তেলতেলে হয়ে গেছে। কলম নিয়ে আনু ওপরে সুন্দর করে লিখল, ‘গড, ইজ গুড’। তারপর জিগ্যেস করল, কার কাছে লিখবো মা? 
তোর মামার কাছে। 

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল আনু পোস্টকার্ডের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু মা কিছুই বললেন না। যখন চোখ তুলে তাকাল, দেখল মা খুব ভাবছেন। মা তাকে মাথা তুলতে দেখে একটু থতমত খেলেন যেন। তারপর পরামর্শ করার গলায় বললেন, টাকা যখন পাওয়াই গেল আনু এবার তোর বড়ো আপাকে বিয়ে দিতে হয়। কত বড়ো হয়ে গেল। লোকে কত কি বলে, আরো বলবে এখন। তোর মামাকে ডেকে আনি, কী বলিস? তুই বড়ো হলে আমার দুঃখ ছিল না। 
মার চোখ যেন পানিতে চিকচিক করতে থাকে। আনু দেখতে চায় না। আনু চোখ নামায় আবার। মা বলেন, লেখ, পাকজোনাবেষু, আমার শত কোটি ভক্তিপূর্ণ সালাম জানিবেন ও ভাবিজানকে দিবেন।

সোমবারে রংপুরে গেল আনু বাবাকে দেখতে। বুলুর বাবার কাজ ছিল রংপুরে! তার সংগে গেল আনু। মা পিঠে বানিয়ে দিয়েছেন বাবার জন্যে। ছোট্ট টিফিনকারিতে ভরে সারাক্ষণ কোলে কোলে রেখে সকাল দশটার গাড়িতে চেপে বেলা দেড়টায় রংপুরে পৌঁছলো আনু। এর আগে আরো কয়েকবার এসেছিল। মাও এসেছিলেন তিনবার। আপা, বড়ো আপা, সেজো আপা, মেজো আপারাও তিনবার। সালু আপা দু’বার। মিনু আপা প্রায় প্রত্যেকবার, যতবার আনু এসেছে। মিনু আপা আজ আসেনি, ওর পরীক্ষা। আনু রোজ মাসে দুবার। আনু যখন জেলগেটে এলো তখন চারটেও বাজেনি। পথে খুব শস্তা বাঁধাকপি দেখে কিনেছিল একটা। মা দেখলে খুশি হবেন। মার মুখটা মনে করে ভালো লাগল আনুর। 

কত লোক এসেছে দেখা করতে। দুটো বউ এসেছে গরুর গাড়ি করে। তাদের সংগের লোকটা উবু হয়ে বসে আর তিনজনের সংগে পরামর্শ করছে। এককোণে চার পয়সার কবিতা সুর করে করে পড়ছে আর বিক্রি করছে দু'জন চোঙা লাগিয়ে। একজন পড়ছে, একজন থেমে যাচ্ছে, আবার সে পড়ছে, আগের জন দম নিচ্ছে। আনুর এক হাতে কপি, আরেক হাতে টিফিনকারি। মেলা লোক ভিড় করে পাঠ শুনছে। হাতখালি ধাকলে আনুও গিয়ে শুনতো। চারটে বাজতে এখনো অনেক দেরি। 
তারপরে লাইনে গিয়ে দাঁড়াল আনু। এগুলো সব তার এখন মুখস্ত হয়ে গেছে। অফিসের এককোণে ছোটোবাবুর টেবিলের কোনায় জিম্মা রাখলো কপিটা। টিফিনকারিটা দেখে দিলো ওরা। ডাক পড়ল আনুর।

রোজকার মতো, বাবা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন আনুকে। আনুর এটা অভ্যেস হয়ে গেছে। আনু বলল, পানু ভাইয়ের পাঁচ হাজার টাকা এসেছে। শুনে চমক ভাঙলো বাবার। বললেন, টাকা কোথায় রেখেছে তোর মা? 
পোস্টাফিসে। মা বললেন, বড়ো আপার বিয়ে দেবে।
কোথায়?
জানি না। আমাকে বলেনি। 
বাবা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। চারিদিকে খুব হইচই হচ্ছে। সবাই দেখা করছে। নিঃশ্বাসটা তাই শুনতে পেল না আনু।
পানুটা থাকলেও ভাবনা ছিল না। তুই নিজে পছন্দ করিস আনু। তোর পছন্দ না হলে না করে দিস্। 
আনুর কেমন লজ্জা করতে থাকে। আবার খুশিও লাগে। বলে, আমার  কথা মা শুনবে? 
শুনবে। আমি চিঠি লিখে দেবো। আর শোন, তোর মামাকে ডাকিস না।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে আনু। বাবা বলে চলেন, তোর মামা লোক ভালো না। নিজের ভালো দেখবে, তোদের কিছু হোক না হোক তাকাবেও না। পানুর টাকার কথা ওকে জানিয়ে কাজ নেই। তোর মায়ের সৎ ভাই হাজার হলেও। কিন্তু সেদিনই রাতে আনু মামার কাছে টাকার কথা লিখেছে মার জবানিতে। বাবাকে বলতে সাহস হয় না। পায়ের লোম দিয়ে মেঝে খুঁড়তে থাকে। বাবা তখন তার মাথায় হাত রেখে চুলের জট ছাড়াতে থাকেন। জিগ্যেস করেন, রংপুরে এসে কিছু খাসনি?
আনু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
কী খেয়েছিস?
আনু জবাব দিতে পারে না। বাবা আরো হাত বুলোতে থাকেন। খামোখা আনু বলে, মিনু আপার পরীক্ষা। একটুও পড়ে না।
আচ্ছা, আমি লিখে দেবো। পড়বে না কেন? না পড়লে কেউ বড়ো হতে পারে? অনেক পড়বে, পড়তে পড়তে স্কুল পাশ করবে, কলেজে যাবে, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি তারপর বিলেত। বিলেত থেকে ফিরে এসে রিসার্চ করবে, ডক্টরেট নেবে। লোকে কত ভালো বলবে। সালাম দেবে। বিদ্বানের কত সম্মান, কত প্রতিপত্তি। রাজা পর্যন্ত বিদ্বানের কাছে মাথা নত করে। 

বলতে বলতে বাবার মুখচোখ দিয়ে আলো ঝরতে থাকে। যেন সুদূর দেখছেন তিনি। আনুর মাথায় সচল হাতটাও কখন থেমে যায়। আনু টের পায়, বাবার গলা ধরে এসেছে। তার নিজেরও কেমন ছমছম করতে থাকে বুকের ভেতর। ঠিক তখন ঘণ্টা পড়ে। ঢং ঢং করে বুড়ো সেপাই ঘণ্টা বাজায়। বটগাছটা থেকে কাকগুলো হঠাৎ উড়ে গিয়ে আবার একে একে বসতে থাকে। আনু বেরিয়ে আসে। এসে বাঁধাকপিটা নেয়। খালি টিফিনকারি পায়ের সংগে লেগে লেগে ঢন্ ঢন্ করতে থাকে। নবাবগঞ্জে এসে গ্রামোফন-ডিলার দাশ-কোম্পানির বেঞ্চিতে জিরোয় আনু। সন্ধ্যের সময় বুলুর বাবা এখান থেকে এসে তাকে নিয়ে যাবেন। বসে বসে গান শুনতে থাকে আনু। সেজো আপা গান শিখলে গলাটা এমনি মিষ্টি হতো। লোকে কত রেকর্ড কিনে নিয়ে যেত সেজো আপার। দাশ কোম্পানির আলমিরার মাথায় বাঁধানো থাকত সেজো আপার ছবি সবার সঙ্গে।
আজ মাছ ধরতে যাবে আনু। দুপুরে সকাল সকাল খেয়ে চুপ করে বেরিয়ে পড়ল। হাফিজ মিয়ার পুকুরে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু যাওয়া যাবে না। হাফিজ মিয়া নিজেই কাল থেকে ছিপ ফেলছেন। পকেটে তবু মেথি দিয়ে তৈরি বড়ো মাছের টোপ বানানো আছে। কাল রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে মেজো আপা আর সে বানিয়েছে। মেজো আপার খুব শখ এদিকে। বাবার সাইকেলটা নিয়ে উঠোনেই সে পাক খায়। চড়তে শিখেছিল কমলাগঞ্জে থাকতে। মা বলেন, গেছো মেয়ে। আনুর খুব ভালো লাগে। বুলুর বাবার দোকানে একটা ছবি ঝোলানো আছে, অনেক ক’টা মেমসাহেব সাইকেল চালিয়ে একসঙ্গে সবাই ডানহাত তুলে হাসতে হাসতে যাচ্ছে।

পথে পিয়ন একটা চিঠি দিলো আনুকে। পথে এ-রকম দেখা হয়ে গেলে সে আর বাসার যাবার কষ্ট করে না। বেঁচে যায় যেন, খুব খুশি হয়। আনু ছিপটা মাটিতে ঠেকিয়ে পোস্টকার্ডটা তক্ষুনি পড়তে শুরু করে। পড়ে দপ, করে আগুন জ্বলে ওঠে মাথায়। কিন্তু সেটা টের পায় না আনু। ছিপ তুলে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসে।
এসে দেখে, মা জলচৌকিতে শুয়ে আছেন। তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে তোলে আনু। বলে, মামা চিঠি লিখেছে মা।
ধড়মড় করে মা উঠে বসেন। বলেন, কই? কখন?

মা পড়তে বলার আগেই আনু পড়তে শুরু করে দেয়-দোয়া বহুত বহুত পর সমাচার এই যে, আয়ুষ্মান আনুর হস্তাক্ষরে একখানি পত্র পাইয়া তোমার যাবৎ বিষয় অবগত হইলাম। রেল কোম্পানি নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিয়াছে, ইহা একরূপ ঠকাইয়াছে বলিয়া আমার ধারণা। পানুর এন্তেকালে এ-সংসারের যাহা ক্ষতি হইল তাহা লক্ষ টাকাতেও শোধ হইবার নহে। যাহা হউক, আল্লাহর নিকট শোকর গোজারি করিলাম যে, অন্তত কিঞ্চিৎ কিনারা হইয়াছে। তোমার প্রথমা কন্যার বিবাহের জন্য ভাবনা করিও না। আমি নিজ দায়িত্বে তাহা সম্পন্ন করিব। অত্র মহাকুমা সদরে একজন বিএ ফেল শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত বংশীয় পাত্রের সন্ধান আছে। আমি দুই চারি দিনের মধ্যেই তাহাকে ও তাহার দুই একজন খাস দোস্ত সমভিব্যহারে তোমার বাটিতে পৌঁছিব। পছন্দ হইলে শুভকার্য এই যাত্রাতেই সম্পন্ন করা যাইবে। আর বিশেষ কী লিখিব? এদিকে আরেক সুযোগ হাত ছাড়া হইতেছে। বিলাতের মাতা তাহার নিষ্কর জমির তিন বিঘা মাত্র দুইশত পঁচিশ টাকা প্রতি বিঘা দরে বিক্রয় করিতে ইচ্ছুক। আমার হাত বর্তমানে কপর্দক শূন্য। যদি সাতশত টাকা ঋণ দিতে পারো তো প্রথম বর্ষের শস্য হইতেই শোধ করিতে পারিতাম। আমি তাহাকে বহু বুঝাইয়া রাখিলাম। তুমি অর্থের জোগাড় রাখিও। শ্রেণিমতো আমার দোয়া পৌঁছাইয়া দিও।

চিঠি পড়া শেষ হতেই মা বললেন, তাহলে তো বাড়িঘর দোর ঠিক করতে হয় আনু।
আনু সেদিকে কান না দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, টাকা দেবে নাকি তুমি মামাকে?
মা অবাক হয়ে তাকালেন। আনু আবার বলল, বলো, তুমি দেবে নাকি?
তুই চেঁচাচ্ছিস কেন আনু?
হাত ধরে তাকে চৌকিতে বসাতে চেষ্টা করেন মা। কিন্তু আনু শক্ত করে চিঠিটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, তুমি টাকা দিতে পারবে না। 
তার গলার স্বর শুনে আপারা এসে ঘিরে দাঁড়ায়। বড়ো আপা জিগ্যেস করে, কার চিঠিরে আনু?
সবার দিকে তাকিয়ে মার চেহারাটা যেন হঠাৎ বদলে যায়। দেখতে পায় আনু যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আনু যেন ছোটো হয়ে যায়। মনে হয়, ভীষণ একটা অন্যায় করে ফেলেছে সে। 

মা বললেন, এত যে চ্যাঁচাস একা মামা ছাড়া তোদের আছে কে? বাপ তো জেলে, তাকে এসব দেখতেও হয় না, শুনতেও হয় না। গুষ্টি মরলে দুনিয়ার শান্তি হতো।
চোরের মতো বেরিয়ে আসে আনু। ছিপটা লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। ছিপটা বাইরের ছোট্ট ঘরে আড় হয়ে পড়ে ছিল। পথে এসে প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই টোপের কৌটো ঠেকল। সেটা খুলে সব ফেলে দিলো কচুবনের মধ্যে। বুলুদের বাসার কলের গান বাজছে। সবই যদি এক সঙ্গে আজ মরে যেতে পারত তো মা টের পেতেন মজা। বড়ো আপার ওপর খুব রাগ হলো তার, মাকে কিচ্ছু বলল না দেখে। অন্যদিন বকলে খুব এসে পেছনে ডাকে, আড়ালে নিয়ে যায়। আজ সে চলে এলো, কেউ চোখ তুলে দেখলও না। বুক পকেটে পোস্টকার্ডখানা উঁকি দিচ্ছে। ভাঁজ করে রাখল আনু। তারপর ইস্টিশনে গিয়ে বসলো। বেলা চারটের গাড়ি এসেছে, ইঞ্জিন ব্যাক করছে, পানি নেবে একটু পরে। উলিপুর চিলমারীর বাস এসে পৌঁছুলো। লোকগুলো দৌড়ে দৌড়ে সব টিকেট ঘরের কাছে যাচ্ছে। বুলবুল চানাচুর বিক্রী করছে, বস্তা একআনা, লালমনিরহাট থেকে ভেজে আনে। ভারি চমৎকার। আনু একটা কিনল।  

তিনদিন পরে রাত আটটার গাড়িতে মামা এলেন। সঙ্গে আরো দু’জন। দু'জনেই প্যান্ট-বুশ শার্ট পরা, একজনের হাতে সবসময় সিগারেট, আরেক জনের চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। দু’জনে নিজেরা নিজেরা কী বলে আর হাসে। তার মধ্যে চশমা পরা লোকটা কম হাসে। সিগারেটওলা প্রায় কাতুকুত দেয়ার মতো করে আনুকে বগলে বগলে টানে আর খালি জিগ্যেস করে- তোমার ক’বোন? কোন বোন বেশি আদর করে? কে ভালো গান গায়? কার চুল লম্বা? একটারও জবাব দিতে পারে না আনু। ভীষণ লজ্জা করে তার। লোকটার গায়ে মাখানো সেন্ট, তার গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে আনুর। লোকট নতুন সিগারেট ধরানোর জন্যে হাত ছাড়তেই আনু প্রায় ছুটে পালায়।
মামা আড়ালে ডেকে ধমকান, বেয়াদব ছেলে! মেহমানদের কথার জবাব না দিয়ে উঠে আসে! দারোগার ব্যাটা আর শিখবে কত!

তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে মামা যান রান্নাঘরে। সেখানে রান্নার জোগাড় করছে আপারা। আজ মেহমান বাড়িতে। মা মুরগির খাঁচা থেকে সেই দশটার সময় দুটো বের করে জবেহ করেছেন। পালক ছাড়ানো, দেখতে দুটো কেবল-হওয়া বাচ্চার মতো, শুয়ে আছে গামলায় গরম পানিতে। গরম মশলার খোশবু ছড়িয়েছে। মামা উবু হয়ে বসতেই মা একটা পিড়ি টেনে দিলেন, মাথায় ঘোমটা টানলেন। মামা বললেন, তোমরা একটু যাও।

আপারা উঠে যেতেই অনুচ্চ কণ্ঠে মামা হাত নেড়ে নেড়ে কী বলতে লাগলেন মাকে। আনু বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। একবার ভাবল, কাছে যায়। আবার সংকোচ হলো। বাবা বলেছেন আনুকে পছন্দ করতে। আনু তখন পায়ে পায়ে বাইরের ঘরের দিকে আসে। কিন্তু তার আগেই সেজো আপা, মেজো আপা, ছোটো আপা, সালু আপা, মিনু আপা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। নিজেরা ঠেলাঠেলি করছে। মিনু আপা হাসতে গেছে তার মুখ চেপে ধরলো মেজো আপা।  

শোবার ঘরে এসে দেখে খাটো করে রাখা হারিকেন। বড়ো আপা নামাজের চৌকিতে এক কোনে চুপ করে বসে আছে। তার দু’হাত কোলের ওপর, যেন এখুনি উঠে যাবে। উঠল না। আনুকে দেখে ম্লান হাসলো বড়ো আপা। বড়ো আপা কখনো হাসে না। হাসলে এত সুন্দর লাগে, মনে হয় নতুন মানুষ, ও যেন আনুর বড়ো আপাই না, অন্য কেউ, একেবারে ছবি। 

বড়ো আপা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ হাসে। তখন আনু একটা কথাও না বলে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। একটা হাত টেনে নিলো মুখের ওপর। সুন্দর চেনা চেনা গন্ধ। আনু টের পায়, বড়ো আপা আজ লুকিয়ে মুখে সর মেখেছে। হাতের ভেতরটা ভারি মিষ্টি হয়ে আছে তার। 
পরদিন বড়ো আপাকে দেখল ওরা।

চশমা পরা লোকটা হচ্ছে পাত্র। আনুর খুব অস্বস্তি লাগে। বুলুর বাবা বড়ো আপাকে নিয়ে এসে তার মুখোমুখি বসলেন। আনু বসলো তার আরেক পাশে। ভেতর থেকে এ-বাড়ি ও-বাড়ির সবাই তাকিয়ে রইল। সবাই মিলে আজ বড়ো আপাকে সাজিয়েছে। মার গয়নাগুলো পরিয়েছে। তোলা নীল শাড়িটা থেকে চামেলি আতরের গন্ধ দিচ্ছে। হাতের নোখে ঠিকরে পড়ছে হ্যাজাকের আলো। বুলুর বাবা তার দোকান থেকে একদিনের জন্যে ধার দিয়েছেন হ্যাজাকটা। শুম শুম করছে তার তেল পোড়ার শব্দ। বড়ো আপাকে জমিদারের বউয়ের মতো লাগছে। বুকের মধ্যে দুপ দুপ করছে আনুর। 

মামাই কথা পাড়লেন- মেয়ে দেখতে হবে না কাশেম মিয়া। আমার ভাগনি বলে নয়, এরকম মেয়ে দু’চার জেলায় হয় না। রান্না, সেলাই, নানাম-রোজা, আদব-তমিজ সব কিছুতেই বরাবর কাবেল। ম্যাট্রিক পাশ করেছিল সেকেন্ড ডিভিশনে। এতদিন আমরা বিয়েশাদির কথা- বড়ো মেয়ে, খানদানি পাত্র শিক্ষিত নওশা তো আর হাতের তুড়িতে আসে না।
বলেই মামা অন্দরে চোখ ঠারলেন। শেষে বললেন, সওয়াল করুন, নাশতা-পানি জুড়িয়ে যাচ্ছে। কই আক্কাস কথা কও না?
আক্কাস অর্থাৎ সিগারেট যার সর্বক্ষণ হাতে হেঁ হেঁ করে হাসল। তারপর কোলবালিস টেনে গলা সাফ করে জিগ্যেস করল, আপনার নাম?
ফাতেমা খাতুন।
বড়ো আপা একটুও ভয় পায়নি। গলা একটুও কাঁপল না। কেবল কেমন যেন লজ্জা জড়ানো-তাও ভালো করে ঠাহর হয় না। বড়ো আপাকে এই নিয়ে আট ন’জন দেখে গেল।

একবার এসেছিল একজন, তাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আনুর। রায়বাজারে এক ছোটো দারোগা ছিল, মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে শিস দিত আর হাঁটত বিকেল বেলায়, চিনিচম্পা কলা খেতে খুব ভালোবাসত ঠিক তার মতো দেখতে। সকালের গাড়িতে এসে রাতের গাড়িতেই চলে গিয়েছিল। যাবার সময় আনু সঙ্গে সঙ্গে ইস্টিশান পর্যন্ত গেছে। অন্ধকারে হঠাৎ তাকে দেখে লোকটা ভারি লজ্জা পেয়েছিল। আনু বুঝতে পেরেছিল, তার সঙ্গে কথা বলতে ভারি ইচ্ছে করছে লোকটার। সেও ঘুর ঘুর করছে। কিন্তু কথা হয়নি। লোকটা গিয়ে আর কোনো খবর দেয়নি।

জিজ্ঞাসাবাদ চলল অনেক্ষণ ধরে। মামা বাইরে গেলেন, বুলুর বাবা বাইরে গেলেন, পাত্র কথা বলল বড়ো আপার সঙ্গে। আনু বসে রইল সারাক্ষণ। বুলুর বাবা বাইরে গেলে বড়ো আপা যেন খুব ভয় পেল। ভালো করে কথা বলতে পারল না। নিঃশ্বাস যেন গলার মধ্যে আটকে রইলো। আবার যখন ওরা ফিরে এলেন, বড়ো আপা নড়ে চড়ে বসলো। বড়ো আপাকে নিয়ে ভিতরে এলো আনু। বারান্দায় বুলু খাবার সাজাচ্ছে খানচায়। মা, মেজো আপা, বুলুর মা তুলে তুলে দিচ্ছেন। 

আনুর পছন্দ হয়নি। কিন্তু বলতে পারল না কাউকে। বড়ো আপা শোবার ঘরে গেল। তাকে সঙ্গে যেতে হলো। বড়ো আপা তার আঙুল ধরে আছে শক্ত করে। ঘরে যেতেই সালু আপা, মিনু আপা, ছোটো আপা, সেজো আপা ঘিরে ধরলো। সবার চোখ মুখ দিয়ে খুশি লাফিয়ে পড়ছে। গা টিপছে, হাসছে, ঢলে ঢলে পড়ছে। এমনকি বড়ো আপাকেও খুব খুশি লাগছে, কিন্তু দেখাচ্ছে না। আনু বলতে পারল না কাউকে। আনু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল জানালার শিক ধরে, এক পা ভাঁজ করে আরেক পায়ে ঠেকিয়ে। অনেকক্ষণ বসে থেকে তার পা ধরে গেছে। বড়ো আপাকে বললে যেন এখুনি ডাকবাংলো, নদীর পাড়, চৌধুরীদের দালান, দু’তিন মাইল বেড়িয়ে আসতে পারবে।
রান্নাঘরে আনুকে খেতে দিয়েছিলেন মা। মামা চটি চটপট করতে করতে এসে একটা মোড়া টেনে বসলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে মা জিগ্যেস করলেন, কী বলল ছেলে?
কী বলবে। সব আমার হাতে। পাকা কাজ না হলে আমি হাতই দিই না। তোমরা দু’তিন গন্ডা পাত্র দেখলে, খালি মুরগি পোলাও ধ্বংস।

অপ্রস্তুত হয়ে মা জড়সড় হয়ে বললেন। আনুকে বললেন, আনু আর একটা গোশত দিই?
আনু মাথা নাড়ল। কিন্তু নিলো। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন মামা। পরে গলা নাবিয়ে বললেন, দাবি দাওয়া খুব বেশি। তাই সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে তোমার ভাবিকে দিয়ে কায়দা করতে হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।
মা একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ, এবার মুখ না তুললে আমার আর দিশা নেই ভাইজান।
তুলবে, বুবু তুলবে। আমি সামনের মাসেই তারিখ ফেলব, তুমি সাফ নিশ্চিন্ত থেকো। আনু, যাও তো পান নিয়ে এসো বাবা।

আনু ঢকঢক করে পানি খেল পুরো এক গেলাস। তারপর যেতে যেতে বারান্দার কাছে এসে চোখ ফিরিয়ে দেখল মা আর মামা ফিসফিস করে কি বলছেন। পান সে যতক্ষণ খুশি দেরি করে আনতে পারে, মামা রাগ করবেন না। আনু আর পান আনলো না। আনু গিয়ে রাতের রাস্তায় জোড়া সুপুরি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রইল! তার পছন্দ হয়নি, এ কথা কাউকে বলা যাবে না। তার ইচ্ছে করছে বলতে, কিন্তু তাহলে বড়ো আপা হয়ত মুখটা আঁধার করে ফেলবে। আনু ফিরে এসে দেখল, বড়ো আপা শুয়ে রয়েছে। মাথার কাছে তোলা কাচের জগ আর পাতলা গেলাস চারটে। হয়ত ঘুমের মধ্যে হাত লেগে ভেঙে যাবে। মাথার কাছ থেকে একটা একটা করে সরিয়ে রাখল আনু।
পরদিন ভোরে মামা যাবার আগে বললেন, আনুর মা, তো আমার কী করলে? 
এ-প্রশ্নটার জন্যেই যেন কাল থেকে বুক কাঁপছিল আনুর মার। তিনি চোরের মতো আনুকে একবার দেখলেন। আনু তখন পরম সাহসে তার ছিপ বার করে উঠোনে বসে বসে তেল খাওয়াচ্ছে। সে শুনতে পেল মা বলছে, আমার এ-দুর্দিনে টাকা কোথায় ভাইজান? দারোগা সাহেবের বিপদের পর উপরে আল্লাহ, জানে কী করে দিন যাচ্ছে এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে।

খুব গম্ভীর হয়ে শুনলেন মামা। আনু ছিপটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে আবার ছেড়ে দিলো। চমৎকার তার হয়েছে ছিপটার। পাঁচ সাত সের পর্যন্ত ভাঙবে না।
শেষ অবধি রাহা খরচ দিতে হলো মামাকে। মামা খুব অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন। মার কথার ভালো করে জবাব দিলেন না। যাবার সময় আনুকে একবার বলেও গেলেন না। আনু আর ইস্টিশনে গেল না।
রান্নাঘরে পানি খাবার ছুতো করে এসে আনু দেখল মা সেখানেও নেই। ছাগলের বাচ্চাগুলো তরকারির খোসা চিবোচ্চে। মা কুয়োতলায় বসে হাঁফাচ্ছেন আর গতরাতের সুরুয়া লাগা দস্তরখানা আছড়ে আছড়ে সাবানের ফেনায় সাফ করছেন। মার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা তাকে দেখে লজ্জা পেলেন যেন। কোনোরকমে থুপথাপ করে কাপড় রেখে হাত ধুতে ধুতে নিচু গলায় বললেন, বুলুদের হ্যাজাকটা দিয়ে আসবি?

পনেরো দিন ধরে মুখর হয়ে রইল বাড়ি বড়ো আপার বিয়ের গল্পে। মামা তো বলেই গেছেন, পছন্দ অপছন্দ তার হাতে, সামনের মাসে তারিখ দেখবেনই। মা আবার শেফালির বোঁটাগুলো রোদে বার করে শুকোচ্ছেন। বুলুর বাবাকে টাকা দিয়েছেন ঢাকা থেকে শাড়ি আনতে। বড়ো আপাকে দিয়ে একটা কাজও আর করিয়ে নেন না মা। একটা কিছু করতে এলে হাত থেকে কেড়ে নেন। গাল পেড়ে সামনে যে মেয়েকে পান, বলেন তোরা করিস কী? খালি আড্ডা আর খাওয়া। লেখাপড়া তো মাথায় উঠেছে।
বড়ো আপা এখন রোজ রাতে মুখে সর মাখে। সেদিন গুনগুন করে গানও গাইছিল। পরশুদিন নতুন স্যান্ডেল পরে আনুকে নিয়ে টাউন হলে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল। বাবাকে আনু বলে এসেছে বিয়ের কথা। বাবা জিগ্যেস করেছিলেন, তোর পছন্দ হয়েছে আনু? 

উত্তরে সে মাথা কাত করে জানিয়েছে- হ্যাঁ। বাবাকেও সে বলতে পারেনি। আনুর পছন্দ হয়নি। মা তাহলে খুব কষ্ট পাবে। বড়ো আপা আবার ঘরের সব কাজ করতে শুরু করবে। ময়লা কাপড় পরবে, গোসল করবে সেই বিকেল বেলায়, একদিনও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আর বলবে না আনুকে।
বড়ো আপা চলে যাবে। আনুর খুব খারাপ লাগে। বড়ো আপাকে আরেকদিন নিয়ে যাবে বকশীদের বাড়িতে। বকশীদের মেয়েগুলো ছবির মতো। ওরা একদিন আনুকে বলছিল- তোর দিদির নাকি বিয়ে? একদিন নিয়ে আসবি বেড়াতে?
আনু নিয়েই যেত। বড়ো আপা যেতে চায় না। হাসে আর বলে, ওদের নিয়ে যা। কিন্তু অন্য কোনো আপাকে নিয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না আনুর। তার উৎসাহে যেন পানি পড়ে।
আয়নার মতো নিজেকে দেখা যাচ্ছে নদী থেকে একটু দূরে খালের পানিতে। আনু ছিপ হাতে নিয়ে ভাবে, বেলে মাছ পেলে বড়ো আপা খুব খুশি হতো। বেলে মাছ কি মিষ্টি, নারে? বড়ো আপা বলবে আর খাবে।
ইস্, ইস্। ছিপ ধরে প্রচণ্ড টান দেয় আনু। কয়েকটা পচা পানা এসে ঠেকেছে। একটা দোলা দিয়ে বড়শিটাকে বাঁ হাত দিয়ে কাছে আনে, তারপর পানা ছাড়িয়ে নতুন একটা পোনামাছ গেঁথে টুপ করে আবার পানিতে ফেলে দেয়। ভাসতে ভাসতে ফাৎনাটা স্থির হয়ে আসে। আনু আস্তে আস্তে তখন কাঁধ নামিয়ে দু’হাঁটুর মাঝখানে ছিপটা রেখে বসে। ঝোপের মধ্যে কোথায় একটা পাখি ডাকতে থাকে- তা টুক টুক, তা টুক টুক।

বাবাকে বললেও হতো। বাবাকে বললে, বাবা খুব শক্ত চিঠি লিখে দিতেন মাকে। মিনু আপাটা পড়ে না কেন? আমি বলতে যাবো। আমি বললেও পারতাম বাবাকে। বাবা আমাকে বললেন, তোর মামা টাকা চেয়েছিল নাকি রে? আমি তখন মাথা নেড়ে চোখে মুখে বললাম, না, না। মা যদি মামাকে টাকা দিত, কী বলতাম বাবাকে? আমার একটুও পছন্দ হয়নি। বাবাকে বললেও হতো। বললে, চিঠি লিখে দিতেন। বাবাকে বললাম না কেন?

কোল থেকে থরথর করে নেমে যাচ্ছিল ছিপটা। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে পড়ি-পড়ি করে উঠে দাঁড়াল আমু। দু’তিন পা এগিয়ে একেবারে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আড় করে একবার টানলো। স্রোতের উল্টো দিকে টানছে। কী? আবার একটু ডানদিকে ফেরালো ছিপটা। ছিপ এলো, বড়শি রয়ে গেছে সেখানেই। মাছটা নড়ছে না। চুপ করে দম নিচ্ছে বুঝি। বড়ো কই হবে। না কই না? কই হলে গোঁত্তা মারত হঠাৎ। একবার ডানে, একবার বাঁমে কয়েকবার দুলিয়ে হু-উ-স করে ডাঙায় তুলে ফেলল ছিপ। সঙ্গে সঙ্গে গোঁড়ালির ওপর ঘুরে আকাশ পানে হাঁ করে তাকিয়ে দুলতে দুলতে আনু দেখে রূপোর করনির মতো ফলি মাছটা দাপাচ্ছে, ভাঁজ হচ্ছে আবার সোজা হচ্ছে। পিঠের ওপর আঁটকেছে বড়শি। খানিকটা ছাল শুদ্ধ ধূসর মাংস ছিলে উল্টে গেছে। খুব লেগেছে মাছটার। বড়শিটা গিললে কষ্টই পেতি না। নিচ দিয়ে যাচ্ছিলি কেন? খুব সাবধানে খুলে আনে আনু। নিচ দিয়ে যাবার সময় বাঁকা হয়ে জোরে ভেসে উঠেছিল, তখন গেঁথেছে।

পেট থেকে আতুরি বার করে ছুরিটা পকেটে রাখে আনু। তারপর একটা গর্ত বানায়, গর্তটা আপনা আপনি ভরে ওঠে পানিতে। কতগুলো ঘাস ছিঁড়ে বিছিয়ে মাছটাকে সেখানে শুইয়ে রাখে আনু। একটা বড়ো নৌকা নদী থেকে খাদের মধ্যে ঢোকে-পলাশ বাড়ির হাট আছে কালকে। আরো কয়েকটা নৌকা গেছে।  

একটা বেলে পেলে হতো। ছোট্ট, এই আধ হাত মতো হলেও হয়। বেলে কেউ পছন্দ করে না। কেবল সে আর বড়ো আপা। আবার ছিপ ফেলে আনু। বাবাকে বললেও পারতাম। বাবাকে বললাম না কেন?
বুলু ভাইকে বললেও হতো। বুলু ভাইকে বললাম, আসতে, এলো না। সালু আপার সঙ্গে ক্যারম খেলছে দুপুর থেকে। মা ঘুমিয়ে কিনা, নইলে দিত এক বকুনি। দিতাম যদি মাকে ডেকে। 
অনেকক্ষণ কিছু ওঠে না। ছিপ উঠিয়ে আনে আনু। টোপ বদলায় অনেকক্ষণ ধরে। একটা তাজা পোনা লাগায়। লাগিয়ে আবার ফেলে। ফেলে চুপচাপ বসে থাকে। নৌকাটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
মামাকে যদি টাকা দিতেন মা? ইস, দেবে কি! আমি তাহলে বাবাকে বলে দিতাম। মা একটা বোকা। মা খুব বোকা। মা কিস্সু বোঝে না। বাবাকে বললাম না কেন? আমি একটা বোকা। আমি খুব বোকা। আমি বোকা। শুনলে, বাবা রাগ করবেন। বাবাকে বললাম না কেন?
আস্তে আস্তে বেলা পড়তে থাকে। পেছনে বাজপড়া তাল গাছটায় কাক বসে আছে। কা কা করছে। একটা ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে ছিপ নড়ে গেল। যাক্গে। আমি খুব বোকা। কাকটা উড়ে গেল।

বাবাকে বলব। আবার যখন দেখতে যাবো বাবাকে, বলব। বলব, আমার পছন্দ হয়নি। বলব, মামা টাকা চেয়েছিল। আমি খুব চ্যাঁচামেচি করেছিলাম কিনা, তাই মা টাকা দেয়নি। আমি অমন না করলে, দিত টাকা মামাকে। মামা সব টাকা নিয়ে যেত। বাবাকে বলব। আমি ভারি বোকা। বাবাকে সব বলব। আবার যখন দেখা করতে যাবো, প্রথমেই বলব। 

ছিপ তুলে আনে আনু। পশ্চিম দিকে আকাশ লাল হয়ে এসেছে। মা এতক্ষণে উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ওজু করতে বসেছেন। ছোটো আপারা বেণি করছে বারান্দায় বসে বসে। বড়ো আপার জন্যে বেলে মাছ একটা পেলে হতো? বেলে মাছের জন্যে কাল পুলের নিচে যাবে আনু। সেখানে একবার দশটা পেয়েছিল আনু। সেখানে একবার বেলে পেয়েছিল আনু, সেখানে কাল যাবে আনু। পকেট থেকে সুতো বের করে ফলি মাছটার ঠোঁটে গেঁথে হাতে ঝুলিয়ে নিলো সে। আরেক হাতে কাঁধের পরে ফেলল ছিপটাকে। খালের পানি সুন্দর কুলকুল করছে। যেন যেতে দিতে চায় না। আজ রেল লাইন ধরে ধরে বাসায় যাবে আনু। হোক সন্ধ্যে মা বকুক। মা কী জানে? মা কিসসু জানে না। মা একটা বোকা। মা খুব বোকা। মা যদি বোকা না হতো, আনু একটুও দুঃখ পেত না।

আনু বাসার উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ছিপটাকে বারান্দায় রাখে ঠেস দিয়ে। মা নামাজ পড়ছেন। মাছটা দেয় সেজো আপার হাতে। ওরা অবাক হয় এতবড়ো মাছ দেখে। আনু একটুও হয় না। আনু হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে। নামাজ থেকে উঠে এসে মাছ দেখে মা তাকে বকুক না! সে মন খারাপ করবে না, শুয়ে পড়বে না, ইস্টিশনে যাবে না, রাস্তায় গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে না। আনু এখন পড়বে। আনু পড়তে শুরু করে। আনু বই নিয়ে পড়তে শুরু করে। আনু ইংরেজি বই থেকে দাগানো শব্দগুলোর মানে মুখস্থ করে মনে মনে। ছ’মাস থেকে কিসসু পড়া হয়নি।
যেন আজ নিজেও জানে, আনু বড়ো হয়ে গেছে।

উৎস : পরিক্রম ॥ ২য় বর্ষ : ২য় সংখ্যা ॥ আশ্বিন : ১৩৬৯, অক্টোবর : ১৯৬২
সম্পাদক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম।  

ভূমিকা 

সৈয়দ শামসুল হক (২৭শে ডিসেম্বর ১৯৩৫-১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৬) ৬ দশকের অধিককাল ধরে লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ের নানান রচনা। কবিতা, কথাকাব্য, কাব্যনাটক, গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ রচনা, চলচ্চিত্রের কাহিনি, গান, আত্মজৈবনিক রচনা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ মিলিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখির পরিমাণ বিপুল। তাঁর রচিত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২ শতাধিক। 

কবিতা দিয়ে লেখালেখির সূচনা হলেও প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘উদয়াস্ত’ শীর্ষক একটি গল্প। ফজলে লোহানী (১৯২৮-১৯৮৫) সম্পাদিত ‘অগত্য’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে গল্পটি প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে আমৃত্যু তিনি বিরামহীনভাবে লিখে গেছেন এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও গ্রন্থাকারে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। 

সম্প্রতি ৩৫ খণ্ডে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও অনুসন্ধ্যানে সৈয়দ শামসুল হকের অগ্রন্থিত রচনার সন্ধান মিলছে। তেমনই এক অগ্রন্থিত রচনা ‘আনুর গল্প’। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘পরিক্রম [লেখক সংঘ পত্রিকা একত্রীভূত]’ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ : দ্বিতীয় সংখ্যায়; আশ্বিন ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ/ আক্টোবর ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে। 

‘আনু’ সৈয়দ শামসুল হকের সৃষ্টি এক অনবদ্য শিশুতোষ চরিত্র। আনুকে কেন্দ্র করে তিনি বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন; আলাদা বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘আনু বড় হয়’ শীর্ষক বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘বাবার সঙ্গে যাওয়া ও অন্যান্য কিশোর গল্প’ শীর্ষক গ্রন্থে ‘পড়ুয়া’, বাবার সাথে যাওয়া ও বদলি শিরোনামে ‘আনু’ সিরিজের তিনটি গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

ছয় দশকের অধিক সময় পূর্বে প্রকাশিত আনুর গল্প-তে সে সময়ের বাস্তবতায় যে সমাজচিত্র লেখক অঙ্কন করেছেন দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তার কতটুকু পরিবর্তন ঘটেছে? গল্পটি পড়ে পাঠক নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করবেন। 

সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আনুর গল্প পুনরায় পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। এখানে ছাপার সময় বর্তমানে প্রচলিত বানান রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।   
 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়