ভালোবাসা এবং কাহলিল জিব্রানের ৫ কবিতা
অনুবাদ : মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম
![ভালোবাসা এবং কাহলিল জিব্রানের ৫ কবিতা ভালোবাসা এবং কাহলিল জিব্রানের ৫ কবিতা](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2023December/1111111-2401061025.jpg)
কাহলিল জিব্রান, ‘প্রোফেট’ থেকে চিত্রিত
আজ থেকে ১০১ বছর আগে যখন জিব্রানের ‘প্রোফেট’ (১৯২৩) প্রকাশিত হয় তখন বিশ্ব কবিতায় দুটো ঘটনা ঘটে। প্রথমত বোঝা যায় বিশ্ব কবিতায় তথা বিশ্বসাহিত্যে এক মরমী, সুফি, আধুনিক এবং দার্শনিক কবির আবির্ভাব হয়েছে, যে আবির্ভাব নবীর আবির্ভাবের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত আরব বিশ্বের, লেবাননের একজন বিস্ময়কর কবি, চিত্রকর ও দার্শনিক বিশ্ব মানচিত্রে নিজের দেশ ও ভাষার জনগোষ্ঠীকে কবিতা দিয়েই প্রতিষ্ঠিত করেন। আর এ সবই সম্ভব হয় কোনো প্রতিবাদ, ম্যানিফেস্টো কিংবা আন্দোলন ছাড়াই। একান্ত নীরবে, জিব্রান তার দিকে পাঠককে, শ্রোতাকে টেনে আনেন তীব্র ভালোবাসায়। মানুষকে ভালোবাসতে শেখান জিব্রান।
আজ ৬ জানুয়ারি কবি, চিত্রশিল্পী জিব্রান কাহলিল জিব্রানের (১৮৮৩-১৯৩১) জন্মদিন। তাকে স্মরণ করা যায় ভালোবাসা বুকে নিয়েই। কবিতার সঙ্গে, কবির সঙ্গে সবচেয়ে বড় লেনদেন তো ভালোবাসারই। তাই আজ পাঠ করা যেতে পারে জিব্রানের ভালোবাসার কবিতা।
জিব্রান লেবাননের কবি হলেও, পরিবারের সঙ্গে অল্প বয়সেই আমেরিকায় অভিবাসী হন। তিনি তরুণ বয়স থেকেই ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই লেখা শুরু করেন। আরব ভাষায় তিনি এক সূক্ষ্ম প্রতিবাদ। আরবি কবিতার ঐতিহ্যবাহী ঘরাণা ভেঙে তিনি গদ্য কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু ফর্মের ক্ষেত্রে ঘরাণা ভাঙলেও আরবী সাহিত্যের মরমীবাদ, সুফিবাদ তাঁর কবিতায় প্রকট। তাই তাকে আরব সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি হিসাবে গণ্য করা হয়।
তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘প্রোফেট’ ইংরেজি এবং আরবী উভয় ভাষীদের কাছেই অত্যন্ত আদরণীয়। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় দার্শনিক ও অনুপ্রেরণাদায়ক ঘরাণার সাহিত্যচর্চায় নতুন জোয়ার আনে। রুমি, শেকসপিয়র এবং লাউৎসের পর জিব্রানই হলেন সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রয় সফল কবি।
ভালোবাসা ও ঘৃণা
এক নারী বললো এক পুরুষকে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
আর পুরুষটি বললো, ‘আমার হৃদয় তোমার ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত।’
এবং নারীটি বলেছিল, ‘তুমি আমায় ভালোবাসো না?’
এবং পুরুষটি কেবল তার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং বলেনি কিছুই।
তখন নারীটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি।’
এবং পুরুষটি বলেছিল, ‘তবে আমার হৃদয় তোমার ঘৃণা পাওয়ারও উপযুক্ত।’
ভালোবাসা
তারা বলে শেয়াল আর ছুঁচো
ঠিক একই স্রোত থেকে পান করে
যেখানে সিংহও পান করতে আসে জল।
আর তারা বলে ঈগল আর শকুন
তাদের চঞ্চু ডোবায় একই শবদেহে,
আর শান্তিতে থাকে, একে অপরের সাথে,
মৃত বস্তুর উপস্থিতিতে।
ও ভালোবাসা, যার ঐশ্বরিক হাত
আমার আকাঙ্খায় বাঁধা দিয়েছে,
আর আমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণাকে দিয়েছে বাড়িয়ে
মর্যাদা আর গৌরবে,
আমার ভেতরে যে দৃঢ় আমি আর অবিচল সে যেন থাকে
রুটি খেয়ে না ফেলে কিংবা সুরা পান না করে ফেলে
যা আমার দুর্বলতর আমিকে প্রলুব্ধ করে।
তারচেয়ে বরং আমাকে অনাহারে মরতে দাও
আর আমার হৃদয় ঝলসে যেতে দাও তৃষ্ণায়,
আর আমাকে মরতে দাও আর শেষ হয়ে যেতে দাও,
আগেই আমি প্রসারিত করলাম আমার হাত
সেই পেয়ালার প্রতি যা তুমি পূর্ণ করোনি
কিংবা সেই পাত্রের প্রতি যা তুমি আশীর্বাদপুষ্ট করোনি।
ভালোবাসা এক যাদু রশ্মি
ভালোবাসা এক যাদু রশ্মি
উত্থিত হয় জ্বলন্ত অন্তঃস্থল থেকে
আত্মার
আর আলোকিত করে
চারপাশের মাটিকে।
সে আমাদের সক্ষম করে
জীবন উপলব্ধি করতে
একটা সুন্দর স্বপ্নের মতো করে
একটা জাগরণ থেকে
আর একটা জাগরণের মাঝখানে।
ভালোবাসার গান
একজন কবি একবার একটি ভালোবাসার গান লিখলেন আর সেটা ছিল সুন্দর। আর তিনি এর অনেকগুলো অনুলিপি করলেন, এবং তার বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের প্রতি পাঠালেন, নারী ও পুরুষ উভয়কে, আর এমনকি সেই তরুণীর কাছেও পাঠালেন যাকে তিনি মাত্র একবার দেখেছিলেন, যে থাকে পাহাড়ের ওপারে।
আর একদিন বা দুইদিন পর একজন বার্তাবাহক সেই নারীর কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এলো। আর সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে নিশ্চিত করে বলতে দিন, আপনার ভালোবাসার গান আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে যা আমার প্রতি আপনি লিখেছেন। আপনি এখন আসুন, আমার বাবা-মা’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন এবং আমাদের বাগদানের ব্যবস্থা করুন।’
আর কবি উত্তর দিলেন সেই চিঠির এবং তাকে বললেন, ‘বন্ধু আমার, এ কেবলই একটি ভালোবাসার গান একজন কবির হৃদয় থেকে উত্থিত যা যে কোনো পুরুষ যে কোনো নারীর জন্য গাইতে পারে।’
আর নারীটি আবার তাকে লিখলেন, ‘ভণ্ড আর মিথ্যুক শব্দের চয়নকারী! আজ থেকে আমার মৃত্যু পর্যন্ত আমি নিশ্চয়ই সকল কবিকে ঘৃণা করে যাবো তোমার কারণেই।’
প্রেমের গান
আমি প্রেমিকের চোখ, আর মদের আত্মা
আর হৃদয়ের পুষ্টি।
আমি একটা গোলাপ।
আমার হৃদয় ভোরবেলা উন্মোচিত হয় আর কুমারী আমাকে চুমু খায় আর আমাকে ধারণ করে তার বক্ষে।
আমি সত্যিকারের ভবিষ্যতের বাড়ি, আর আনন্দের মৌলসূত্র,
আর শান্তি ও প্রশান্তির সূচনা আমি।
আমি তার ঠোঁটের সৌন্দর্যে মধুর হাসি,
যখন তরুণেরা আমার পেছনে ছোটে তারা পরিশ্রম ভুলে যায়,
আর তারা পুরো জীবনটা সত্য থেকে মিষ্টি স্বপ্নে পরিণত হয়।
আমি কবির উল্লাস,
আর শিল্পীর প্রতি প্রতিভাস,
আর সুরকারের অনুপ্রেরণা।
আমি এক শিশুর হৃদয়ে পবিত্র মন্দির,
একজন সদয় মাতার আরাধ্য।
আমি হৃদয়ের কান্নায় আবির্ভূত হই; আমি চাহিদা পরিহার করি;
আমার পূর্ণতা হৃদয়ের আকাঙ্খাকে অনুসরণ করে;
সে পরিহার করে কণ্ঠের অসার দাবীকে।
আমি আদমের কাছে আবির্ভূত হয়েছি ঈভের মাধ্যমে
আর নির্বাসন তার নিয়তি ছিল;
তবু আমি নিজেকে প্রকাশ করেছিলাম সোলোমনের কাছে আর তিনি আমার উপস্থিতি থেকে প্রজ্ঞাকে খুঁজে নিয়েছিলেন।
আমি হেলেনের পানে হেসেছিলাম আর সে ধ্বংস করেছিল ট্রয়;
তবুও আমি ক্লিওপেট্রাকে রানী অভিষিক্ত করেছিলাম আর শান্তি বয়ে ছিল নীল নদের উপত্যকায়।
আমি মহাকালের মতো- আজকের দিন গড়ি আর
কালকের দিনে ভেঙে ফেলি;
আমি ঈশ্বরের মতো, যে সৃষ্টি করে এবং ধ্বংসও করে;
আমি ভায়োলেট ফুলের দীর্ঘশ্বাসের মতো মিষ্টি;
আমি ত্রুদ্ধ ঝড়ের চেয়েও নিষ্ঠুর।
কেবল উপহার আমাকে প্রলুব্ধ করে না;
বিচ্ছেদ আমাকে নিরুৎসাহিত করে না;
দারিদ্র্য আমাকে তাড়া করে না;
ঈর্ষা আমার সচেতনতার প্রমাণ নয়;
পাগলামি আমার উপস্থিতির প্রমাণ নয়;
ওহে অনুসন্ধানকারী, আমি সত্য, সত্যের অনুনয়;
আর তোমার সত্য হলো অনুসন্ধান এবং গ্রহণ করতে পারা
আর আমাকে রক্ষা করলে আমার আচরণ নির্ধারণ করতে পারবে।
তারা//
আরো পড়ুন