ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

উর্দুকে ভিলেনের রূপ দেয়া হয়েছে : হাইকেল হাশমী

ফাইরুজ সাইয়ারা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ২০:৫৯, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪
উর্দুকে ভিলেনের রূপ দেয়া হয়েছে : হাইকেল হাশমী

পুরো নাম মোহাম্মাদ মোস্তাফা হাইকেল হাশমী। বর্তমানে ব্যাংক এশিয়ার ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সাহিত্য মহলে ‘হাইকেল হাশমী’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। মূলত কবিতা লিখলেও গল্প এবং অনুবাদ করে সুনাম কুড়িয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক। বিশেষ করে উর্দু সাহিত্যে তার দখল রয়েছে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন উর্দু সাহিত্য নিয়ে। কেমন সে অভিজ্ঞতা? জানতে হাইকেল হাশমীর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাইরুজ সাইয়ারা।    

ফাইরুজ সাইয়ারা : বাংলা, উর্দু, ইংরেজি— তিন ভাষায় অনুবাদ ও সাহিত্যচর্চা করছেন। কোন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে বেশি স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন?

হাইকেল হাশমী : আমার আসলে কোনো প্রেফারেন্স নেই। যেমন ধরো, উর্দু কখনোই আমার একাডেমিক ভাষা ছিল না। স্কুল, কলেজে কোথাও পড়তে হয়নি। বাংলা আমাকে একাডেমিকেলি পড়তে হয়েছে। তবে আমি সবচেয়ে সহজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি ইংরেজিতে। কিন্তু বাংলা বা উর্দুর প্রতি যে টান তা আসলে খুব ন্যাচারালি আমার ভেতর থেকে আসে। আবার আমার মনে হয়, কিছু কিছু ভাষায় কিছু স্পেসিফিক জিনিস সহজে বলা যায়। যেমন ধরো, গজল লিখতে হলে উর্দুতে লিখতে হবে, বাংলায় লিখলে অত পাওয়ারফুল হবে না। আবার কবিতা লিখতে গেলে যার মাঝে ভাব, বিভব, প্রেম, দ্রোহ ইত্যাদি আছে তার জন্য বাংলা সবচেয়ে সুন্দর। আবার একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ওয়ার্ড লিখতে গেলে ইংলিশ সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। তাই সব মিক্স করেই আমি লিখি। বলতে পারো সবগুলো ভাষা মিলিয়ে তৈরি আমার কাব্যসত্তা।

আবার অনেক কিছু পড়তে হয়। যেমন আমি যদি রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজিতে পড়ি তাহলে তো আমি ওই মজাটা পাবো না। আবার আমি যদি রুমীকে পার্সিয়ানে পড়তে পারি তাহলে সেটা ভালো। আবার বুল্লে শাহকে যদি পাঞ্জাবিতে না পড়ে বাংলায় পড়া হয় তাহলে মূলভাব বোঝা যায় না। আসলে এই আত্মার তৃপ্তি পাওয়ার জন্য আমি অনেকগুলো ভাষা রপ্ত করেছি। যেমন পার্সিয়ান, পাঞ্জাবি, হিন্দি। আবার ইতালির মিলানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং ও ফাইনান্স পড়ার সুবাদে এবং ফ্রান্সে থাকার অভিজ্ঞতার কারণে আমি ইতালিয় ও ফ্রেঞ্চ বুঝতে পারি। ফলে এখন দেখা যায় আমি বাংলাতেও লিখি, ইংলিশেও লিখি। আমার পার্টিকুলার কোনো প্রেফারেন্স নেই। 

ফাইরুজ সাইয়ারা : উর্দু সাহিত্যের প্রতি বাংলাদেশি পাঠক ও প্রকাশকদের কেমন মনোভাব দেখতে পান? এর পেছনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কতটুকু ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন? 

হাইকেল হাশমী : ১৯৫২ সালে জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্টেটমেন্ট দেয়ার পর মানুষের মাঝে ধারণা তৈরি হয় যে, উর্দু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শত্রু। উর্দুকে আসলে ভিলেনের রূপ দেয়া হয়েছে। কিন্তু মজার কথা হলো যারা উর্দু নিয়ে বলেছিলেন যেমন মিস্টার জিন্নাহ, তিনি বলেছেন ‘Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan.’ কিন্তু তার মাতৃভাষা কিন্তু উর্দু ছিল না। তিনি গুজরাতি ছিলেন। এবং আমার মনে হয় যে উর্দু কোনো একটা নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। যেমন বাংলাদেশে বাংলা বলা হয়, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, বালুচিস্তানে বালুচ, কিন্তু উর্দুস্তান বলে কোনো জায়গা নেই। এটা আসলে সব জায়গায় একটা কন্সপিরেসির স্বীকার হয়েছে। ইন্ডিয়াতে হিন্দি, উর্দু নিয়ে মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। ওরা মনে করে উর্দু হলো মুসলিমদের ভাষা আর হিন্দি হলো হিন্দুদের ভাষা। কিন্তু রাস্তায় যখন তুমি বলবে ‘আপকা নাম কিয়া হ্যায়?’ এটা হিন্দিতেও যা, উর্দুতেও তা। কোনো তফাৎ নেই। 

আমার বাবা বিখ্যাত কবি নওশাদ নূরির একটা কবিতা আছে ‘মোহেনজোদারো’ যেটা লেখা হয়েছিল বাঙালির ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করে। ওই কবিতার জন্য উনি চাকরিও হারিয়েছেন। এরকম অনেক লোক ছিল যারা উর্দুভাষি কিন্তু বাংলাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং জেলে গিয়েছেন। তবে এখন যখন আমি বলি যে আমি উর্দু জানি বা লিখি তখন অন্যান্য সাহিত্যের মতো উর্দুকেও একটা সাহিত্য হিসেবে মানুষের মাঝে আমি গ্রহণযোগ্য দেখতে পাই। 

ফাইরুজ সাইয়ারা : এ দেশের সাহিত্য সম্মেলন, বইমেলা বা সাংস্কৃতিক আয়োজনগুলোতে উর্দুভাষী লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন না। বা কোনো বৈষম্যের শিকার হন কিনা? 

হাইকেল হাশমী : সবচেয়ে বড় কথা উর্দু ভাষার এখানে পরিচিত বা বিখ্যাত কোনো লেখক নেই। যেমন আমার বাবা মারা গিয়েছেন, সম্প্রতি আহম্মেদ ইলিয়াস মারা গিয়েছেন। তো এখন আর তেমন কেউ নেই। আর লিখবেই বা কেনো বলো? উর্দু তো কেউ শিখছে না। এটার কোনো এপ্লিকেশান এ দেশে নেই। যদি এই ভাষা শিখে উপার্জন করবার বা জীবিকা নির্বাহ সম্ভব না হয় তাহলে তা কে শিখবে? তাই আমাদের কাছে স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ শেখা যেরকম, এখন উর্দু শেখাটাও ওরকম হয়ে গিয়েছে। মানে প্রয়োজন নয়, মনের তাগিদে ভাষাটা শেখে কেউ কেউ। এমনকি বিহারিদের ক্যাম্পেও ওরা বাংলা শিখছে এখন। 

ফাইরুজ সাইয়ারা : বিহারি-বাংলাদেশী ডায়াসপোরা সাহিত্যে কিছুটা উপস্থিত থাকলেও চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের গল্প আমরা সেভাবে দেখতে পাই না। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

হাইকেল হাশমী :  আসলে বিহারি ডায়াসপোরার পপুলেশান সাইজটাই তো ছোট। তিন, সাড়ে তিন লাখের মতো। বিশ কোটি মানুষের মধ্যে এটা আসলে খুব ছোট পার্সেন্টেজ। তাই তাদের ইম্প্যাক্টটাও আসলে ছোটই হবে। আর তারা যখন ক্যাম্পে থাকছে তখন তাদের কাছে সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলোও পৌঁছাচ্ছে না। এত ছোট কম্যুনিটি, আমার তো মনে হয় ঢাকা শহরে জেনেভা ক্যাম্প না থাকলে বিহারিদের অস্তিত্বই মানুষ ভুলে যাবে। আলটিমেটলি তারা আসলে মেইনস্ট্রিম পপুলেশানের সাথে এমালগেমেটেড হয়ে যাবে। তাদের বর্তমান আইডেন্টিটিও আসলে থাকবে না। তুমি তো জানো সব নদী শেষ পর্যন্ত সমুদ্রেই মেশে।

আমি আমার নিজেকে শেষ প্রজন্ম হিসেবে দেখি যে উর্দু লিখতে এবং বলতে জানে। আমার উর্দু ও আসলে কতটুকু ঠিক তা আমি জানি না। কারণ আমার কোনো একাডেমিক শিক্ষা নেই। এখন উর্দু পড়ানো হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। যেখানে অধিকাংশ ছাত্র আসছে মাদ্রাসা থেকে। তবে সারাজীবন উর্দু না শিখে যদি তুমি গ্র্যাজুয়েশানে এসে উর্দুতে হাতেখড়ি নাও তাহলে তুমি কীভাবে গালিব পড়বে! গালিবও তোমাকে বাংলাতেই পড়তে হবে। 

ফাইরুজ সাইয়ারা : নতুন প্রজন্মের উর্দুভাষী শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলায় লেখাপড়া করছে। ঘরের বাইরে তাদের উর্দু চর্চার সুযোগ আসলে কতটুকু? এতে করে কি ভবিষ্যতে বাংলাদেশী উর্দুভাষী কম্যুনিটি এবং সাহিত্যের পরিসর আরো ছোট হয়ে আসার আশঙ্কা রয়েছে?

হাইকেল হাশমী : অবশ্যই ছোট হবে। আমি যদি আমার কথা বলি, আমার বাবা-মা দুজনই বিহারি ছিলেন। আমার সন্তানেরা কিন্তু উর্দু জানে না। তারা হয়তো বোঝে, কিন্তু বলতে বা লিখতে পারে না। ক্যাম্পে যারা থাকে তাদেরও তো একই অবস্থা। একটা ব্যাপার বুঝতে হবে যে বিহারিদের প্রকৃত ভাষা কিন্তু উর্দু না।  তারা বলতো মেথলি অথবা ভোজপুরি। উর্দু ছিলো ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা’। একে অন্যের সাথে কথা বলার সময় কমন ডায়ালেক্ট হিসেবে উর্দু ব্যবহার করতেন। এমনকি আমার বাবা-মাও কিন্তু উর্দু বলতেন না। তারা  মৈথালি বলতেন। 

ফাইরুজ সাইয়ারা : প্রয়াত কবি নওশাদ নূরির পুত্র হবার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে আপনার কাছের মানুষদের ভূমিকা, দেশপ্রেম, প্রতিবাদ আপনি যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন, তার সাথে মিডিয়ায় প্রচারিত উর্দুভাষী বাংলাদেশীর স্বদেশচিন্তা কতটুকু আলাদা? 

হাইকেল হাশমী :  মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার বয়স ছিল ১১। এখন আমি ৬২ বা ৬৩ তে। মুক্তিযুদ্ধকালে যে বিহারি প্রজন্ম ছিল তাদের কেউ আসলে এখন বেঁচে নেই ওসব ফেইস করার জন্য। কিন্তু এটা আসলে আমরাও ফেইস করেছি। এই স্টেরিওটাইপ শুরু করেছিল পাকিস্তানিরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে ৪৭-এর দেশভাগের ইতিহাস বিকৃত করার লক্ষে। তারা ব্রেইনওয়াশড ছিল এটা ভেবে যে, তারা তাদের ঘর ও পরিবার পাকিস্তান গড়ার জন্য ত্যাগ করেছে। কিন্তু এখন ওটা পার পেয়ে চলে এসেছি। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। 

আরেকটা ট্র্যাজেডি হচ্ছে যে, বিহারি ডায়াসপোরার মাঝে কোনো নেতৃত্ব নেই। সত্যি বলতে বিহারিরা তো প্রথম থেকেই টার্গেটেড ছিল। তারা ছিল বাংলার চেনা শত্রু। কিন্তু তুমি নতুন প্রজন্মের বিহারি ছেলে মেয়েদের মাঝে বেশিরভাগকে পাবে যে তারা বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করে ও ভালোবাসে। শুধু কুর্তা পাজামা আর টুপি পরিয়ে, আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দু বলিয়ে সিনেমা তৈরি করলে ওদের আসল চিন্তা ভাবনা বা জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে না।  

ফাইরুজ সাইয়ারা : ইতোমধ্যে আপনি ৬টি অনুবাদ বই প্রকাশ করেছেন যার মাঝে আছে দুই খণ্ডের ‘বাংলাদেরশের উর্দু ছোট গল্প’ এবং ‘উপমহাদেশের ছোট গল্প’। আরও আছে সাদাত হোসেন মান্টো এবং মুহাম্মাদ জামিল আখতারের গল্পের অনুবাদ সংকলন। আপনার কবিতার সংকলনের ৫টি বই বের হয়েছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ কে সামনে রেখে কিছু লিখেছেন? 

হাইকেল হাশমী :  হ্যাঁ। আমি গুলজারের ছোটগল্পের অনুবাদ করছি। যেটা এবার আসবে। আর একজন কবি আছেন ওবায়েদ আকাশ। তার কবিতার একটা সংকলন আসবে ইংরেজিতে। তাছাড়া আমার নিজের মৌলিক ছোটগল্পের একটা সংকলনের কাজ চলছে।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়