ভুরুঙ্গামারির বইমেলা
তুমুল উত্তেজনায় প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছিল ‘খোলা জানালা’। দৈনিক ‘মুক্তকণ্ঠ’র সাহিত্য সাময়িকী ‘খোলা জানালা’ ছিল আট পৃষ্ঠার; দুই পৃষ্ঠা রঙিন। ১৯৮৯-৯৯ সালের বাস্তবতায় এটা নিঃসন্দেহে দারুণ ব্যাপার! এখনকার দৈনিকে সাহিত্য সাময়িকীর জন্য এক পৃষ্ঠা-দেড় পৃষ্ঠা বরাদ্দ হতে দেখছি। আমাদের সেই ‘খোলা জানালা’র কার্যনির্বাহী প্রধান ছিলেন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, সঙ্গে সংযুক্ত শহীদুল ইসলাম রিপন ও আমি। গল্প-কবিতা-শিল্পকলার আর্টিকেল, বই সমালোচনা বা কত কিছুই না দিয়ে প্রতি সপ্তাহে আট পৃষ্ঠা ভরাট করতে হতো আমাদের!
যাই হোক, তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে গরুর ওপরে বিশেষজ্ঞ হয়ে সদ্য দেশে ফিরেছেন তরুণ লেখক অমল সাহা। তিনি চাকরিতে ঢুকেছেন সাভারে, জাতীয় পশুপালন খামারে। এক সংখ্যা ‘খোলা জানালা’য় অমল সাহা একটি বইয়ের সমালোচনা লিখলেন; বইটির নাম ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। বইয়ের লেখক তখনো জীবিত, তিনি সোহরাওয়ার্দীতে প্রায় প্রতিদিন বিকালে বাইসাইকেল চালান কিম্বা ফুলার রোড থেকে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি-চারুকলা-পাবলিক লাইব্রেরি-জাদুঘরের সামনে দিয়ে যান, শাহবাগ বিপণি বিতানের রেস্টুরেন্ট মৌলী-সিলভানা-সিনোরিটাতে বসে তরুণদের সঙ্গে আড্ডা দেন, যান আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকান প্যাপিরাসে- তিনি হুমায়ুন আজাদ। তো আমাদের নির্মাণ করা ‘খোলা জানালা’য় হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থের সমালোচনা ছাপা হলো। এ দেশের গ্রন্থ সমালোচনাতে যা থাকে সাধারণত, অধিক প্রশংসা ও ছিটেফোঁটা নিন্দে করার চেষ্টা, অমল সাহার সেই লেখাতেও তাই ছিল। হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘রাজনীতিবিদগণ’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল ‘খোলা জানালা’য়। কারওয়ানবাজারের দৈনিক ‘মুক্তকণ্ঠ’ অফিস থেকে আমি ফুলার রোডে যেতাম উপন্যাসের হাতে লেখা কিস্তি আনতে, কখনো লেখার পারিশ্রমিকের চেক নিয়ে যেতাম।
ব্যাবলনীয় সভ্যতার পর আজিজ মার্কেটে যে শাহবাগীয় সভ্যতার পত্তন হয়, আমি নিজেই সেই পত্তনকারীদের একজন। কাজেই, সারাদিন চাকরিতে যেখানেই থাকি না কেন, তখনকার সে সব দিনের শেষে সন্ধ্যায় আমরা শাহবাগে যেতামই। অমল সাহার লেখা হুমায়ুন আজাদের বইটির সমালোচনা ছাপা হওয়ার পরদিন বা তারপরের দিন সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে দেখা হলো হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে। আমি তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতাম। স্যার আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলেন, ‘এই, এই অমল সাহাটা কে?’
আমি বুঝতে পারলাম, ছাপানো সমালোচনা নিয়েই হয়তো তিনি কথা বলবেন। বললাম, ‘স্যার অমল সাহা পশুবিজ্ঞানী। তরুণ লেখক, সাভারে আছেন।’
হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘ও তো একটা পশু, পশু আবার বিজ্ঞানী হয় নাকি? ও তো আমার লেখা বুঝতেই পারেনি।’
আমি হুমায়ুন আজাদ স্যারের মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছি আবার ‘খোলা জানালা’র পক্ষে তো একটা অবস্থান নিতে হবে, সেদিকে সচেষ্ট থাকছি। তাই বললাম, ‘স্যার, অমল সাহা অস্ট্রেলিয়া থেকে গবেষণা করে এসেছেন।
’হুমায়ুন আজাদ এবার বললেন, ‘অ্যাঁ, তাই! তাহলে অস্ট্রেলিয়ার কোনও ভুরুঙ্গামারিতে বসে গবেষণা করেছে, ও আমার লেখা কীভাবে ধরবে?’
হুমায়ুন আজাদ স্যার বেঁচে নেই আর। এখনো আমার মাঝেমধ্যে মনে পড়ে, ‘অস্ট্রেলিয়াতেও কোনও ভুরুঙ্গামারি আছে, হয়তো পৃথিবীর সব দেশেই কোথাও একতা করে ভুরুঙ্গামারি আছে। ভুরুঙ্গামারি এমন যেখানে কেউ যেতে চায় না। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় অবস্থিত প্রকৃত ভুরুঙ্গামারিতে আমি আজও যাইনি, ইচ্ছা আছে যাব। না গেলেও বুঝতে পারি, ভুরুঙ্গামারি এমন কোনও জায়গা, যেখানে নাগরিকতা এখনো ঠিকঠাক পৌঁছয়নি, সুযোগ-সুবিধা কম, অর্থাৎ বেড়াতে যাওয়া আকর্ষণীয় জায়গার তালিকায় এই নাম- ভুরুঙ্গামারি কখনো কেউ লিখবে না। ভুরুঙ্গামারিতে কি আলো পৌঁছয়নি? কি জানি!
ঢাকার বইমেলা, অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢুকে আমার আবার ভুরুঙ্গামারির কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে বইমেলার স্টল-প্যাভিলিয়ন দেখতে দেখতে আমি ঢাকা থেকে ভুরুঙ্গামারি চলে যাই। কীভাবে যাই? বলি। যতদিন বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণে বইমেলা হতো, ততদিন ভুরুঙ্গামারির কথা আমার মনে আসেনি। এখন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা আয়োজনের পর থেকেই দেখতে পাই, প্রতিবছরই পুনরাবৃত্তির এই দৃশ্য। এমন ভাবে মেলার স্টল-প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ হয়, দেখা যায়, মেলার কোনও কোনও জোন একেবারে ঝিকঝাক শাহবাগ বা লেকবেষ্টিত ধানমন্ডি, সুন্দর, প্রয়োজনীয় পরিসর আছে এসব এলাকায়। বই কিনুক আর না কিনুক, মেলায় আগত পাঠক-দর্শক এ সব এলাকায় যাবেই যাবে।
আবার স্টল থাকে এমন কিছু জোনে, সেই জোন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের ওপারের অঞ্চল, পাঠক-দর্শক হয়তো সেদিকে একবার তাকায়, মনে মনে ভাবে, ওদিকে না গেলেও তার চলবে। মেলার অংশ হয়েও মূল মেলা থেকে কিছু জোন বিচ্ছিন্ন মনে হয়। আমার মনে হওয়া দিয়ে যায় আসে না, কিন্তু সেই বিচ্ছিন্ন জোনে যায় না মেলায় আগত দর্শক। স্টল খুলে বসে আছে, কেউ যাচ্ছে না তাদের স্টলের দিকে। ব্যাপারটা কেমন লাগে? খুবই মায়া লাগে স্টলে একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে কেউ, অন্য কেউ সেদিকে যায়নি, যাচ্ছেও না। আর স্টলের লোকটি ভাবছে, কেউ হয়তো সারাদিনে আসবে তার স্টলে একবার। তাদের প্রকাশনা না কিনলেও নেড়ে চেড়ে দেখবে। মেলার মধ্যেই ভাসান চর আছে, সেখানে কিছুটা ঠেলাঠেলি করে পাঠানো হয় কিছু স্টল। এখন, ভাসান চরে আর যাবে কে? পাঠক আগ্রহ দেখাবে এমন প্রকাশনা না থাকলেও মেলার বেশ কিছু বনেদি অংশে কী কারণে যেন বসানো হয় প্রাতিষ্ঠানিক কিছু প্যাভিলিয়ন। এটা একেবারেই লোক দেখানো। আবার, তরুণদের লিটল ম্যাগাজিনের এলাকাটা দেখলেই মনে হয়, এদিকে এতিমখানা। কেউ কেউ বলে, গাবতলি গরুর হাটের ডিজাইন অনুযায়ী লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে সারি সারি বাঁশখুঁটি বাঁধা। এবং মেলায় আগত দর্শক বা পাঠক লিটল ম্যাগাজিন এলাকায় যাবেই না, এমনভাবে ডিজাইন করা মনে হয়।
একটা দেশের তরুণ লেখকদের জন্যে সেদেশের বড়দের এই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি? এই তরুণরাই তো বড় হবে। তাহলে এখন যারা বড়, তারা যখন তরুণ ছিলেন, তারাও কি মেলায় এরকম অবহেলার শিকার ছিলেন? অতএব, বড় হয়ে সেই অবহেলাই উগরে দিচ্ছেন? এ কি অবহেলা উৎপাদনের পরম্পরা? লিটল ম্যাগাজিনের তরুণেরা তো আর রোহিঙ্গা নয়, আমাদেরই সন্তান। মেলার ডিজাইন কি এমনভাবে করা যায় না, যাতে করে আগত দর্শকপাঠক যাতে লিটল ম্যাগাজিন এলাকার ভেতরে মেলায় এসে একবার হলেও যেতে পারেন। বুঝলাম, সব লিটল ম্যাগাজিনই বস্তুনিষ্ঠ প্রকাশনা নয়, সে তো বড়দের বেশির ভাগ বইও অবস্তুনিষ্ঠ; চলছে না? আগে চিন্তায় জায়গা দিতে হবে, তাহলে কী রকম ডিজাইন করলে মেলায় আগত দর্শক পাঠক সব স্টলের সামনে দিয়েই যেতে পারে, সেটা করা যাবে। কিছু অঞ্চল গুলশান-বারিধারা হবে আর কিছু অঞ্চল কুড়িল বস্তি বা বড়জোর কাঁঠালবাগান বা মগবাজার খেজুরগাছের গলি হবে- এ রকম সমাজ ও রাষ্ট্রের নগর কাঠামো চিন্তা নিয়ে যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে মেলার স্টল-প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন তোলা খুব যৌক্তিক কিছু।
আগে মনোজগতে পরিবর্তন দরকার। আরে বাবা, মেলার মাঠ এমনভাবে ডিজাইনে আনা হোক, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা করে ডিজাইন গ্রহণ করা যেতেই পারে, যাতে সেই ডিজাইনে সব স্টল বা প্যাভিলিয়নকেই এক আবাসিক এলাকার মতো একই মাত্রায় বিন্যাস করা যায়। যায় না? যায়। নইলে বেশ কিছু স্টল, বিশেষ করে ক্ষুদ্র পুঁজির প্রকাশকেরা, যারা মূলত সিঙ্গেল স্টল বরাদ্দ নিয়ে থাকেন, তারা ভীষণ বঞ্চিত থাকেন। অনেকটা দেশের সাধারণ বঞ্চিত মানুষের মতো, যারা কিনা শতকরা সত্তুর ভাগ। এতে করে নাগরিক শ্রেণির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। নাগরিক শ্রেণি বিকশিত না হলে আর্ট-কালচার শুধু সেই ধনিক শ্রেণির ইচ্ছাতেই মনোরঞ্জন করে যাবে। যে কারণে দেশের লোক বিশ কোটি ছুঁইছুঁই, একটা নতুন লেখকের নতুন বই বিক্রি হয় না তিনশো কপি। বৃহত্তর মানুষকে বঞ্চিত রাখার ঔপনিবেশিক চিন্তার সিন্দুক জাদুঘরে পাঠাতে হবে নাকি এভাবে চলাই আমাদের অগ্রগতি? নাকি নিয়তি বা উপায়হীনতা!
তাহলে, কথা একটাই, বইমেলার ডিজাইন এমনভাবে করা হোক, যাতে স্টল-প্যাভিলিওন বরাদ্দে কোনও এলাকা লেকের পাড়ের ধানমডি আর কোনও এলাকা ভুরুঙ্গামারি না হয়- একটা সাম্য দরকার। সাম্যটাই সুন্দর- এইটুকু দর্শন আমাদের মেনে নিতে শিখতে হবে। যেন মনে হয়, উজানতলিতে মেলা বসেছে, মানুষের নিজেদের মধ্যে দেখাশোনা হচ্ছে, বই বিক্রি হচ্ছে, আড্ডা হচ্ছে। সবার মুখেই একটা হাসি হাসি ভাব। কারণ, কেউ মেলাতে বঞ্চিত নয়। মেলা আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষের অন্তরে সেরকম একটা মনোভাব আসতে পারে না?
পারে কিন্তু। আমাদের বইমেলার উদ্দেশ্য কী? বই পাঠের উদ্দেশ্য কী? বইমেলা ও বসন্তকাল একসঙ্গে একাকার এখন, উদ্যানে কোকিল ডাকছেই, কোকিলের উদ্দেশ্য কী? আমার উদ্দেশ্যে ছিল একটি রসতোষ রচনা লেখার, লেখা সেদিকে যেতে যেতে পথের বাঁকে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। এই ঘুরে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী?
/লিপি