‘মাসুদ রানা’ পড়ার পরে বড় হয়ে গেলাম : ধ্রুব এষ
ধ্রুব এষ। জন্ম ১৯৬৭ সালে, সুনামগঞ্জের উকিলপাড়ায়। বাবা শ্রীভূপতি এষ। মা শ্রীমতী লীলা এষ। গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একডেমি পুরস্কার। শিল্পী, সাহিত্যিক ধ্রুব এষের শৈশব আর স্কুলজীবনের গল্প উঠে এসেছে এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে। কথোপকথনে ছিলেন স্বরলিপি
আগে তো বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকতো। কিশোর মন হারিয়ে যেতে চাইতো ছুটির আনন্দে। সেই সময়ের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ে?
আমরা চার ভাই। পোটলা-পুটলি গুছিয়ে আমাদের চার ভাইকে নিয়ে মা ছুটতো তার বাবার বাড়ি শ্রীমঙ্গল। বাবা যেত না। মামাবাড়িতে আমার বয়সী অনেক মামা, মাসি ছিল; তাদের সঙ্গে বেড়াতাম। শ্রীমঙ্গলেই প্রথম কাঞ্চন ফুল দেখেছিলাম। ওখানে গেলে খুব মজা হতো! ছোটবেলায় দেখা শ্রীমঙ্গল এখন অন্যরকম অনুভূতি দেয়। বড় হওয়ার পরে মনে হয়েছে শ্রীমঙ্গল এতো সুন্দর একটা শহর, যেখানে জঙ্গল শহরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় শহর জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ঘুরে বেড়াতাম, আনন্দ হতো খুব! সময় চলে যেত চোখের পলকে। এক সময় পরীক্ষার রেজাল্ট বের হতো। রেজাল্টের খবর জানিয়ে বাবা চিঠি লিখতো।
ছোটবেলায় কার কাছে বেশি আদর পেয়েছেন?
আমি আমার মায়ের আদরে বড় হয়েছি। আর ছিল এক পিসিমা। পাশের বাড়ির পিসি। আমি একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ওই পিসির কোলেকাঁখে মানুষ হয়েছি। পিসিকে একটা মজার নামে ডাকি- ‘টেডি পিসি’। সত্তুরের কাছাকাছি বয়স হয়েছে পিসির। তিনি কিন্তু এখনও আগের মতোই ভালোবাসেন। পিসির সঙ্গে কথা হয় এখনও।
স্পঞ্জ বা স্যান্ডেল কীভাবে চলার সঙ্গী হলো?
আমি স্কুলে কোনোদিন জুতা পরে যেতাম না। শুধু আমি না, আমাদের সময় বেশিরভাগ ছাত্রই খালি পায়ে স্কুলে যেত। সাজুগুজু করা ফুলবাবুও ছিল। তারা স্যুট-প্যান্ট পরে স্কুলে আসতো। কিন্তু খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া ছাত্রদের সংখ্যা ছিল বেশি। আমি সেই দলে ছিলাম। দিন ভালো যেত কিন্তু রাতে ঘুমানোর আগে পা ধোয়ার জন্য স্যান্ডেল লাগতো। পা না ধুয়ে শুতে গেলে তো মা শুতে দেবে না! সে সময় বাসায় পরা হতো স্পঞ্জের স্যান্ডেল। আমিও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে পা ধুয়ে শুতে যেতাম। সকালে আর কে স্যান্ডেল পরে? আবার খালি পায়ে বের হয়ে যেতাম। স্কুল জীবন এভাবেই গেছে। কলেজে যাওয়ার পরে স্যান্ডেল পরে কলেজে যেতে শুরু করলাম। একদিন চামড়ার স্যান্ডেল পরেছিলাম। এতো অস্বস্তি লেগেছিল যে, মনে হলো ধুর! এ সব চামড়ার স্যান্ডেল পরতে পারবো না। আমার স্পঞ্জের স্যান্ডেলই ভালো। দেখলাম সমস্যা তো নাই। এখন পর্যন্তও তাই। স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে যেসব জায়গায় গেলে সমস্যা, আমি ওসব জায়গায় নাই- সোজা হিসাব।
প্রাইমারি স্কুলের কোনো স্যারের কথা মনে পড়ে?
প্রাইমারি স্কুলের দুজন স্যারের কথা মনে আছে। মন্টু স্যার আর ভূঁইয়া স্যার। ভূঁইয়া স্যার অনেক বড়সড় মানুষ ছিলেন। লুঙ্গি আর পাঞ্জারি পরে ক্লাস নিতেন। মন্টু স্যার ছিলের রোগা পাতলা।
স্যারের হাতে কখনো মার খেয়েছেন?
ওরে আমি মার খাইছি, খাইছি। ক্লাসে কয়েকজন থাকে না… খুব ভালো বন্ধু। এর মধ্যে আমি আর বাপী ছিলাম। ও খুব ভালো ছাত্র ছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেনও ছিল। একদিন ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে, তো ব্যক্তিগত ঝগড়া। সে সময় টিফিন পিরিয়ডের পরে ক্লাস টিচাররা আসতেন রি-চেক করতে। জানতে চাইতেন ছেলেমেয়েরা দুষ্টুমি করেছে কি না। রি-চেক করতে যে স্যার আসত আমরা তাকে বলতাম ‘পাঞ্জাবি স্যার’। কারণ উনি পাঞ্জাব থেকে আসছিলেন। কারা কারা দুষ্টুমি করেছে তাদের নামের সঙ্গে ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেব বাপী আমার নামও একদিন ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আরে স্কেলের যে একটা বারি খেয়েছিলাম! দীর্ঘ দিন ওই অপমান মাথা থেকে যায় নাই। রাগে পাঞ্জাবি স্যারকে দুই চোক্ষে দেখতে পারতাম না! ঘটনাটি ক্লাস থ্রির। এরপরেও মার খাইছি ক্লাস সিক্সে এবং ক্লাস নাইনে। সিক্সে কাজী স্যার মেরেছিলেন। সিঙ্গুলার নম্বর আর প্লুরাল নম্বর শেখাচ্ছিলেন। ওখানে তো বয়, বয়েস, গার্ল, গার্লস। আমি করেছি কি- প্রত্যেকটার সঙ্গে এপোসটপি এস বসিয়ে দিয়েছিলাম। সেই যে মাইরটা খেলাম। মাইর মানে চূড়ান্ত মাইর! বেতের বাড়ি খেয়ে ‘মাগো, বাবাগো’ বলে কাঁদতে কাঁদতে শেষ!
স্কুলের কোন বিষয় এখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে- খুব মিস করেন?
স্কুলের সব নিয়ম-কানুন, আনন্দ-উৎসব ছিল সুশৃঙ্খল। আমাদের টিফিন দিতো স্কুল থেকে। খাবার নেওয়া এবং দেওয়ার মধ্যে কোনো উড়াতাড়া ছিল না। শৃঙ্খলাবোধ আমরা স্কুল থেকেই শিখেছি। একটা ক্লাস ছিল বিতর্ক ক্লাস। শনিবারে এই ক্লাসটা হতো। ওই দিন চারটা পিরিয়ড ছিল। শুক্রবারে ছিল হাফ ডে, আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত। রবিবার স্কুল বন্ধ থাকতো। শনিবার স্যারেরা বই নিয়ে আসতেন ক্লাসে। ক্লাসে ৩৪ জন ছাত্র থাকলে ৩৪টা বই নিয়ে আসতেন। একেক জনকে একেকটা বই দিতেন। আমাদের কোনো জবাবদিহিতা করতে হতো না যে- বই পড়েছি কি পড়িনি। প্রত্যেক শনিবারে বই নিয়ে যেতাম। আমরা চাইলে প্রত্যেকে বই চুরি করতে পারতাম, কিন্তু করতাম না। এক শনিবারে নেওয়া বই আরেক শনিবারে ফেরত দিয়ে আবার অন্য বই নিতাম। এটা ছিল অন্যরকম সুন্দর ব্যাপার। শিক্ষকেরা কখনো জোর খাটাতেন না। বা বলতেন না যে- বই নিলে পড়তেই হবে। এই ক্লাসটাতে কেউ গান গাইতো, কবিতা আবৃত্তি করতো। প্রত্যেকে বই জমা দিয়ে নতুন বই নিত। আমরা সবাই বই পড়তাম। পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে ওভাবেই। দস্যু বনহুর ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার সময়েই পড়ে ফেলেছি। এরপর কুয়াশা, মাসুদ রানা এগুলো পড়া শুরু হলো। ‘মাসুদ রানা’ পড়ার পরে তো আমরা বড় হয়ে গেলাম। শৃঙ্খলাটা ছিল এরকম- শুক্রবারে আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত ক্লাস হতো। পরের দিন দশটা থেকে একটা, এরপরের দিন পুরাপুরি ছুটি। মানে পুরো বিষয়টি একেবারে ছাত্রদের সইয়ে নেওয়ার বিষয় ছিল। বলছি না আমাদের সময়টা খুউব ভালো ছিল, কিন্তু আমার এখনও ভাবলে ভালো লাগে।
তারা//