প্রতিদিনই নারী দিবস, জানে শুধু নারীই, পঞ্জিকার পৃষ্ঠা তা জানে না
পাপড়ি রহমান || রাইজিংবিডি.কম
‘এক বছরে নারীদের সম্পর্কে কতগুলো বই লেখা হয়েছে আপনার কোনো ধারণা আছে? আপনার কোনো ধারণা আছে পুরুষদের দ্বারা কতগুলো লেখা হয়? আপনি কি জানেন যে, সম্ভবত মহাবিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত পশু নারী?'
ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন উপরোক্ত কথাটি। ১৯৪১ সালে যিনি প্রয়াত হয়েছেন। তিনি প্রয়াত হবার বহুকাল বাদেও কিন্তু নারীদের অবস্থার সেরকম কোনো হেরফের হয়নি। এই যে ২০২৪ এর বইমেলা বিগত হলো, নারী বিষয়ক কতগুলি বই প্রকাশিত হলো- কেউ খোঁজ রেখেছেন?
এখন অবশ্য যুগ পাল্টেছে, নারীরাও লিখছে কমবেশি যাই হোক না কেন? এই বইমেলায় নারী লেখকদের কয়খানা বই প্রকাশিত হয়েছে? হলো? যাও-বা হলো সেসব লেখা কেমন লেখা বা কী লিখছেন আমাদের নারীরা? ভাবনা করার মতো বিষয় বটে! আমি যেমন ভাবছি, আমি চাই- আপনিও এ রকম ভাবুন। যিনি লিখছেন তিনি অতি অবশ্যই ভাববেন। আপনি যদি সিরিয়াসলি ভাবেন, তাহলে ‘আলোচিত পশুটি’ নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম পাবে অন্যরা। ভগ্নিরা, সামান্য চেষ্টা করুন, যেন আপনাদের লেখাপত্র নিয়েই কথাবার্তা হয়।
প্রতিদিন একজন নারী কী করেন? সংসার, সন্তান, অফিস সামলান। স্বামী, বস, সন্তান সামলান। স্বামী বা নিজের আত্মীয়-স্বজন, নিজেদের বন্ধুবান্ধব। সব সামলিয়ে আপনি লিখতে বসেন। তখন হয়তো মধ্য যামিনী। নিজের অচল দেহখানি প্রদীপ করার লক্ষে তুলে ধরেন ল্যাপটপের স্ক্রীনে। এতসব করেটরে যা লেখেন সেসবও তকমা দেনেওয়ালারা এক ফুঁ দিয়েই খারিজ করে দেন। তা তারা দিতেই পারেন। কারণ তাদের আলোচনার বিষয় তো আপনি, মানে আপনি নামক পশুটি। পশুর ঘাড়-গর্দান, কোমরের বাঁক, ক্লিভেজ, নিতম্বের হালচাল। কী করা?
সমাজ এভাবেই অভ্যস্ত! ধন্যি মোদের পশুজীবন! গলদ তো সবখানে। দেখবেন, পুরুষেরা অলখ বন্ধনে থেকে যায়। যাচ্ছে। কী দারুণ তাদের ব্রাদারহুড! তাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। (আগে শুনতাম নারীরাই নাকি এমন!) কেউ-ই কারো বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করবে না। ইনারা পুরুষ, দেবতা, পশু তো নয় কভু! দেবতারা কিনা পশুদের নিয়ে কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন আড্ডায়, পানশালায়।
বহিনাগণ, এক্ষণে আমি আর আপনি করিতেছি কী? পশুবৎ মার খেয়ে খেয়ে বিলাইয়ের হাড়সম শক্ত হয়ে উঠছি। এই যে আমাদের শক্ত হাড়, তবুও তো ধরাশায়ী হচ্ছি বার্ধক্য আসার পূর্বেই। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত কারণে আমাদের মার খাওয়া হাড় চুরচুর করে ভেঙে পড়ছে! আমরা তো হাড়ের যত্নে উদ্যমী নই। যতোটা উদ্যমী পোষাক-আশাকে! তুমি ক্রেতা আমিও পণ্য। আর আমি পণ্য হলে তুমি তো ক্রেতা অতি অবশ্যই। পশু তো পণ্যই। বিক্রি-বাট্টা ছাড়া পশুর মূল্য বোঝা যায় কী দিয়ে?
ঝা চকচকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছ তুমি, অত্যাধুনিক বেশভূষা কিন্তু তোমার মননে-মগজে থইথই অন্ধকার। তুমি তোমার স্বজাতিকেই বেল্টের তলা দিয়ে ছুরিকাঘাত করছ! হবে না সিস্টার! শাণিত কোরো মগজ। বালি আর পাথরে ঘষে নাও নিজের চিন্তা আর দৃষ্টি হোক সদা সার্চলাইটের মতো। পিঞ্জর খুলে দাও। কোন সে পিঞ্জর? নিজের ভেতরের বদ্ধতার পিঞ্জর। অন্ধকার আর পশ্চাদপসরণের পিঞ্জর।
‘আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে, সেও আমি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন রাতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তব পরিচয়।’
( চিত্রাঙ্গদা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই যে উন্মোচন- এরই জয় হোক। এরই সাধনা হোক। ‘পশু’ থেকে সহচরী বনে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি বলি কি- কী দরকার চর, চড়াই, সহায়, উৎরাই নিয়ে মেতে থেকে? বরং নিজের দিকে তাকাই। সামান্য নার্সিসিস্টিক হই। দেখি তো কেন অকারণ হাড়গুলো নাজুক হয়ে উঠল? মাথার ভেতরের বহু যুগ ধরে বিছিয়ে থাকা থইথই অন্ধকার দূরীভূত করতে ঝর্নাতলার নির্জনে যাওয়া যাক।
দিনে মোর যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ করে
মেটে বা নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে
সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে
এসেছি সকল চাওয়ার বাহির দেশে
নেব আজ অসীম ধারার তীরে এসে
প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে...
তারা//