ঢাকা     মঙ্গলবার   ০২ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৮ ১৪৩১

স্মৃতিগদ্য

আমার স্মৃতির ডালপালা

নাসরীন জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৩, ১৮ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৭:৩৬, ১৮ জুন ২০২৪
আমার স্মৃতির ডালপালা

উনিশশো চুরাশি সালের এক ভোরে প্রথম রমনার বটমূলের ছায়ানাটের অনুষ্ঠান দেখি। এবং জমজমাট বহুবর্ণিল বৈশাখ উদযাপন অনুভব করি। আমরা নতুন দম্পতি। অনেকরকম পিঠা খেয়ে আড্ডা দিয়ে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে ফিরেছিলাম! এরপর প্রতিবছর রমনার বটমূল আর বইমেলায় যাওয়া আমার জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে। এক সময় কন্যা অর্চির জন্ম হলো। আমরা দুজন ওই পুচকেকে ঘাড়ে নিয়ে ছায়ানটের উৎসবে যেতাম। ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে রমনার ঘাসে পেপার বিছিয়ে ফিরে পাওয়া শৈশবের বাতাসার সাথে নকশি, পুলি, ভাপা কতরকম পিঠা যে খেতাম!  

অর্চি সেই পিচ্চিকালেই চটপটি খেয়ে হা হু করত, তাও তার চটপটি খাওয়া চাই। আমরা অবশ্য খুব ছোটবেলা থেকে যখন নানার বাড়ি ছিলাম, যখন মা-বাবার বাড়ি ছিলাম; গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম যে, পহেলা বৈশাখে ভালো খাওয়া দাওয়া জরুরি। তাহলে সারাবছর ভালো খাওয়া যাবে। আমরা অবশ্য পান্তা দিয়ে দিন শুরু করতাম না। বিশেষ করে নানার বাড়িতে পান্তা ছিল গৃহকর্মী, ক্ষেতমজুরদের খাওয়া। পোলাও, মাংস আর নানারকম পিঠে হতো। আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে খিচুড়ি ডিমভাজি, বেগুনভাজি হতো। ধীরে ধীরে ঢাকায় আমাদের বাসায়ও সেই খিচুড়ি চালু হলো, সাথে নানারকম ভর্তা।

যাহোক, ধীরে-ধীরে নানারকম মুখোশ নিয়ে চারুকলা থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা আসতে শুরু করল। যা এখন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত। চালু হলো পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ বিক্রি। তা নিয়ে সেকি বিতর্ক মানুষের মধ্যে, গরিবদের পান্তা নিয়ে ফাজলামো হচ্ছে! ব্যবসা হচ্ছে! কিন্তু হুজুগপ্রিয় বাঙালি সে পান্তার ব্যবসা জমিয়ে ফেলল! তখনো রমনার ঘাসে গোল হয়ে আড্ডা দেওয়ার অবস্থা ছিল। 

একবার তেমনই আড্ডা দিতে দিতে বারডেম হাসপাতালের গবেষক ড. লিয়াকত আলী এবং তাঁর স্ত্রী আসমার সাথে দেখা। দারুণ জমে গেল আড্ডা। আমরা তাঁদের জোর করে আমাদের বাড়ি এনে প্রচুর ভর্তাসহ দুপুরে ইলিশ খিচুড়ি খাওয়ালাম। শর্ত দিলো, পরের বছর আমাদেরকে তাদের বাড়িতে যেতে হবে।

বছর গড়ালে রমনা থেকে তাঁদের বাড়ি গেলাম। ধীরে ধীরে এমন বাৎসরিক আসা যাওয়ার মধ্যেই লিয়াকত ভাই সেই আড্ডা প্রসারিত করে তাঁদের ছাদে নিয়ে গেলেন। অনেক মানুষ তাঁদের ছাদে বৈশাখী খানাদানায়  আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আসতে শুরু করল। এক সময় সেটা অনেক বড় একটা আকৃতি ধারণ করে। যার নাম হয় সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র। সেখান থেকে কতবার যে আমরা বনভোজনে গেছি!

একবার এক আয়োজনে লিয়াকত ভাই ঘোষণা দিয়ে আমাকে পুরস্কৃত করলেন। বললেন, নাসরীন সেদিন জোর করে তাদের বৈশাখী দাওয়াতে আমাদের নিয়ে না গেলে এই সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের জন্ম হতো না। এক সময় শুনি আসমা ভাবী মারা গেছেন! আমার ভেতরের তার ছিঁড়ে যায়। তবে মঞ্চে সেদিন আমি আমাদের শৈশবের বৈশাখ যাপন নিয়ে বলেছিলাম। ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় ওই উৎসব উদযাপিত হতো। আমি আর শৈশব বন্ধু রুবী আমরা অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠে কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটতাম আর শুনতাম কোরাস, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ কিন্তু দীর্ঘ সার্কিট হাউসের মাঠ পেরিয়ে কিছুতেই সেই গানটা আর সামনাসামনি শোনা হতো না। আব্বা ছিলেন বোহেমিয়ান। বাজারের টাকা না দিয়ে আগের মতো সেবারও কোথায় যেন চলে গেলেন। অসহায়, ক্ষুব্ধ আম্মা কোনো রকম মিষ্টি আলু খাইয়ে সবাইকে ঘুম পাড়ালেও আমি আমার ভাগের আলু ছোট ভাইকে দিয়ে দিই। 

সারারাত উপোসের মধ্যে জাগরণ! কখন রুবী জানালায় নক করে! আমি ধীরে পায়ে বেরিয়ে যাই। ছায়া আঁধার পথ ধরে আমরা তখন ছুটছি। আজ যেভাবেই হোক, শুরু থেকে অনুষ্ঠান দেখব। আমরা মাঠ দিয়ে না গিয়ে সাহেব কোয়ার্টারের ছায়াচ্ছন্ন গলি ধরে ভূতের মতো ছুটছি। তখন ব্রহ্মপুত্রে কত জল টলটল করত। প্রকৃতি শৈশব থেকে আমাকে টানতো। আহা! নদীর পারের পার্ক সংগ্রহশালা কত ছিমছাম ছিল। মানুষ গিজগিজ করত না।

কী আনন্দ! আমরা যেতেই শুরু হলো গান ‘এসো হে বৈশাখ...!’ আমরা ঘাসের মধ্যে বসে বুঁদ হয়ে পুরো অনুষ্ঠান শেষে যখন বাড়ির দিকে ফিরছিলাম তখন রোদ কড়া চোখ মেলে দিয়েছে বিস্তারিত প্রান্তরে। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় আমি নেতিয়ে পড়ছি, তাও কিছুতেই রাত থেকে কিছু খাইনি- এসব রুবীকে বলছি না। রুবী বলে উত্তেজনার ঠেলায় পয়সা আনতে ভুলে গেছি! এখন মুড়ি মুড়কি কীভাবে খাই?

আমিও। এই বলে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকি। আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। রুবী প্রশ্ন করে, তোর কী হয়েছে?
কিচ্ছু না!
সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই বলে, ওহ্ খালু বাজার করে যায়নি? তুই না খেয়ে আছিস? আমি না তোর বন্ধু? আমার কাছেও তোর লজ্জা? এরপর সে একটা রিকশা ডেকে আনে। আমরা উঠে বসি। সে রেললাইন টপকে ভাড়া মিটিয়ে আমাকে কতরকম খাবার খাওয়ালো! ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গেলেই আমার শৈশবের বৈশাখের কথা মনে পড়ে যেত। 

আরও পিচ্চিবেলায়, খুব ভোরে ভরপেট পিঠা খেয়ে আমরা ভাইবোন মেজোমামার হাত ধরে বৈশাখী মেলায় চলে যেতাম। কোনো ঈদে ভেতরে এমন বর্ণিল অনুভূতি হতো না। কারণ বৈশাখী মেলা মানে হাজার রঙের উৎসব! মেলার মধ্যে পৌঁছেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে হাত-পা কাঁপত। মনে হতো, রূপকথার জগতে এসে পড়েছি। মনে হতো পুরো মেলা ঘাড়ে করে বাড়ি এনে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি।

অর্চির মধ্যেও আমি হুবহু সেই বিহ্বলতা দেখতাম। কিন্তু ২০০১ সালে গ্রেনেড হামলার পরে আমরা অর্চির সামনে থেকে এই রূপকথার দরজাটা বন্ধ করে দিই। তা ছাড়া এখানে-সেখানে কোথাও আর মেলায় আড্ডার পরিবেশ নেই। মানুষের গিজগিজ ভিড়ে পাশাপাশি দাঁড়ানোই যেখানে মুশকিল, সেখানে সুন্দরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে কিই-বা দেখব, আর কিই-বা খাব?

যাহোক, এবার রোজার ঈদ আর বৈশাখ প্রায় একসময় পালিত হয়েছে। এবার ঈদের আনন্দ বেদনার স্মৃতি নিয়ে কিছু লিখি। আব্বা কেবলই নিজ প্রোপার্টি বিক্রি করে এদিকে-ওদিকে ঠিকানাহীন কোথায় কোথায় যে হারিয়ে যায়! ফলে আমাদের জীবনে অপরিসীম বেদনা নেমে আসে। একবার এক ঈদে আমার মেজ ভাই আলোক; যে কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। তার ইচ্ছে অনিচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যেত না। তবে ঈদের দিন ভালো খাবার পেলে তার আর কিছু না হলেও চলত। ঈদের কাপড় নিয়ে আমিও আম্মাকে কোনোরকম চাপ দিতাম না। 

এক ঈদে আম্মা বাকি চার ভাইবোনকে ঈদের নতুন কাপড় দিয়ে আমাদের দুজনে বাদ দিলেন; পরের ঈদে আমাদের দেবেন বলে। সেদিন সারাদিন হঠাৎ করে আলোক ভাইয়ের দেখা নেই। দুপুরে কোর্মা পোলাওয়ের সময়ও নেই। আম্মা অস্থির হয়ে উঠলেন। আব্বা তার বড়বুজির (আমাদের বড়ফুপু) বাড়ি ঈদ করতে গেছেন। ভাইয়ের অদর্শনে আমাদের সবার ঈদ বেদনায় পরিণত হলো। সন্ধ্যায় সে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অনেক জোরাজোরি করে জানা গেল, তাকে নতুন শার্ট দেওয়া হয়নি বলে সে সারাদিন কোথাও কিছু খায়নি। তার বন্ধুরা টিটকিরি দিয়ে বলেছে, তুই আসলে ওই বাড়ির ছেলে না, তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিল ওরা।

আগেই বলেছি, আমাদের আব্বা বোহেমিয়ান ছিলেন। যে কোনো ছুটির দিন, ঈদের দিন কোথায় কোথায় চলে যেতেন! একবার ঈদের আগে কোনো টাকা-পয়সা না দিয়ে কোথায় গেলেন, আমরা কেউ জানতেই পারলাম না। আম্মার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঈদের দিন কোর্মা পোলাও ছাড়া কীভাবে চলে? আব্বার প্রতি দারুণ অভিমান হলো। কিন্তু তাও মনে হচ্ছিল, আম্মা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু সেবার আম্মা রাগে-ক্ষোভে-কষ্টে প্রচুর কেঁদে কড়া করে বললেন, তোমাদের আব্বা বাজারের টাকা দেয়নি, ফলে এই বাড়িতে ঈদ হবে না। আমাকে আর জ্বালিও না। আমি অনেক সহ্য করেছি।

আমরা ভাইবোনরাও কষ্টে বেদনায় কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ ঈদের ভোরে দরজায় শব্দ। দরজা খোলার পরে এ কি! রাজ্যির কাপড়ের ব্যাগ আর পোলাও-চাল-মুরগিসহ বাবা দাঁড়িয়ে! বললেন, কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? সেই ঈদের আনন্দ আমি এখনো ভুলতে পারি না। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে আমার এখনো মনে হয়-আমার জীবনটা এমন আলো অন্ধকারের ভারসাম্যতায় ভরপুর বলেই হয়তো আমি জীবনকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি। 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়