ছোটগল্প
কয়েকটি কাঠগোলাপ
অলাত এহ্সান || রাইজিংবিডি.কম
আমি কদাকার চেহারার মানুষ। সচরাচর যার দিকে কেউ নজর দেয় না। যেমনটা ভাবতাম ডাস্টবিন নিয়ে; কেউ ঘৃণা করে না, স্রেফ এড়িয়ে যায়। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। মানুষের ঘৃণা থেকে কিছুই বাদ যায় না। ডাস্টবিনেও আঘাত করতে ছাড়ে না। তার ভেতরের বর্জ্য রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়ে ঘৃণা উদযাপন করে। এ সবই বুঝেছি একটা কাঠ গোলাপের জন্য।
আমি গ্রামান্তরিত মানুষ। কেউ কেউ বলে, শহরে সবার জায়গা হয় না। কিন্তু শহরে এসে দেখলাম আমার জন্য জায়গা আগে থেকেই নির্ধারিত। কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সোজা বছিলা বেড়িবাঁধ। শ্রমিক বস্তি। রাস্তার একপাশে সারবেঁধে ঘর। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে শহরের সবচেয়ে প্রশস্ত নর্দমা। সেখানে সারাক্ষণ বুঁদবুঁদ ওঠে। শহরটা যদি ফুটন্ত জলের হাঁড়ি মনে করা যায়, তাহলে এটা হাঁড়ির কান্দা। সেখানে অনেক কিছুরই জায়গা হয়। আমারও একটা মেসে জায়গা হয়ে গেল। আমার সঙ্গের সবাই প্রায় বাসে হেলপারি করে। কয়েকজন টেম্পোর কন্ট্রাক্টর। আমার কাজ শুরু হলো টেম্পোর পেছনে ঝুলে। সেখানে অবশ্য চেহারার দরকার পড়ে না।
আমি নিরেস মাথার মানুষ। সামান্য টাকার হিসাব করতেও গোলমাল বেঁধে যায়। ঝুলতে ঝুলতে টাকা তোলা, রাস্তায় চোখ রাখা কম ঝক্কির নয়। একবার যাত্রীদের ভাড়ার টাকা গুছিয়ে নিতে গিয়ে হাত ফসকে ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। একেবারে গড়াগড়ি দিয়ে ওঠা আর কি! এরপর কাজ পেলাম রাস্তার পাশের এক নার্সারিতে। তখনই ফুল আর গাছের প্রতি গ্রামীণ টান আবার জেগে উঠল। সারাক্ষণ টব নাড়াচাড়া করতাম। কোন ফুলের পাশে কোন ফুল শোভা পাবে ঠিক করতে চাইতাম। নার্সারি মালিক বিরক্ত হয়ে গেলেন। সেখান থেকে পাঠিয়ে দিলেন বাসাবাড়িতে। একটা বাগান গুছিয়ে দেওয়ার কাজ।
আমি একটা ভ্রমর চেহারার মালি। বাড়ির মানুষগুলো ফর্সা। বাগানের রঙিন ফুলের মতো তাদের গাল। কিন্তু তাদের বাগানের ফুলগুলো শুধুই রঙিন, কোনো গন্ধ নেই। সবচেয়ে আশ্চর্য, বাগানে কোনো মৌমাছি আসে না। অথচ গ্রামের লাউ-কুমড়া-ধুন্দলের মাচায়ও কত ভ্রমর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাগানে অপরাজিতা, গেট ফুলের লতাগুলো মাটি কামড়ে পড়ে আছে, বুক ঘষে তেমন বাড়তে পারেনি। আমি অপরাজিতার জন্য সামান্য কুঞ্চি দিয়ে মাচা করে দিলাম। বাগানের মাঝে পুঁতে দিলাম কয়েকটা গন্ধরাজের চারা। কামিনী, হাসনাহেনাও এনেছিলাম। রাতে ফোঁটা ফুল অধিকাংশই সুগন্ধী হয়। তাতে ফুল আসতেই ভ্রমরের আনা-গোনা দেখা গেল। মাচা থেকে ঝুলে পড়ল নীল ফুলের অপরাজিতা লতা। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে অভিযোগ এলো ফুলের গন্ধে তারা ঘুমাতে পারেন না। তাই গন্ধরাজের চারা উপরে ফেলতে বললেন। ধীরে ধীরে সব শেষ করেও এনেছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে একটা উচ্চাভিলাষী ভ্রমর বাসার ভেতর ঢুকে পড়েছিল। একেবারে প্রতিশোধস্পৃহা। কোনো অলক্ষুণে মুহূর্র্তে ওটা সাহেবার হাতে হুল ফুটিয়ে দিলো। ব্যাস। কাজটা গেল তৎক্ষণাৎ। প্রায় খুনের অভিযোগ! ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি একটা কদাকার, তোমার ভ্রমরগুলোও কদাকার।’
আমি থোবড়ান ডিব্বার মতো মানুষ। এই চেহারার সাযুজ্য একটা কাজ পেয়েছিলাম তারপর। একটি প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যানের সহকারী। কালিঝুলিতে প্রতিদিন আমার চেহারা নতুন রূপ পেত। কিন্তু নিরেস মাথার কারণে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো প্রিন্টিং সেকশনে। প্রেসে দুই-তিন শিফটে কাজ হতো। মোটাদাগে দিনে পোস্টার-ম্যাগাজিন ছাপা, রাতে পত্রিকা-ম্যাগাজিন। কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে সরকারি অফিসের মানুষগুলো বাসায় ঢুকে যেত। রাস্তায় গন্ধ ছড়াত নগর বিভাগের গাড়িতে বয়ে নেওয়া ডাস্টবিন থেকে পড়া ময়লা। সাধারণত একাই ফিরতাম। কোনো কোনো দিন এক সহকর্মী পথের সাথি হতেন। বিপরীত দিক থেকে এক-দুইটা গার্মেন্টসের কর্মীরা ফিরত বিস্তর কোলাহল করে।
আমি আঁধারের মতো মানুষ। প্রচণ্ড বৃষ্টিঝরা এক রাতে গার্মেন্টস শ্রমিকের বহর পাস কাটিয়ে যাচ্ছিলাম। এ সময় ফুটপাতে একটা কাঠগোলাপ আবিষ্কার করলাম। অদ্ভুত সুন্দর! নতমুখে চলায় গাছের দিকে তাকানো হয়নি কখনো। তারপর প্রতিদিন সেখান থেকে ফুল কুড়িয়ে নিতাম। কোনো কোনো রাতে গার্মেন্টস ফেরত নারী শ্রমিকেরা দেখে হাসত। কেউ কেউ হয়তো পাগল ঠাওরাতো, কেউ-বা মনে করত নেশায় আসক্ত। আমি একটা ফুল কানের কাছে গুঁজে দিয়ে কয়েকটা ফুল হাতে ধরে আসতাম। এগুলো শহরের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য দারুণ কাজ করত!
আমি অস্বচ্ছ ছাপা ছবির মতো মানুষ। কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো কিছুই নেই। তবু কানে ফুল গোঁজার পর কেউ কেউ পাশ ফিরে তাকাত। এমনকি উঁচু দালানের বাসিন্দাও আছে সেই তালিকায়। তাদের মধ্যে ফুল চেয়ে নেয়ার মতো দু’একটি আগ্রহী চোখ-মুখও দেখা যায়। কে কী মনে করে জানি না। হয়তো মনে করে একজন প্রেমিক। কেউ কেউ ফুলের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে দূর পর্যন্ত চেয়ে থাকে। হয়তো আমার সঙ্গে ফুলের সৌন্দর্য মেলানোর চেষ্টা করত। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিত। কিন্তু কেউ ফুল চেয়ে নেয়ার জড়তা ভাঙেনি।
আমি নিশি রাঙানো নতমুখ শ্রমিক। একজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফিরতাম। মূলত সে-ই বলত, আমি শুনতাম। সে কথা বলত শ্রমিক অধিকার, মজুরি, আন্দোলন, অভ্যুত্থান নিয়ে। কি এক সংগঠনে করে। নতমুখে ওর কথা শুনতে শুনতে চোখ মিইয়ে যেতো। এমন দিনে এক মেয়ের সঙ্গে কথা হলো। আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। কালো বটে, তবে আমার মতো কদাকার নয়। পরিশীলিত থাকে। ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজের ওপর মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রি করছিল। আমাকে বলল, ‘একটা ফুল দিয়্যা যান না?’ ওকেই প্রথম দেখলাম ভালো লাগার ফুল দ্বিধাহীন চেয়ে নিতে। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম আর একটা কাঠগোলাপ তুলে দিলাম। ও একটু শুঁকে কানের পাশে গুঁজে রেখে বলল, আমার নাম কাঠগোলাপ। আমার সহকর্মী বলল, মেয়েটার মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রি একটা ছদ্মবেশ। খানিক বাদে হয়তো ভাড়া হয়ে যাবে। অবশ্য তারপর আর কখনোই তাকে সেখানে দেখিনি।
আমি নিতান্তই কামলাখাটা মানুষ। বেচারা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই। নিরীহ তো বটে, তার অধিক করুণার পাত্র। তাই আর ওই মেয়েকে চিন্তা করিনি। নারীর জন্য কারও সঙ্গে লড়তেও পারব না। তাই কারও সাতে-পাঁচে নাই। কারও সঙ্গে লাগতেও যাই না। যা হম্বিতম্বি করে কাজে যাই, ফিরে আসি একেবারে নতমুখে। নিজের চেহারা নিয়ে দুঃখ করার সময়টুকু নেই। কেউ আমার শত্রু নয়, আমার শত্রু আমি নিজে।
আমি দুর্ভাগা। ভাগ্যই কখনো কখনো বিপদ নিয়ে আসে। একদিন ফুটওভার ব্রিজ থেকে নেমে দেখলাম একজন লোককে ঘিরে কয়েকজন যুবক কেমন গ্যালাখেলা করছে। দু’তিনটা ছোট কুকুর একটা মাদি কুকুরি ঘিরে যেমন করে। ওরা সবাই তৈরি হচ্ছিল গ্রুপ সেলফি তোলার জন্য। এর মধ্যে একজন আমার কানে গোঁজা ফুলটা নিয়ে গেল। আমি তাদের ছবি তোলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তারা ফুলটা ফেরত না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি আরও শান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে রেগে গেল তাদের একজন। পরে মারপিট করে তাড়িয়ে দিলো। বলল, ‘‘আজ ভাই বড় পদ পাইছে, তাই একবার ‘ঘা মেরে’ এলেন। আমরা সেলিব্রেট করলাম, বুঝলি। যা গা।’’
আমি ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ। আমি জানি না, ভাগ্য আমার বিপদ নিয়ে আসে, না কি আমিই অপেক্ষমাণ বিপদের দিকে এগিয়ে যাই। শুধু জানি, যে মানুষের একজীবনে মৃত্যু হয়েছে, তার পুনর্জন্ম হলেও মৃত্যুবরণ করতে হবে। দ্বিতীয় দিনও ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ির গোড়ায় তাদের গ্যালাখেলা করতে দেখলাম। এদিনও তারা সেলফি তুলছিল। একজন এগিয়ে এসে আমার কানে গোঁজা কাঠগোলাপটা খুলে নিলো। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম দেখে দ্বিতীয় দিনের মতো মারপিট করল। তৃতীয় দিন মারপিট করল একই কারণে। কী নির্মম পরিহাস! ভাগ্য আমাকে প্রতিদিন সেখানে উপস্থিত করত। সপ্তম দিনে নির্বুদ্ধিতার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে মারা হচ্ছে কেন?’ ওই দলের একজন আমাকে মারতে মারতে ক্লান্ত হলে, করুণা করে থেমে বলল, ‘তোর চেহারাই এমন, দেখলেই মারতে ইচ্ছে করে। তার মধ্যে আবার ফুল মারাস!’
আমি একজন সৌভাগ্যবান মানুষ। অষ্টম দিনে ফুটওভার ব্রিজের গোড়ায় কাউকে দেখলাম না। একটু থমকে কানের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম কাঠগোলাপটি তখনো আছে। সিঁড়ি থেকে ফুটপাতে পা রাখতেই নিত্যদিনের পোশাকের দু’জন আমাকে পাঙ্গা দিয়ে ধরল। তুলল কালো গ্লাসে মোড়া একটা জিপে। নামালও একটা অন্ধকার কক্ষের সামনে। তারা আমাকে পিটিয়ে পিটিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি এক নারীকে অপহরণ করেছিলাম কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন নারী? তেমন তো কাউকেই আমি চিনি না!’ তারা আরেক দফা পিটিয়ে একজন নারীর নাম বলল। খুবই শহুরে নাম। সহজে মনে থাকার নয়। আমি কখনো শুনিনি। তাকে নাকি এক সপ্তাহ আগে অভিজাত এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছে। আট দিন আটকে রেখে ধর্ষণের পর আজ মারা গেছে। রাজাবাজার এলাকার একটা ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ জন্য আমাকে অপহরণ করা হলো কেন?’ একজন বলল, ‘আমার চেহারাটাই সন্দেহজনক।’ তারপর একটা শুকনো কাঠগোলাপ এগিয়ে দিলো।
আমি চুপচাপ মাথা নোয়ালাম। আমি কদাকার চেহারার মানুষ, আমার কোনো উত্তর থাকতে পারে না। তারপর তারা আবার শুরু করল।
তারা//