ঢাকা     মঙ্গলবার   ২২ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ৬ ১৪৩১

স্মৃতিগদ্য

ফিরে দেখা সে কোন সুদূরের দিন        

আনোয়ারা সৈয়দ হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৬, ২৯ জুলাই ২০২৪  
ফিরে দেখা সে কোন সুদূরের দিন        

আমার ছেলেবেলার বৈশাখের কথা বলি। সে ছিল আগের রাতের এক ঘুমহারা আনন্দের দিন। পহেলা বৈশাখের আগের রাত থেকেই সকল বাটি-ঘটি, ছোট্ট পেতলের থালা বা পেতলের পিরিচ গুছিয়ে তুলে রাখতে হতো। কারণ পহেলা বৈশাখের সকাল থেকেই আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা দোকানে-বাজারে ঢুঁ মারতে চলে যেতাম। 

তারও আগে আমাদের গাছের নিচ থেকে ফুল কুড়ানো হয়ে যেত। পাড়ার যার যেখানে যে গাছ আছে, চুরি করে ফুল তুলে আমাদের ফুলের ডালি সাজিয়ে ফেলতাম। তারপর সেগুলো একটা বাটির পানিতে ভাসিয়ে রেখে আমাদের বাইরে গিয়ে লুচি রসোগোল্লা কুড়ানো শুরু হতো!সেদিন সকাল আটটার ভেতরেই দোকানপাট খোলা শুরু হয়ে যেত। দোকানের সমানের রাস্তার অংশটুকু যে যার মতো ঝাড়ু দিয়ে, তারপর রাস্তায় পানির ছিটে দিয়ে ধুলোর উৎপাত দমিয়ে, দোকানের সমৃদ্ধির দেবতা গণেশকে ফুলপাতা দিয়ে সজ্জিত করে, দোকানের ভেতরটা ভালো করে পরিষ্কার করে ফেলতেন। 

এদিকে মুসলিম দোকানদাররা খোদার কালাম কাগজে লিখে দরজার সামনে ঝুলিয়ে, লোবান, আগরবাতি জ্বালিয়ে দোকান খুলে ফেলতেন। 

বাবা-চাচারা সক্কালে উঠে স্নান সেরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বা লুঙি-শার্ট পরে বিভিন্ন দোকানে যেতেন তাদের সারা বছরের সব খুঁটিনাটি দেনা শোধ দিতে। আমরাও চলতাম। বাজারের কাপড়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা সরু বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করতাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো না। একটু সময় পরেই কী রে, তোরা মন্ডা খাবি? বলে একজন দোকানের ভেতরের ঘর থেকে একটা বাঁশের ঝুড়ি বের করে তার ভেতর থেকে বের করে আনতেন ভাজা লুচি আর গরম রসোগোল্লা। রসোগোল্লা না হলে তেলে ভাজা মচমচে জিলিপি।

দেবতা গণেশেরও সেদিন বড়ই লক্ষ্মী একটি দিন। চারপাশে নতুন বস্ত্রের সমাহারের মধ্যে দেবতা গম্ভীর মুখে শুঁড় বাঁকিয়ে চুপটি করে বসে থাকতেন মাথায় সিঁদুরের ফোঁটা ধারণ করে। সেদিন দেখা যেত দেবতা গণেশেরও কেরামতি। যার দোকানের বাকি যত শোধ হলো, সেই দোকানের দেবতা গণেশের খুশি দেখে কে!

মুসলিম দোকানে গিয়ে অপেক্ষা করতে না করতেই থালায় এসে জুটত সুজির হালুয়া আর পাতলা রুটি, কখনো-বা ছোলার হালুয়া, লুচি আর বুঁন্দিয়া। আর সেই বুঁন্দিয়ার চেহারা কি! একটা লাল রঙের তো আরেকটা সবুজ, অথবা আরেকটা হলুদ। সে যে কি আমাদের হাসি আর উৎসাহ! মনে মনে ভাবতাম— আহা! এমন যদি প্রতিদিন হতো। লেখাপড়ার বালাই নেই, শুধু সকালে উঠে মালা-ঠোলা নিয়ে কাকা, চাচা, মামা, দাদাদের দোকানে ঘোরাঘুরি করা।

পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ রৈ রৈ করে ঘুরে বেড়ানো। কোচড়ভর্তি করে দোকানে দোকানে খাবার জোগাড় করে, পথে কিছু খেয়ে, কিছু ফেলে, কিছু বাড়িতে টেনে এনে মায়ের ঝুলিয়ে রাখা কুলুঙ্গির ভেতরে আতি সযত্নে তুলে রাখা। মাঝে মাঝে গুনে গুনে দেখা কতগুলো লুচি, কতগুলি রসোগোল্লা, কতগুলো হালুয়া আর জিলিপি তখনও আছে। 

এইসব মহার্ঘ্য খাদ্যদ্রব্য আবার চুরির ভয় ছিল! ছোট ভাইবোনেরা ছিল, তাদের লুব্ধ দৃষ্টি পড়ে থাকত আমার খাদ্যভান্ডের দিকে। তাই যতদূর সম্ভব সবচেয়ে উঁচু ঝুলন্ত শিঁকেয় খাবারগুলো নিরাপদে সংগ্রহ করে রাখতাম। তবে এসব খাদ্যদ্রব্যের আলটিমেট ভবিষ্যৎ যে কী, তা নিয়ে তখন চিন্তা করবার সময় বা মনোবৃত্তি ছিল না। তাছাড়া ভাইবোনদের মধ্যে আমার খাবারটাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হতে হবে, নইলে মান থাকবে না! এই বোধও জোরেশোরে মনের মধ্যে কাজ করত। তখন এটুকু বোধ ছিল না যে, রাত পোহাবার আগেই বেশির ভাগ খাবার খেয়ে ফেলতে হবে বা বিলিয়ে দিতে হবে, নইলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ ফ্রিজ বলে কোনো পণ্য বাড়িতে নেই বা আশেপাশে কারও বাড়িতেই তখন ছিল না। এতসব ঘটনার পরেও বাড়িতে ফিরে এসে মায়ের দেওয়া পান্তাভাত আর গরমাগরম ইলিশ মাছ ভাজাটাও খেতে হবে। 

আমার বাবার ধুতি পাঞ্জাবি পরা লম্বা ফর্সা টকটকে চেহারাটা আমার চোখে এখনো ভাসে। সেই শান্তিপুরি ধুতির কোঁচা থাকত পাঞ্জাবির পকেটে গোঁজা। কোঁকড়া চুল আর উন্নত ললাট ছিল তাঁর। তিনি আমাদের বলতেন, তাঁর পূর্ব পুরুষ রাজপুতানার বংশের মানুষ। বাবারও অনেক বন্ধু ছিলেন। অশ্বিনী কাকু, ডাক্তার কাকু, কেষ্ট কাকু, মোস্তফা চাচা, সিদ্দিক চাচা, পহেলা বৈশাখে তারা আমাদের বাড়ির দরজার সামনে এসে হাঁক দিতেন— ওরে ঘ্যানা! 

আমার বাবা সারাজীবন রোগা। তাই তার নাম ঘ্যানা। আর আমার মা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য বংশের মেয়ে এবং অন্য এক বাড়ির মেয়ে, কিন্তু তাঁর নাম ছিল ঘন! সে আরেক অবিশ্বাস্য কাহিনি। আমাদের বাবা সকালবেলাতেই বন্ধুদের ডাকে বেরিয়ে যেতেন। বাবার ছিল একটি উদাসী ধরনের মন। সংসার যে তার কাছে খুব ভালো লাগত একথা বলতে পারব না।

তারপর বাবা-চাচা-মেসো-খুড়ো তারা যে দলবেঁধে কোথায় যেতেন আমি জানিনে। তবে তাদের সঙ্গে যেন চোখাচোখি না হয়, এই কামনা আমরা ভাইবোনেরা মনে মনে করতাম। নইলে আমাদের ঝোলাভর্তি ফকিরের মতো খাবার দাবার টেনে বেড়াতে দেখে নির্ঘাৎ কান মলা ছাড়া আর কিছুই জুটতো না। এমন কি হাত থেকে কেড়ে নর্দমায় ফেলে দিতেও আমার বাবার জুড়ি ছিল না!

আমাদের যশোরের তসবীর মহলে পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় শুরু হতো গান, বাজনা ও আবৃত্তি। পহেলা বৈশাখে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী যশোরের শেফালি দিদি গান গাইবেন স্টেজে। নজরুল সংগীত। আহা! কি তাঁর গলার জোর। কি তাঁর গানের কেরামতি। একবার তো তাঁর গান শুনতে শুনতে একজন যুবক অডিয়েন্সের ভেতরে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তাই নিয়ে যশোর শহরে কত হাসাহাসি! 

আবার যশোরের মহসীন ভাইও খুব নামকরা সংগীতশিল্পী ছিলেন। তিনিও পহেলা বৈশাখে তসবির মহলে স্টেজে উঠে ভালো গান গাইতেন। তাঁর বাড়ি ছিল লালদিঘীর পাড়ে। তাঁরও গলায় সুন্দর সব আধুনিক গান খেলা করত। তাঁর চেহারাটাও ছিল রাজপুরুষের মতো। আমরা স্কুলের মেয়েরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাঁর গাওয়া গান মুগ্ধ হয়ে শুনতাম! মনে মনে আমিও কল্পনা করতাম তাঁর মতো আমিও একদিন ওরকম স্টেজে দাঁড়িয়ে গান গাইব! লোকে আমাকে প্রশংসা করবে। আমার গান শুনে হাততালি দেবে। যে হাততালি আর থামতেই চাইবে না!
আমার মনের কথাটা একদিন বড় বোন রিজিয়ার কানে কানে বলতেই সে ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, ইস রে, কুঁজোর চিৎ হয়ে শোওয়ার শখ!
আমাদের মা যে-সমস্ত শ্লোক বলে আমাদের খোঁটা দিতেন, তার সব আমার বড় বোনের মুখস্থ ছিল। আর সে জন্যে তো আমি একদিন রাগ করে তার মাথার চুল জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম!

শেফালি দিদি আমার বড় বোন রিজিয়া খাতুনের সতীর্থ ছিলেন। দুজনের ছিল গলায় গলায় ভাব। শেফালি দিদির বাড়ি রেলরোডে। কখনো কখনো আমার বুবু আমাকে সঙ্গে করে শেফালি দিদির বাড়িতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। ওদের ভেতরে কত গল্প, কত কথা, কত হাসাহাসি। যশোরের কে একজন শেফালি দিদিকে ভালোবেসে ফকিরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে— তাই নিয়েও দুই সখীতে হা হা হি হি। 

আমি সেসব কথার আর হাসির কোনো মানেই বুঝতাম না। আমি ওদের সঙ্গে শুধু ‘ল্যাংবোট’ হয়ে ঘুরতাম। আমার মা নিশ্চয়ই আমার বোনকে একা বাইরে ছাড়তে চাইতেন না, তাই মনে হয় স্পাই হিসাবে আমাকে তার সফরসঙ্গী হতে হতো। সে কারণে আমিও বোনের সঙ্গে শেফালি দিদির বাড়িতে যেতাম। দিদির মা রান্নাঘরে বসে লুচি বেলতেন। আমি সেই রান্নাঘরে মাটিতে উঁবু হয়ে বসে লুচিবেলা দেখতাম।

কাঁসার গামলায় ময়দা ফেলে লবণ আর একটু ঘি দিয়ে একটু চটকে মাখানো। মাখিয়ে খাল করে নরম করে ফেলা। তারপর সেগুলিকে ছোট ছোট টুকরো করে লুচি করে ফেলা। ওঁর মায়ের হাতের ক্ষিপ্ত বেলায় ময়দার লুচিগুলো যেন ভরতনাট্যমের মতো এঁকেবেঁকে কিছুক্ষণ নাচ করে গোল হয়ে উঠত! শুধু গোল বললে হবে না, একেবারে সুগোল। আগুনের তাপ পড়তেই লুচিগুলো টেনিসবলের মতো ফুলে উঠত। তখন তার নাম হতো ফুলকো লুচি। তারপর সেই লুচি আর মোহনভোগ খেয়ে আমি খুশিতে পাগল হয়ে যেতাম। এত ভালো স্বস্বাদু লুচি আর মোহনভোগ আমি আর জীবনে কারও হাতে খাইনি! যশোরে রায়ট হলে শেফালি দিদিরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন। 

তো তসবীর মহলে শুরু হতো পহেলা বৈশাখ উদযাপন। সারাটা হল ভর্তি হয়ে যেত মানুষে। ফুলের গন্ধে হল মৌ মৌ করত। আমিও কোনো এক বৈশাখে আমাদের স্কুলের হয়ে একটি নাটকে যোগ দিলাম। আমার রোল সেনাপতির। আমার কোমরে ঝুলন্ত লম্বা তলোয়ার, মাথায় জরির মুকুট, পরনে সিল্কের শাড়ি ধুতি করে পরা। পায়ে সোনালি চাপ্পল।

নাটকে সেই প্রথম জীবনে অভিনয় করছি! আমার বাহাদুরি দেখে কে! বাবাকে আগের দিন বললাম আমার অভিনয়ের কথা। ডায়ালগ মাত্র একটা। ইনিংসের ফাঁক দিয়ে ঢুকে সিংহাসনে বসে থাকা রাজাকে একটা খবর দেওয়া মাত্র। তারপর আবার সাঁৎ করে পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া। সবই ঠিক ছিল। পর্দার আড়ালে আমার বাবা দর্শকের সামনের সারিতে এসে বসেছেন সেটাও উঁকি মেরে দেখলাম। বাবাকে বাহাদুরি দেখাবার জন্য মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। তারপর যখন স্টেজে প্রবেশ করবো, তখুনি আমার এক পায়ের চপ্পল আমার অজান্তে কোনো বেহুদার রেখে দেওয়া পাপোশে গেল আটকে। কিছুতেই আর ছাড়াতে পারিনে। ওদিকে সময় বহে যায়। সময় বহিয়া যায়।

রাজামশাই সিংহাসনে বসে উদগ্রীব হয়ে উইংসের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আর কি করি। এদিকে প্রম্পটার তাড়া দিচ্ছে। ওদিকে এক পায়ের স্যান্ডেল পাপোশ থেকে উঠাতে পারিনে। সুতরাং এক পা খালি আর আরেক পায়ে স্যান্ডেল নিয়ে স্টেজে ঢুকে রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে কুর্নিশ করে ডায়ালগ বলে আবার কুর্নিশ করতে করতে পিছিয়ে এলাম। পর্দার বাইরে এসে মন খারাপ করে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সেই আমার জীবনের প্রথম স্টেজ নাটক এবং সেই শেষ! 

পহেলা বৈশাখের দিন আমাদের পাড়ার ডায়মন্ড ক্লাবও চুপ করে বসে থাকত না। কোনো না কোনো নাটক তারা স্টেজে দাখিল করত। তবে বেশির ভাগ হাসির নাটক করত। পাড়ার অনেক মেয়েরা সেই নাটক দেখতে যেত। আমার ভাইয়েরা সব নাটক করায় ছিল ওস্তাদ। শহীদুল, হেদায়েতুল, কবিরুল সব ভাই নাটক করত। নাটক করে অনেক প্রাইজ জিতে নিয়ে আসত বাড়িতে। তবে ঐ পর্যন্তই।

আমার ছেলেবেলার পহেলা বৈশাখে আমার কাকিমার কথা তো না বললেই নয়। এই কাকিমা ছিলেন আমাদের বসত বাড়ির বিশাল চৌহদ্দির ঠিক উল্টো দিকে। কাকিমার বাড়িও ছিল অনেক বড়। সামনে লম্বা টানা বারান্দা এমুড়ো থেকে ওমুড়ো। সেই বারন্দা ছিল চারদিকে খোলা। আমরা সেখানে উঠে খেলাধুলা করতাম। কাকার নাম ছিল রণজিৎ কুমার বোস। তিনি ছিলেন যশোর কোর্টের নামকরা উকিল। কালো লম্বা কোট পরে তিনি আদালতে যেতেন। আর কাকিমা ছিলেন গৃহিণী। কিন্তু সর্বদাই তাঁর হাতে ধরা থাকত একটি বই। তাঁর চেহারা ছিল টকটকে ফর্সা। লম্বা একহারা চেহারা। কপালে বড় একটি সিঁদুরের টিপ। পরনে চওড়া লাল পাড় শাড়ি। তার বাড়ির সবকিছু ছিল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অথচ একগাদা ছেলেমেয়ের তিনি মা। স্বাগতা দিদি ছিলেন তাঁর বড় মেয়ে। আমাদের সঙ্গে এমএসটিপি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। তার চেহারাও দেখতে খুব সুন্দর ছিল। গোরা, সত্য, ভাস্কর ছিল তার ভাইদের নাম। মনীষা ছিল সবার ছোট বোন। 

আমি আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি তার পেছনে আমার এই কাকিমাটির অবদান অসীম। কিন্তু সেকথা বলবার কোনো অবকাশ মেলেনি। তাঁর মুখেই আমি শুনেছি অবিভক্ত ভারতের বিপ্লবীদের বীর ইতিহাস। শুনেছি সূর্যসেনের কথা, শুনেছি বাঘা যতীনের কথা, শুনেছি বীর তিতুমীরের কথা, শুনেছি সিরাজউদ্দৌলার কথা। আমার নিজের বাড়িটি ছিল বই-পত্র-ম্যাগাজিনহীন শুষ্ক একটি গহ্বর। আমার চিন্তার খোরাক জোগান দিতেন, আমার আগ্রাসী বই-ক্ষুধার জোগান দিতেন আমাদের পাড়ার এই কাকিমা। জানিনে এ রকমের কাকিমা বাংলাদেশে আর আছেন কিনা। বা থাকলেও কোথায় আছেন আমি জানিনে। তবে অবশ্যই আছেন কোথাও না কোথাও, এ বিশ্বাস এখনও আছে।

আমি জানিনে আমার কাকিমা কতদূর লেখাপড়া করেছিলেন, বা আদৌ তার গতানুগতিক শিক্ষার কোনো ইতিহাস ছিল কি না, কিন্তু তাঁর সুডৌল, সুমসৃণ হাতে ধরা থাকত সর্বদাই একটি বই। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস পড়েই তিনি তাঁর বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘গোরা’। এই কাকিমার বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা বা অন্য কোনো গৃহদেবতার পূজার সময় ফল কাটা থেকে তাঁর পূজার সামগ্রী গুছিয়ে দেওয়ার ভার ছিল আমার এবং আমার ছোট বোনদের। স্বাগতাদিদিও থাকতেন আমাদের সঙ্গে। মনীষাও থাকত আমাদের সঙ্গে। পূজোর এইসব সরঞ্জাম আমরা একসঙ্গে গোছাতাম বলে পাড়ার অন্য হিন্দু মহিলারা, তারাও ছিলেন আমাদের কাকিমা-জেঠিমা, তারা কাকিমাকে মন্দ বলতেন। বলতেন, তোমার পূজো কি হবে? মুসলমানের হাতে তোমার পুজো কি হবে? 

তার উত্তরে শুনেছি কাকিমা একদিন পাড়ার কেষ্ট মামার স্ত্রী, আমরা যাকে মামি বলে ডাকতাম, তাকে বলেছিলেন, দিদি, এই যে তুমি আতপ চাল দিয়ে, শাক আলু দিয়ে, আখ দিয়ে, চিড়ে দিয়ে ঠাকুরের নৈবদ্য সাজাও, এই যে তুমি হেঁসেলে প্রতিদিন চাল বসিয়ে নিজেদের খাওয়ার জন্যে ভাত রান্না করো, এই যে তুমি সুক্ত করো, ডাল করো, এর প্রতিটি জিনিস মুসলমানের হাতে তৈরি হয়েছে। একেবারে গোড়া থেকে। বীজ থেকে ধান, তারপর চাল, সবকিছু এই মুসলমানের দিবারাত্রির পরিশ্রমের তৈরি, কই তখন তো বলো না, না আমি নিজের হাতে ধান বুনে চাল তৈরি করে ভাত রান্না করে খাবো! নইলে আমার জাত যাবে। তোমার জাত তো দিদি বহুকাল আগেই চলে গিয়েছে! এখন আর কীসের জাত তোমার?

ডাক্তারি পড়তে ঢাকায় আসবার কালে আমি কাকিমার হাত ধরে বলে এসেছিলাম, কাকিমা, আমি ডাক্তারি পড়া  শেষ করে যখন যশোরে ফিরে আসবো, তখন কিন্তু আমি আপনাকে ঠিক এইরকম দেখতে চাই। আপনি কিন্তু আমাদের ছেড়ে কোত্থাও যাবেন না। তিনি আমার কথা শুনে বলেছিলেন, পাগল! তারপর তিনি আমাকে চিঠি লিখেও কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি ঠিকই আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করে থাকবেন। কিন্তু ১৯৬৩’র রায়টের পর তিনি কথা দেবার পরেও যশোরে আর থাকতে পারেননি। মূলত কোনো হিন্দু পরিবারই আর সেভাবে থাকতে পারেনি। সকলকেই একে একে বিদায় নিতে হয়েছে। পাকিস্তানের জোর কি কম? আমাদের সংস্কৃতি নিধনের ধারা তো পাকিস্তানের হাতেই। যার লিগেসি আমরা এখন পর্যন্ত টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি!

আর আমি এতকথা বলার পরেও এই কাকিমার নামটি পর্যন্ত এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি! তবে এসব কথা এখন থাক। কাকিমার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কথাটা বলি। সেদিন কাকিমার বাড়িতে গেলে প্রসাদ পেতাম দরাজ হাতে। কত রকমের খাবার পেতাম খেতে। কত যে গল্প হতো সেই সঙ্গে। কাকিমা কখনো উপদেশ দিতেন না, কিন্তু তিনি কিছু না বলতেই আমরা যেন বুঝে যেতাম কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক। 

এখন আমি বয়সের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। যেন চোখের নিমেষে জীবন শেষ! যেন ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই জীবন শেষ! যেন জীবন নদীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব, আমি বিহ্বল! তারপরও আমার আনাড়ি হাতে কতবার করে যে কাকিমাকে ফেইসবুকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করেছি! কোনো ফল পাইনি। সেইসঙ্গে আমার ছেলেবেলার পহেলা বৈশাখকেও যে কতবার খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি, সে চেষ্টাও আর সফল হয়নি। এখন মনে করি এইসব খোঁজাখুঁজির ভেতরে সময় আর অপচয় করতে নেই। কালের গহ্বরে যা একবার ঢুকে গেছে তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার ঠিক সেইটুকু, যেটুকু আজ আমাকে এইখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই সময়ের পহেলা বৈশাখ তার নিজের দর্শন নিয়ে, নিজের সময় নিয়ে সমুখের দিকে এগিয়ে চলুক। আমিও থাকব তার সঙ্গে। কারণ চলাই হচ্ছে জীবন। 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়