শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুর্তজা বশীর : বন্ধুর জন্য জন্মদিন বদল
কাজল রশীদ শাহীন || রাইজিংবিডি.কম
মুর্তজা বশীর বিশেষ একটা কারণে খুইয়েছিলেন পিতৃপ্রদত্ত জন্মদিন। প্রকৃত জন্মদিনে রাখতেন না কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা। সবাই জানেন ১৭ আগস্ট উনার জন্মদিন, তাতে কোনোপ্রকার মিথ্যে বা সংশয় নেই একরত্তি। কারণ, পিতা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সকল সন্তানের জন্মদিন ও জন্মমুহূর্ত টুকে রাখতেন। যাতে উল্লেখিত ছিল সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্মদিন ১৭ আগস্ট ১৯৩২। খ্রিস্টাব্দ ২০০৫ অবধি সেভাবেই পালিত হতো উনার জন্মদিন। পরের বছর পাল্টে যায় সেই তারিখ। এমনিতে জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বাস করতেন না তিনি। নিকটজনদের আবদার ও জোরাজুরিতে কোনোরকমে কিছু একটা করা হলেও সেটা করতেন পরদিন ১৮ আগস্ট। কেন করতেন এমনটা, তাঁর জবাব তিনি নিজেই দিয়েছেন। সে কথা বলার আগে একটু জেনে নেয়া যাক উনার মানসগঠন সম্পর্কে।
স্বাধীনচেতা বলতে যা বোঝায় আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেন তার প্রতিভূ। সবসময় নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছেন। নিজের পরিচয়ে বড় হওয়ার বাসনা জারি রেখেছেন। পিতা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যশ্বস্বীজন। এ নিয়ে উনার অহঙ্কার যে ছিল না, তা কিন্তু নয়। তবে সেটা ছিল একেবারে শৈশবে এবং কৈশোরক বয়সের মাঝামাঝি অবধি। একটা ঘটনায় বদলে যায় পিতাকে নিয়ে সেই দম্ভ বা অহঙ্কার। তারপর থেকে তিনি পিতার ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠেন নিজের পরিচয় দাঁড় করানোর জন্য। এমনকি পাল্টে নেন নিজের নামও।
মুর্তজা বশীরের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল আবুল খায়র মুহম্মদ মুর্তজা বশীরুল্লাহ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রেখেছিলেন ওই নাম। তিনি আগে-পরে ছেঁটে সংক্ষিপ্ত করে নিজের নাম রাখেন মূর্তজা বশীর। একদিন বাসার ঠিকানায় চিঠি আসে ওই নামে। পিয়ন ‘মূর্তজা বশীর’ নাম ধরে বললেন, ‘চিঠি চিঠি’। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঘর থেকে বেরিয়ে পিয়নকে জানালেন, ‘ওই নামে এখানে কেউ নেই।’ পাশের ঘর থেকে মুর্তজা বশীর বেরিয়ে এলেন। বললেন , ‘ওটা আমার চিঠি, আমিই মূর্তজা বশীর।’ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভিমড়ি খেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে খামের ওপর লেখা নাম দেখে বললেন, ‘মূর্তজা’ বানানটা দীর্ঘ-ঊ-কার দিয়ে কেনো লিখেছো? মূর্খ বানান লেখা হয় দীর্ঘ-ঊ-কার দিয়ে, তুমি তো মূর্খ নও, হ্রস্ব-উ-কার দিয়ে লেখো। যুক্তিটা মনে ধরলো। মূর্তজা বশীর সেদিন থেকে হয়ে গেলেন মুর্তজা বশীর।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন সপরিবারে থাকতেন বগুড়ায়। ওখানকার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। মুর্তজা বশীর শহর ঘুরে বেড়ান বাবার পরিচয়ের দম্ভ নিয়ে। সবাই এক নামে চেনে। দেখলেই রাস্তা ছেড়ে দেয়, আগবাড়িয়ে ছালাম জানায়। যা বলেন যা করেন, কোনোপ্রকার প্রশ্ন ছাড়াই বন্ধুরা একবাক্যে মেনে নেয় সেসব। এমনকি বড়রাও সমীহ করে চলে। কারণ একটাই, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে বলে কথা। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন জনৈক ভদ্রলোক। কাছে ডেকে নিয়ে নানা আলাপের মাঝে স্পষ্ট করে বললেন, তুমি কি জানো, সবাই তোমাকে এতো সমীহ করে চলার কারণ হলো তুমি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে। তোমার নিজের কী পরিচয়, কী হয়েছো আর কীইবা পারো তুমি? বাবা ছাড়া তুমি যে জিরো, সেটা কি বোঝো?
কথাগুলো মনে ধরলো মুর্তজা বশীরের। মুহূর্তেই মনে হলো, পুরো পৃথিবীটা শূন্য, পায়ের তলায় মাটি নেই একটুও। সত্যিই তো, ‘আমার কোন পরিচয় নেই।’ ঘরে-বাইরের সব জায়গায় একটাই পরিচয় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে তিনি। পণ করলেন জীবনে আর কোনোদিন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পরিচয়ে পরিচিত হবেন না। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবেন, যাতে সবাই ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে মুর্তজা বশীর না পরিচয় দিয়ে বলে যেন মুর্তজা বশীরের বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।’ মুর্তজা বশীরের এই আকাঙ্ক্ষা পরে বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছিল।
ছাত্রজীবনেই যুক্ত হয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। এ জন্য খ্রিস্টাব্দ ১৯৫০-এ কারান্তরীণ ছিলেন প্রায় পাঁচ মাস। এ সময়ও তিনি আদালতে বা অন্যত্র ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে পরিচয়ে বিশেষ কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেননি। পরবর্তীতে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিজে আদালতে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন।
মুর্তজা বশীর নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা জারি রেখেছিলেন জীবনভর। আমৃত্যু সেই চেষ্টা থেকে বিচ্যুত হননি। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো কিছু করার ধাত বা অভ্যাস ছিল না কখনোই। যখন যেটা ভালো মনে করেছেন, নিজের যুক্তি ও বিবেচনায়, সেটাই করেছেন। এ সবে কে কী মনে করলো তা নিয়ে কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম মুর্তজা বশীরের জন্মদিন বদলে নেওয়ার কথা। কেন তিনি ১৭ আগস্ট জন্মদিন পালন না করে ১৮ আগস্টকে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ ওই দিন মারা যান উনার প্রিয় বন্ধু কবি শামসুর রাহমান। সেই থেকে ২০১৯ অবধি জন্মদিন পালন করেন ১৮ আগস্টে। বন্ধুর প্রতি এ রকম ভালোবাসা কেবল বিরল নয়, তুলনারহিতও বটে। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে মুর্তজা বশীরকে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতা পদক থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়। অথচ আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান কারোরই অজানা নয়।
সাব্বীর আহমেদ বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ করেছেন, ‘‘মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং রক্তাক্ত আবুল বরকতকে অন্যদের সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যান। ২২শে ফেব্রুয়ারি কলা ভবনের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার ওপর ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামে ১৯৫২ সালে তিনি লিনোকাটে চিত্রটি আঁকেন, যা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক সংকলনে ১৯৫৩ সালে প্রথম মুদ্রিত হয়। ‘রক্তাক্ত ২১শে’-এটিকে ভাষা আন্দোলনের ওপর আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের ওপর ‘পারবে না’ শিরোনামে তাঁর কবিতা ছাপা হয় এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত একুশের স্মরণিকায় ‘ওরা প্রাণ দিল’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে ‘স্বা-ধী-ন-তা’ মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এর আগে ১৯৭১ সালের ১১ই মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের ‘মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যাফেয়ার্স’ কর্তৃক আয়োজিত রিজিওনাল কো-অপারেশন কাউন্সিল (আরসিসি) ভুক্ত দেশের শিল্পীদের প্রদর্শনী তিনিসহ অন্যান্যরা বর্জন করেন। এ সময় তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তান সেনাদের হামলা এবং বিভিন্ন স্থানে অনেককে হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্তদের প্রতি খেতাব বর্জনের আহবান জানান।’
মুর্তজা বশীর একুশে পদক পান ১৯৮০-তে। তারপর দীর্ঘ সময় উনাকে স্বাধীনতা পদক থেকে বঞ্চিত রাখা হয়, কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনায়। এই নিয়ে উনার দুঃখ ছিল। এটাকে তিনি রাষ্ট্রের তরফে বঞ্চনা বলে জ্ঞান করতেন। সেই সময় যাদের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে, সেই তালিকা বিবেচনায় উনার এই দুঃখবোধ যুক্তিসঙ্গত। এ কারণে তিনি আমাদের বলেছিলেন, মৃত্যুর পর যদি তাঁকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়, সেটা যেন পরিবারের কেউ গ্রহণ না করেন, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন। মৃত্যুর মাত্র একবছর আগে মুর্তজা বশীরকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। উনি বিশ্বাস করতেন এই পদক না দেওয়া কিংবা দেরিতে দেওয়ার পেছনেও উনার বন্ধুরা কলকাঠি নাড়িয়েছেন।
এসবে প্রধানতম ব্যতিক্রম ছিলেন শামসুর রাহমান। যার মন ছিল অনসূয়া বর্জিত, কলুষতা মুক্ত এবং অপরের কল্যাণে নিবেদিত। বন্ধু তালিকায় আরও কেউ কেউ অবশ্যই ছিলেন, তবে তারা কেউই শামসুর রাহমানের মতো নন। এরকম একজন প্রিয় ও পরীক্ষিত বন্ধুর মৃত্যুদিন হবে উনার জন্মদিনে, তা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। এ কারণে বন্ধুকে হারিয়ে যে কয়টা জন্মদিন এসেছে তাঁর জীবনে, তার সবকটাই ছিল বেদনার চাদরে মোড়া। বন্ধুর জন্য শোককৃত্য বিশেষ।
জন্মদিন নিয়ে কোনো প্রকার আদিখ্যেতা ছিল না কোনো দিনই। বরং অন্যদিনের চেয়ে চুপচাপ এবং নিজের মতো করে থাকতেই পছন্দ করতেন। কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। পত্রিকায় কোনো লেখা বা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলে, সেটা নিয়ে কথা বলতেন। বোঝা যেত, এসবের মাঝেও নীরবতাকে খুঁজে চলেছেন তিনি। এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, স্পষ্ট করে কিছু বলতেন না, কেবল কাজগুলো শেষ করে যাওয়ার অভিব্যক্তি আর্তনাদের মতো করে উচ্চারিত হতো। আর একটা কথা প্রায়ই বলতেন, বিশেষ করে জন্মদিনে। মৃত্যুর পরও আমি বেঁচে থাকব তো? আমার কাজ টিকে থাকবে তো? শিল্পের ভুবনে কোনো আঁচড় কি রেখে যেতে পারলাম! এই জিজ্ঞাসা নিরন্তর কাজ করতো তাঁর মাঝে। আমরা ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিলেও উনি কিছুই বলতেন না। হয়তো তখন তিনি মহাকালের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, মহাকাল আমি থাকবে তো তোমার কীর্তিমান সন্তানের তালিকায়? মুর্তজা বশীর মারা যান ২০২০ এর ১৫ আগস্ট। দ্রোহ ও প্রেম দুটোই ছিল তীব্র ও উচ্চমার্গের।
মুর্তজা বশীরের কাছের মানুষ মাত্রই জানতেন, উনি কোনো সামাজিকতা রক্ষা করতেন না। এ ব্যাপারে ছিল না কোন প্রকার ঢাক ঢাক গুড় গুড়। স্পষ্ট করেই বলতেন, সব কাজ সবার জন্য না। বলতেন, আমি তো কাউকে বাধা দিচ্ছি না। যার যেতে ভালো লাগে যাবে। যার যেতে ভালো লাগে না, তিনি যাবেন না। এটাই তো হওয়া উচিৎ, নাকি? সামাজিক পরিসরের কোনো কিছুতেই এ কারণে উনাকে দেখা যেত না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে কোথাও গেলেও খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। বিশ্বাস করতেন, এসব সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মুর্তজা বশীর আজন্মই ছিলেন স্পষ্টবাদী। নিজে যেটা ভালো মনে করতেন, যাতে যুক্তি খুঁজে পেতেন সত্য ও ন্যায়ের। সেসব প্রকাশে তিনি ছিলেন খাপখোলা তলোয়ার। কে কী মনে করলেন, এই নিয়ে ভাবান্তর ছিল না মোটেই।
বন্ধুর জন্য যেমন ছিলেন উৎসর্গীকৃত প্রাণ, আবার অন্যায়েও ছিলেন সমালোচনামুখর। সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে বন্ধু মনে করতেন। বলতেন, একসঙ্গে চললেই, একসঙ্গে পড়াশোনা, শিল্প-সাহিত্য করলেই সবাই বন্ধু হন না। কারণ, বন্ধুত্বের লেবাসে সুযোগ-সন্ধানী থাকেন, মুখোশধারী শত্রুও থাকে। বন্ধু হয়ে ওঠার জন্য যোগ্যতা লাগে। এ কারণে আমি সবাইকে বন্ধু মনে করি না। যদিও কেউ কেউ আমাকে ওদের বন্ধু মনে করেন। কিন্তু আমি তো জানি ওরা আসলে কী।
একবার একটি দৈনিক পত্রিকায় বন্ধু দাবিদার একজন তাঁকে নিয়ে একটা লেখা লেখেন। ওই লেখাটা দেখিয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘শোনো কাজল, এরা বন্ধু দাবি করলেও আমি কিন্তু ওদেরকে বন্ধু বলে মনে করি না। ওরা আমাকে এত দুঃখ, কষ্ট দিয়েছে যে, ওদের মুখের দিকে তাকানোর চেয়ে আমি ময়লা-আবর্জনার ড্রেন বা ডাস্টবিনের দিকে তাকাতেই আনন্দবোধ করি। কারণ ওই মুখ আমাকে পদে পদে কেবলই বন্ধুত্বের লেবাসে হতমান আর অবিমিশ্র ব্যথা ও বেদনা দিয়েছে। সকল প্রকার যোগ্যতা থাকার পরও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হতে পারিনি কেবল ওদের জন্য। শুধু কি তাই? শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় আমার অ্যাপ্লিকেশন বারবার ওরা উধাও করে দিয়েছে, আমাকে একটাবারের জন্যও ভাইবা ফেস করার সুযোগ দেয়নি।’
মুর্তজা বশীরের বেডরুমে যারা গিয়েছেন, তাদের নিশ্চয় মনে আছে ওই ছবিটার কথা। যেটায় জয়নুল আবেদিনের সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। সেই ছবির স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন- এই ছবিটা সেদিনের পিজি হাসপাতালে তোলা। জয়নুল স্যার তখন অসুস্থ। আমি দেখা করতে গেলাম। উনি কাছে ডেকে নিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি তোমার ওপর অনেক অন্যায় করেছি। দোয়া করি, আগামীতে যেন কেউ আটকিয়ে রাখতে না পারে তোমার পথ। মুর্তজা বশীর বললেন, জয়নুল স্যার এই অন্যায়গুলো করেছিলেন আমাদের বন্ধুদের দ্বারা।
কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমানের সঙ্গে ছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। হাসান হাফিজুর রহমানের কথা বলতেন নানা প্রসঙ্গে। আবু হেনা মোস্তফা কামালকে পছন্দ করতেন। এঁদের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তিনি। আনিসুজ্জামানের প্রতি অনুভব করতেন বন্ধুত্বের ঐকান্তিক টান। শিল্পীদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম ও দেবদাস চক্রবর্তীর কথা ঘুরেফিরে উঠে আসতো। আমিনুল ইসলাম বয়সে ও বিদ্যায়তনিক পরিসরে কিঞ্চিত জ্যেষ্ঠ হলেও বন্ধুত্বে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। আমিনুল ইসলামের আড্ডার পরিসরেও হাজির থাকতেন মুর্তজা বশীর। এই লেখকের সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল দুজনেরই সান্নিধ্য পাওয়ার। যেখানে দেখা মিলেছে বন্ধুর জন্য বন্ধু অন্তঃপ্রাণ হৃদয়ের। মুর্তজা বশীরের চিত্রকলা যেমন আলাদা, প্রচলিত ধারা থেকে ব্যতিক্রম ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। বন্ধুকৃত্যও ঠিক তাই, আলাদা, স্বয়ম্ভূ ও সহজাত।
লেখক: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক
তারা//