গোলাম মুরশিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা
স্বরোচিষ সরকার || রাইজিংবিডি.কম
লন্ডনের কুইন্স হাসপাতালে গত ২২শে আগস্ট সকাল ১১টায় গোলাম মুরশিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৩৯ সালের ৮ই এপ্রিল শনিবার বরিশাল জেলার ধামুরা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সে অনুযায়ী তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। বাঙালির গড় বয়সের হিসেবে তিনি দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন বলা যায়। তবে শুধু জৈবিকভাবে বাঁচা নয়, আমৃত্যু তিনি তাঁরলেখনী সচল রাখতে পেরেছিলেন। উনিশশো ষাটের দশক থেকে দুই হাজার বিশের দশক পর্যন্ত প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি যেভাবে বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, তা সাধারণত দেখা যায় না। এই দীর্ঘ সময় ধরে তিনি অর্ধশতাধিক গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন, যার বিষয়বস্তু বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি। এমন বিস্তৃত এলাকা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার জন্য ২০১৯ সালের একটি সংবর্ধনা সভায় তাঁকে ‘বঙ্গবিদ্যাবিশারদ’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়। এই উপাধি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে। বঙ্গবিদ্যাবিশারদ গোলাম মুরশিদকে অন্তিম অভিবাদন|
১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ থেকে গোলাম মুরশিদ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডেভিড কফ। গবেষণাকর্মটি ১৯৮৪ সালে ‘হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক’ নামে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তিনি তাঁর এই গবেষণায় উপস্থাপন করেন।
গোলাম মুরশিদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে। পিএইচডি করার পরপরই অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের অধীনে গোলাম মুরশিদ একটি পোস্ট ডক্টরাল কাজের সুযোগ পান। এই গবেষণাকাজে তিনি দেখতে পান, উনিশ শতকের নারী জাগরণ মূলত পুরুষদের আগ্রহে এবং পুরুষদের প্রয়োজনে ঘটেছিল। গবেষণার শিরোনামের মধ্যেও ধারণাটির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে রাজশাহী থেকে Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization নামে।
এর দুই বছর পর ১৯৮৫ সালে বইটির একটি বাংলা সংস্করণ ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ পায়। নাম দেওয়া হয়: ‘সংকোচের বিহ্বলতা: আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী’। ২০১৬ সালে এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রথমা প্রকাশন। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক নাগাদ বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন স্টাডিজ নামের একটি শৃঙ্খলা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই শৃঙ্খলায় গোলাম মুরশিদের এই গবেষণাটি অগ্রণী হিসেবে সমাদৃত হয়ে থাকে।
আশির দশকের সূচনায় গোলাম মুরশিদ বিবিসির চাকরি নিয়ে লন্ডন-প্রবাসী হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি এ সময়ে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী গবেষণার অভ্যাসটিও বজায় রাখেন। অবসর সময় এবং ছুটির দিনে তিনি ছুটে যান লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরি, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, এমনকি অক্সফোর্ডের একাধিক লাইব্রেরিতে। উনিশ শতকের ভাষা-সাহিত্যের উপকরণাদি সংগ্রহ করতে থাকেন। এভাবে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ‘কালান্তরে বাংলা গদ্য’ নামে তিনি একটি বই লেখেন, যা ১৯৯২ সালে কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ থেকে প্রকাশ পায়। আঠারো শতকের গদ্যের বহু অনালোচিত গদ্যনির্দশন এ বইয়ে প্রথমবারের মতো উপস্থাপিত হয়। তবে বইটির বিশেষ গুরুত্ব অন্য একটি কারণে। উনিশ শতকের বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের ঝোঁক বাড়তে থাকায় ক্রমে তা আঠারো শতকের ভাষা থেকে খানিকটা স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে থাকে, বইটিতে গোলাম মুরশিদ তা বিশেষভাবে লক্ষ করেন এবং প্রক্রিয়াটির নাম দেন ‘সংস্কৃতায়ন’। বিশ-একুশ শতকের বাংলা ভাষায় এখনো যে তৎসম তথা সংস্কৃত চেহারার শব্দের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি, গোলাম মুরশিদের এই তত্ত্ব ছাড়া অন্য কোনোভাবে তার ব্যাখ্যা মেলে না।
প্রায় একই সময়ে গোলাম মুরশিদ লন্ডন ও অক্সফোর্ডের পাশাপাশি প্যারিসের জাতীয় লাইব্রেরি থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন সংক্রান্ত বহু নতুন তথ্য সংগ্রহ করেন। নতুন বিশ্লেষণসহ এসব তথ্য যোগ করে গোলাম মুরশিদ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ ‘আশার ছলনে ভুলি’। শতাধিক বছর ধরে মধুসূদনের জীবনী বহু জনে লিখেছেন। কিন্তু গোলাম মুরশিদের লেখা এই জীবনী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। এখানে শুধু নতুন তথ্য আছে তাই নয়, এখানে মাইকেলের অন্তরলোকও চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনীটি ১৯৯৪ সালে কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ থেকে প্রকাশিত হয়।
বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকে গোটা বাংলাভাষী অঞ্চলে মাইকেলের জীবনীকার হিসেবে গোলাম মুরশিদের জনপ্রিয়তা অসাধারণ বৃদ্ধি পায়। ক্রমে তাঁর এ জনপ্রিয়তা এতোটা বাড়ে যে, বাংলাভাষী পাঠকের বৃত্ত ছাড়িয়ে তা আন্তর্জাতিক পাঠককে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ শতকের সূচনায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বইটির একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে Lured by Hope: A Biography of Michael Madhusudan Dutt (২০০৩) নামে। প্রায় একই সময়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস গোলাম মুরশিদকে দিয়ে মধুসূদনের চিঠিপত্রের একটি সংকলনও সম্পাদনা করায়, যার নাম দেওয়া হয় The Heart of a Rebel Poet: Letters of Michael Madhusudan Dutt (২০০৪)।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। গোলাম মুরশিদ এই যুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধপূর্ব কালেও পালন করেছিলেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। যেমন ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্যাসাগর’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ। স্মারকগ্রন্থটিতে তৎকালীন বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রায় সব বুদ্ধিজীবী বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে তাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উজ্জীবিত করতে অনেকটা অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। একটি প্রবন্ধে একজন প্রবন্ধকার বিদ্যাসাগরের নৈতিক দৃঢ়তাকে তুলনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৈতিক দৃঢ়তার সঙ্গে। সম্পাদক হিসেবে গোলাম মুরশিদ ছিলেন এসব জাতীয়তাবাদী চেতনাসমৃদ্ধ প্রবন্ধের মালাকার। পরিণতি হিসেবে তিনি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কুদৃষ্টিতে পড়েন। তাই পাকিস্তানের কল্যাণের লক্ষ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষককে হত্যা করার তালিকা বানানো হয়, গোলাম মুরশিদের নাম সেখানে দুই নম্বরে থাকে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যেই তাই গোলাম মুরশিদকে শরণার্থী হিসেবে ভারতের কলকাতায় আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। সেখানে প্রথম দিকে তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কাজ নেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় তিনি ‘হাসান মুরশিদ’ ছদ্মনামে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি’ নামে ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন। লেখাগুলোর একটি সংকলন একই নামে ওই বছরেই কলকাতার এসোসিয়েটেড প্রেস থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গোলাম মুরশিদ তাঁর শরণার্থী জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’। বইটি ১৯৯৩ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি সম্পর্কে অন্তত এই কথাটি বলা দরকার যে, স্মৃতিকথা বলতে যা বোঝায়, এটি তার চেয়ে খানিকটা আলাদা। স্মৃতিচারণের পাশাপাশি এখানে মুক্তিযুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু ঘটনাকে বিশ্লেষণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে বইটিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হিসেবেও গ্রহণ করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গোলাম মুরশিদের সেরা বই ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস’। বইটি ২০০৫ সালে ঢাকার প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। নির্লিপ্ত না হলে ইতিহাস একপেশে হয়ে যেতে পারে, হয়ও। ১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো বইটির শিরোনামে গোলাম মুরশিদ এভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই এটি নির্দলীয় ইতিহাস—নিরাসক্ত দৃষ্টিতে এবং নির্লিপ্তভাবে লেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
গোলাম মুরশিদের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত বইটির নাম ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’। নাম এবং আয়তন যাই হোক, এটি আসলে গত এক হাজার বছরের বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস। বইটির নাম ‘হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস’ বললেও অসঙ্গত হতো না। ২০০৬ সালে ঢাকার অবসর প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। বইটির এপিগ্রাফে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, এটি তিনি পণ্ডিতদের জন্য রচনা করেননি। কিন্তু বইটির আলোচ্য বিষয়, ঘটনার বিশ্লেষণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপস্থাপনকৌশলের বিচারে এটিকে একটি উচ্চতর গবেষণাকর্ম বলা যায়। এমন নির্মোহ ও অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয়টি লেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। এর সঙ্গে তুলিত হতে পারে একমাত্র নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব’। কিন্তু বাস্তবে সেটা বাংলা নামক দেশ সৃষ্টি হওয়ার আগেকার ইতিহাস। এই বিবেচনায় নীহাররঞ্জন রায়ের ইতিহাস যেখানে শেষ, গোলাম মুরশিদের ইতিহাস সেখানে শুরু। গ্রন্থ দুটিকে বরং পরস্পরের পরিপূরক বলা যায়।
২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় গোলাম মুরশিদের ‘কালাপানির হাতছানি: বিলেতে বাঙালির ইতিহাস’। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সূত্রে আঠারো শতক থেকে বহু বাঙালিকে বিভিন্ন উপলক্ষে ব্রিটেনে যেতে হয়েছে। অনেকের গমন সাময়িক বা অল্প কালের জন্য হলেও ক্রমে বহু বাঙালি ব্রিটেনে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। এভাবে একুশ শতক নাগাদ বাঙালি হয়ে ওঠে ব্রিটেনের অন্যতম বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী। বিলেতে বাঙালিদের এই অভিবাসী ও নিবাসী হওয়ার ইতিহাস গোলাম মুরশিদ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। অন্যান্য গবেষণার মতো এ বইটিতেও গোলাম মুরশিদ যে অত্যন্ত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তা খানিকটা বোঝা যায় বইটি প্রকাশের পর ব্রিটেনবাসী সিলেটিদের ক্ষোভ প্রকাশের ধরন দেখে।
গোলাম মুরশিদের ‘রেনেসন্স বাংলার রেনেসন্স’ বইটি ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। এর প্রকাশক ঢাকার অবসর প্রকাশনা সংস্থা। বাংলার জাগরণ সম্পর্কে এর চেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল বই এর আগে আর প্রকাশিত হয়নি। ইটালির রেনেসন্সের সঙ্গে বাংলার জাগরণের তুলনা করে অনেকেই বাংলার জাগরণকে অসম্পূর্ণ বলতে চান; গোলাম মুরশিদ কিন্তু অসম্পূর্ণ বলেন না, বলেন অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও সাহিত্যের মতো কিছু ক্ষেত্রে বাংলার জাগরণ বরং অগ্রগামী। গোলাম মুরশিদ দীর্ঘদিন ধরে উনিশ শতক নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ তাঁর নিবিড় গবেষণার ক্ষেত্র। তার ফলে উনিশ শতকীয় জাগরণকে গোলাম মুরশিদ যতোটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, বাংলার রেনেসন্স নিয়ে পূর্ববর্তী লেখকগণ তা পারেননি। এমনকি রেনেসন্সের সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করার জন্য তিনি যেভাবে জগদীশ বসুর কীর্তিকে আলোচনায় যুক্ত করেন, পাশাপাশি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এবং নজরুল ইসলাম পর্যন্ত এসে থামেন, সেটাও গোলাম মুরশিদের বইয়ের উল্লেখযোগ্য একটি দিক। বাংলার জাগরণ যে ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশেরও চেতনাগত ভিত্তি, গোলাম মুরশিদের এ বই পড়ার পরে পাঠকের সে বোধ স্পষ্ট হয়।
অতি সম্প্রতি (২০১৮) প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীগ্রন্থটি গোলাম মুরশিদের সর্বশেষ অবদান। ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ নামের এই জীবনীগ্রন্থে গোলাম মুরশিদ কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। জীবনীগ্রন্থের যে মডেল তিনি ‘আশার ছলনে ভুলি’-তে তৈরি করেছিলেন, নজরুলের জীবনীতেও তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। অর্থাৎ শুধু সনতারিখের ইতিহাস নয়, নজরুল ইসলামের মনোলোকের ইতিহাসও এ জীবনীতে ধরা পড়ে।
১৯৭২ সালে গোলাম মুরশিদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিদ্যাসাগর বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। পরে সেই বক্তৃতা বই আকারে বের হয় ১৯৮১ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে ‘রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা’ নামে। বইটির পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে ‘রবীন্দ্রমানস ও সৃষ্টিকর্মে পূর্ববঙ্গ’ নামে ঢাকার অবসর প্রকাশনা সংস্থা থেকে। বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ড রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার বিকাশে কী ভূমিকা পালন করে, একদিকে সেটা যেমন এ বইয়ের আলোচ্য; একইভাবে ১৯৪৭-পরবর্তী বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে চর্চার বিষয় হয়েছেন সেটাও এর অন্যতম আলোচ্য।
গোলাম মুরশিদের জীবন-সাধনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন অভিধান সম্পাদনা। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে মোট তিন খণ্ডে ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদিত ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’। অভিধানটি এককথায় বাংলা শব্দের ইতিহাস। শব্দ যেহেতু চেতনার ধারক, সেই অর্থে অভিধানটি বাঙালির যাবতীয় চেতনাকে ধারণ করে। বাংলা ভাষায় একটি শব্দ ঠিক কখন লিখিত চেহারা পেয়েছে, কখন সেই শব্দের অর্থ বদলে গেছে, কখন শব্দটির চেহারায় পরিবর্তন এসেছে—অভিধানটিতে তা বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার সকল রচনার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। অভিধানটি থেকে এভাবে গোলাম মুরশিদের পঠন-অভিজ্ঞতার সামগ্রিকতা সম্পর্কে আন্দাজ করা যাবে।
গোলাম মুরশিদের লেখা অনেক প্রবন্ধ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে বহু মৌলিক ধারণাকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এর মধ্যে অনেক ধারণা নিয়ে গোলাম মুরশিদ আলাদা বই লিখতে পারতেন। শিক্ষা, সাংবাদিকতা, আদর্শবাদ, ভাষা প্রভৃতি বিষয়ে লিখিত তাঁর এসব প্রবন্ধ পাঠ করে এ কথা খুব সহজেই মনে হয়। তবে এ পর্যন্ত গোলাম মুরশিদের নিকটে যা পাওয়া গেছে, তার পরিমাণও নিতান্ত কম নয়। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন, বাংলা গানের ইতিহাস লিখেছেন, বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড়ো অভিধান প্রণয়ন করেছেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর সম্পর্কে নতুন ধারণা সৃষ্টিকারী গ্রন্থ রচনা করেছেন, বাংলাদেশে মানবীবিদ্যা চর্চার সূচনা করেছেন, উনিশ শতকের জাগরণের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বাংলা ভাষার বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করেছেন। গোলাম মুরশিদের কাজের এই বহুমুখিতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে একটাই মাত্র ঐক্য, তা হলো বাংলাদেশটাকেই তিনি বিভিন্ন দিক দিয়ে দেখেছেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী উপস্থাপন করেছেন।
গোলাম মুরশিদের এসব গবেষণায় যে নির্লিপ্ততা ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়েছে, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে তা কাজে লাগুক এই প্রত্যাশা। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
তারা//