ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

কবিতা : অবগাহনরীতি

অনিকেত সুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৭, ১৮ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ১৮:২৩, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
কবিতা : অবগাহনরীতি

গদ্যের কঠিন চক্রে অচ্ছেদ্য বাঁধা যে-জীবন, কবিতার সঙ্গে তার সদ্ভাবরক্ষা দুরূহ কাজ। আমাদের প্রাত্যহিক গেরস্থালি গদ্যের সঙ্গে; এর কর্তৃত্ব ও দখলদারি প্রায় নিরঙ্কুশ এবং তা প্রায়শই জোয়ালের ভারচাপা এক জবরদস্তি। এই নিদারুণ সম্পর্কের দায় আমাদের প্রত্যেককেই আমৃত্যু বহন করতে হয়। সংসারের সমস্ত দায় মিটিয়ে, গার্হস্থ্য ও জাগতিক কর্তব্যের সব ঝামেলা চুকিয়ে তবেই কবিতার সঙ্গে মিলনের আয়োজন চলতে পারে।

কবিতার সঙ্গে আমাদের যোগমিলন ইন্দ্রিয়জ নয় বলেই এর টান আলাদা। জিভ ও ত্বকের স্থূল সীমার আওতায় জীবনের সমাপ্তিরেখায় পৌঁছার তাড়নাকে আমরা কেবল ইতর জৈবিকতার সদৃশরূপে গণ্য করি। অন্নে উদরপূর্তি হয়, ঘরের চার দেয়াল ও ছাদে বিশ্রাম ও শয়নের ব্যবস্থা। দেহরক্ষা ও দৈহিক আরামের নিশ্চয়তাবিধান হলেই জেগে ওঠে আরেক ক্ষুধা; জীবনের অভিজ্ঞতাগুলিকে ভিন্নভাবে রূপদানের ইচ্ছা; কলমে, তুলির আঁচড়ে, সুরের স্বরগ্রামে। আমাদের জীবনের নানাস্তর অভিজ্ঞতা ও সেসবের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, কামনার অতৃপ্তি, প্রচলপ্রথা ও ট্যাবুর সঙ্গে সংঘাত, স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নের ভাঙনসম্ভূত বিচিত্র আলোড়ন, সংক্ষোভ, অন্তর্গত ক্ষরণ ও তরল রক্তপ্রবাহের উঠতি-পড়তির ভেতর থেকে ডালপালা বিস্তার করতে থাকে নানা ছবি ও চিত্রকল্প। কবিতা, চিত্রকলা ও সংগীতে এই ছবি ও দৃশ্যকল্পের নানাভঙ্গি উপস্থাপনায় প্রকাশপ্রবণ জীবনের আরেক দাবিকে আমরা মিটিয়ে নিতে সচেষ্ট হই।

কবিতার উপস্থিতি জীবন ও জাগতিকতার উপরিতলে নয়; এর স্রোতটা অন্তঃশীলা। জাগতিকতার যেমন জবরদস্তি আছে; আর এ কারণেই কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন: The world is too much with us.  তেমনি আছে কবিতার অবশ্যম্ভাবী দ্রোহ; ধাবমান যানে ভ্রমণপথে যখন চলি, প্রবহমান গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আন্দোলিত হৃদয়তল থেকে চেতনলোকের আলোয় হুড়হুড় ক’রে বেরিয়ে আসে অবরুদ্ধ যত শব্দ, অনুভবরঞ্জিত এক একটি পঙ্‌ক্তি। কখনো দুপুরে বা সন্ধ্যায় বা নির্ঘুম রাতের নৈঃশব্দে বস্তুজগতের উপদ্রবছিন্ন নিঃসঙ্গ সত্তার গহনলোকে বিচিত্রিরঙ প্রজাপতির পাখা মেলবার মতো ঝিলমিলিয়ে ওঠে এমন অনুভব। এক টুকরা সংবাদ বা একটি গল্প পড়তে পড়তেও গাঢ় সংবেদনার জন্মের সঙ্গে মনে উঁকি দেয় কবিতার মুখ। দৈবাৎ আবার স্খলিত নিদ্রায়, স্বপ্নঘোরে জল টলমল ঢেউয়ের দোলায় শ্বেতহংসীর মৃদুমসৃণ সঞ্চরণের ঢঙে তীরে ভেসে আসে কোনো কোমল কবিতালেখা, আর তখনই আমাদের নিদ্রা টুটে যায়।

কিন্তু এই সর্বগ্রাসী দৈন্যের দেশে কবিতাপ্রেম এক অকল্পনীয় ভাববিলাস; কবিতায় তো আর ভাত-কাপড়-বাসস্থানের চাহিদা মেটে না। অতএব, উপরের কথাগুলি কেবল একজন কবির জন্যই প্রযোজ্য। কবিতার অল্পকিছু পাঠক যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও কবিতায় ক্রমশ আগ্রহ হারিয়েছেন। কেন? যদিও প্রকরণগত কারণে বিশ্বে কবিতার পাঠকসংখ্যা খুব কম। তবু এই বাস্তবতা মেনে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, আমাদের এখানে কবিতার পাঠ বিস্তৃত না হওয়ার ব্যাপারে কবিদের দায় কিছু আছে। কিছু নতুন পাঠক তো তৈরি হচ্ছেন যাঁরা অন্তত কবিতা পড়তে চান। এঁদের প্রকারান্তরে নিরস্ত করা হচ্ছে মেকি আধুনিকতার অভিমান দিয়ে। এই ভান-করা কাঠশুকনা আধুনিকতার উৎকট এক লক্ষণ হলো দুর্বোধ্যতা। কিন্তু আধুনিকতার সংজ্ঞা কী? কবিতায় প্রতীচ্যের জন্য যা আধুনিক, আমাদের জন্য তা নয়। সমাজ সংগঠনের উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক বিকাশে আমাদের সঙ্গে প্রতীচ্যের পার্থক্য বিস্তর। ইতিহাসের গতির সঙ্গে তা বদলায়। আমাদের এখানে ইতিহাসের বদলটা মোটা দাগে ভৌগোলিক, সমাজের প্রাণে পরিবর্তন ক্ষীণ। তাই আধুনিকতার ধারাকে আমাদের মতো ক’রেই এগিয়ে নিতে হবে। কিছু ফিউশন যা হতে পারে, তা বাংলা কাব্যভাষার মূল চলনকে পাশ কাটিয়ে নয়, তাকে টিকিয়ে রেখে। আমাদের সুর আলাদা। ভঙ্গিটাও আলাদা। 

কিন্তু চলমান ভাষাভঙ্গির পক্ষে একটা উদ্ভট কৈফিয়ত কেউ কেউ দেন। তা হলো, আধুনিক কবিতা লিখতে মেধা লাগে। আমার স্পষ্ট মত এই যে, কবিতায় ‘মেধা’ শব্দটা একদম অপ্রাসঙ্গিক। যা প্রয়োজন তা হলো হৃদয়বৃত্তি, গাঢ় সংবেদনশীলতা। এবং ‘মেধা’র স্বার্থপর ঝোঁকটাকে কে অস্বীকার করবে! তার অহমিকারই বা কি মূল্য! আমরা কেবল হৃদয় দিয়েই অন্যকে নিজের সঙ্গে জড়াই। সাহিত্য তো এই জড়িয়ে নেবার কাজ। ‘লোকটা মেধাবী’, এ কথার চেয়ে আমরা বরং শুনতে ভালোবাসি- ‘লোকটা হৃদয়বান’। মেধার দাবি আসে কবিতায় কৃত্রিমতাকে একটা অনন্যোপায় সুরক্ষা দেবার তাগিদ থেকে। 

কবিতা প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন আছে। কবির পণ্ডিত হওয়া আবশ্যক কিনা। কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস হলেও প্রশ্নটি কেউ কেউ উচ্চকিত করেছেন। তাঁদের মতে, পাণ্ডিত্য কবিতাকে আলাদা একটা মাত্রা দেয়। দর্শন, পুরাণ, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিচিত্র দিকে আগ্রহ ও এসব বিষয়ে লব্ধ জ্ঞান কবির কাব্যচেতনাকে শাণিত করে। এসব থেকে আহরিত নানা উপাদানের ব্যবহার কবিতাকে উপমাসমৃদ্ধ এবং এর আবেদনকে গাঢ়তা দান করে। কথাগুলির সাথে দ্বিমত পোষণ করার কিছু নেই। কবির ইতিহাস ও বিজ্ঞানচেতনা থাকবে, দর্শন-পুরাণ তিনি অধ্যয়ন করবেন, এসব কথা ফলাও ক’রে প্রচারের জরুরৎ কি আছে! প্রত্যক্ষ উদাহরণে দেখা গেছে পাণ্ডিত্যের প্রদর্শনী সত্তেও কবিতায় কোনো কবিতা নেই। ভালো কবিতায় দর্শন ওতপ্রোত জড়ানো থাকে। চলমান সময় থেকে কবি যা আহরণ করেন, তাই তো ইতিহাসের অঙ্গে পরিণত হয়। বিজ্ঞান-পুরাণের উপাদানরহিত সার্থক কবিতার উদাহরণ রয়েছে ভুরিভুরি। 

পাণ্ডিত্যের অতিমাত্রিক প্রদর্শনীতে কবিতাগুণ হারায়। অলঙ্কারপীড়িত দেহ দৃষ্টিকটু। একটা জমকালো চাকচিক্যে সে চমক জাগায় বটে কিন্তু তার আবেদন হৃদয়ে পৌঁছায় না। জ্ঞানশাস্ত্র ও পুরাণের ব্যবহার কবিতার হৃদয় থেকে আপনাআপনি উঠে আসা চাই। কবিতা রচনা করেন একজন কবি, কোনও পণ্ডিত তা করতে পারেন না। পাণ্ডিত্য প্রায়শই কবিতার চলনকে আড়ষ্ট ক’রে দেয়। এর দেহের কোমলতা কমিয়ে একটা রুক্ষ খটখটে ভাব জাগিয়ে তোলে। এবং অনুভবের দৈন্য ঢাকতেও পাণ্ডিত্যের সাড়ম্বর প্রকাশ ঘটানো হয়। 

কবিতায় পরোক্ষ বক্তব্য, ইঙ্গিত ও বিমূর্ততার ব্যবহার নিয়ে যেসব তত্ত্বকথা আছে, তার প্রায়োগিক দৃষ্টান্তগুলিও সব সুখকর কবিত্ব নয়। এখানেও আছে অনেক অমিতাচার। প্রায়োগিক যাথার্থ্যের ঘাটতি। প্রশ্ন জাগে, পরোক্ষের প্রকৃতি কী? ইঙ্গিত কি কবিতার উদ্দেশ্যসাধনে সক্ষম হলো, নাকি জটীলতার আবর্তে পড়ে পথ হারালো? একটি প্রশ্নের ভেতর যেমন সমাধানের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে, কবিতার অঙ্গে তেমনই কাব্যভাবনার ইঙ্গিত যথার্থ অনুপাতে ধৃত না হলে যোগাযোগক্ষমতার ঘাটতিহেতু কবিতা ব্যর্থ হয়ে যায়। 

বিমূর্ততার প্রসঙ্গেও প্রায় একই ধরনের কথা বলা চলে। আমাদের সমাজবাস্তবতা বিমূর্তর উস্কানি বা প্ররোচনা দেয় না। এটি এখানে অতোটা প্রাসঙ্গিক নয়, যতোটা ইউরোপে। কবির মনে সামষ্টিক অভিজ্ঞতার প্রভাব থাকতে হবে। আমাদের সমাজে ইন্দ্রিয়জাগতিক অভিজ্ঞতাগুলি এতো প্রবল ও প্রত্যক্ষ যে সেসবের তাড়নাকে অস্বীকার করা নিজ সমাজ এবং একরকম নিজেকেই অস্বীকার করার সামিল। কবির একান্ত অভিজ্ঞতার উন্মোচন কখনো কখনো বিমূর্ততা বা পরাবাস্তব আবহের আশ্রয়ে ঘটতে পারে, তা ঠিক। কিন্তু সমাজ ও দৃশ্যমান সত্যের তর্জনী উপেক্ষা ক’রে তিনি কেবলই বিমূর্ততার কারবারী হয়ে উঠবেন, এমনটা প্রত্যাশিত নয়। কবিতায় অতি বিমূর্ততার ব্যবহার কবিকে পাঠককুল থেকে পুরাপুরি বিচ্ছিন্ন ক’রে দেয়। 

কবিতা-ভাষার জটিল হয়ে পড়া রচনাকারীর এক ধরনের দুর্বলতা, যা আসে নিজেরই কাছে নিজের ভাবনা ও বোধের অস্পষ্টতা থেকে। সহজের সরল উদ্‌গম ঘটে মূলত সহজ মনোজমিন থেকে; সহজের মনোগত চর্চা এবং বাহ্যানুশীলন, দুই-ই প্রয়োজন। অহমিকা ও আত্মরতির সীমা ডিঙিয়ে যাওয়াটাও জরুরি। তবেই কবিতা হবে সহজ অনুভবের নিরাভরণ প্রকাশ যার আবেদন খুব সহজভাবে আমাদের মর্মে এসে পৌঁছয়। নমুনা হিসাবে এখানে দু’টি হৃদয়ঘন সরল কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছি: 

(১) 
“মা, তোমার দড়ির শিকেটা দাও- চালাঘরে বাঁধি,
দেশ গ্রাম তুলে রাখি, যেমন তুমি তুলে রাখতে-
পিঁপড়ের মুখ থেকে- নির্জলা দুধের মাঠা
তুলে রাখি, হৃদয়ের পঠন-পাঠন
পাহাড় সমুদ্র নদী
সাত সকালের শিশিরে ভেজা গাছগুলি
কাল সারারাত সোনামুখী বনে কান্না উঠেছিল
প্রহরী জানে না
দুর্জয় কুঠার- অনেক উঁচুতে তাই- 
না হলে ঐ চাঁদখানা কেটেকুটে রেখে যেত
এখনো যা আছে অবশিষ্ট জল
মানুষের বুকে মমতার ছায়া-
মা, তোমার দড়ির শিকেটা দাও-
তুলে রাখি।” 

[শিকে: সচ্চিদানন্দ হালদার]

(২) 
“ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল
মাঝপথে, অচেনা স্টেশনে
মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?
নাকি, তারা যেখানে নামে?
নাকি, গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!
বিহ্বল স্টেশনে নেমে আমরাও ভাবি-
এখানেই কি নামতে চেয়েছি
নাকি, ট্রেনই নামিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের
এই ঘন কুয়াশারাত্রিতে!
যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল
কিছুই আসলে সত্য নয়
আমাদের চোখের সামনে শুধু ছবি হয়ে থাকে
ট্রেনের জানালা
আর, খুব দ্রুত ছুটে চলা যমুনা ব্রিজ…” 

[ট্রেন: ফরিদ কবির]

কবিতায় শেষাবধি কোনো দার্শনিক মত ও পথের আদর্শ সীমারেখা এঁকে দেওয়া সম্ভব নয়। এর অন্তর্গত সম্ভাবনা অসীম। চিন্তা ও অনুভবের বহুধা বৈচিত্র্য, কবিস্বভাবের ভিন্নতা, প্রকাশ-প্রকরণগত স্বকীয়তা বহুধারাকে প্রাণদান করে। এই বিস্ময়বৈচিত্র্যেই সম্ভবত কবিতাকে এতো মোহনীয় করেছে। তা বলে একে অবাধ স্বেচ্ছাচারের বাহন ক’রে তোলার চেষ্টা মুক্ত স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না। 

কবিতা সেই মিথষ্ক্রিয়া যেখানে কবি ও পাঠক সমভাবে পরস্পরের দিকে চালিত হন। সমান অনুভবে ও প্রতিশ্রুতিতে। এবং এই রসায়নেই কবিতা সফল হয়ে ওঠে।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়