ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

লাতিন আমেরিকার পঞ্চনারীর পাঁচটি কবিতা

অনুবাদ ও ভূমিকা: আলম খোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০১, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৮:১৬, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
লাতিন আমেরিকার পঞ্চনারীর পাঁচটি কবিতা

লাতিন আমেরিকার কবিতার ইতিহাসে নারীদের খুব সম্মানজনক ও মর্যাদাবান অবস্থান রয়েছে। মেহিকোর সাহসী আশ্রমকন্যা সোর হুয়ানা ইনেস দে লা ক্রুস (১৬৪৮-১৬৯৫) এর শ্রদ্ধাসিক্ত নামোল্লেখ ছাড়া লাতিন আমেরিকার কবিতার কোনো সামগ্রিক আলোচনার সূত্রপাতই হতে পারে না। প্রকরণের দিক থেকে ‘বারোক’ রীতির অনুসারী সোর হুয়ানার কবিতা ও অন্যান্য রচনায় সামাজিক, ধর্মীয়, লৈঙ্গিক বৈষম্য ও অসঙ্গতি এমন প্রবলভাবে বিবৃত হয় যে, সমালোচকেরা পরবর্তীকালে তাঁকে হিস্পানিক সাহিত্যের একজন সাহসী ‘প্রটোফেমিনিস্ট’ আখ্যা দিতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর অনতিক্রম্য প্রভাব পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে এসে আরও প্রবলভাবে অনুভূত হতে থাকে, মুখ্যত তাঁর নারী অনুসারীদের মধ্যে। 

আমরা জানি, ১৯৪৫ সালে প্রথম নোবেলবিজয়ী লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিক একজন কবি ও নারী; তিনি এই সোর হুয়ানারই আরেক দূরবর্তী মানসকন্যা, চিলির গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (১৮৮৯-১৯৫৭)। অবশ্য তাঁরও আগে বলিভিয়ার আদেলা সামুদিও (১৮৫৪-১৯২৮) এবং উরুগুয়ের জাতিকা দেলমিরা আউগুস্তিনি (১৮৮৬-১৯১৪) লাতিন আমেরিকার কবিতায় আধুনিকতার সূচনাকারী অন্যতম বলিষ্ঠকণ্ঠ ছিলেন। এরপর থেকে অদ্যাবধি লাতিন আমেরিকাজুড়ে নারীরা দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করছেন কবিতার রাজ্যপাট। 

এঁদের মধ্যে অন্তত এক ডজন বিশ্বখ্যাত কবির নাম করা যায়, যাদের উল্লেখ ছাড়া লাতিন আমেরিকার আধুনিক কবিতার কোনো আলোচনাই সম্ভব নয়। এঁরা হলেন উরুগুয়েরই আরও দুজন, হুয়ানা দে ইবার্‌বুরু (১৮৯৫-১৯৭৯) ও সারা দে ইবানেস (১৯১০-১৯৭১); আর্জেন্টিনার আল্‌ফোন্সিনা স্তোর্নি (১৮৯২-১৯৩৮) ও ওল্‌গা আরোস্‌কো (১৯২০-১৯৯৪); এল সালভাদোরের ক্লাউদিয়া লার্স (১৮৯৯-১৯৭৪) ও ক্লারিবেল আলেগ্রিয়া (১৯২৪-২০১৮); ব্রাজিলের এন্‌রিবেতা লিস্‌বোয়া  (১৯০৩-১৯৮৪); নিকারাগুয়ার মারিয়া তেরেসা সাঞ্চেস (১৯১৮-১৯৯৪) ও জিওকোন্দা বেইয়ি (জন্ম ১৯৪৮), উরুগুয়ের শতবর্ষী ইদা বিতালে (জন্ম ১৯২৩), মেহিকোর রোসারিও কাস্তেইয়ানোস (১৯২৫-১৯৭৪) ও এলেনা পোনিয়াতৌস্কা (জন্ম ১৯৩২) প্রমুখ। 

তো, এঁদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি লাতিন আমেরিকার পঞ্চনারীর পাঁচটি প্রতিনিধিত্বশীল কবিতার অনুবাদ এখানে উপস্থাপিত হল, যাদের মধ্যে তিনজনই এখনও জীবিত ও সৃজনে সক্রিয়; যথাক্রমে ব্রাজিলের আদেলিয়া প্রাদো (জন্ম ১৯৩৫), কিউবার নান্সি মোরেহোন (জন্ম ১৯৪৪) ও চিলির মার্হোরি আগোসিন (জন্ম ১৯৫৫)। অন্য দুজন, ব্রাজিলের সেসিলিয়া মেইরেলিস (১৯০১-১৯৬৪) ও আর্জেন্টিনার সুবিখ্যাত পরাবাস্তববাদী কবি আলেহান্দ্রা পিসার্‌নিক (১৯৩৬-১৯৭২) প্রয়াত হয়েছেন।


সেসিলিয়া মেইরেলিস

আত্মপ্রতিকৃতি

তখন আমার মুখ এমন ছিল না,
এত শান্ত, এত শীর্ণ, এত বিষণ্ন,
এই চোখজোড়াও এমন শূন্য ছিল না
কিংবা এমন তিক্ত এই ওষ্ঠযুগল।

আমার হাতদুটো এমন দুর্বল ছিল না,
এমন স্থির এমন শীতল এমন মৃত:
আমার এই হৃৎপিণ্ড
এতটা গোপন ছিল না।

আমি এ রূপান্তর প্রত্যাশা করিনি,
এত সাধারণ, এত সুনিশ্চিত, এতটা সহজ:
কোন সে আয়না যেখানে আমার
মুখখানা হারিয়ে ফেলেছি আমি?


আদেলিয়া প্রাদো

সরল ভালোবাসা

আমি স্রেফ সরল ভালোবাসা চাই।
সরল ভালোবাসায় কেউ কারো দিকে তাকায় না।
একবার পাওয়া গেলে, বিশ্বাসেরই মতো,
আর কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না।
পুরনো বুটজুতোর মতো মজবুত, সরল ভালোবাসা
দেখতে শুনতে কাঠখোট্টা কিন্তু রমণ-কাতর,
তার সন্তানাদির সংখ্যা আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে।
সরল ভালোবাসা না বলার ক্ষতি পুষিয়ে দেয় কাজের মাধ্যমে।
সে সারা বাড়িতে তে-রঙা চুমু এঁকে দেয়,
বেগুনি ও সাদা কামনার চিহ্ন,
একইসঙ্গে সরল ও সুতীব্র।
সরল ভালোবাসা ভালো, কেননা তার বয়স বাড়ে না।
সে কেবল সারবস্তুর ওপর মনোনিবেশ করে,
তার চোখে যা চকচক করে সেটাই সে বলে: আমি পুরুষ, তুমি নারী।
সরল ভালোবাসার কোনো মোহ নেই, তার যা আছে সেটা আশা:
আমি সেই সরল ভালোবাসাকে চাই।


আলেহান্দ্রা পিসার্‌নিক 

ছাইগুলো

চূর্ণবিচূর্ণ নক্ষত্রের রাত
আমাকে বিস্ময়ভরা চোখে দেখে
বাতাস ছুড়ে দেয় ঘৃণা
তার মুখমণ্ডল সজ্জিত 
গানের আভায়

আমরা দ্রুতই প্রস্থান করব

গোপন স্বপ্নেরা
আমার মুচকি হাসির পূর্বসূরি
পৃথিবী শুকিয়ে যাচ্ছে
এবং সেখানে তালা আছে চাবি নেই
এবং সেখানে ভয় আছে অশ্রু নেই

আমাকে নিয়ে কী করব আমি?

কারণ আমি যা, তার জন্য তোমার কাছেই ঋণী

কিন্তু আমার কোনো আগামীকাল নেই

কারণ তোমার কাছে আমি ...

রাত্রি কষ্ট পায়।


নান্সি মোরেহোন

মা

আমার মায়ের কোনো বাগান ছিল না
কেবল সূর্যের নিচে,
প্রবালকুচির মাঝে ভাসমান,
পাথুরে এক দ্বীপভূমি।

তাঁর চোখে কোনো মসৃণ বৃক্ষশাখা নয়
কেবল অগুনতি ফাঁসির দড়ি দৃশ্যমান,
আহা কী দিন ছিল, সেইসব দিন, যখন তিনি
খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াতেন এতিমখানার চুনার উঠানে,
এবং হাসতে জানতেন না
এমনকি দিগন্তের দিকে তাকাতেও।
তাঁর ছিল না কোনো গজদন্তের শয়নকক্ষ,
বেতের আসবাবে সাজানো বসবার ঘর,
প্রাচ্যের নৈঃশব্দ্যে রাঙানো কাচের দেয়াল।
আমার মায়ের ছিল রুমাল আর গান
যা দিয়ে তিনি আমার গভীরতর বিশ্বাসকে 
ঘুম পাড়াতেন আর তাঁর নির্বাসিত রানির মাথাটিকে 
উঁচু করে রাখতেন, এবং শত্রুর শীতল দেহাবশেষের সামনে
আমাদের তুলে দিতেন, দামি পাথরের মতো তাঁর হাতদুটো।


মার্হোরি আগোসিন

সাতটি পাথর

মৃত বালিয়াড়ির বুক থেকে
আজ আমি কুড়িয়ে নিয়েছি
পাখি ও অনাথসদৃশ
সাতটি পাথর।
আমি তাদের দিকে এমনভাবে তাকাই
যেন তারা কোনো
অনন্য সময়ের উপহার,
যেন তারা সাতজন
বিপন্ন ভ্রামণিক।

জাদুকরী নারীর মতো
আমি এগিয়ে এসে
আমার চিবুকের ছোঁয়ায়
তাদের সিক্ত করে তুলি।

আমার ত্বকের ভেতরে
আমিও তো হতে চাই
সাতটি পাথর,
হতে চাই, যেমন ধরুন,
খুব গোলাকার ও মসৃণ,
যেন কেউ আমাকেও হাতে তুলে নেবে,
তারপর বাতাসের ভেজা কণ্ঠস্বরে
চিড় ধরিয়ে দেবে আমার দু’পাশে।

আমি চেয়েছিলাম
তুমি আমাকে কুড়িয়ে নেবে,
চুমু খাবে,
যেন আমি তোমার মোহনার মুখে
নদীর নুড়ি হয়ে উঠি।

আমি সেই সাতটি পাথরকে
আমার পকেটে ভরে রাখি।
তারা একটি টিলার মতো 
ফুলে থাকে আমার হাতে 
আর আমার শূন্যতার গল্পগুলো
ক্রমে ভরে উঠতে থাকে
শ্যাওলাভেজা শব্দে।

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়