বই আলোচনা
দশ কথা: বিশিষ্টজনের মুখোমুখি
জি এইচ হাবীব || রাইজিংবিডি.কম
মানুষ অন্যের হাঁড়ির খবর জানতে চায়: পাড়া-পড়শী, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, নেতা-নেত্রী, বিখ্যাত ব্যক্তি— কার নয়? দরজা খোলা থাকলে সন্তও একবার তাকিয়ে দেখতে চায় কামরার ভেতরে কী আছে। মানুষ জানতে চায়— এরপর কী হলো, তারপর কী হলো; যে-কারণেই-না আরব্যরজনীর উজিরকন্যা শাহেরজাদী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। কারণ মানুষের এই যে চিরন্তন প্রবণতা এটাই সে উসকে দিয়েছিল তার স্বামী শাহরিয়ারের মধ্যে, যে কিনা ‘আরব্যরজনী’র কল্যাণে আমরা জানি, তার দেখা কিছু নারীর অবিশ্বস্ততার কারণে নারীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিয়ের রাত পোহালে নববধূকে কতল করত। কিন্তু শাহেরজাদীকে বিয়ে করার পর প্রথম রাতে এই নববধূ তাকে গল্প শোনাতে শুরু করে কিন্তু শেষ করে না। ফলে কাহিনীর শেষটা জানার জন্য স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় শাহরিয়ারকে। আর এভাবেই একের পর এক পৌনঃপুনিক ঘটনায় কেটে যায় এক হাজার এক রাত। রাজার মন থেকে দূর হয় নারীবিদ্বেষ, বেঁচে যায় শাহেরজাদী। কিন্তু কী পায় জেনে? কেন জানতে চায়? নিছক কৌতূহল নিবৃত্তি? নাকি জ্ঞানলাভ? তুলনা? পথের দিশা? যে কোনোটিই হতে পারে, বা একাধিক, বা এসবের সব কিছু, বা একবারেই অন্য কিছু। ব্যক্তিভেদে তা ভিন্ন হতেই পারে।
তবে শুধু মানুষের হাঁড়ির খবরই মানুষের একমাত্র জ্ঞাতব্য নয় অবশ্যই। তার আশপাশ, প্রকৃতি, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জীব-জন্তু তো বটেই, এসব ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে, নিজ গ্রহ ছাড়িয়ে অসীম মহাকাশও তার জানার বিষয়। সেই দূর অনধিগম্য গ্রহে সে মানুষ বা যন্ত্র পাঠিয়ে খবর নিতে চায় সেখানের হাল-হকিকত কী, সেসব স্থানে কেউ বাস করে কিনা, ইত্যাদি? কেউ বা কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিয়ে গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে ভেবে নিতে চায় সেখানে মানুষ গেলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, বা সেখানকার ‘বুদ্ধিমান’ প্রাণীরা পৃথিবীতে এলে কী কী ঘটতে পারে, সায়েন্স ফিকশনে যা বিধৃত আছে।
আর অতি অবশ্যই সে নিজেকেও জানতে চায়। হয়ত এত কিছু যে সে জানতে চায় বা এত কিছুর প্রতি তার যে কৌতূহল সেটা তার নিজেকে জানারই একটি উপায়; সমস্ত মানুষের, প্রকৃতির, আর ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তার নিজের অবস্থা ও অবস্থানকে জানার একটি হাতিয়ার। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।’ আর বলা হয়ে থাকে সেই অতীব প্রাচীন কথাটি: ‘Know thyself.’
জানার এই অসম্ভাব্যতার সূত্রে চলে আসে দার্শনিক প্রসঙ্গ, যা যুগে যুগে চিন্তাশীল মানুষকে বিচলিত, আলোড়িত করেছে: আমাদের জানার দৌড় কতটুকু? আমরা যা জানছি তা কতটা নির্ভরযোগ্য? একই ঘটনা বা ফেনোমেনন সম্পর্কে নানান জনের নানান মুনীর নানান মত। ‘রশোমন এফেক্ট’। তাহলে ভরসা কোথায়? সত্য কী? ফেনোমেনন সম্পর্কেই এই যদি অবস্থা তাহলে, নুমেনা (noumenon) বা প্রকৃত যে ঘটনা বা সারবস্তু, ঘটনার পেছনের ঘটনা, তার কী হবে ? অধিবিদ্যা কি তাহলে অনধিগম্য, যেমনটা বলেছিলেন অভিজ্ঞতাকারীরা, বা কান্ট? নাকি হেগেলই ঠিক? আকাশের ওপারে আকাশ নেই আসলে। যা সামনে রয়েছে তাই আসল।
দার্শনিক এবং মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস কৌতূহলককে বলেছিলেন ‘the impulse towards better cognition’ (বেহতর বোধের জন্য ঝোঁক ), তার মানে, আমরা যা জানি না বলে মনে করি তা বোঝার ইচ্ছা। তিনি আরো বলেছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে এই কৌতূহল বা ঝোঁকটিই তাঁদের নতুন এবং রোমাঞ্চকর জিনিসের দিকে আকৃষ্ট করে বা তাড়িয়ে নিয়ে যায়, তার মানে উজ্জ্বল, স্পষ্ট, প্রাণবন্ত আর চমকপ্রদ জিনিসের দিকে। আবার, ইংরেজিতেই একটা কথা আছে: ‘curiosity killed the cat.’ যার মর্মার্থ এই যে, অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়। কিন্তু মানুষের কৌতূহল আর মার্জার বা অন্যান্য প্রাণীর কৌতূহলের মধ্যে বোধহয় একটা বড় ফারাক আছে। কোনো বিড়ালের বা জীব-জন্তুর পেছন থেকে একটা বল গড়িয়ে সেটার সামনে আস্তে করে ছুঁড়ে দিলে বলটা কোথা থেকে এল বা কে গড়িয়ে দিল তা দেখার জন্য কিন্তু ফিরে তাকায় না, সামনে চলে আসা বলটার দিকেই সে ছুটে যায়। কিন্তু মানুষ পেছনে তাকিয়ে দেখে বলটা কোথা থেকে এল, কে পাঠাল। তার মানে মানুষ ঘটনার কার্যকারণ, ইতিহাস জানতে চায়। পশুপাখি (সম্ভবত) তা জানতে চায় না, তারা বর্তমান নিয়েই সন্তুষ্ট। মানুষ তার অতীত, তার বর্তমান এমনকি তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
এই অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণে তাকে মূল্যও দিতে হয়েছে প্রচুর। কখনো কখনো বিড়ালটির মতোই নিজের প্রাণ দিয়ে, কখনোবা মান, সম্পদ বা শারীরিক ক্ষতি স্বীকার করে। পুরাণ ও সাহিত্যে এই দুর্নিবার কৌতূহলের জন্য মর্মন্তুদ মূল্য দেয়া প্রথম মানুষটি কি ঈদিপাস? অনিবার কৌতূহলের কারণে মানুষ যা জানতে পেরেছে তার সঙ্গে অযুতবার যখন সংঘাত বেঁধেছে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের প্রচলিত বয়ানের, তার ওপর কি নেমে আসেনি চরম অত্যাচার? তাকে কি দিতে হয়নি প্রাণ, ও মান? জিওর্দানো ব্রুনোর কথা মনে পড়বে, আসবেন গ্যালিলিও, এ সূত্রে। আরো আছেন এন্তার যাঁরা তাঁদের গবেষণার কাজ করতে গিয়ে, পর্বতারোহনে গিয়ে, জলে ডাঙায় অন্তরীক্ষে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, বিকলাঙ্গ হয়েছেন, শারীরিক অসুস্থতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু এসব নিগ্রহ মানুষকে দমাতে পারেনি। এই কৌতূহলই তাকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে। তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাদের শিশুকালে কৌতূহল থাকে অপার। তাই থাকে নানান প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা। শিশু যত বড় হতে থাকে তার এসব কৌতূহল যেন মিইয়ে যেতে থাকে, সব কিছুকেই সে স্বাভাবিক, গতানুগতিক বলে ধরে নেয়। দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা এই কৌতূহল বাঁচিয়ে রাখেন জীবনভর।
তো, লেখার শুরুতে যে হাঁড়ির খবরের কথা বলেছিলাম, তা জানার যতো উপায় আছে তার মধ্যে সাক্ষাৎকার অন্যতম। বিশেষ কোনো প্রসঙ্গ, সমস্যা, কোনো সংকট বা সম্ভাবনা উপলক্ষ্যে এসব সাক্ষাৎকার পাঠকের জন্য গ্রহণ করা হতে পারে। হতে পারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অনালোচিত বা নাতি আলোচিত কোনো ব্যক্তিত্বের জীবন ও কাজ সাধারণ বা বিশেষ কোনো পাঠক গোষ্ঠীর জন্য। তবে এর চল যে অর্বাচীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সাক্ষাৎকার বলতে যতটা না, তার ইংরেজি ‘ইন্টারভিউ’ বললে প্রথমেই মনে আসে চাকরির জন্য ‘ইন্টারভিউ’-র কথা। মজার ব্যাপার হলো, এই ‘জব ইন্টারভিউ’-র আবিষ্কারক নাকি অসংখ্য আবিষ্কারের জনক মেনলো পার্কের জাদুকর টমাস আলভা এডিসন। এই মাত্র সেদিন, একশ দুই বছর আগে, যে-বছর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই ১৯২১ সালে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞান পরীক্ষা করেছিলেন। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, গবেষণা সহকারী নিয়োগ দেবার সময় তিনি তাঁদের সাক্ষাৎকার নেবার সময় তাদের এক বাটি স্যুপ দিতেন। সঙ্গে লবণ আর মরিচ। তিনি দেখতেন চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে কে সেই স্যুপে লবণ বা মরিচ নিচ্ছে। এর কারণ হলো, তিনি মনে করতেন, যে মরিচ বা লবণ যোগ করছে সে ধরে নিচ্ছে স্যুপে যথেষ্ট লবণ বা মরিচ দেয়া হয়নি। আর এডিসন মনে করতেন এ ধরনের ধরে নেয়া বা অনুমান করা উদ্ভাবন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলে সেরকম প্রার্থী বাদ পড়ে যেত।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের আরেক পদ্ধতির নাম ‘প্রস্ত কোশ্চেনেয়ার’ (Proust questannaire), উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটেনে ‘অটোগ্রাফ বুক’ বা ‘কনফেশন অ্যালবাম বা কনফেশান বুক’ নামে এক ধরনের বইয়ের বেশ চল ছিল, সেখানে আপনার প্রিয় রঙ, প্রিয় ফুল, প্রিয় পেশা, প্রিয় কবি, সুখ বলতে আপনি কী বোঝেন, এই ধরনের প্রশ্ন থাকত (যার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত), আর সেসবের জবাব দেবার জন্য ডান পাশে জায়গা থাকত। আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্সেও এ ধরনের বইয়ের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। ১৮৬৫ সালে কার্ল মার্ক্স, এবং ১৮৬৮ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসও এ রকম ‘কনফেশন অ্যালবাম’-এর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন নাকি। মার্ক্স উল্লেখ করেছিলেন তাঁর প্রিয় রঙ নীল, আর এঙ্গেলস ‘সুখ বলতে আপনি কী বোঝেন’ এই প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করেছিলেন, শ্যাতো মার্গ-র কথা (Chateau Margaux)। আর বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্ত, ১৮৮৬ সালে, তখন তিনি ১৪ বছরের কিশোর Confessions. An Album to Record Thoughts, Feelings শিরোনামের একটি ইংরেজি কনফেশন অ্যালবামের প্রশ্নের উত্তর লিখেছিলেন। এই অ্যালবামটি ২০০৩ সালে ৩৪ হাজার পাউন্ডে নিলাম হয়েছিল। ১৯৫০-এর দিকে প্রুস্তের প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার সুবাদে প্রথমে ফান্সে, এবং পরে আমেরিকার টিভিতে এবং আরো পরে ১৯৮০ সালে জার্মানির একটি পত্রিকার মাধ্যমে, এবং ১৯৯৩ সালে ভ্যানিটি ফেয়ার সুবাদে প্রুস্ত কোশ্চেনেয়ার নামে পরিচিতি লাভ করে, যেখানে সমাজের প্রথিতযশা লোকজনকে সেই গোড়ার দিককার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে বলা হতো।
ছাত্রদের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস পড়াতে হয় ক্লাসে। সেই সূত্রে ‘দ্য গ্রেট ফিলসফার্স’ নামে চমৎকার একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৫ বছরেরও আগে। ব্রায়ান এডগার ম্যাগী (১৯৩০-২০০৯) নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক পাশ্চাত্য দর্শনের বিভিন্ন দিকপালদের জীবন ও কাজ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের তথা সমসাময়িক দার্শনিকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিবিসি টেলিভিশনের ‘দ্য গ্রেট ফিলসফার্স’ নামের একটি অনুষ্ঠানের জন্য; সেটা ১৯৮৭ সালের কথা। সেই সিরিজে তিনি অন্যান্যদের মধ্যে প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং দেকার্তর দর্শন নিয়ে আলাপ করেছিলেন বিভিন্ন জনের সঙ্গে; এ ছাড়াও হেগেল ও মার্ক্স নিয়ে আলাপ করেছিলেন দার্শনিক পিটার সিঙ্গারের সঙ্গে। সবশেষে ছিল ভিটগেসন্টাইনের সঙ্গে আলাপ, মার্কিন দার্শনিক জান সার্ল-এর সঙ্গে। সমস্ত আলাপই দুই মলাটের মধ্যে গ্রথিত হয়েছিল। তার আগেও ব্রায়ান ম্যাগি এ ধরনের প্রকল্পে কাজ করেছিলেন বিংশ শতকের দার্শনিকদের সঙ্গে, এবং দর্শনকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে সেসব সাক্ষাৎকার বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিল ময়ার্সের সঙ্গে পুরাণ নিয়ে জোসেফ ক্যাম্পবেলের সাক্ষাৎকার ‘মিথের শক্তি’ যা বাংলায় খালিকুজ্জামানের অনন্য অনুবাদে বাংলা ভাষীদের মন জয় করেছে। আর, একই অনুবাদকের কলমে প্লিনিও আপুলিও মেন্দোজার নেয়া ১৯৮২ সালের কলম্বীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সাক্ষাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘পেয়ারার সুবাস’।
এ ছাড়াও আমরা পরিচিত ওরিয়ানা ফাল্লাচি নামটির সঙ্গে। ইতালির এই সাংবাদিক গত শতকের ছয়, সাত ও আটের দশকে বিশ্বের অসংখ্য নেতার ‘long, aggressive and revealing interviews’ সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। টেলিভিশনে (সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল) আরেকটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান খুব বিখ্যাত ছিল: ‘ল্যারি কিং লাইভ’, যেখানে প্রতিনিয়ত নাস্তানাবুদ হতেন জগতের বহু বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্ব, ১৯৮৫ সালের ৩ জুন থেকে ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর অব্দি সপ্তাহে তিন দিন প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির প্রথিবীজুড়ে ছিল লক্ষ দর্শক। এ ধরনের আরো অনুষ্ঠান রয়েছে বা ছিল, বলাই বাহুল্য। আবার মনোবিশ্লেষক বা সাইকোএনালিস্টরা নেন অন্য রকমের সাক্ষাৎকার, রোগ নির্ণয়ের জন্য, যা ১৮৯০-এর দশকে প্রচলন করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘গুরু’ জোসেফ বাওয়ার, তাঁর রোগী, নারীবাদী বার্থা পাপেনহাইমের চিকিৎসার সূত্রে। এই পদ্ধতি ‘টকিং কিওর’ নামে পরিচিত।
আমরা দেখেছি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার নামে একটা অংশই থাকে যেখানে নিয়মিতভাবে দেশ-বিদেশের নানান গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়ে থাকে। এমন কিছু বিখ্যাত পত্রিকা হচ্ছে প্যারিস রিভিউ, ইউনেস্কা কুরিয়ার, ইত্যাদি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইভিত্তিক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘বইয়ের দেশ’-এর প্রতি সংখ্যাতেও থাকে একজন বিশিষ্ট মানুষের সাক্ষাৎকার।
গল্পকার ও সাংবাদিক অলাত এহ্সানের ‘দশ কথা : বিশিষ্টজনের মুখোমুখি’ বইতে যে দশজন কৃতী মানুষের ১১টি সাক্ষাৎকার সংকলিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে সম্ভবত একজন ছাড়া বাকি নয়জন কৃতী মানুষের সাক্ষাৎকার এর আগে নানান পত্রপত্রিকায় বের হয়েছে, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেসব নানান বইয়ে সংকলিত বা গ্রথিত হয়েছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক সন্জিদা খাতুনের সাক্ষাৎকারটি আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এবং এই গ্রন্থে সবচেয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি মনে হয় এটিই। এই সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে অলাত এহ্সানের সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কবি এবং ছোটকাগজ ‘পূর্ব’ সম্পাদক রণজিৎ অধিকারী। সন্জীদা খাতুন কথা বলেছেন কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর বাবার বন্ধুত্ব, ঢাকায় কবিকে ঘিরে তার স্মৃতি, বাবাকে নিয়ে পারিবারিক স্মৃতি, ছায়ানট গঠন, ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের সংস্কৃতিক আন্দোলন, লেখালেখি, সংগীতের শুদ্ধ চর্চা নিয়ে। কথোপকথনে এসেছে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, সত্যেন সেনের স্মৃতি।
আর জাফর আলম যাঁকে; তাঁর নিজের কথা উদ্ধৃত করে বলতে হয় ‘কেউ লেখক বলেই মনে করেনি’ তাঁর ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি বোধহয় একমাত্র সাক্ষাৎকার। এখানে অনুবাদের সাধারণ করণ-কৌশল এবং তাঁর নিজের অনুসরণ করা পথ সম্পর্কে কথা বলেছেন তিনি: ‘অনুবাদ তো কেবল ভাষার পরিবর্তন নয়, অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ তো একটি মৌলিক সমস্যা।’ আরেক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘আগে গল্প পড়ে আত্মস্থ করতে হবে। তারপর ভাবানুবাদ করতে হবে, যাতে পাঠকপ্রিয়তা পায়, পাঠক বুঝতে পারে। মূল বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। আসলে পাঠক যদি না পড়ে তাহলে তো লাভ নেই।’ অর্থাৎ তিনি তাঁর অনুবাদে সবচাইতে নজার দেন পাঠযোগ্যতা, এবং পাঠকের পড়ার ওপর।
এই সাক্ষাৎকার সংকলনে হাসান আজিজুল হক একমাত্র লেখক যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহীতার দুটো আলাপ রয়েছে। প্রথমটিতে বা প্রথম পর্বে ‘সাক্ষাৎকার’ গল্পের সূত্রে এসেছে একজন লেখক হিসেবে তাঁর, তথা যে কোনো লেখকের সাহসিকতার প্রসঙ্গ, শাসকের চোখে চোখে রেখে সত্য কথনের দায়িত্বের কথা: এসেছে একই মর্মবস্তু নিয়ে লেখা তাঁর আরো তিন বিখ্যাত গল্প ‘খনন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’-এর কথা। বিষয়টি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, এখন নির্লজ্জ মোসাহেবীর কাল। এই আলাপে অন্য যে বিষয়গুলো তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হলো তা হচ্ছে এই কীর্তমান লেখকের বক্তৃতায়, সাধারণ কথাবার্তায় উইট হিউমারের যথেষ্ট পরিচয় থাকলেও তাঁর সাহিত্যে যেন তার বড়ই অভাব, এই প্রসঙ্গটি, আর তাঁর সাহিত্যে যৌনতার বিষয়টিরও প্রত্যক্ষ উল্লেখের অপ্রতুলতার বিষয়। এই গ্রন্থের পাঠকরা নিশ্চয়ই আগ্রহের সঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা পড়তে চাইবেন। আরো একটি জরুরি প্রসঙ্গ এখানে আছে: সাহিত্যের সমালোচনা। সাহিত্য তত্ত্বের রবরবার এই যুগের ভাবসাব দেখে মনে হয় লেখকের যেন আগে সাহিত্য তত্ত্ব সব গুলে খেয়ে তারপর সাহিত্য করা উচিত। আর ছাত্ররাও যদি সেই সব তত্ত্ব অনুযায়ী সাহিত্যকর্মগুলো না দেখতে পারে তাহলে তাদের ছাত্রজীবনের ষোলো আনাই মিছা। রিডার রেসপন্স ওই সব ভারি ভারি ভাষায় লেখা সাহিত্য তত্ত্ব মেনেই চলতে হবে যেন। নইলে সে সাহিত্য পাঠক হিসেবে অপাংক্তেয়!
দ্বিতীয় পর্বে আছে আমাদের সাহিত্যে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ কতটা সার্থকভাবে এসেছে সেই প্রসঙ্গ। আরো এসেছে আমাদের জীবনে বাংলা ভাষার গুরুত্বের প্রসঙ্গটিও। তাঁর কথা উদ্ধৃত করে বললে: ‘পঁচানব্বই ভাগ মানুষের ভাষাই বাংলা।, তাই না। তাহলে বাংলা ভাষায় জোরটা সর্বোচ্চ দেয়ার কথা, সেটা কিন্তু নাই। আমাদের বই রাষ্ট্রের মধ্যে নাই, আমাদের উচ্চস্তরের সামাজিকতার মধ্যে নাই।’
সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসগুলোর বক্তব্যের সমাজধর্মীতা সত্ত্বেও তা ‘শিল্পের জায়গা রক্ষা করেই’ করার বিষয়টি। সেইসঙ্গে এই লেখক তাঁর লেখা সম্পর্কে সমালোচকের সমালোচনা যে তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলো ‘বলিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও’ ‘তারা পুরুষতান্ত্রিক’ এ বিষয়ে জবাব দিয়েছেন। প্রসঙ্গত এসেছে সমালোচকদেরও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা।
অধ্যাপক ও আমাদের দেশের প্রথম সারির নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আলাপে আমরা পাই কাজী নজরুল ইমলামের গানের আদি সুর ও বাণী পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার কথা, তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা। আর পাই অনুবাদক নজরুল এবং ইংরেজি, ফরাসি, চিনীয়, হিস্পানী, ইতালীয়, প্রভৃতি ভাষায় নজরুল সাহিত্যের অনুবাদের প্রসঙ্গ। প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে যদিও সাক্ষাৎকারগ্রহীতা মন্তব্য করেছেন যে ‘যে বিষয়ে তিনি (নজরুল) রবীন্দ্রনাথের চেয়েও এগিয়ে, তিনি অনুবাদও করেছিলেন’, প্রায় জীবনভর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ প্রচেষ্টার কথা, ভারতীয় নানান ভাষার সাহিত্য, বিদেশী সাহিত্য, ও তাঁর নিজের করা নিজের সাহিত্য অনুবাদের কথা আমাদের মনে না পড়ে পারবে না, মনে পড়বে অশ্রুকুমার সিকদার রচিত কবির অনুবাদ নামের সুলিখিত গ্রন্থটির কথা। আর মনে পড়বে যে তাঁর নিজের রচনার তাঁর নিজের করা অনুবাদই তাঁকে নোবেল এনে দিয়েছিল।
দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক মুর্তজা বশীরের সাক্ষাৎকার নানান দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে যাতায়াতের সুবাদে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখ নেতার নামের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁদের প্রতিকৃতি আঁকতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জওহরলাল নেহেরুর কাছ থেকে একটি বাণীসহ অটোগ্রাফ পেয়ে তাঁর সেই বাণীকে নিজের শিল্পী জীবনের ধ্রুবতারা করে এগিয়ে যাওয়া তাঁর যে বিচিত্র বর্ণিল জীবন কাহিনী এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তা পাঠককে ঋদ্ধ করবে।
সাক্ষাৎকারগ্রহীতার ভাষায় ‘নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যের জন্য বিখ্যাত শাহাদুজ্জামান’, যিনি নিজেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, দিয়েছেন তো বটেই, তাঁর সঙ্গে আলাপে সাধারণ প্রসঙ্গ ছাড়াও অবশ্যম্ভাবীভাবে এসেছে ‘একজন কমলালেবু’ নামক গ্রন্থ ঘিরে যে বিতর্ক— সেটা কি উপন্যাস না ডকু ফিকশন না অন্য কিছু সেই বিষয়টি। এসেছে অনুবাদের প্রসঙ্গ (সম্ভবত এই কারণে যে লেখক নিজেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ করেছেন), ভালো অনুবাদ খারাপ অনুবাদ এবং বিশেষ করে দুটি তাৎপরযপূর্ণ বিষয় যে বিদেশী সাহিত্য যারা বাংলায় অনুবাদ করেন তাঁদের চাইতে এদেশে যাঁরা বাংলা সাহিত্য বিদেশী তথা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন তাঁদের বেশি সম্মানলাভের কৌতূককর বিষয়টি; সেই সঙ্গে আর আমাদের সাহিত্যিকদের যেন তেন প্রকারে তাঁদের লেখা অন্যভাষায় তরজমা করিয়ে বিদেশী আনুকূল্য বা স্বীকৃতিলাভের হ্যাংলাপনার অস্বস্তিকর বিষয়টি।
চিত্রশিল্পী রণি আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটি একেবারেই অন্যরকম। সেখানে যতটা না তাঁর শিল্প নিয়ে কথা হয়েছে তার চাইতে বশি কথা বলা হয়েছে সম্ভবত সুফীবাদ, পরাবাস্তববাদ, ধ্যান, ধর্ম, সুর, সঙ্গীত, ইত্যাদি নিয়ে। তার সঙ্গত কারণ এই যে শিল্পী রণি আহমেদের কাজে এ সব বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। পাঠক এক ভিন্ন ধরনের মেজাজ পাবেন এই সাক্ষাৎকারটিতে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক দিলওয়ার হাসান অলাত এহসানের সঙ্গে ছিলেন।
অনুবাদ নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ, যদিও বহুল চর্চিত বা আলোচিত প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন সাক্ষাৎকার গ্রহীতা অলাত এহ্সান: অনুবাদে স্বাধীনতা, অনুবাদকের একজন লেখক বা একটি দেশ ও ভাষা নিয়ে কাজ করা সঙ্গত বা ভালো কিনা, অনুবাদের প্রতি সাধারণ মানুষ ও অ্যাকাডেমিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের বেশিরভাগ অনুবাদ ইংরেজি থেকে হওয়া, অনুবাদের মান নিয়ন্ত্রণে রেগুলেটরি বোর্ডের প্রয়োজনিয়তা, আমাদের অনুবাদের মান, অনুবাদ বিষয়ক পুরস্কার, কপিরাইট, অনুবাদে চৌর্যবৃত্তি, ইত্যাদি। বাংলাদেশের কবি, প্রাবন্ধিক, ও হিস্পানী ভাষার প্রখ্যাত অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন এবং কলকাতা নিবাসী জাপানী ভাষার অনুবাদক অধ্যাপক অভিজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকারে এসব বিষয়ে প্রাণবন্ত ও চিন্তা উদ্রেককারী আলাপন রয়েছে।
উল্লেখ্য, এখানে একমাত্র অভিজিৎ মুখার্জির সাক্ষাৎকারই যাকে বলে ‘প্রুস্ত কোশ্চেনেয়ার’-এরি মাধ্যমে নেয়া হয়েছে, সাক্ষাৎ আলাপের মাধ্যমে নয় (তবে অবশ্যই, এবং বলাই বাহুল, এই ‘প্রুস্ত কোশ্চেনেয়ার’-এ সাবেক কালের সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ছিল না।) অনুমান করি দুজনের, অর্থাৎ সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও সাক্ষাৎকার দানকারীর অবস্থানের ভৌগলিক দূরত্বের কারণেই লিখিত প্রশ্নের মাধ্যমে এই সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে, যদিও তিনি বারদুয়েক বাংলাদেশ সফর করেছেন। এই আলাপে তাঁর প্রিয় দুই কথাসাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ আর ভি এস নাইপল নিয়েও মনোগ্রাহী আলাপ রয়েছে।
আমাদের হাতে হাতে যখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর মননে ঘোর অন্ধকার, চারদিকে যখন শিক্ষা-দীক্ষার এন্তার উপকরণ অথচ প্রাণে শিক্ষা-বিমুখতা আর রূপোর চাঁদি ও ক্ষমতা অর্জনে অসীম ব্যাগ্রতা, প্রযুক্তির কল্যাণে অতীত সংরক্ষণের নানান উপায় যখন হাতের নাগালে অথচ আমরা পেছনে ফিরে তাকাতে পরাঙ্মুখ, বর্তমানের অস্থির, টালমাটাল বস্তুতান্ত্রিক জীবনযাপন নিয়ে শশব্যস্ত, তখন আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিছু বরেণ্য ব্যক্তিত্বের যেসব সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে দুই মলাটের মধ্যে গ্রথিত করার প্রয়াস নিয়েছেন গল্পকার ও সাংবাদিক অলাত এহ্সান তার জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাই। নানান তথ্যে, চিন্তা জাগানিয়া কথায়, অমূল্য স্মৃতিচারণে ঋদ্ধ এই সাক্ষাৎকারগুলো আমাদের এই বরেণ্য ব্যক্তিদের ‘হাঁড়ির খবর’ দেবার পাশাপাশি পাঠককে একটু থির হয়ে নিজেদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার অবকাশ দেবে বলে মনে করি। এহ্সান ঐকান্তিক যত্নে কথোপকথনগুলোতে উল্লিখিত নানান ব্যক্তিত্ব ও বিষয় সম্পর্কে যে টীকা প্রস্তুত করেছেন তা বিশেষ করে নব প্রজন্মের পাঠকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সেজন্য অলাত এহ্সানের জন্যে বাড়তি ধন্যবাদ।
বই তথ্য
দশ কথা : বিশিষ্টজনের মুখোমুখি
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অলাত এহ্সান
প্রকাশক : বেঙ্গলবুকস
পৃষ্ঠা: ২৯৬
মূল্য : ৪৯০ টাকা
তারা//