‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবর
শাহ মতিন টিপু : ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই / যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ কবির এই গান সত্যি হয়েছে। মসজিদেরই পাশেই কবর হয়েছিল তার। মৃত্যুর পর কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। কবিকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১২ ভাদ্র। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে এ দিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে বঙ্গাব্দ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী ।
কবির জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকাল ৭৭ বছরের। সৃষ্টিশীল ছিলেন মাত্র ২৩ বছর। ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর ছড়ানো দ্রোহী চেতনা কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত। খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবির। অভিষিক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়।
কাজী নজরুল ইসলাম তার স্বল্প পরিসর সাহিত্য জীবনে রচনা করেছেন ২২টি কাব্য গ্রন্থ, ৫১টিরও অধিক গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধগ্রন্থ, সঙ্গীতগ্রন্থ, নাটক-নাটিকা, কিশোর কাব্য, কাব্যানুবাদ, কিশোর নাটিকা -যা প্রতিটিই শিক্ষাণীয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর এই যে, তিনি রচনা করেছেন ৫ হাজারেরও বেশি গান। যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন কবি রচনা করতে সক্ষম হননি।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন-শোষণ থেকে উপমহাদেশের মুক্তির আন্দোলন এবং একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। সংকট ও সম্ভাবনায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম বাঙালির জীবনে জুগিয়ে চলেছে নিরন্তর প্রেরণা।
কাজী নজরুল ইসলামের কর্মময় জীবন যেমন ঘটনাবহুল, তেমনই বিচিত্র তার সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি। দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে কবির পৃথিবীতে আগমন । বেশি দূর এগোয়নি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । নজরুল নিজের চেষ্টায় প্রচুর পড়াশোনা আর জীবনাভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছেন চিন্তার জগৎ।
ছোটবেলায় রুটির দোকানে কাজ করা, লেটোর দলে যোগদান, যৌবনে যুদ্ধযাত্রা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিসংশ্লিষ্টতা সব মিলিয়ে এক বিচিত্র জীবন তার। অসাম্য, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অক্লান্ত বিদ্রোহী।
বিদ্রোহী কবির মর্যাদা পেলেও তিনি চিরকালের প্রেমের কবি। সব ধর্মের মানুষের কাছে তিনি পেয়েছেন সমান মর্যাদা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে তিনি লিখে গেছেন অবিরাম। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার অজর কবিতা। বাংলা গানের জগৎকে গীতসুধারসে ভরিয়ে দিয়েছে তার বৈচিত্র্যময় গানের কলি, তাতে যোগ করেছে নতুন নতুন মাত্রা ও স্বাদ।
জন্মস্থান ভারতে হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে কবি নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরের একটা সময় কেটেছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল-দরিরামপুরে। কুমিল্লায় তার শ্বশুরবাড়ি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেটেছে তার আনন্দ-বেদনার অনেকগুলো দিন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভারত থেকে নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এরপর থেকে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত।
কবির লেখা একটি জনপ্রিয় গানের কলি : ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,/ অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে / বুঝবে সেদিন বুঝবে!/ ছবি আমার বুকে বেঁধে / পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে / ফিরবে মরু কানন গিরি, / সাগর আকাশ বাতাস চিরি` / যেদিন আমায় খুঁজবে / বুঝবে সেদিন বুঝবে!’ কবি তার মৃত্যু পরবর্তী জীবন অনুধাবন করে লিখে যাওয়া গান আজ আমাদের জন্য চিরন্তন সত্যে পরিণত হয়েছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট ২০১৪/টিপু
রাইজিংবিডি.কম