ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩২

রফিক আজাদ : কবিতার মানচিত্রকর

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রফিক আজাদ : কবিতার মানচিত্রকর

কবি রফিক আজাদ

অলাত এহসান

‘ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা, তা না হ’লে মানচিত্র খাবো।’

স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর। অর্থলিপ্সু একদল মানুষের অপরিণামদর্শী লুটপাটে দেশজুড়ে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কাছে হেরে যাচ্ছে যেন সদ্য স্বধীন দেশ। ভাতের জন্য হাহাকার, মানুষ মরছে অনাহারে। তখন জনমনে যে ক্ষোভ জন্মে, তা একবাক্যে প্রকাশ করলেন এক কবি। এ শুধু কাব্যভাষায় প্রতিবাদ নয়, মনে রাখতে হবে সময়। ১৯৭৪ সালে সেই পরিস্থিতিতে এই পঙ্ক্তি কম সাহসের ছিল না। বহুল আলোচিত সেই অমর কবিতাটি কোনো ব্যক্তি বা সরকারের বিরুদ্ধে যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদের নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে। কবিতাটি সময়োপযোগী শুধু ছিল না, বিশ্বব্যাপী বুভুক্ষু মানুষের পক্ষে এটি ছিল এক বলিষ্ঠ উচ্চারণ, যার প্রয়োজনীয়তা আজো ফুরিয়ে যায়নি। তাই আজকে যখন মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, তখন এই কবিতাটি আমাদের সামনে চলে আসে।

কবিতারটি লেখক রফিক আজাদ। জন্ম ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামে। পিতা সলিম উদ্দিন খান ছিলেন সমাজসেবক। গৃহিণী মায়ের দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তিনি যখন মায়ের গর্ভে তখন অকালপ্রয়াত বড় বোন তার নাম রেখেছিলেন ‘জীবন’। জীবন তার ডাক নাম। হয়তো এ কারণেই রফিক আজাদ ‘জীবন একটি নদীর নাম’ কবিতায় লিখেন :
‘...নদীকে তোমরা জানো ভাঙচুরের সম্রাট!
দু’কূল-ছাপানো তার আবেগে উদ্বেল
পলি তোমাদের জীবনে কি এনে দ্যায়নি কখনো
শস্যের সম্ভার?’

শস্যের সম্ভার এনে দিয়েছিলেন তিনি। এই শস্য তার কবিতা। আসলে জীবনই তাকে কবিতে পরিণত করেছে। সম্প্রতি তার আত্মজীবনী ‘কোনো খেদ নেই’-এ তিনি এ কথা বলেছেন। বায়ান্ন সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। সে সময় বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে, ২২ ফেরুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে মিছিলে খালি পায়ে অংশগ্রহণ করেন। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও ছিল তার সক্রীয় অংশগ্রহণ। ১৯৭১ সালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সহকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা ও দেশের প্রতি এই দায়বোধ, ভালোবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে তৈরি করেছিল একজন কবি হিসেবে, আদর্শ মানুষ হিসেবে। এ ছাড়া গুণী গ্রামের পাশেই ছিল মনিদহ গ্রাম। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ ছুতার, ধোপা, দর্জি, চাষা ইত্যাদি। এই নিম্নশ্রেণীর সম্প্রদায়ভুক্ত ছেলেমেয়েরাই ছিলেন রফিক আজাদের শৈশব-কৈশোরের বন্ধু। যে কারণে তার কবিতায় এই সব শ্রমজীবী নিম্নশ্রেণীর মানুষের কথা বারবার এসেছে।

আপাত দৃশ্যে প্রেম-প্রতিমার প্রতিকৃতিই তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। কিন্তু তার প্রেম কেবলই দেহজ নয়, শুধু নুলিয়ে পরে না এই কাঁধ থেকে ওই কাঁধে, বাহু থেকে বিছানায়। তার প্রেমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে সমাজ-সংসার ও প্রকৃতি। এই সমাজ-সংসার ও প্রকৃতির কাছেই তার আমৃত্যু ঋণ। এই প্রেমই তাকে বিদ্রোহী, প্রতিবাদী করে দেয়। তিনি লিখেন :
‘তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে-
তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে,
আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা
তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে...।’
(তোমার কথা ভেবে)।

তার প্রেমময়তার ভেতরও লুকিয়ে থাকে যুদ্ধ, খরা, ধ্বংস, ক্ষয়, মহামারী, মৃত্যু আর পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আঁচড়ের ভয়ঙ্কর দুঃসহ চিত্রপট। তিনি লেখেন :
‘স্পর্শকাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
...চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করে
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।’
(চুনিয়া আমার অর্কেডিয়া)

রফিক আজাদ কবিতাকে নিছক কলাবৈকল্যবাদে ভুগতে দেননি। প্রতিটি সংগ্রামে তিনি সাড়া দিয়েছেন কবিসুলভ সংবেদনশীলতা এবং একইসঙ্গে দৃঢ়তায়। সমাজের প্রকৃত উন্নয়নে সহায়ক ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের পক্ষে তিনি। কবিস্বভাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে প্রগতিশীল জীবনভাবনা। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তার কবিতা বক্তব্যপ্রধান। অনেক তিনি খোলামেলা। তাই তার কবিতায় অঙ্কিত হয় গালির (স্ল্যাং) শিল্পিত রূপ। বৃষ্টির রাতেও তার আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ বেরিয়েই আসে :
‘...সারাটা দুনিয়া জুড়ে
মানুষের এত দুঃখ-এর থেকে পরিত্রাণ নেই?
বৃষ্টির প্রপাত শুনে, গাছের সবুজে চোখ রেখে
শিশুদের গালে চুমো খেয়ে আমরা পারি না ফের
এই দুঃখী গ্রহটির অন্তর্গত অসুখ সারাতে?’
(বৃষ্টি)

জীবনাভিজ্ঞতা আর শুভাকাঙ্ক্ষার মিশেল এই কবিতা। তিনি বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ দিন। নাম উহ্য রেখে সম্পাদনা করেছেন ‘রোববার’ পত্রিকা। পেশাজীবনে শিক্ষকতাও করেছে কিছুদিন। সাহিত্যিক জীবনে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭), আলাওল পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদকসহ (২০১৩) বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেয়েছেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননাও (১৯৯৭)।

ষাট ও সত্তরের দশকে এ দেশীয় কবিতার যে ধারা তাতে রফিক আজাদ ব্যতিক্রমী ও বিশিষ্ট নাম। সুবিধাবঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ মধ্যবিত্ত সমাজের যোগ্য কাব্যপ্রতিনিধি হিসেবে তাকে চিনতে ভুল হয় না। তার কবিতাগুলো কেবল নিজত্বচিহ্নিত নয়, এক ধরনের প্রতিবাদও বটে। খুব অল্পসংখ্যক কবিই তার মতো উচ্চারণ করতে পারেন সত্য শব্দ। বলতে পারেন ‘ভাত দে হারামজাদা…।’ এমন তীব্র পঙ্ক্তিমালা পৃথিবীর যে কোনো ভাষার কাব্য ইতিহাসে বিরল, যা কবিতার মানচিত্রকে নতুনভাবে চিহ্নিত করে, ভাবতে শেখায়।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়